বিদআতের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে- নতুন জিনিস। যেমন- কুরআন করীম ইরশাদ ফরমান -
قُلْ مَا كُنتُ بِدْعًا مِنَ الرُّسُلِ
(বলে দিন, আমি নতুন রসুল নই।)
¶ সূরা নং- ৪৬: সূরা আহকাফ, আয়াত, ৯
অন্যত্র ইরশাদ করেন-
بَدِيعُ السَّمٰوَاتِ وَالْأَرْضِ
(আসমান ও যমীনসমূহের সৃষ্টিকর্তা।)
¶ সূরা নং- ২: সূরা বাক্বারা, আয়াত, ১১৭
আর এক জায়গায় ইরশাদ করা হয়েছে-
وَرَهْبَانِيَّةً ٱبْتَدَعُوهَا مَا كَتَبْنَٰهَا عَلَيْهِمْ
(সন্ন্যাসবাদ তারা নিজেরাই প্রবর্তন করেছিল, আমি তাদেরকে এর হুকুম দিইনি।)
¶ সূরা নং- ৫৭: সূরা হাদীদ, আয়াত, ২৭
উপরোক্ত আয়াতসমূহে 'বিদআত' শব্দকে শাব্দিক অর্থে-অর্থাৎ সৃষ্টি করা, নতুন কিছু তৈরী করা ইত্যাদি অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। মিশকাত শরীফের ব্যাখ্যাগ্রন্থ মিরকাত- ٱلِٱعْتِصَامُ بِٱلْكِتَابِ وَٱلسُّنَّةِ শীর্ষক অধ্যায়ে উল্লেখিত আছে-
قَالَ ٱلنُّورِيُّ ٱلْبِدْعَةُ كُلُّ شَيْءٍ عُمِلَ عَلَىٰ غَيْرِ مِثَالٍ سَبَقَ
অর্থাৎ, বিদআত সে কাজকে বলা হয়, যা বিগত কোন কিছুর অনুকরণ ছাড়া করা হয়।
¶ ইমাম নববী, শরহে মুসলিম, ৬/১৫৪পৃ: দারু ইহ্ইয়াউত তুরাসুল আরাবী, বয়রুত, লেবানন, দ্বিতীয় প্রকাশ- ১৩৯২হিঃ মোল্লা আলী ক্বারী, মেরকাত, ১/২২৩পৃ: হা/১৪১ এর আলোচনা, দারুল ফিকর ইলমিয়্যাহ, বয়রুত, লেবানন, প্রথম প্রকাশ- ১৪২২হিঃ।
বিদআত তিন অর্থে ব্যবহৃত হয়
প্রথম অর্থে ব্যবহৃত বিদআত দু'প্রকার- বিদআতে হাসনা ও বিদআতে সাইয়া। দ্বিতীয় অর্থে ব্যবহৃত বিদআত মাত্রই সাইয়া (মন্দ)। যে সব বুযুর্গানে কিরাম প্রত্যেক বিদআতকে সাইয়া (মন্দ) বলেছেন, তাঁরা তা দ্বিতীয় অর্থের বেলায় বলেছেন এবং হাদীসে যে বলা হয়েছে- প্রত্যেক বিদআত গুমরাহী, তা দিয়ে তৃতীয় অর্থের বিদআত বোঝানো হয়েছে। সুতরাং, হাদীসসমূহ ও উলামায়ে কিরামের উক্তিসমূহের মধ্যে কোন বিরোধ নেই।
শরীয়তের পরিভাষায় বিদআত বলতে সে সব আকীদা ও আমলকে বলা হয়, যা হুযূর আলাইহিস সালাতু ওয়াস সালামের জাহেরী জিন্দেগীকালে ছিল না; পরে প্রচলন হয়েছে।
এ সংজ্ঞা থেকে প্রতীয়মান হয় বিদআতে শারেয়ী দু'রকম- বিদআতে ইতিকাদী ও বিদআতে আমলী।
বিদআতে ইতিকাদ সে সব মন্দ আকীদাকে বলা হয়, যা হুযূর আলাইহিস সালাতু ওয়াস সালামের পরে ইসলাম ধর্মে সূচিত হয়েছে। ঈসায়ী, ইহুদী, মজুসী এবং মুশরিকদের আকীদাসমূহ বিদআতে ইতিকাদী নয়। কেননা, এরা হুযূর আলাইহিস সালামের পবিত্র জিন্দেগীতে বিদ্যমান ছিল।
