আক্বিদাহঃ নবী হচ্ছেন সে সব পুরুষ মানুষ, যাঁদেরকে আল্লাহ তা’আলা শরীয়তের বিধি নিষেধ প্রচার করার জন্য পাঠিয়েছেন (শরহে আকায়েদ) অতএব, ‘নবী’ মানুষ ভিন্ন অন্য কেউ নন; আর মহিলা নন।
কুরআন ইরশাদ করছেঃ
وَمَا أَرْسَلْنَا قَبْلَكَ إِلَّا رِجَالًا نُوحِي إِلَيْهِمْ
-‘‘হে নবী (ﷺ)! আমি আপনার আগে যাঁদেরকে পাঠিয়েছিলাম, তাঁরা হচ্ছেন মানব জাতির সে সব মহাপুরুষ, যাঁদের প্রতি ওহী প্রেরণ করতাম।’’
সূরাঃ আম্বিয়া, আয়াতঃ ৭, পারাঃ ১৭
একথা থেকে জানা যায় যে, জ্বীন, ফিরিশতা, মানবজাতির মহিলা বা অন্য কোন জীব নবী হতে পারে না।
আকীদাহঃ নবী সব সময়ই উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন পরিবারেই জন্মগ্রহণ করেন, উচ্চ বংশোদ্ভুত হয়ে থাকেন এবং অতি উত্তম স্বভাব-চরিত্রের অধিকারী হন। নিচু বংশোদ্ভুত হওয়া ও অশোভনীয় চাল-চলন থেকে তাঁরা মুক্ত (বাহারে শরীয়ত)।
বুখারী শরীফের ১ম খন্ডের শুরুতে আছে যে, রোমের সম্রাট হিরাকলের নিকট হুজুর (ﷺ) এর সুমহান ফরমানঃ اَسْلِمْ تَسْلَمُ [ইসলাম গ্রহণ করুন, শান্তিতে থাকবেন] পৌঁছার পর তিনি আবু সুফিয়ানকে হুজুর (ﷺ) সম্পর্কে কিছু প্রশ্ন করলেন। প্রথম প্রশ্নটি ছিল
كَيْفَ نَسْبُهُ فِيْكُمْ
-‘‘আপনাদের মধ্যে সে নবীর পারিবারিক ও বংশ মর্যাদা কিরূপ?’’ হযরত আবু সুফিয়ান (رضي الله عنه) বললেনঃ
هُوَ فِيْنَا ذُوْ نَسَبٍ
অর্থাৎ- তিনি আমাদের মধ্যে খুবই উচ্চ বংশ জাত ও উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন পরিবারের লোক। তিনি হচ্ছেন কুরা্শী, হাশেমী ও সুপ্রসিদ্ধ আবদুল মোতালিবের পরিবারভুক্ত।
এরপর হিরাকল বলেনঃ
وَكَذَالِكَ الرُّسُلُ تَبْعَثُ فِىْ قَوْمِهَا
-‘‘আম্বিয়ায়ে কিরাম সব সময় উচ্চ বংশ ও উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন পরিবার থেকেই হয়ে থাকেন।’’
এর থেকে জানা যায় যে, সম্মানিত নবীগণ উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন পরিবারেই আবির্ভূত হন।
বিঃ দ্রঃ কেউ কেউ বলেন যে, প্রত্যেক জাতির মধ্যে নবী আবির্ভূত হয়েছেন। অর্থাৎ খোদা মাফ করুন, শেতর, চামার, হিন্দ, বৌদ্ধ, জৈন প্রভৃতি ধর্মাবলম্বীদের মধ্যেও তাদের জাতি থেকে নবীদের আবির্ভাব হয়েছে। অতএব লাল গুরু, কৃষ্ণ, গৌথম বুদ্ধ প্রমুখ যেহেতু নবী হতে পারে, সেহেতু তাদের সম্পর্কে খারাপ কোন ধারণা পোষণ করতে নেই। কুরআন ইরশাদ করেছে- لِكُلِّ قَوْمٍ هَادٍ -‘‘প্রত্যেক জাতির মধ্যে পথ প্রদর্শক আছেন।’’ অধিকন্তু, অনেক মহিলাও নবী হয়েছে, কেননা, হযরত মুসা (আলাইহিস সালাম) এর মা ও হযরত মারয়ামের (আলাইহিস সালাম) এর নিকট ওহী প্রেরিত হয়েছে এবং যার নিকট ওহী আসে; সেই-ই নবী।
