নবীদের সম্পর্কে অধিকাংশের মত যে, চারজন নবী জীবিত আছেন। তাঁদের মধ্যে খিজির (আ) ও ইলিয়াস (আ) পৃথিবীতে এবং ঈসা (আ) ও ইদ্রীস (আ) আসমানে আছেন। মর্যাদার দিক দিয়ে নবী-রাসূলদের পর ফিরিশতাদের স্থান। মানুষের মাঝে নবীদের ও রাসূলদের পর খুলাফায়ে রাশেদূনের স্থান। কারো কারো মতে তাঁরা সকলেই মর্যাদায় সমান। আবার কারো কারো মতে তাঁদের মর্যাদা খিলাফতের ক্রমধারায় ।
জাহিলী আমলে তাঁর নাম ছিল আবদুল কা'বা । ইসলাম গ্রহণের পর রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাঁর নাম রাখেন আবদুল্লাহ্। তাঁর পিতার নাম আবু কুহাফা উসমান ইবন আমির ইবন কা'ব ইবন তায়ম ইবন মুররা। তিনি ষষ্ঠ পুরুষে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সঙ্গে মিলিত হন। তিনি একজন কুরায়শ ।
তিনি রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর জীবদ্দশায় সালাতে তাঁর প্রতিনিধিত্ব করেন। রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক, সত্যানুরাগ, ইসলাম গ্রহণে অনতিক্রম্য প্রাধান্য, রিসালাতের পদের সমাপ্তির পর খিলাফতের প্রথম দায়িত্ব পালন ইত্যাদি দিক দিয়ে আবূ বকর সিদ্দীক (র) এর মর্যাদা অনন্য ।
অষ্টম পুরুষে তিনি রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সঙ্গে মিলিত হন। তাঁর বংশ তালিকা—উমর ইবন খাত্তাব ইবন নুফাইল ইবন আবদুল উজ্জা ইবন রিবাহ ইবন আবদুল্লাহ ইবন কুরাত ইবন দার্রাহ ইবন আদী ইবন কা'ব আল কারাশী আল আদাভী। তিনি হক ও বাতিলের মধ্যে আপোষহীন পার্থক্যকারী ছিলেন বিধায় তাঁকে আল-ফারূক--পার্থক্যকারী উপাধীতে ভূষিত করা হয়। সূরা নিসা ৪, আয়াত ৬০-এ উমর (রা)-এর রায়ের অনুকূলে আল্লাহর ফয়সালা নাযিল হলে রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেনঃ হক তো উমরের জবানে জারি হয়। তাঁর খিলাফতের শপথ, ফযিলত, উসমানের জন্য খিলাফতের শপথ, শাহাদাত ইত্যাদি সহীহ বুখারীতে বিশদভাবে বর্ণিত আছে।
তিনি ছিলেন কুরাইশ বংশের উমাইয়্যা শাখার । তাঁর বংশ তালিক—উসমান ইবন আফ্ফান ইবন আল-আস ইবন উমাইয়্যা ইবন আবদ শামস ইবন আবদ মান্নাফ ইবন কুসাই। পঞ্চম পুরুষে রাসূলুল্লাহ্র সঙ্গে তিনি মিলিত হন। তাঁকে যুন্নুরাইন-দুটি নূরের মালিক খিতাবে ভূষিত করা হয়েছে। কারণ তিনি রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর দু' কন্যা-রুকাইয়া ও উম্মু কুলসুমকে শাদী করেছিলেন । উসমান (রা) ছাড়া আর কেউ কোন নবীর দু'কন্যাকে কখনো শাদী করেননি। এ ছিল তাঁর জন্য অনন্য বৈশিষ্ট্য। রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেছেন : আমার আরো কন্যা থাকলে উসমানের সঙ্গে শাদী দিতাম ।
রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর চাচা আবূ তালিবের পুত্র এবং তাঁর কন্যা ফাতিমা যোহরা (রা)-এর স্বামী, হাসান (রা) ও হুসাইন (রা)-এর পিতা। তাঁকে রাসূলুল্লাহ্ (সা) ‘জ্ঞানের নগরী' বলেছেন এবং মুসলিমদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ বিচারক আখ্যা দিয়েছেন।
এদের সম্পর্কে সূরা তওবা ৯, আয়াত ১০০-তে বর্ণিত হয়েছে : মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে যারা প্রথম অগ্রগামী আর যারা নিষ্ঠার সঙ্গে তাঁদের অনুসরণ করে আল্লাহ্ তাঁদের প্রতি প্রসন্ন এবং তাঁরাও তাতে সন্তুষ্ট এবং আল্লাহ্ তাঁদের জন্য প্রস্তুত করে রেখেছেন জান্নাত, প্রবাহিত হয় যার পাদদেশে নহরসমূহ, সেথায় তাঁরা স্থায়ী হবে। এ হলো মহা সাফল্য।