অধিকন্তু, সেসব আকীদাকে ঈসায়ী ও অন্যান্যগণ ইসলামী আকাইদ বলে না। জবরীয়া, কদরীয়া, মরজিয়া, ছকড়ালবী, লা-মাযহাবী ও দেওবন্দীদের আকীদা হচ্ছে বিদআতে ইতিকাদী। কেননা, এসব ফিরকা পরে আবির্ভূত হয়েছে এবং এরা তাদের আকীদাকে ইসলামী আকীদা মনে করে থাকে।
যেমন দেওবন্দীরা বলে,
এসব নাপাক আকীদা ১২০০ হিজরীর আবিষ্কার। আমি এ কিতাবের শুরুতে ফাল্গুয়ায়ে শামীর উদ্ধৃতি দিয়ে এর প্রমাণ দিয়েছি।
এখন বিদআতে হাসনার প্রমাণ নিনঃ
আল্লাহ তা'আলা ফরমান-
وَجَعَلْنَا فِي قُلُوبِ ٱلَّذِينَ ٱتَّبَعُوهُ رَأْفَةًۭ وَرَحْمَةًۭ وَرَهْبَانِيَّةً ٱبْتَدَعُوهَا مَا كَتَبْنَٰهَا عَلَيْهِمُ ٱبْتِغَآءَ رِضْوَٰنِ ٱللَّهِ
(আমি তাঁদের আত্মায়, যাঁরা তাঁর অনুসরণ করেছেন, আরাম ও রহমত দান করেছি। সন্ন্যাসবাদ তারাই প্রবর্তন করেছিল; আমি তাদেরকে এর হুকুম দিইনি। আল্লাহর রেযামন্দীর উদ্দেশ্যে এর সূচনা করেছিল।)
¶ সূরা নং- ৫৭: সূরা হাদীদ, আয়াত, ২৭
পুনরায় ইরশাদ করেন:
فَـَٔاتَيْنَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوا۟ مِنْهُمْ أَجْرَهُمْ
(তাদের মধ্যে যারা ঈমান এনেছে, আমি ওদেরকে পুরস্কার দিয়েছি।)
¶ সূরা নং- ৫৭: সূরা হাদীদ, আয়াত, ২৭
এ আয়াত থেকে বোঝা গেল যে ঈসায়ীগণ বিদআতে হাসনা, অর্থাৎ সংসার ত্যাগী হওয়াটা আবিষ্কার করলো, আল্লাহ তা'আলা এর প্রশংসা করলেন এবং এর জন্য পুরস্কারও দিলেন।
তবে হ্যাঁ, যারা একে চালু রাখতে পারেনি, তাদের নিন্দা করা হয়েছে। বলা হয়েছে-
فَمَا رَعَوْهَا حَقَّ رِعَايَتِهَا
(এটাও তারা যথাযথভাবে পালন করেনি।)
¶ সূরা নং- ৫৭: সূরা হাদীদ, আয়াত, ২৭
লক্ষ্য করুন, এখানে বিদআতের জন্য নিন্দা করা হয়নি, বরং এটা চালু না রাখায় নিন্দা করা হয়েছে। তাই প্রমাণিত হলো যে, বিদআতে হাসনা ভাল ও ছওয়াবের কাজ। কিন্তু যথাযথ পালন না করা পাপ।
خَيْرُ ٱلْأُمُورِ أَدْوَمُهَا
(সবচেয়ে ভাল কাজ হচ্ছে ওটার উপর অটল থাকা।)
সুতরাং, মুসলমানগণ যেন যথাযথভাবে মীলাদ মাহফিল ইত্যাদি উদযাপন করেন।
মিশকাত শরীফের ٱلِٱعْتِصَامُ অধ্যায়ের প্রথম হাদীছে আছে-
مَنۡ أَحْدَثَ فِيٓ أَمْرِنَا هَٰذَا مَا لَيْسَ مِنْهُ فَهُوَ رَدٌّۭ
(যে ব্যক্তি আমার এ ধর্মে ওই ধরনের আকীদার প্রচলন করে, যা ধর্মের বিপরীত, সে অভিশপ্ত।)