কুরআন ইরশাদ করছেঃ
وَاَوْحَيْنَا اِلَى اُمِّ مُوْسَى
-‘‘আমি হযরত মুসা (আলাইহিস সালাম) এর মায়ের নিকট প্রত্যাদেশ পাঠিয়েছি।’’
{সূরাঃ কাসাস, আয়াতঃ ৭, পারাঃ ২০}
উপরোক্ত মত দুইটি ভ্রান্ত
প্রথমতঃ এজন্য যে, উলেখিত আয়াতটির সম্পূর্ণ অংশের উলেখ করা হয়নি সেখানে আর সে জন্য অনুবাদও সঠিক হয়নি। সম্পূর্ণ আয়াতটি হচ্ছে এ রকমঃ
إِنَّمَا أَنْتَ مُنْذِرٌ وَلِكُلِّ قَوْمٍ هَادٍ
-‘‘হে নবী (ﷺ), আপনি হচ্ছেন ভীতি প্রদর্শনকারী ও প্রত্যেক জাতির পথ প্রদর্শক।’’
{সূরাঃ রা’দ, আয়াতঃ ৭, পারাঃ ১৩}
প্রত্যেক জাতির পথ প্রদর্শক হওয়াটাই হুযুর (আলাইহিস সালাম) এর একমাত্র বৈশিষ্ট। অন্যান্য নবীগণ পৃথক পৃথক জাতিরই নবী। আর যদি তর্কের খাতিরে মেনে নেওয়া হয় যে, আলোচ্য আয়াতের অর্থ হচ্ছে, প্রত্যেক জাতির মধ্যেই পথ প্রদর্শক আবির্ভূত হয়েছেন, তা হলেও একথা কোথায় আছে যে, প্রত্যেক জাতির মধ্যে সেই জাতির থেকে পথপ্রদর্শক হয়েছেন? এও হতে পারে যে, উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন জাতির থেকেই পথ প্রদর্শক হয়েছেন? এও হতে পারে যে, উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন জাতির মধ্যে নবীর আবির্ভাব হয়েছিল, আর অন্যান্য জাতি তাঁরই হিদায়তের অধীন ছিল।
হুজুর (ﷺ) হলেন কুরাইশী, কিন্তু পাঠান, শেখ, সৈয়দ মোটকথা সমস্ত জাতির, এমনটি সমস্ত মখলুকের নবী হচ্ছেন তিনি। তাছাড়া উলেখিত هَادِىْ ‘হা্দী’ শব্দটির ব্যাপক অর্থ রয়েছে- নবী ও নবী নয় এমন পথ প্রদর্শক উভয়কেই অন্তভুর্ক্ত করে। সুতরাং, আয়াতাংশটির এ অর্থ হতে পারে যে, প্রত্যেক জাতির মধ্যে কেউ কেউ জাতির অন্তভুর্ক্ত অন্যান্যদের জন্য পথ প্রদর্শকরূপে নিয়োজিত ছিলেন। অধিকন্তু, মহাদেব, কৃষ্ণ প্রমুখের অস্তিত্ব সম্পর্কে শরীয়ত সম্মত কোন প্রমাণ নেই। কুরআন হাদীছে তাদের সম্পর্কে কিছুই বলা হয়নি। কেবল মূর্তি পূজারীদের মাধ্যমে তাদের কিছু কিছু পরিচয় পাওয়া যায়। তাও এরূপ যে কারো চার হাত, কারো ছয় পা, কারো মুখে হাতীর মতই শুড় গজানো, কারো পিছনে কালো মুখ ও দীর্ঘ লেজ বিশিষ্ট বানরের মত লম্বা লেজ সংযোজিত। তাদের নাম যেমন মনগড়া, আকৃতি সমূহও মনগড়া।
মহান প্রভু আল্লাহ তা’আলা আরবের মূর্তি পূজারীদের উদ্দেশ্যে বলেছেনঃ
إِنْ هِيَ إِلَّا أَسْمَاءٌ سَمَّيْتُمُوهَا أَنْتُمْ وَآبَاؤُكُمْ
-‘‘সেগুলো হচ্ছে তোমাদের ও তোমাদের বাপ-দাদাদের মনগড়া কতগুলো নাম মাত্র।’’
{সূরাঃ নাজম, আয়াতঃ ২৩, পারাঃ ২৭}
অতএব, যখন ওদের অস্তিত্বের ব্যাপারে নিশ্চিতরূপে কিছু বলা যাচ্ছে না, সেহেতু তাদেরকে নবী হিসেবে জ্ঞান করার কীই বা যৌক্তিকতা থাকতে পারে?
