নবী মানব জাতির মধ্যে আবির্ভূত হয়ে থাকেন, আর তিনি মানবই হন; জ্বিন কিংবা ফিরিশতা নন। এটি হচ্ছে পার্থিব বিধি-বিধান অনুযায়ী। কেননা মনুষ্য সৃষ্টির সূচনা হয় হযরত আদম (আলাইহিস সালাম) থেকে তিনিই হলেন মানুষের পিতা। আর, হুজুর (ﷺ) সে সময়েও নবী ছিলেন, যখন আদি পিতা হযরত আদম (আলাইহিস সালাম) মাটি ও পানির সাথে একাকার ছিলেন।
স্বয়ং হুজুর (ﷺ) ইরশাদ করেছেনঃ
كُنْتُ نَبِيَّا وَاَدَمُ بَيْنَ الْمَاءِ وَالطِّيْنِ
[আমি তখনও নবী ছিলাম, যখন হযরত আদম (আলাইহিস সালাম) পানি ও মাটির সাথে একীভূত ছিলেন।]
সে সময় অর্থাৎ হযরত আদম (আলাইহিস সালাম) এর সৃষ্টির পূর্বে হুজুর (ﷺ) নবী ছিলেন ‘মানব’ ছিলেন না। এসব কিছুই সঠিক। তবে, নবীদেরকে ‘বশর’ বা ‘ইনসান’ বলে আহবান করা, কিংবা হুজুর (ﷺ) কে ‘হে মুহাম্মদ’, ‘হে ইব্রাহীমের পিতা’, ‘হে ভাই’, ‘হে দাদা’, ইত্যাদি ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক নির্দেশক শব্দাবলী দ্বারা সম্বোধন করা ‘হারাম’ বা নিষিদ্ধ। যদি কেউ অবমাননার উদ্দেশ্যে এভাবে সম্বোধন করে, তা’হলে ‘কাফির’ বলে গণ্য হবে।
‘আলমগীরী’ ও অন্যান্য ফিকাহ এর কিতাবসমূহে আছে, যে ব্যক্তি হুজুর (ﷺ) কে অবমাননা করার উদ্দেশ্যে هَذَا الرَّجُلُ এ লোকটি’ বলে অভিহিত করে, সে ‘কাফির’। তাঁকে বরং ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ! ‘ইয়া শাফীয়াল মুযনেবীন’ ইত্যাদি সম্মানসূচক শব্দাবলী দ্বারা স্মরণ করা জরুরী। কবিগণ তাদের কাব্যে ‘ইয়া মুহাম্মদ’ লিখে থাকেন বটে, তবে তা স্থানের সংকীর্নতার কারণে লিখা হয়। অবশ্য কবিতা পাঠকারী যেন (ﷺ) পড়ে নেন।
পূর্ববর্তী পেইজ | পরবর্তী পেইজ |
(৩৭) নবীর সংজ্ঞা ও তাঁদের মর্যাদার স্তর সম্পর্কিত বর্ণনা | (৩৯) হুযুর পুর নুর (সঃ) এর মানব হওয়ার বিষয়কে কেন্দ্র করে উত্থাপিত আপত্তি ও জবাব |
সূচীপত্র | এরকম আরো পেইজ |
যেমনঃ এ পংক্তিতে বলা হয়েছে-
واه كيا جود وكرم هے شه بطحاتيرا
(বাহ! হে সুপ্রশস্থ, বিস্তীর্ণ ভূ-খন্ড তথা মক্কার বাদশাহ! ‘তোর’ দান ও বদান্যতা কী অপূর্ব!)
