আমি বিদআতে আমলী প্রসঙ্গে বলেছি যে, ধর্মীয় বা দুনিয়াবী যে কাজ হুযূর আলাইহিস সালামের পবিত্র যুগের পরে, হয়তো সাহাবায়ে কিরামের যুগে বা এর পরে আবিষ্কৃত হয়েছে, তা বিদআত। এ প্রসঙ্গে দুটি প্রসিদ্ধ আপত্তি রয়েছে।
বিদআত শুধুমাত্র সেই ধর্মীয় কাজকে বলা হবে, যা হুযূর আলাইহিস সালাতু ওয়াস সালামের পরে চালু হয়েছে। দুনিয়াবী নতুন কাজ বিদ্আত নয়। সুতরাং, মীলাদ মাহফিল ইত্যাদি বিদ্আত, কিন্তু তারবার্তা, টেলিফোন, রেলগাড়িতে আরোহণ বিদআত নয়। কারণ, হাদীস শরীফে এসেছে-
مَنْ أَحْدَثَ فِي أَمْرِنَا هَذَا مَا لَيْسَ مِنْهُ فَهُوَ رَدٌّ
(যে ব্যক্তি আমার ধর্মে নতুন কিছু চালু করে, সে মরদুদ (ধর্মত্যাগী)।)
أمرنا শব্দ দ্বারা প্রতীয়মান হচ্ছে যে, পার্থিব আবিষ্কৃত বস্তুসমূহ বিদ্আত নয় এবং ধর্মীয় বিদআত বলতে কোনটাই হাস্না (উত্তম) নয়, সবই হারাম। কেননা হাদীস শরীফে সে সবের হোতাকে মরদুদ বলা হয়েছে।
ধর্মীয় কাজের শর্তারোপ করাটা মনগড়া কথা এবং সহীহ হাদীস, উলামায়ে কিরাম, ফকীহগণ ও মুহাদ্দিছীনে কিরামের উক্তিসমূহের বিপরীত। হাদীস শরীফে এসেছে-
كُلُّ مُحْدَثٍ بِدْعَةٌ
(প্রত্যেক নতুন কাজ বিদআত।)
এখানে ধর্মীয় বা দুনিয়াবী কাজের কোন উল্লেখ নেই। অধিকন্তু, আমি মিশকাত শরীফের ব্যাখ্যাগ্রন্থ 'আশআতুল-লুমআত' ও 'মিরকাত'-এর ভাষ্য উদ্ধৃত করেছি, যেখানে দ্বীনি কাজের জন্য কোন শর্তারোপ করা হয়নি। তদুপরি, আমি প্রথম অধ্যায়ে মিরকাত ও শামীর ইবারত উদ্ধৃত করে দেখিয়েছি যে, গ্রন্থকারদ্বয় উন্নতমানের খাদ্য গ্রহণ ও ভাল কাপড় পরিধান করা বিদ্আতে জায়েয হিসেবে গণ্য করেছেন। অথচ এগুলো দুনিয়াবী কাজ, কিন্তু এগুলোকে বিদ্আত হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। সুতরাং, ওই ধরনের শর্তারোপ করাটা ভুল।
যদি এটা মেনেও নেয়া হয় যে বিদআতের ক্ষেত্রে দ্বীনি কাজের শর্ত রয়েছে, তাতেও কিছু আসে যায় না। দ্বীনি কাজ তো সেটাকেই বলা হয়, যার জন্য ছওয়াব পাওয়া যায়। মুস্তাহাব, নফল, ওয়াজিব ও ফরজ কাজসমূহ সবই ধর্মীয় কাজ। এগুলো মানুষ ছওয়াবের উদ্দেশ্যে করে থাকে। দুনিয়াবী কোনো কাজ সৎ উদ্দেশ্যে করা হলে, তার জন্যও ছওয়াব পাওয়া যায়।
হাদীস শরীফে আছে- মুসলমানের সাথে প্রফুল্ল মন নিয়ে সাক্ষাৎ করলে সদকার ছওয়াব পাওয়া যায়।
حَتَّى اللَّقْمَةِ تَرْفَعُهَا فِي فِي إِمْرَأَتِكَ
(স্ত্রীর মুখে যে গ্রাসটি তুলে দেওয়া হয়, তাতেও ছওয়াব রয়েছে।)
¶ ইমাম খতিব তিবরিযি, মিশকাত, ২/৯২৪পৃ: হা/৩০৭১, ইমাম বুখারী, আস-সহীহ, ৭/৬২পৃ: হা/৫৩৫৪, ইমাম তিরমিযি, আস-সুনান, ৩/৫০১পৃ: হা/২১১৬, ইমাম বায়হাকী, শুয়াবুল ঈমান, ১১/১৬২পৃ:, সুনানে আবি দাউদ, হা/২৮৬৪
এখন বলুন, সৎ নিয়তে পোলাও খাওয়াটা বিদআত কিনা? আর দ্বীনি কাজের শর্তারোপ করাতে আপনাদের কোন লাভ নেই। কেননা, দেওবন্দ মাদ্রাসা, ওখানকার সিলেবাস, দাওরায়ে হাদীস, বেতন নিয়ে মাদ্রাসায় পড়ানো, পরীক্ষা, ছুটি, কুরআন শরীফের হরকত দেয়া, কুরআন ও বুখারী শরীফের খতম পড়া—যেমন দেওবন্দ মাদ্রাসায় পনের টাকা নিয়ে পড়া হয়, সমস্ত হাদীসের বিষয়সমূহ, হাদীস সমূহকে কিতাবের আকারে সংকলিত করা, কুরআন শরীফকে কাগজে সংরক্ষণ করা, এতে রুকু স্থাপন করা, ত্রিশ পারায় বিভক্ত করা ইত্যাদি সবই ধর্মীয় কাজ এবং বিদ্আত। কেননা হুযূর আলাইহিস সালাতু ওয়াস সালামের যুগে এসব কাজের কোনটাই হয়নি। বলুন, এগুলো হারাম, না হালাল? তাহলে মাহফিলে মীলাদ শরীফ ও ফাতিহা শরীফ কী অপরাধ করলো, যা হুযূর আলাইহিস সালামের যুগে প্রচলিত না থাকার দরুণ হারাম সাব্যস্ত হলো, আর উপরোক্ত সব কাজ হালাল গণ্য হলো?