¶ খতিব তিবরিযি, মিশকাত, ১/৫১পৃ: হা/১৪০, ইমাম মুসলিম, আস-সহীহ, ৩/১৩৪৩পৃ: হা/১৭১৮, ইমাম ইবনে মাযাহ, আস-সুনান, ১/৭পৃ: মুকাদ্দামা, হা/১৪, ইমাম ইবনে হিব্বান, আস-সহীহ, ১/২০৮পৃ: হা/২৬
আমি উপরোক্ত হাদীসে শব্দের অর্থ আকীদা এ জন্য করেছি যে ধর্ম হচ্ছে আকীদার অপর নাম।
গৌণ আমলসমূহের ক্ষেত্রে যেমন- বেনামাযী গুণাহগার বটে, কিন্তু বেদীন বা কাফির নয়, অথচ মন্দ আকীদা পোষণকারী হয়তো গুমরাহ, না হয় কাফির।
এ প্রসঙ্গে 'মিরকাত' গ্রন্থে বর্ণিত আছে-
وَٱلْمَعْنَىٰ أَنَّ مَنْ أَحْدَثَ فِي ٱلْإِسْلَامِ رَأْيًۭا فَهُوَ مَرْدُودٌ عَلَيْهِ
(যে কেউ ইসলামে এ ধরনের আকীদার প্রচলন করে, যা ধর্মের পরিপন্থী, সে মরদুদ।)
আমি বলতে চাই যে هَذَا ٱلْأَمْرُ দ্বারা ওদিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে ইসলামের ব্যাপারটা পরিপূর্ণ হয়েছে।
প্রমাণিত হলো বিদআত আকীদাকে বলা হয়েছে। মিশকাত الإيمان بالقدر অধ্যায়ে উল্লেখিত আছে- হযরত ইবনে উমর (রাঃ) কে কেউ বললেন যে অমুক ব্যক্তি আপনাকে সালাম দিয়েছেন। তখন তিনি বললেন-
بَلَغَنِي أَنَّهُ قَدْ أَحْدَثَ فَإِنْ كَانَ أَحْدَثَ فَلَا تُقْرِئْهُ مِنِّي السَّلَامَ
(আমি জানতে পারলাম যে সে বিদ্আতী হয়ে গেছে। তা যদি হয়, তাকে আমার সালাম বলবেন না।)
জিজ্ঞাসা করা হলো বিদআতী কিভাবে হতে পারে? ফরমালেন,
يَقُولُ يَكُونُ فِي أُمَّتِي خَسْفٌ وَمَسْخٌ أَوْ قَذْفٌ فِي أَهْلِ الْقَدَرِ
(হুযুর আলাইহিস সালাম ইরশাদ ফরমাতেন যে, আমার উম্মতের মধ্যে কদরীয়া সম্প্রদায়ের বেলায় ভূমি ধ্বসে যাবে, চেহারা বিকৃত হবে, অথবা পাথর বর্ষিত হবে।)
প্রতিভাত হলো যে, কদরীয়া ফির্কাকে অর্থাৎ যারা তকদীরকে অস্বীকার করতো তাদেরকে বিদআতী বলা হয়েছে। দুরুল মুখতারের كتاب الصلاة لامت শীর্ষক অধ্যায়ে বর্ণিত আছে-
وَمُبْتَدِعٌ إِلَى صَاحِبِ بِدْعَةٍ وَهِيَ ٱعْتِقَادُ خِلَافِ ٱلْمَعْرُوفِ عَنِ ٱلرَّسُولِ
(বিদআতী ইমামের পিছনে নামায পড়া মাকরূহ। বিদ্আত হচ্ছে সেই আকীদার বিপরীত আকীদা পোষণ করা, যা হুযূর আলাইহিস সালাতু ওয়াস সালাম থেকে প্রসিদ্ধি লাভ করেছে।)
¶ হাসকাফী, দুররুল মুখতার, ৭৩পৃ: কিতাবুল ইমামত, মাতবাউ মুজতাবা, লাহোর, পাকিস্তান, ইমাম ইবনে আবেদীন শামী, ফাতওয়ায়ে শামী, ১/৫৬০পৃ: দারুল ফিকর ইলমিয়্যাহ, বয়রুত, লেবানন।