এ ‘তোর’ শব্দটি নিবিড় সম্পর্ক ও আবদার নির্দেশক শব্দ। যেমন- বলা হয়ে থাকে- ‘হে মওলা! আমি তোর জন্য উৎসর্গকৃত। ওহে মা! তুই কোথায়? ‘হে আল্লাহ! তুই আমাদের প্রতি দয়া কর’। এ ধরনের ‘তুই’ ও ‘তোর’ প্রভৃতি শব্দাবলীর তাৎপর্য ভিন্ন।
কুরআন করীম ইরশাদ করেছেঃ
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَرْفَعُوا أَصْوَاتَكُمْ فَوْقَ صَوْتِ النَّبِيِّ وَلَا تَجْهَرُوا لَهُ بِالْقَوْلِ كَجَهْرِ بَعْضِكُمْ لِبَعْضٍ أَنْ تَحْبَطَ أَعْمَالُكُمْ وَأَنْتُمْ لَا تَشْعُرُونَ
-‘‘তোমরা তোমাদের মধ্যে রাসূলকে ডাকার এমন রীতির প্রচলন করিও না, যেমন করে তোমরা একে অপরকে ডেকে থাক। তাঁর সমীপে চেঁচিয়ে কথা বলিও না যেমন করে তোমরা পরস্পরের সাথে উচ্চস্বরে কথা বল; পাছে তোমাদের ‘আমলসমূহ তোমাদের অজ্ঞাতসারে ব্যর্থতায় পর্যবসিত (বিনষ্ট) না হয়।’’
আমলসমূহ কুফরের কারণে নস্যাৎ হয়ে থাকে।
‘মাদারেজ’ গ্রন্থের প্রথম খন্ডে وصل از جمله رعايت حقوق او ليست শীর্ষক আলোচনায় উলেখিত আছেঃ
مخوانيد اورابنام مبارك اوچنانكه مى خوانيد بعضے از شما بعض را بلكه بگويد يارسول الله يانبى الله يا توقير وتوضيع
অর্থাৎ- নবী (ﷺ) কে তাঁর পবিত্র নাম ধরে ডাকতে নেই, যেমন তোমরা পরস্পরকে ডেকে থাক। বরং তাঁকে আদব, সম্মান ও বিনয় সহকারে এভাবেই ডাকবে- ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ’। ইয়া নবীয়াল্লাহ’।
তাফসীরে ‘রূহুল বয়ানে’ উক্ত আয়াত এর ব্যাখ্যা করা হয়েছে এরূপঃ
وَالْمَعْنَى لاَتَجْعَلُوْا نِدَاء كمْ اِيَّاهُ وَتَسْمِيْتَكُمْ لَهُ كَنِدَاء بَعْضِكُمْ بَعْضًا لْاِسْمِهِ مِثْلُ يَامُحَمَّدُ وَيَااِبْنَ عَبْدِ اللهِ ولَكِنْ بِلَقَبِهِ الْمُعَظَّمِ مِثْلُ يَانَبِىَّ اللهِ وَيَارَسُوْلَ اللهِ كَمَا قَالَ اللهُ تَعَالَى يَااَيُّهاالنَّبِيُّ وَيَااَيُّهَا الرَسُوْلُ
-‘‘মূল কথা হচ্ছে হুজুর (ﷺ) কে ডাকার ও তাঁর নাম লওয়ার সময় এমনভাবে ডাকবে না, যেভাবে তোমরা পরস্পরকে নাম ধরে ডাকাডাকি। কর। যেমন- হে মুহাম্মদ! ওহে আবদুল্লাহর পুত্র! ইত্যাদি। তবে, তাঁকে মহিমান্বিত উপাধিসমূহের মাধ্যমে ডাকবে, যেমন- ওহে আল্লাহর নবী! ওহে আল্লাহর রাসূল! যেমন স্বয়ং মহা প্রভু আল্লাহ তাঁকে ‘হে নবী’। হে রাসূল! বলে সম্বোধন করে থাকেন।’’
{আল্লামা ইসমাঈল হাক্কীঃ তাফসীরে রুহুল বায়ানঃ ৬/২৪০ পৃ.}
এসব কুরআনের আয়াত, তাফসীরকারক ও হাদীছবেত্তাগণের উক্তিসমূহ থেকে বোঝা যায় যে, যে কোন অবস্থায় হুজুর (ﷺ) এর মান-মর্যাদার প্রতি সবিশেষ লক্ষ্য রাখতে হবে, চাই ডাকার সময় হোক, বা কথা বলার সময় হোক কিংবা তাঁর সাতে যে কোন আচরণের সময় হোক।
পার্থিব মান-সম্মানের অধিকারী ব্যক্তিবর্গকেও তাদের নাম ধরে ডাকা যায় না। মাকে ‘আম্মা সাহেবানী’, বাপকে ‘শ্রদ্ধেয় পিতা’ এবং ভাইকে ‘ভাইজান’ ইত্যাদি শব্দাবলীর দ্বারা অভিহিত করা হয়। কেউ যদি নিজের মাকে বাপের বউ, বাপকে মা’র স্বামী বলে অভিহিত করে, কিংবা তাদের নাম ধরে ডাকে, বা ‘ভাই’ ইত্যাদি বলে আহবান করে, তাকে বেআদব, অভদ্র বলা হবে, যদিও কথাগুলো সত্য। তার সম্পর্কে বলা হবে- সমতাসূচক শব্দাবলী দ্বারা কেন সে মুরুব্বীদের