আমি মৌলবী ছানাউল্লাহ অমৃতসরীর সাথে মুনাজিরা করার সময় বলেছিলাম, আপনারা চারটি বিষয়ের অর্থাৎ বিদআত, শিরক, দ্বীন ও ইবাদতের সঠিক ব্যাখ্যা প্রদান করুন, যাতে কোন আপত্তি না থাকে এবং ব্যাখ্যাটা যেন পরিপূর্ণ হয়। এরপর আমার থেকে যা খুশী পুরস্কার নিন। আল্লাহর উপর ভরসা করে বলতে পারি, দুনিয়ার কোন দেওবন্দী, কোন লা-মাযহাবী এবং শিরক ও বিদআত নিয়ে সারাক্ষণ বকবককারী ওই চারটি বিষয়ের বর্ণনা এমনভাবে কখনও করতে পারবে না, যাতে তাদের মাযহাবের উপর কোন আঁচ না লাগে।
এখনও প্রত্যেক দেওবন্দী ও লা-মাযহাবীর কাছে সাধারণ ঘোষণা দেয়া আছে যে ওসবের এমন সঠিক বর্ণনা দিক, যাতে মাহফিলে মীলাদ হারাম আর রেসালায়ে কাসেম ও পরচায়ে আহলে হাদীছ হালাল প্রতিভাত হয়; আল্লাহর ওলীদের থেকে সাহায্য প্রার্থনা শিরক আর পুলিশ ও অন্যান্যদের থেকে সাহায্য চাওয়া ইসলামসম্মত বোঝা যায়। ইনশা আল্লাহ এসবের ব্যাখ্যা দিতে পারেনি এবং পারবেও না। তাদের উচিৎ, এ ভিত্তিহীন মাযহাব থেকে তওবা করে যেন আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। আল্লাহ তাওফীক দিক!
তারা যে হাদীছটি পেশ করেছে, সেটা প্রসঙ্গে আমি উল্লেখ করেছি যে, "أمرنا" শব্দ দ্বারা আকাইদ বোঝানো হয়েছে; কেননা ধর্ম হচ্ছে আকীদার উপর নির্ভরশীল। যদি আমল বোঝানো হয়, তাহলে "ليس منه" বাক্যাংশ দ্বারা ওসব আমল বোঝানো হয়েছে, যা সুন্নাত বা ধর্মের বিপরীত নয়। আমি এর রেফারেন্সও ইতোপূর্বে প্রদান করেছি।
'প্রত্যেক বিদ্আত হারাম। বিদ্আতে হাসনা বলতে কিছু নেই'- এ রকম বলাটা প্রথম অধ্যায়ে উল্লেখিত ওই হাদীছের বিপরীত, যেটাতে সুস্পষ্টভাবে বর্ণিত আছে যে, যিনি ইসলামে ভাল কাজের সূচনা করবেন, তিনি ছওয়াবের ভাগী হবেন; যে মন্দ কাজে প্রচলন করবে, সে আযাবের ভাগী হবে। অধিকন্তু উক্ত অধ্যায়ে ফাওয়ায়ে শামী, আশ্আতুল লুমআত ও মিরকাতের উদ্ধৃতি দিয়ে প্রমাণ করা হয়েছে যে, বিদআত পাঁচ প্রকার- জায়েয, ওয়াজিব, মুস্তাহাব, মাকরূহ ও হারাম।
যদি মেনেও নেয়া হয় যে প্রত্যেক বিদআত হারাম, তাহলে মাদ্রাসা ইত্যাদিকে ধ্বংস করে দিন। কেননা তাও হারাম। তাছাড়া ফিকহি মাসায়েল, সুফিয়ানে কিরামের যিকর-আযকার, যা কুরুনে ছালাছার পরে আবিষ্কৃত হয়েছে, সবই হারাম সাব্যস্ত হবে।
শরীয়তের চারটি সিলসিলা হানাফী, শাফেঈ, মালেকী ও হাম্বলী, অনুরূপ তরীকতের চারটি সিলসিলা কাদেরী, চিশতী, নকশবন্দী ও সরওয়ার্দী—এসব হুযূর আলাইহিস সালামের বরং সাহাবায়ে কিরামের পরে আবিষ্কৃত হয়েছে। তদুপরি ইজতিহাদী মাসায়েল, আমলসমূহ, ওজীফা, মুরাকাবা, চিল্লে ইত্যাদি সব পরে আবিষ্কৃত হয়েছে। কিন্তু সকলেই এগুলোকে দ্বীনের কাজ মনে করে থাকেন।
ছয় কলেমা, ঈমানে মুজমাল ও ঈমানে মুফাস্সল, কুরআনের ত্রিশ পারা, হাদীছের প্রকারভেদ এবং আহ্কাম অর্থাৎ সহীহ, জঈফ, হাসন বা মুফাসসিল ইত্যাদি পার্থক্যকরণ, আরবী মাদ্রাসার নেসাব, দস্তারবন্দীর সভা, সনদ বিতরণ, পাগড়ী পরানো ইত্যাদি বিষয়ের সম্পর্কে কুরআন-হাদীছে কোন নাম নিশানা নেই।
কোন দেওবন্দী ওহাবী ওসব বিষয়ের একটি নামও কোন হাদীছে দেখাতে পারবে না। আবার হাদীছের সনদ এবং রিওয়ায়েতকারীদের ব্যাপারে সাক্ষ্য গ্রহণ কুরুনে ছালাছা থেকে প্রমাণিত নয়।
মোট কথা, শরীয়ত ও তরীকতের এমন কোন আমল নেই, যেখানে বিদআতের ছোঁয়া লাগেনি।
মৌলবী ইসমাঈল ছাহেব তাঁর 'সিরাতুল মুস্তাকীম' এর ৭ পৃষ্ঠায় বলেছেন-
"نیز اکابر طریقت نے اگرچه از کار و مراقبات وریاضت و مجاهدات کی تعیین میں جو راہ ولایت کی مبادی ھیں کوشش کی ہے لیکن بحكم بر سخن وقتي وبرنكته مقامی دارد بربر وقتکے مناسب اشغال اور بربر قرن کے مطابق حال ریاضت جدا جدا ہیں."