উপরোক্ত ভাষ্য থেকে বোঝা গেল, বিদআত নতুন ও মন্দ আকীদাকে বলা হয়। হাদীসসমূহে বিদ্আত ও বিদআতী সম্পর্কে যে কঠিন হুমকি দেয়া হয়েছে, এর দ্বারা আকীদাগত বিদ্আতকে বোঝানো হয়েছে। হাদীস শরীফে আছে- যে বিদআতীর (আকীদাগত) সম্মান করলো, সে যেন ইসলামকে ধ্বংস করার ব্যাপারে সাহায্য করলো। ফাওয়ায়ে রশীদিয়া প্রথম খণ্ড كتاب البدعة এর ৯০ পৃষ্ঠায় উল্লেখিত আছে- "
যে বিদআতের ব্যাপারে কঠিন হুমকি দেয়া হয়েছে, তা হচ্ছে আকীদাগত বিদ্আত যেমন- রাফেজী ও খারেজীদের বিদআত।"
আমলী বিদআত সেসব কার্যাবলীকে বলা হয়, যা হুযূর আলাইহিস সালামের পবিত্র যুগের পরে, দুনিয়াবী বা ধর্মীয় হোক সাহাবায়ে কিরামের যুগে বা এর পরে আবিষ্কৃত হয়েছে। মিরকাত গ্রন্থের الاعتصام অধ্যায়ে উল্লেখিত আছে-
وَفِي الشَّرْعِ إِحْدَاثُ مَا لَمْ يَكُنْ فِي عَهْدِ رَسُولِ اللَّهِ عَلَيْهِ السَّلَامُ
(বিদআত হচ্ছে শরীয়তে ওই ধরনের কাজের সূচনা করা, যা হুযূর আলাইহিস সালাতু ওয়াস সালামের যুগে ছিল না।)
¶ ইমাম মোল্লা আলী ক্বারী, মেরকাত, ১/২২৩পৃ: হা/১৪১ এর আলোচনা, দারুল ফিকর ইলমিয়্যাহ, বয়রুত, লেবানন, প্রথম প্রকাশ- ১৪২২হিঃ।
أَتْمَةُ ٱللُّغَةِ সেই একই অধ্যায়ে বর্ণিত আছে-
بِدَانْكِهْ بَرْچِيزْ بِيَدَا شُدَهْ بَعْدَ أَپِيغَمْبَرِ عَلَيْهِ ٱلسَّلَامُ بِدْعَةٌ
(যে কাজ হুযূর আলাইহিস সালাতু ওয়াস সালামের পরে সূচিত হয়েছে, তা বিদআত।)
¶ শায়খ আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী, আশিয়াতুল লুম‘আত, ১/১৩৫পৃ: মাকতাবায়ে হাক্কানীয়া, পিশওয়ার, পাকিস্তান।
উপরোক্ত ইবারতদ্বয়ে দীনের কাজের শর্তও নেই আর সাহাবায়ে কিরামের যুগের কথাও উল্লেখ নেই, যে কোন কাজ দুনিয়াবী হোক বা ধর্মীয়, যা হুযূর আলাইহিস সালাতু ওয়াস সালামের পরে যে কোন সময়ে সাহাবায়ে কিরামের যুগে বা এর পরে চালু হয়েছে, তা বিদ্আত হিসেবে গণ্য। তবে, প্রচলিত ভাষায় সাহাবায়ে কিরামের আবিষ্কারকে সুন্নাতে সাহাবা বলা হয়, বিদ্আত বলা হয় না। এটা প্রচলন মাত্র, না হয়, হযরত ফারুকে আযম (রাঃ) তারাবীর নামাযে নিয়মিত জামআতের প্রবর্তন করে বলতেন না-
نِعْمَةُ ٱلْبِدْعَةُ هَذِهِ
(এতো খুবই উত্তম বিদআত)