আর ২য় মতটি এজন্য ভ্রান্ত যে, হযরত মুসা (আলাইহিস সালাম) এর শ্রদ্ধেয় মাতার অন্তরে একটি ভাবের অবতারণা করা হয়েছিল বা তাঁর অন্তরে বিশেষ একটি বিষয়ের অভ্যুদয় ঘটানো হয়েছিল, যার বর্ণনা কুরআন এভাবে দিয়েছেঃ اَوْ حَيْنَا ‘ওহী’ শব্দটি ইলহাম’ অর্থেও ব্যবহৃত হয়।
যেমন কুরআন আছেঃ
وَأَوْحَى رَبُّكَ إِلَى النَّحْل
-‘‘আপনার প্রভু মধু মক্ষিকার অন্তরে এ ধারণার সৃষ্টি করেছেন।’’ এখানে ‘ওহী’ শব্দটি অন্তরে অভ্যুদয় ঘটানো অর্থেই প্রয়োগ করা হয়েছে।
{সূরাঃ নাহল, আয়াতঃ ৬৮, পারাঃ ১৪}
আর হযরত মরিয়মের প্রতি যে ওহী পাঠানো হয়েছিল, তা’ প্রচারধর্মী ছিল না। তাঁকে প্রচারধর্মী বিধি-নিষেধ সমূহ প্রচারের জন্য পাঠানো হয়নি। তাছাড়া ফিরিশতাদের প্রত্যেকটি কথা ‘ওহী’ নয়, আবার প্রত্যেক ওহীও প্রচারধর্মী নয়। কোন কোন সাহাবীও তাঁদের কথা শুনেছেন; আর মৃত্যুর সময় ও কবর ও হাশরে সবাইতো ফিরিশতাদের সাথে কথা বলবেন। তাই বলে তারা সবাইতো নবী নয়। এ সম্পর্কে আরও বিস্তারিত তথ্যাবলী জানতে হলে আমার রচিত ‘শানে হাবীবুর রহমান’ গ্রন্থটি অধ্যয়ন করুন।
আক্বীদাহঃ কোন ব্যক্তি নিজের ইবাদত ও ধর্মীয় কার্যাবলী সুচারুরূপে সম্পন্ন করার দ্বারা ‘নবুওয়াত’ লাভ করতে পারে না। নবুওয়াত হচ্ছে একমাত্র খোদার দান।
اللَّهُ أَعْلَمُ حَيْثُ يَجْعَلُ رِسَالَتَهُ
-‘‘কোথায় রিসালাতের ভার অর্পিত হবে, তা আল্লাহ ভালরূপেই জানেন।’’
{সূরাঃ আনআম, আয়াতঃ ১২৪, পারাঃ ৮}
আর, নবী নয় এমন ব্যক্তি গাউছ, কুতুব, আবদাল যা’ই হোন না কেন, না নবীর সমতুল্য হতে পারেন, না নবীকে অতিক্রম করে যেতে পারেন। একথা কয়টি খেয়াল রাখা চাই।