(তারীকতের শাইখগণ যদিওবা যিকর-আযকার, মুরাকাবাত, রিয়াজাত ও মুজাহেদাতের ক্ষেত্রে যে পথটি বেলাদত প্রাপ্তির সহায়ক, চেষ্টা করেছেন, কিন্তু প্রত্যেক সময় অনুযায়ী আশগাল এবং প্রত্যেক যুগ অনুযায়ী রিয়াজাতের অবস্থা ভিন্ন ভিন্ন।)
এ ইবারত থেকে বোঝা গেল যে, তাসাউফের যিকর-আযকার সমূহ সুফিয়ানে কিরামের আবিষ্কৃত এবং যুগে যুগে নতুন নতুন আবিষ্কার হচ্ছে এবং এটি বৈধ। বরং সুলুকের পথ তাঁদের দ্বারাই লাভ করা হয়। বলুন, এখন আপনাদের সেই দাবী অর্থাৎ প্রত্যেক নতুন কাজ হারাম, কোথায় রইলো? মানতেই হবে যে, যে কাজ সুন্নাতের বিপরীত তা মন্দ, বাকী সব পছন্দনীয় ও ভাল।
বিরুদ্ধবাদীগণ এটাও বলে থাকেন যে, যে কাজ হুযূর আলাইহিস সালাতু ওয়াস সালাম বা সাহাবায়ে কিরাম বা তাবেঈন বা তবে তাবেঈনের আবিষ্কৃত হয়ে থাকে, তা বিদ্আত নয়। এ যুগ সমূহের পর যা আবিষ্কার হবে, সেটা বিদআত এবং এগুলোর কোনটাই জায়েয নয়, সবই হারাম।
সুতরাং, প্রতীয়মান হলো যে, সাহাবায়ে কিরাম, তাবেঈন ও তবে তাবেঈনের আবিষ্কৃত কাজসমূহ সুন্নাত হিসাবে গণ্য। এ জন্য মিকাত শরীফের الاعتصام অধ্যায়ে বর্ণিত আছে-
"فَعَلَيْكُمْ بِسُنَّتِي وَسُنَّةِ الْخُلَفَاءِ الرَّاشِدِيْنَ الْمَهْدِيِّينَ تَمَسُّكُوا بِهَا وَعَضُوْا عَلَيْهَا بِالنَّوَاجِدِ."
(তোমাদের কর্তব্য আমার সুন্নাত ও হিদায়েত প্রাপ্ত খুলাফায়ে রাশিদীনের সুন্নাতকে দাঁত দ্বারা শক্ত করে ধরে থাকা।)
¶ আহমদ, আল-মুসনাদ, ৪/১২৬পৃ: হাদিস : ১৭২৭৫-৭৬, আবু দাউদ, আস্-সুনান: ৫/১৩পৃ: হাদিস, ৪৬০৭, তিরমিযী, আস্-সনান, ৫/৪৩পৃ: হাদিস : ২৬৭৬, ইবনে হিব্বান, আস্-সহিহ, ১/১৭৮পৃ: হাদিস : ৫, দারেমী, আস্-সুনান, ১/৫৭ পৃ, হাদিস- ৯৫, খতিব তিবরিযী, মিশকাত, কিতাবুল ইতিসাম, ১/৪৫ পৃ, হাদিস- ১৬৫, বায়হাকী, আস্-সুনানুল কোবরা, ১০/১১৪ পৃ, ও শুয়াবুল ঈমান, ৬/৬৭ পৃ, হাদিস- ৭৫১৫-৭৫১৫, বগভী, শরহে সুন্নাহ, ১/১৮১ পৃ, হাদিস- ১০২.
উক্ত হাদীছ খুলাফায়ে রাশিদীনের কাজসমূহকে সুন্নাত বলা হয়েছে এবং এসবের অনুসরণ করার জন্য জোর দেয়া হয়েছে। এতে বোঝা যায় যে, তাঁদের আবিষ্কৃত কাজ সমূহ বিদ্আত নয়।
মিশকাত শরীফ فضائل الصحابه শীর্ষক অধ্যায়ে আছে-
خَيْرَ أُمَّتِي قَرْنِى ثُمَّ الَّذِينَ يَلُونَهُمْ ثُمَّ الَّذِينَ يَلُوْنَهُمْ ثُمَّ إِنَّ بَعْدَ ذَالِكَ قَوْمًا يَشْهَدُونَ وَلَا يَسْتَشْهَدُونَ وَيَخُونَونَ وَلَا يُوْ تَمنُونَ
(আমার উম্মতের মধ্যে শ্রেষ্ঠ জামাত হচ্ছে আমার যুগের, অতঃপর যাঁরা ওদের সাথে সংশ্লিষ্ট, এর পর যারা ওদের সাথে সংশ্লিষ্ট। অতঃপর এমন একটি গোত্রের আবির্ভাব হবে, যারা সাক্ষী হিসেবে মনোনীত না হয়েও সাক্ষ্য দিবে, বিশ্বাসঘাতকতা করবে এবং তারা বিশ্বস্ত হবে না।)
¶ ইমাম বুখারী, আস-সহীহ, ৫/২পৃ: হা/৩৬৫০, খতিব তিবরিযি, মিশকাত, ৩/১৬৯৫পৃ:হা/৬০১০
এতে বোঝা গেল যে, ভাল যুগ হচ্ছে তিনটা- সাহাবায়ে কিরাম, তাবেঈন ও তবে তাবেঈনের যুগ। এর পর হচ্ছে মন্দ যুগ, তাই ভাল যুগে যা আবিষ্কৃত হবে, তা ভাল অর্থাৎ সুন্নাত এবং মন্দ যুগে যা আবিষ্কৃত হবে, তা মন্দ অর্থাৎ বিদআত।
মিশকাত শরীফের فضائل الصحابة অধ্যায়ে আরও উল্লেখিত আছে-
"تفترق أمتى عَلَى ثَلْثٍ وَسَبْعِينَ مِلَّةً كُلُّهُمْ فِي النَّارِ إِلَّا واحدة قالوا مَنْ هِيَ يَارَسُولَ اللهِ قَالَ مَا أَنَا عَلَيْهِ وَأَصْحَابِي."