সম্বোধন করলো? আর হুজুর (ﷺ) হচ্ছেন আল্লাহ পাকের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতিনিধি, তাঁর নাম ধরে ডাকা, বা তাঁকে ‘ভাই’ ইত্যাদি বলে অভিহিত করা নিশ্চিতরূপে ‘হারাম’। ঘরের মধ্যে বোন, মা, স্ত্রী ও কন্যা সবই মেয়ে লোক কিন্তু তাদের নাম, কাজকর্ম ও তাদের সাথে আচরণের রীতি-নীতি ভিন্ন। কেউ যদি ‘মা’ কে স্ত্রী বরে বা স্ত্রীকে ডাকে, সে বেঈমান; যে ব্যক্তি তাদের সবাইকে একই দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখে, সে ‘মরদুদ’। অনুরূপ, যে নবীকে উম্মত ও উম্মতের কাউকে নবীর মত মনে করে, সে ‘মলউন’ (অভিশপ্ত)। দেওবন্দীগণ নবীকে উম্মতের সমপর্যায়ে নিয়ে এসেছে বা তাদের পথে দিশারী/ নেতা মৌলভী ইসমাঈল দেহলভী, সৈয়দ আহমদ বেরেলবীকে নবীর স্তরে নিয়ে গেছেন। খোদা মাফ করুন।
(‘সিরাতুল মুস্তাকীম’ গ্রন্থের সমাপ্তি পর্ব দ্রষ্টব্য)
মহান আল্লাহ যাঁকে কোন বিশেষ মর্যাদা দান করেছেন, তাঁকে সাধারণের জন্য ব্যবহৃত উপাধি দ্বারা আহবান করা তাঁর উচ্চ পদ মর্যাদাকে অস্বীকার করার নামান্তর। পার্থিব সরকারের পক্ষ থেকে কেউ যদি ‘নবাব’ বা খাঁন ‘বাহাদুর’ খেতাব পান, তাহলে তাঁকে ‘মানুষ’, ‘মানব সন্তান’ বা ‘ভাই’ ইত্যাদি বলে ডাকা তথা তাঁর প্রাপ্ত উপাধির মাধ্যমে না ডাকা অপরাধ হিসেবে গণ্য। কারণ এ ধরনের আচরণ দ্বারা সরকার প্রদত্ত উপাধিসমূহের প্রতি তার অসন্তোষ প্রকাশ পাচ্ছে। তাহলে যে মহান সত্ত্বাকে আল্লাহ তা’আলা ‘নবী-রাসূল’ ইত্যাদি উপাধিকে ভুষিত করেছেন, তাকে ওসব উপাধি বাদ দিয়ে ‘ভাই’ ইত্যাদি বলে অভিহিত করা মারাত্মক অপরাধ।
স্বয়ং আল্লাহ তা’আলা মহা প্রতিপালক হয়েও যেখানে কুরআন করীমের মধ্যে হুজুর (ﷺ) কে ‘হে মুহাম্মদ’ হে ‘মুমিনদের ভাই’ বলে সম্বোধন করেন নি, বরং ‘হে নবী’ ‘হে রাসূল’ ‘হে কম্বলাবৃত বন্ধু’ ‘হে চাদর পরিহিত বন্ধু’ প্রভৃতি প্রিয়-উপাধিসমূহ দ্বারা সম্বোধন করেছেন, সে ক্ষেত্রে আমাদের মত গোলামদের তাঁকে ‘মানুষ’ বা ‘ভাই’ বলে আখ্যায়িত করার কি অধিকার আছে?
কুরআন মক্কার কাফিরদের চিরাচরিত প্রথার বর্ণনা দিচ্ছে-
قَالُوْا مَا اَنْتُمْ اِلاَّ بَشَرٌُ مِّثْلَنَا
-‘‘তাঁরা বলত, আপনারা আমাদেরই মত মানুষ বৈ অন্য কিছু নন।’’
{সূরাঃ ইয়াসীন, আয়াতঃ ১৫, পারাঃ ২২}
لَئِنْ اَطَعْتُمْ بَشْرً امِثْلَكُمْ اِنَّكُمْ اِذًا لَّخَسِرُوْنَ
-‘‘তোমরা যদি তোমাদের মত একজন মানুষের কথা মত চল, তাহলে তোমরা ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে গণ্য।’’ ইত্যাদি, ইত্যাদি।
{সূরাঃ মু’মিনুন, আয়াতঃ ৩৪, পারাঃ ১৮}
এ ধরনের আরও অনেক আয়াত আছে। এভাবে সমতা বিধান বা আম্বিয়ায়ে কিরামের মান-সম্মান খর্ব করা ইবলীসেরই রীতি। সে বলেছিল-
خَلَقْتَنِىْ مِنْ نَّارٍ وَّ خَلَقْتَهُ مِنْ طِيْنٍ
-‘‘হে খোদা! তুমি আমাকে সৃষ্টি করেছ আগুন থেকে, আর তাঁকে (হযরত আদম আলাহিস সালাম কে) সৃষ্টি করেছে মাটি থেকে।’’
{সূরাঃ আ’রাফ, আয়াতঃ ১২}
এ কথার তাৎপর্য হলো ‘আমি তার চেয়ে শ্রেষ্ঠ’। এরূপ আমাদের ও পয়গাম্বরদের মধ্যে কি পার্থক্য’ আমরা যেমন মানুষ তাঁরাও সেরূপ মানুষ’ বরং আমরা জীবিত, তাঁরা মৃত-এসব ইবলীসী কথা ও ধ্যান ধারণা।