আমলী বিদআত দু'প্রকার- বিদ্আতে হাসনা ও বিদআতে সাইয়া। বিদ্আতে হাসনা ওই ধরনের নয়া কাজকে বলা হয়, যা কোন সুন্নাতের বিপরীত নয়। যেমন- মীলাদ মাহফিল, ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ, নিত্য নতুন উন্নতমানের খানাপিনা, ছাপাখানায় কুরআন শরীফ ও ধর্মীয় কিতাব ছাপানো ইত্যাদি।
আর বিদ্আতে সাইয়া ওইসব কাজকে বলা হয়, যা কোন সুন্নাতের বিপরীত বা কোন সুন্নাতকে বিলুপ্তকারী হিসেবে প্রতিভাত হয়। যেমন- জুমআ ও উভয় ঈদে আরবি বাদ দিয়ে অন্য ভাষায় খুৎবা পাঠ করা বা মাইকের সাহায্যে নামায পড়া বা পড়ানো।
কেননা এর ফলে আরবি ভাষায় খুৎবা পাঠ করা এবং তক্তীর দেয়া অর্থাৎ তীরের সাহায্যে আওয়াজ পৌঁছানো যে সুন্নাত, তা লুপ্ত হয়ে যায়।
বিদ্আতে হাসনা জায়েয বরং কোন কোন সময় মুস্তাহাব ও ওয়াজিবে পরিণত হয়। আর বিদআতে সাইয়া হচ্ছে মাকরূহ তানযিহী, মাকরূহ তাহরীমী অথবা হারাম। এ প্রকারভেদকে আমি সামনে বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করবো।
বিদআতে হাসনা ও বিদ্আতে সাইয়ার প্রমাণ শুনুন- أَتْمَةُ ٱللُّمَعَاتِ গ্রন্থের প্রথম الاعتصام অধ্যায়ের وكل بدعة ضلالة অংশে আছে-
وَأَنَّشْ مَوَافِقُ أُصُولِ وَقَوَاعِدِ سُنَّةِ أَوْسْتُ وَقِيَاسٌ كَرْدَهُ شُدَهُ أَسْتَ أَنْ رَا بَدْعَةٌ حَسَنَةٌ قُوْيَنْدَ وَأَنَّشْ مُخَالِفَ أَنْ بَاشَدْ بَاعِثٌ ضَلَالَةٌ قُوْيَنْدَ
(যে বিদআত ধর্মের মূলনীতি, নিয়ম কানুন ও সুন্নাতের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং এর সাথে কিয়াস করা হয়েছে, একে বিদ্আতে হাসনা বলা হয়। আর যা এর বিপরীত, সেটাকে বিদআতে গুমরাহী বলা হয়।)
¶ আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী, লুম‘আত, ১/১৩৫পৃ:
মিশকাত শরীফের العلم অধ্যায়ে বর্ণিত আছে-
مَنۡ سَنَّ فِي ٱلْإِسْلَامِ سُنَّةً حَسَنَةً فَلَهُۥ أَجْرُهَا وَأَجْرُ مَنۡ عَمِلَ بِهَا مِنۢ بَعْدِهِۦ مِنۡ غَيْرِ أَن يَنقُصَ مِنْ أُجُورِهِمْ شَيْـًٔا وَمَنۡ سَنَّ فِي ٱلْإِسْلَامِ سُنَّةً سَيِّئَةً فَعَلَيْهِ وِزْرُهَا وَوِزْرُ مَنۡ عَمِلَ بِهَا مِنْ غَيْرِ أَن يَنقُصَ مِنْ أَوْزَارِهِمْ شَيْـًٔا
(যে কেউ ইসলামের মধ্যে ভাল রীতি প্রচলন করেন, তিনি এর জন্য ছওয়াব পাবেন; যাঁরা এর উপর আমল করবেন, এর জন্যও ছওয়াব পাবেন, তবে তাঁদের ছওয়াবের মধ্যে কোন কমতি হবে না; এবং যারা ইসলামে মন্দরীতি প্রচলন করে, এর জন্য তাদের পাপ হবে এবং যারা এর উপর আমল করবে, তার জন্যও পাপের ভাগী হবে, তবে ওদের পাপের বেলায় কোন কমতি হবে না।)