(আমার উম্মত তিয়াত্তর ফিরক্কায় বিভক্ত হবে এবং এক ফিরকা ব্যতীত বাকী সব জাহান্নামী হবে। আরয করা হলো- ইয়া রাসূলাল্লাহ (দঃ)। সেই এক ফির্কা কোনটি? ইরশাদ ফরমালেনঃ যার উপর আমি ও আমার সাহাবা রয়েছেন।)
¶ খতিব তিবরিযি, মিশকাতুল মাসাবিহ, ১/৬১পৃ: কিতাবুল ই‘তিসাম বিস্-সুন্নাহ, হাদিস নং-১৬১, তিরমিযি, আস্-সুনান, ৫/২৬পৃ: হাদিস, ২৬৪১, আহলে হাদিস আলবানী সুনানে তিরমিযির তাহক্বীকে হাদিসটি ‘হাসান’ বলেছেন, তাবরানী, মু‘জামুল কাবীর, ১৩/৩০পৃ: হাদিস, ৬২, ১৪/৫২পৃ: হাদিস, ১৪৬৪৬, মাকতুবাতু ইবনে তাইমিয়া, কাহেরা, মিশর, প্রকাশ-১৪১৫হিঃ বায়হাকি, ই‘তিক্বাদ, ১/২৩৩পৃ: বাগভী, শরহে সুন্নাহ, ১/২১৩পৃ: হাদিস, ১০৪
অতএব বোঝা গেল, সাহাবায়ে কিরামের অনুসরণ হচ্ছে বেহেশতের পথ। এজন্য তাঁদের আবিষ্কৃত বিষয়সমূহকে বিদ্আত বলা যায় না।
মিশকাত শরীফে فضائل الصحابه অধ্যায়ে আরও উল্লেখিত আছে-
"أَصْحَابِي كَالنُّجُومِ فَبِأَيِّهِمْ اقْتَدَيْتُمْ اهْتَدَيْتُمْ."
(আমার সাহাবাগণ হচ্ছেন উজ্জ্বল নক্ষত্রের মত। তুমি যে কারো অনুসরণ কর না কেন, সঠিক পথ পেয়ে যাবে।)
¶ ইমাম আবু রাজীন : তাজরীদ ফিল বাইনাস সিহহাহ : ১/২৮০ পৃ:, খতিব তিবরিযী : মিশকাতুল মাসাবীহ : কিতাবুল মানাকিব : হাদিস : ৬০১৮ এ হাদিস সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে আমার লিখিত ‘‘প্রমাণিত হাদিসকে জাল বানানোর স্বরূপ উন্মোচন’’ এর ১ম খন্ডের ২৩৪-২৪১ পৃষ্ঠা দেখুন।
এর থেকেও প্রমাণিত হয়, সাহাবায়ে কিরামের অনুসরণ নাজাতের সোপান। সুতরাং, সাহাবীদের আবিষ্কৃত বিষয়সমূহ বিদ্আত নয় কেননা বিদআত তো হচ্ছে পথভ্রষ্টকারী।
এ ধরনের প্রশ্ন কেবল ধোঁকা মাত্র। আমি মিশকাত শরীফের প্রসিদ্ধ ব্যাখ্যাগ্রন্থ 'মিরকাত' ও আশ্আতুল লুমআত' এর উদ্ধৃতি দিয়ে প্রমাণ করেছি যে বিদআত হচ্ছে সেই কাজ, যা হুযূর আলাইহিস সালাতু ওয়াস সালামের পরে চালু হয়েছে। ওখানে সাহাবায়ে কেরাম ও তাবেঈনের কোনো উল্লেখ নেই। অধিকন্তু মিশকাত শরীফের قيام شهر رمضان শীর্ষক অধ্যায়ে আছে— হযরত উমর (রাঃ) স্বীয় খিলাফতের যুগে নিয়মিতভাবে জামাত সহকারে তারাবীহ নামায আদায় করার হুকুম দিয়েছিলেন এবং জামাত অনুষ্ঠিত হতে দেখে বলেছেন:
نِعْمَتِ الْبَدْعَةُ هَذِهِ
(এতো বড়ই ভাল বিদ্আত।)
¶ ইমাম মালেক, আল-মুয়াত্তা, ১/১১৪পৃ: কিয়ামু রামাযান, হা/২৫০, সহীহ বুখারী, ২/৭০৭পৃ: হা/১৯০৬, সহীহ ইবনে খুজায়মা, ২/১৫৫পৃ: হা/১৫৫, মুসান্নাফে আব্দুর রায্যাক, ৪/২৫৮পৃ: হা/৭৭২৩
দেখুন, হযরত উমর (রাঃ) নিজেই নিজের প্রচলিত কাজকে বিদ্আতে হাসনা বলেছেন। তিরমিযী, ইবনে মাজা, নাসায়ী এবং মিশকাত শরীফে لقلوب শীর্ষক অধ্যায়ে হযরত আবু মালেক আশআরী (রাঃ) বর্ণনা করেন— আমার পিতাকে ফজর নামাযে কুনুতে নাযেলা পড়া প্রসঙ্গে জিজ্ঞাসা করেছিলাম। তিনি ফরমান, হে বৎস, এ হচ্ছে বিদআত।
দেখুন, সাহাবায়ে কিরামের যুগের কাজকে বিদ্আতে সাইয়া বলা হয়েছে। যদি সাহাবায়ে কিরামের আবিষ্কৃত বিষয়সমূহ বিদআত না হতো, তাহলে তারাবীর জামাতকে কেন বিদআতে হাসানা বলা হলো এবং কুনুতে নাযেলাকে কেন বিদ্আতে সাইয়া আখ্যায়িত করা হলো? ও সময় তো বিদআতের কাল ছিল না।
প্রথম অধ্যায়ে মিরকাতের বরাত দিয়ে বর্ণনা করা হয়েছে যে, তারাবীর জামাত বিদআতে হাসানা অর্থাৎ তারাবীহ হচ্ছে সুন্নাত এবং জামাত সহকারে আদায় করা হচ্ছে বিদআতে হাস্না। তাঁরা হযরত উমর ফারুকের (রাঃ) কাজকে বিদআতের অন্তর্ভুক্ত করেছেন।
বুখারী শরীফের كتاب فضائل القرآن এর جمع القرآن অধ্যায়ে বর্ণিত আছে— হযরত সিদ্দীক (রাঃ) যখন হযরত যায়েদ ইবন ছাবেত (রাঃ) কে কুরআন একত্রিত করার হুকুম দিলেন, তখন তিনি আরয করলেন:
كَيْفَ تَفْعَلُونَ شَيْئًا لَمْ يَفْعَلْهُ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمْ قَالَ هُوَ خَيْرٌ
আপনি এ কাজ কেন করতে যাচ্ছেন, যা হুযূর আলাইহিস সালাম করেননি? হযরত সিদ্দীক (রাঃ) ফরমালেন: এতো ভাল কাজ।
¶ ইমাম বুখারী, আস-সহীহ, ৪/১৭২০পৃ: হা/৪৪০২, সুনানে তিরমিযি, হা/৩১০১, খতিব তিবরিযি, মিশকাত, ১/৬৮০পৃ: হা/২২২০, ইমাম নাসাঈ, আস-সুনানিল কোবরা, ৫/৭পৃ: হা/২২০২
অর্থাৎ হযরত যায়েদ ইবন ছাবেত (রাঃ) হযরত সিদ্দীক (রাঃ) এর সমীপে আরয করলেন, কুরআন একত্রিতকরণ হচ্ছে বিদআত। তাই আপনি কেন বিদ্আতে হাত দিচ্ছেন? তখন হযরত সিদ্দীক (রাঃ) ইরশাদ ফরমালেন: বিদ্আত বটে তবে উত্তম বিদআত।
এর থেকে প্রমাণিত হলো— সাহাবায়ে কিরামের কাজ হচ্ছে বিদআতে হাসানা।
فَعَلَيْكُمْ بِسُنَّتِى وَسَنَةِ الخُلْفَاء الراشدين
এ হাদীছ খুলাফায়ে রাশেদীনের উক্তি ও কাজসমূহকে শাব্দিক অর্থে সুন্নাত বলা হয়েছে। অর্থাৎ—
হে মুসলমানগণ, আপনারা আমার ও আমার খুলাফায়ে রাশিদীনের পথসমূহ অনুসরণ করুন।
যেমন আমি প্রথম অধ্যায়ে একটি হাদীছ উদ্ধৃত করেছি:
مَنْ سَنَّ فِي الْإِسْلَامِ سُنَّةً حَسَنَةً فَلَهُ أَجْرُهَا وَمَنْ سَنَّ فِي الْإِسْلَامِ سُنَّةً سَيِّئَةً
এ হাদীছে সুন্নাত অর্থ তরীকা বা পথ।
কুরআন করীম ইরশাদ ফরমান:
سنة منْ قَدْ أَرْسَلْنَا قَبْلَكَ مِنْ رُّسُلِنَا وَلَا تُجِدُ لِسُنَّتِنَا تَحْوِيلًا
আরও ইরশাদ ফরমান:
سُنَّتُ اللهِ الَّتِي قَدْ خَلَتْ
আয়াত ও হাদিসে উল্লেখিত সুন্নাতদ্বারা শরয়ী সুন্নাত বুঝানো হয়েছে এবং এটি বিদআতের মুকাবিলায় নয় বরং এখানে তরীকা বা পন্থা অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। সুন্নাতে ইলাহীয়া হচ্ছে আল্লাহর তরীকা, সুন্নাতে আম্বিয়া হচ্ছে নবীদের তরীকা এবং অন্যান্য।
فَعَلَيْكُمْ بِسنَتِي এর ব্যাখ্যায় প্রখ্যাত আশ্আতুল লুমআত গ্রন্থে উল্লেখিত আছে:
وبحقیقت سنت خلفائے راشدین همان پیغمبر است که در زمان انحضرت عليه السلام شهرت نیافته بود و در زمان ایشان مشهور و مضاف به ایشان شده
খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাত বললে আসলে সুন্নাতে নববী, যা হুযূর আলাইহিস সালামের সময় প্রকাশ পায়নি, তাঁদের যুগেই প্রকাশ পেয়েছে এবং তাঁদের বলেই আখ্যায়িত করা হয়েছে।
এর থেকে প্রতীয়মান হলো যে, সুন্নাতে খুলাফা আসলে সুন্নাতে রসূলুল্লাহকেই বলা হয়, কিন্তু মুসলমানদের মধ্যে প্রচলনকারী হচ্ছেন খুলাফায়ে রাশেদীন।মুহাদ্দিছীন ও ফকীহগণ বলেন: খুলাফায়ে রাশিদীনের নির্দেশ সুন্নাতের সাথে সংশ্লিষ্ট অর্থাৎ সুন্নাত নয়, সুন্নাতের সাথে সংযোজন করা হয়েছে। যদি তাঁদের আবিষ্কৃত কাজ সুন্নাত সাব্যস্ত হতো, তাহলে সংযোজনের কিইবা অর্থ হতে পারে?
নুরুল আনোয়ার গ্রন্থের শুরুতে আছে:
وَقُولُ الصَّحَابِي فِيْمَا يُعْقَلُ مُلْحَقِّ بِالْقِيَاسِ وَفِيْمَا لَا يُعْقَلُ فَمُلْحَقُ بِالسُّنَّةِ
(সাহাবায়ে কিরামের যেসব বাণী যুক্তি নির্ভর, তা কিয়াসের সাথে সম্পৃক্ত আর যে সব বাণী যুক্তির উর্ধে, তা সুন্নাতের সাথে সম্পৃক্ত।)
যদি সাহাবায়ে কিরামের সমস্ত উক্তি ও কর্ম সুন্নাত বলে গণ্য হতো, তাহলে কিয়াস ও সুন্নাতের সাথে সম্পৃক্তের কি অর্থ হতে পারে?