¶ সহীহ মুসলিম, ২/৭০৪পৃ: হা/১০১৭, খতিব তিবরিযি, মিশকাত, ১/৭২পৃ: হা/২১০, সুনানে নাসাঈ, হা/২৫৫৪ এবং আস-সুনানিল কোবরা, হা/২৩৪৬, মুসনাদে আবি দাউদ তায়লসী, হা/৭০৫, ইমাম ইবনে হিব্বান, আস-সহীহ, হা/৩৩০৮, মুসনাদে আহমদ, ৪/৩৫৭-৫৮পৃ: , সুনানে ইবনে মাযাহ, মুকাদ্দামা, ১/৭৪পৃ: হা/ ২০৩
সুতরাং, বোঝা গেল যে ইসলামে কোন ভাল কাজের প্রচলন করাটা হচ্ছে ছওয়াবের কাজ আর মন্দ কাজের সূচনা করাটা হচ্ছে পাপের ভাগী হওয়া।
ফাওয়ায়ে শামীর ভূমিকায় ইমাম আবু হানীফা (রহঃ) এর ফযীলত বর্ণনা প্রসঙ্গে উল্লেখিত আছে-
قَالَ ٱلْعُلَمَاءُ هَذِهِ أَحَادِيثُ مِن قَوَاعِدِ ٱلْإِسْلَامِ وَهُوَ أَنَّ كُلَّ مَنِ ٱبْتَدَعَ شَيْـًٔا مِنَ ٱلشَّرِّ كَانَ عَلَيْهِ مِثْلُ وِزْرِ مَنِ ٱقْتَدَىٰ بِهِۦ فِى ذَٰلِكَ وَكُلُّ مَنِ ٱبْتَدَعَ شَيْـًٔا مِنَ ٱلْخَيْرِ كَانَ لَهُۥ مِثْلُ أَجْرِ كُلِّ مَنۡ يَعْمَلُ إِلَىٰ يَوْمِ ٱلْقِيَامَةِ
উলামায়ে কিরাম বলেন- এসব হাদীসসমূহ ইসলামের কানুন হিসেবে প্রযোজ্য। যে কেউ ইসলামে কোন মন্দ কাজের সূচনা করলে সে এর উপর সমস্ত আমলকারীদের গুনাহের ভাগী হবে; আর যে ব্যক্তি কোন ভাল কাজের প্রচলন করেন, তিনি কিয়ামত পর্যন্ত সমস্ত আমলকারীদের ছওয়াবের ভাগী হবেন।
¶ ইমাম ইবনে আবেদীন শামী, রুদ্দুল মুহতার, ১/৫৮পৃ: মুকাদ্দামা
এর থেকেও প্রমাণিত হলো ভাল বিদ্আতে ছওয়াব আছে ও মন্দ বিদ্আতে গুনাহ হয়।
যেটা সুন্নাতের বিপরীত, সেটা হচ্ছে মন্দ বিদআত। এর প্রমাণও প্রত্যক্ষ করুনঃ মিশকাত শরীফের الاعتصام অধ্যায়ে উল্লেখিত আছে-
مَنۡ أَحْدَثَ فِيٓ أَمْرِنَا هَٰذَا مَا لَيْسَ مِنْهُ فَهُوَ رَدٌّ
(যে ব্যক্তি আমার ধর্মে নতুন এমন কোন কিছু প্রচলন করলো, যা ধর্মের মধ্যে নেই, তাহলে সে মরদুদ হিসেবে গণ্য।)
¶ খতিব তিবরিযি, মিশকাত, ১/৫১পৃ: হা/১৪০, ইমাম মুসলিম, আস-সহীহ, ৩/১৩৪৩পৃ: হা/১৭১৮, ইমাম ইবনে মাযাহ, আস-সুনান, ১/৭পৃ: মুকাদ্দামা, হা/১৪, ইমাম ইবনে হিব্বান, আস-সহীহ, ১/২০৮পৃ: হা/২৬
'ধর্মের মধ্যে নেই' এর ভাবার্থ হলো ধর্মের বিপরীত। যেমন أَتْمَةُ ٱللُّغَةِ-এ হাদীসের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বর্ণিত আছে-
وَمُرَادُ شَيْءٍ هُوَ ٱلْمُخَالِفُ وَٱلْمُغَيِّرُ لَهُ
(এর দ্বারা এটাই বোঝানো হয়েছে, যা ধর্মের বিপরীত বা ধর্ম পরিবর্তনকারী।)