আশ্আতুল লুমআত এ فَعَلَيْكُمْ بِسُنَّتِى এর প্রেক্ষাপটে উল্লেখিত আছে:
پس برچه خلفائے راشدین بدان حکم کرده باشند. اگرچه باجتهاد وقياس ایشان بود موافق سنت نبوی است اطلاق بدعت بر آن نتوان کرد
(যে বিষয়ে খুলাফায়ে রাশেদীন রায় দিয়েছেন, তা যদি নিজস্ব কিয়াস ও ইজতিহাদ দ্বারা হয় এবং সুন্নাতে নববী অনুযায়ী হয়, তবে তাকে বিদআত বলা সমীচীন নয়।)
এ ভাষ্য থেকে একেবারে সুস্পষ্টরূপে প্রতীয়মান হলো যে, খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাত শাব্দিক অর্থে বলা হয়েছে এবং শরয়ী সুন্নাতের সাথে সংশ্লিষ্ট। একে সম্মান স্বরূপ বিদআত বলা যাবে না। কেননা বিদ্আত বলতে প্রায় সময় বিদ্আতে সাইয়াকে বোঝানো হয়।
خيراً متى قرني এ হাদিস থেকে এটাই বোঝা গেল যে এ তিন যুগ (কুরূনে ছালাছা) পর্যন্ত ভালো কাজ বেশি হবে এবং এদের পর ভালো কম, মন্দ বেশি হবে। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে, এ তিন যুগে যে কোনো কাজ আবিষ্কৃত হোক কিংবা যে কেউ আবিষ্কার করুক, তা-ই সুন্নাত হিসেবে গণ্য হবে। এ হাদীসে সুন্নাত হওয়ার উল্লেখ কোথায় আছে? তাহলে জবরিয়া মাযহাব এবং কদরিয়া মাযহাব তাবেঈনের যুগে আবির্ভূত হয়েছিল এবং ইমাম হুসাইন (রাঃ) এর শাহাদাত ও হাজ্জাজের জুলুম ওই যুগেই সংঘটিত হয়েছিল। তাহলে কি (মায়াজাল্লা) এগুলোকে সুন্নাত বলা হবে?
ما أنا عَلَيْهِ وَأَصْحَابي (যার উপর আমি এবং আমার সাহাবা) এবং أصحابي كالنجوم (আমার সাহাবাগণ উজ্জ্বল নক্ষত্রের মত) এ হাদীসদ্বয় দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, সাহাবায়ে কিরামের অনুসরণ হিদায়ত প্রাপ্তির সহায়ক এবং বিরোধিতা করা হচ্ছে গুমরাহীর নামান্তর। এটি নিঃসন্দেহে সঠিক এবং এর উপর প্রত্যেক মুসলমানের আস্থা রয়েছে। কিন্তু একথা কোথা থেকে বোঝা গেল যে, তাঁদের প্রত্যেক কাজই শরয়ী সুন্নাহর অন্তর্ভুক্ত? অনেক সময় বিদ্আতে হাস্নার অনুসরণও ওয়াজিব হয়ে পড়ে। যেমন মিশকাত শরীফের الاعتصام অধ্যায়ে উল্লেখিত আছে:
اتَّبِعُوا السَّوَادَ الأَعْظَمِ فَإِنَّهُ مِنْ شَدَّ شُدَّ فِي النَّارِ
(বড় জামাতের অনুসরণ করুন। যে এর থেকে পৃথক রইল, সে দোযখে পৃথক অবস্থায় থাকবে।)
¶ খতিব তিবরিযি, মিশকাত, ১/৬১পৃ: হা/১৭৩, সুনানে ইবনে মাযাহ, ২/১৩০৩পৃ: হা/৩৯৫০
আরও উল্লেখিত আছে:
ماراه المُؤْمِنُونَ حَسَنًا فَهُوَ عِنْدَ اللهِ حَسَنُ
(মুসলমান যাকে ভালো মনে করে, আল্লাহর কাছেও তা ভালো)
¶ ইমাম আবু দাউদ তায়লসী : আল-মুসনাদ : ১/১৩০ হাদিস : ২৪৬, ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল : আল মুসনাদ : ১/৩৭৯ : হাদিস : ৩৬০০ এবং ১৭০২, ইমাম আবু নুঈম ইস্পাহানী : হুলিয়াতুল আউলিয়া : ১/৩৭৫পৃ:ইমাম তাবরানী, মুজামুল আওসাত, ৪/৫৮পৃ: হাদিস, ৩৬০২ দারুল হারামাঈন, কাহেরা, মিশর, আল্লামা ইবনে হাজার হায়সামী : মাযমাউদ যাওয়াইদ : ১/১৭৭-১৭৮ পৃ: দারুল কুতুব ইলমিয়্যাহ, বয়রুত,লেবানন, আল্লামা ইবনে কাসীর : বেদায়া ওয়ান নিহায়া : ১০/৩২৭ : হাদিস:৪০২, আল্লামা আযলূনী : কাশফুল খাফা : ২/২৪৫ পৃ: : হাদিস : ২২১৪, ইমাম বায্যার : আল মুসনাদ : ৫/২১২ পৃ: : হাদিস : ১৮১৬, ইমাম বায়হাকী : আল-ই‘তিক্বাদ : ১/৩২২ পৃ:,আল্লামা খতিব বাগদাদী : তারীখে বাগদাদ : /৪৪৬ পৃ:,ইমাম বগভী : শরহে সুন্নাহ : ১/১০৫ পৃ:,ইমাম আহমদ : মুসনাদ : ১/৩৬৭ পৃ: : হাদিস : ৫৪১, আল্লামা হাকেম নিশাপুরী : আল-মুস্তাদরাক : ৩/৮৩পৃ:হাদিস: ৪৪৬৫,তিনি বলেন হাদিসের সনদটি সহিহ,আর তাঁর সাথে যাহাবী একমত পোষন করেছেন,ইমাম তাবরানী : মু‘জামুল কবীর :৭/১১২-১১৫ হাদিস নং ৮৫৮২ ও ৮৫৯৩,ইমাম ইবনে রযব : জামিউল উলূম : ১/২৫৪পৃ: ইমাম সাখাভী : আল মাকাসিদুল হাসানা : ৪২২ পৃ: : হাদিস : ৯৫৭, আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী ,মওদ্বুআতুল কবীর : ৩২ পৃ: নূর মুহাম্মদ কারখানা, করাচি, আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী : মিরকাত : ৩/২৫৪ পৃ:,ইমাম আহমদ,ফাদ্বায়েলুল সাহাবা,১/৩৬৭পৃ:হাদিস,৫৪১,আবূ সাঈদ ইবনে আরাবী (ওফাত.৩৪০হিঃ) মু‘জামে ইবনে আরাবী,২/৪৪৩পৃ:হাদিস,৮৬১,তিনি হাদিসটি উক্ত সাহাবির দুইজন ছাত্রের দ্বারা দু‘টি সূত্রে বর্ণনা করেছেন, যায়লাঈ, নাসবুর রায়্যাহ, ৪/১৩৩পৃ:তিনি হাকিম নিশাপুরীর রায়কে গ্রহন করেছেন,তিনি তার কিতাবের অন্যত্র বাবুল ইসতিহাসানেও বর্ণনা করেছেন, ইবনে কাসীর,তুহফাতুল তা¡লেব বি মা‘রিফাতু আহাদিস, ১/৩৯১পৃ: হাদিস/৩৩৪, তিনি বলেন,হাদিসটির সনদ শক্তিশালী। হায়সামী,গায়াতুল মাকসুদ ফি যাওয়াইদুল মুসনাদ, ১/১১১পৃ: হাদিস,২৪৬, দারুল কুতুব ইলমিয়্যাহ,বয়রুত,লেবানন, ইবনে= হাজার আসকালানী, ইত্তেহাফুল মুহরাত,১০/১৯৬পৃ:হাদিস,১২৫৬৮, ইবনে হাজার, দিরায়া ফি তাখরীজে হেদায়া, অধ্যায়, কিতাবুল ইজারা, ২/১৮৭পৃ:হাদিস,৮৬৩, তিনি বলেন সনদটি ‘হাসান’, সুয়ূতি,আদ্দরুল মুনতাসিরা ফি আহাদিসুল মুসতাহিরাহ, ১/১৮৮পৃ: হাদিস,৪০১, জামিয়াতুল মুলকে সুউদ, রিয়াদ. সৌদি আরব, দরবেশ হুত, আস্-সুনানিল মুত্তালিব, ১/২৪৭পৃ: হাদিস, ১২৫৭, দারুল কুতুব ইলমিয়্যাহ,বয়রুত, তিনি এ হাদিসটির ইবনে আব্বাস থেকে আরেকটি সূত্র আছে বলে উলেখ করেছেন। ছুহাইব আব্দুল জাব্বার, জামেউল সহিহ লিল সুনান ওয়াল মাসানিদ, ৩/১১২পৃ:ও ৩/৪৩৮পৃ:, দারেকুতনী, আল-ইলল, ৫/৬৬পৃ: হাদিস,৭১১, তিনি তাঁর এ গ্রন্থে উক্ত সাহাবির অনেক ছাত্রের সূত্রের দ¦ারা হাদিসটি বর্ণনা করেছেন। তাহের পাটনী, তাযকিরাতুল মওদ্বুআত,১/৯১পৃ: তিনি বলেন সনদটি ‘হাসান’,মোল্লা আলী ক্বারী, আসরারুল মারফূআহ, ১/১০৬পৃ: হাদিস,৫৫, তিনি এ সাহাবি থেকে মারফূ ও মওকুফ উভয় সূত্রে বর্ণনা করেছেন। হাসকাফী, র্দুরুল মুখতার ওয়া হাশিয়ায়ে ইবনে আবেদীন, ২/২৩৭পৃ: মায়্যেতের দাফন অধ্যায়,ও ৪/৩৬৪পৃ: কিতাবুল ওয়াক্ফ অধ্যায়।
وَمَنْ فَارَقَ الجماعة شبرا فَقَدْ خَلَعَ رِبْقَةَ الإِسْلَام عَنْ عُنُقِهِ
মুসলমানদের জামাত থেকে যে কনিষ্ঠাঙ্গুলী পরিমাণও পৃথক রইল, সে যেন ইসলামের রশি নিজ গলা থেকে ফেলে দিল।
¶ খতিব তিবরিযি, মিশকাত, ১/৬৫পৃ: হা/১৮৫, সুনানে আবি দাউদ, ৪/২৪১পৃ: হা/৪৭৫৮, আলবানী পর্যন্ত এটিকে সহীহ বলেছেন।
কুরআনে করীমে ইরশাদ হয়েছে:
وَيَتَّبِعْ غَيْرُ سَبِيلِ الْمُؤْمِنِينَ نُوَلِهِ مَا تَوَلَّى وَنَصْلِهِ جَهَنَّمَ
(যে মুসলমানের পথ থেকে ভিন্ন পথে চলে, আমি তাকে সে অবস্থায় ছেড়ে দেব এবং তাকে দোযখে প্রবেশ করাবো।)
¶ সূরা নিসা, আয়াত, ১১৫
এ আয়াত ও হাদীস থেকে বোঝা গেল যে, আকীদা ও আমলসমূহের ব্যাপারে মুসলমানদের বড় জামাতের অনুসরণ করা প্রত্যেকের জন্য প্রয়োজন; ওদের বিরোধিতা করা মানে দোযখের পথ পরিষ্কার করা। কিন্তু তা দিয়ে এ কথা প্রমাণিত হয় না যে, মুসলিম জামাতের আবিষ্কৃত কোনো কাজই বিদ্আত নয়, সবই সুন্নাত সাব্যস্ত হবে। তা কখনো হতে পারে না। বিদআতই হবে, তবে বিদআতে হাস্না। যেভাবে সাহাবায়ে কিরামের আবিষ্কৃত কাজকে সুন্নাতে সাহাবা বলা হয়, তদ্রূপ সলফে সালেহীনের আবিষ্কৃত কাজকে শাব্দিক অর্থে সুন্নাতে সালফ অর্থাৎ পছন্দনীয় ধর্মীয় তরীকা বলা হয়।
যারা প্রত্যেক বিদ্আত অর্থাৎ প্রত্যেক নতুন কাজকে হারাম মনে করে থাকেন, তারা এ মূলনীতির ব্যাপারে কী বলবেন?