মিশকাত শরীফের সেই একই অধ্যায় الاعتصام এর তৃতীয় পরিচ্ছেদে উল্লেখিত আছে-
مَا أَحْدَثَ قَوْمٌ بِدْعَةً إِلَّا رُفِعَ مِثْلُهَا مِنَ ٱلسُّنَّةِ فَتَمَسَّكْ بِسُنَّةٍ خَيْرٌ مِّنْ إِحْدَاثِ بِدْعَةٍ
(যে কোন কওম যে পরিমাণ বিদআতের সূচনা করে, সে পরিমাণ সুন্নাত বিলুপ্ত হয়ে যায়। সুতরাং, সুন্নাতকে গ্রহণ করা বিদআতের প্রচলন করা থেকে উত্তম।)
¶ খতিব তিবরিযি, মিশকাত, ১/৬৬পৃ: হা/৮৭, ইমাম আহমদ, আল-মুসনাদ, ২৮/১৭৩পৃ: হা/১৬৯৭০, ইমাম মোল্লা আলী ক্বারী (رحمة الله) বলেন- (رَوَاهُ أَحْمَدُ) ، قَالَ مَيْرَكُ: بِسَنَدٍ جَيِّدٍ. -‘‘ইমাম আহমদ (رحمة الله) এই হাদিসটি সংকলন করেছেন, ইমাম মিরক (رحمة الله) বলেন, এই সনদটি শক্তিশালী।’’ (মেরকাত, ১/২৭০পৃ: হা/৮৭) এমনটি ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী (رحمة الله) বলেছেন। (ফতহুল বারী, ১৩/২৫৩পৃ:) এই সনদটি আলবানী মিশকাতের তাহকীকে ‘ইবনে আবি মারিয়াম’ নামক রাবীর কারণে যঈফ বলেছেন। ইমাম যাহাবী (رحمة الله) তার জীবনীতে লিখেন- الإِمَامُ، المُحَدِّثُ، القُدْوَةُ، الرَّبَّانِيُّ، -‘‘তিনি ছিলেন হাদিসের ইমাম, মুহাদ্দিস, অনুসরণযোগ্য ব্যক্তি, মর্যাদাপূর্ণ ব্যক্তি।’’ (ইমাম যাহাবী, সিয়ারু আলামুল নুবালা, ৭/৬৪পৃ: ক্রমিক- ২৫) যাহাবী (رحمة الله) আরও উল্লেখ করেন- وقال ابْن عدي: أحاديثه صالحة -‘‘ইমাম ইবনে আদি (رحمة الله) বলেন, তিনি হাদিস বর্ণনায় সৎ ছিলেন।’’ (যাহাবী, তারিখুল ইসলাম, ৪/২৫৮পৃ:) তাই এই হাদিসটি হাসান বা শক্তিশালী।
এর ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে "আশআতুল লুমআত"-এ উল্লেখিত আছে-
وحول احداث بدعة رافع سنت است هميں قياس اقامت سنت قاطع بدعة خواهد بود
(যেহেতু বিদআতের সূচনা করাটা হচ্ছে সুন্নাত বিলুপ্তির সহায়ক, সেহেতু সুন্নাতের উপর অটল থাকাটা হবে বিদআত প্রতিরোধের সহায়ক।)
এ হাদীস ও এর ব্যাখ্যা থেকে এটা বোঝা গেল যে বিদআতে সাইয়া অর্থাৎ মন্দ বিদআত হচ্ছে, যার দ্বারা সুন্নাতের বিলুপ্তি ঘটে। ইতিপূর্বে এর উদাহরণ দেয়া হয়েছে। বিদ্আতে হাসানা ও বিদআতে সাইয়ার পার্থক্য ভালভাবে স্মরণ রাখা প্রয়োজন। কেননা এ ক্ষেত্রে প্রায়শই ধোঁকা দেয়া হয়।
পূর্ববর্তী পেইজ | পরবর্তী পেইজ |
(০০১) অনুবাদকের কথা | (০০৩) বিদআতের প্রকারভেদ |
সূচীপত্র | এরকম আরো পেইজ |