الأَصْلُ فِي الْأَشْيَاءِ الْإِبَاحَةُ
(সমস্ত বস্তু মূলত মুবাহ)
¶ ফাতওয়ায়ে শামী, ১/১০৫পৃঃ
অর্থাৎ প্রত্যেক বস্তু মূলত মুবাহ এবং হালাল তবে যদি শরীয়ত কোনো বস্তুকে নিষেধ করে তাহলে সেটা হারাম বা নিষিদ্ধ বলে গণ্য হবে। সুতরাং, নতুন হওয়ার জন্য নয় বরং নিষেধাজ্ঞা দ্বারা হারাম প্রমাণিত হবে।)
এ মূলনীতিটা কুরআনে পাক, সহীহ হাদীছসমূহ ও ফকীহগণের উক্তিসমূহ থেকে প্রমাণিত এবং মুকাল্লিদের দাবীদার কোনো ব্যক্তি এ মূলনীতি অস্বীকার করতে পারে না। কুরআন করীম ইরশাদ করেন:
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَسْئَلُوا عَنْ أَشْيَاءَ إِنْ تُبْدَلَكُمْ تَسُؤْكُمْ وَإِنْ تَسْأَلُوا عَنْهَا حِينَ يُنَزَّلَ الْقُرْآنُ تُبْدُلُكُمْ عَفَا اللَّهُ عَنْهَا
(হে ঈমানদারগণ, এ রকম বিষয়সমূহ জিজ্ঞাসা করো না, যা তোমাদের কাছে প্রকাশ করা হলে খারাপ লাগবে এবং যদি কুরআন অবতীর্ণ হওয়ার সময় ওসব বিষয়ে জিজ্ঞাসা কর, তাহলে প্রকাশ করে দেয়া হবে। আল্লাহ তাদেরকে মাফ করে দিয়েছেন।)
¶ সূরা মায়েদা, ১০১
এ থেকে বোঝা গেল, যেটা সম্পর্কে হালাল-হারাম কিছুই বলা হয়নি, সেটা ক্ষমার যোগ্য। এজন্য কুরআন শরীফ, যেসব মহিলাদের বিবাহ করা হারাম, ওদের বর্ণনার পর ইরশাদ করেন:
وَأُحِلُّ لَكُمْ مَا وَرَاءَ ذَالك
(ওদের বাদে বাকি সমস্ত মহিলা তোমাদের জন্য হালাল।)
¶ সূরা নিসা, ২৪
আরও ইরশাদ হয়েছে:
وَقَدْ فَصِّلَ لَكُمْ مَاحُرِّمَ عَلَيْكُمْ
(তোমাদের কাছে বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করা হয়েছে ওসব বিষয়, যা তোমাদের জন্য হারাম।)
¶ সূরা আনআম, ১১৯
অর্থাৎ, হালাল জিনিসসমূহের বিস্তারিত বিবরণের প্রয়োজন নেই, সব জিনিসই হালাল তবে কিছু জিনিস নিষিদ্ধ রয়েছে, যার বিবরণ দেয়া হয়েছে।
মিশকাত শরীফের كتاب الاطعمة باب اداب الطعام এর দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে উল্লেখিত আছে:
الْحَلَالُ مَا أَحَلَّ اللَّهُ فِي كِتَابِهِ وَالْحَرَامُ مَا حَرَّمَ اللَّهُ فِي كِتَابِهِ وَمَا سَكَتْ عَنْهُ فَهُوَ مِمَّا عَفَى عَنْهُ
(হালাল হচ্ছে, যা আল্লাহ তাআলা স্বীয় কিতাবে (কুরআন) হালাল করেছেন আর হারাম হচ্ছে, যা আল্লাহ তাআলা স্বীয় কিতাবে হারাম করেছেন। এবং যেটা সম্পর্কে নীরব রয়েছেন, সেটা মাফ।)
¶ খতিব তিবরিযি, মিশকাত, ২/১২২০পৃঃ হা/৪২২৮, সুনানে তিরমিযি, ৩/২৭২পৃঃ হা/১৭২৬, সুনানে ইবনে মাযাহ, ২/১১১৭পৃঃ হা/৩৩৬৭, ইমাম তাবরানী, মু‘জামুল কাবীর, ৬/২৫০পৃঃ হা/৬১২৪
এ হাদীস থেকে বোঝা গেল, জিনিস তিন রকমের হয়ে থাকে। প্রথমতঃ ওই ধরনের জিনিস, যার হালাল হওয়া সম্পর্কে কুরআনে সুস্পষ্ট উল্লেখ আছে। দ্বিতীয়তঃ সে ধরনের জিনিস, যার হারাম হওয়া সম্পর্কে সুস্পষ্ট নির্দেশ রয়েছে। তৃতীয়তঃ যে বিষয়ে কিছু বলা হয়নি, তা মাফ।
ফাওয়ায়ে শামী প্রথম খণ্ড কিতাবুত্তাহারাত শীর্ষক আলোচনায় উল্লেখিত আছে:
الْمُخْتَارُ أَنَّ الْأَصْلُ الْإِبَاحَةُ عِنْدَ الجَمْهُورِ مِنَ الْحَنَفِيَّةِ وَالشَّافِعِيَّةِ
(অধিকাংশ হানাফী ও শাফেঈদের এ মতামতই রয়েছে যে, প্রত্যেক কিছু মূলত মুবাহ (পাপ-পুণ্যহীন) হয়ে থাকে।)
¶ ফাতওয়ায়ে শামী, ১/১০৫পৃঃ
এখন যারা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের কাছে জিজ্ঞাসা করে যে, মীলাদ শরীফ উদযাপন করাটা কোথায় লেখা আছে? বা হুযূর আলাইহিস সালাম বা সাহাবায়ে কিরাম, তাবেঈন বা তবে তাবেঈন কখনও উদযাপন করেছিলেন কিনা? এটা নিছক ধোঁকা মাত্র।
আহলে সুন্নাতের উচিত তাদের জিজ্ঞাসা করা— বলুন, মীলাদ শরীফ করা যে হারাম, তা কোথায় লেখা আছে? যখন আল্লাহ নিষেধ করেননি, রসূল আলাইহিস সালাম নিষেধ করেননি এবং কোনো দলীল থেকেও নিষেধাজ্ঞা প্রমাণিত হয়নি, তাহলে আপনারা কোন যুক্তিতে হারাম বলছেন? মীলাদ শরীফের প্রমাণ না থাকাটা জায়েয হওয়ারই লক্ষণ।
পূর্ববর্তী পেইজ | পরবর্তী পেইজ |
(০০৪) বিদ্আতের প্রকারসমূহের পরিচয় ও লক্ষণসমূহ | (০০৬) মাহফিলে মীলাদ শরীফের বর্ণনা |
সূচীপত্র | এরকম আরো পেইজ |