খুলাফায়ে রাশেদূন সম্পর্কে উম্মতের ইজমা যে, তাঁরা মুহাজিরদের মধ্যে সাবিকুন - প্রথম অগ্রগামী ছিলেন। তাঁরা উক্ত আয়াতের মর্মানুযায়ী নিঃসন্দেহে আল্লাহ্ সন্তোষভাজন। তাঁদের প্রতি আল্লাহর প্রসন্নতা বিরাজমান । তাঁরা রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সময় যেরূপ সত্যের ওপর কায়িম ছিলেন, মৃত্যু পর্যন্ত সে অবস্থায় ছিলেন। তাঁদের মধ্যে তাকওয়া ও ঈমানদারীর কোন পরিবর্তন হয়নি। যারা মনে করে যে, প্রথম তিনজন খলীফা রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর জমানার পর বদলে গেছেন, তাই তাঁদের মর্যাদা প্রশ্নাতীত নয়, তাদের এ ধারণা অলীক, বাতিল। আর যারা মনে করে যে, আলী (রা), মুআবিয়া (রা), আ (রা), মুআবিয়া (রা), আমর ইবন আল আস (রা) ও তাঁদের অগ্রগামীরা কাফির ও তাঁদের হত্যা করা ওয়াজিব, তাদের এ ধরনের ধারণা উদ্ভট ও ভ্রান্ত ৷
খুলাফায়ে রাশেদূন সম্পর্কে আল-কুরআনে অনেক আয়াত নাযিল হয়েছে। সূরা তওবা ৯, আয়াত ৪০-এ বর্ণিত হয়েছে : যদি তোমরা তাঁকে সাহায্য না কর তবে মনে রেখ, আল্লাহ্ তাঁকে সাহায্য করেছিলেন যখন কাফিররা তাঁকে বহিষ্কার করেছিল এবং তিনি ছিলেন দু'জনের একজন, যখন তাঁরা উভয় গুহার মধ্যে ছিল। তিনি তখন তাঁর সঙ্গীকে বলেছিলেন : বিষণ্ণ হয়ো না, আল্লাহ্ আমাদের সঙ্গে রয়েছেন। তারপর আল্লাহ্ তাঁর ওপর তাঁর প্রশান্তি বর্ষণ করেন এবং তাঁকে শক্তিশালী করেন এমন এক সেনাবাহিনী দিয়ে, যাদের তোমরা দেখনি ৷
এ আয়াতে উল্লেখিত গুহাসঙ্গী বলতে আবূবকর সিদ্দীক (রা)-কেই বোঝানো হয়েছে। সূরা লায়ল ৯২, আয়াত ৪-৭, ১৮-২১-এ হযরত আবূবকর সিদ্দীক (রা)-এর শানে ; সূরা আলে ইমরান ৩, আয়াত ১৫৯-এ হযরত আবূ বকর ও হযরত উমর (রা)-এর শানে ; সূরা আল-হিজর ১৫, আয়াত ৪৭-এ হযরত আবূ বকর, হযরত উমর ও হযরত আলী (রা)-এর শানে ; এ ধরনের অনেক আয়াত আল-কুরআনে খুলাফায়ে রাশেদূনের শানে নাযিল হয়েছে। হাদীসে তাঁদের সম্পর্কে অনেক ফযীলতের বর্ণনা রয়েছে। রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাঁর সাহাবীদের খারাপ নামে ডাকতে ও গালি দিতে নিষেধ করেছেন । তাই আমরা তাঁদের মর্যাদার সাথে স্মরণ করি। তাঁদের সম্পর্কে কোন প্রকার খারাপ ধারণা পোষণ করি না। রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সঙ্গীদের সবার সম্বন্ধে আমরা ভাল ধারণা রাখি। তাঁদের কারো থেকে মানুষ হিসাবে কোন ত্রুটি-বিচ্যুতি ঘটে যেতে পারে, এমন কোন কাজ সংঘটিত হতে পারে যা দৃশ্যত: ঠিক নয়, এমনটি ঘটলে তা ইজতিহাদের কারণে ঘটতে পারে অথবা পরে সংঘটিত ব্যাপারে তওবা করে তা থেকে ফিরে এসে থাকতে পারেন। তাঁরা কখনোই ফাসাদ সৃষ্টির জন্য, বৈরিতার জন্য কোন কাজ করেন নি। ইমাম আহমদ ইবন হাম্বল (র)-কে হযরত আলী ও হযরত আয়েশা (রা)-এর মধ্যকার ঘটনা সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে তিনি উত্তরে বলেছিলেন : তাঁরাতো অতীত লোক, তাদের জন্য তা যা তাঁরা অর্জন করেছে, আর তোমরা যা অর্জন কর তা তোমাদের। তারা যা করত সে সম্বন্ধে তোমাদের প্রশ্ন করা হবে না। (সূরা আল-বাকারাহ ২, আয়াত ১৩৪, ১৪১) ইমাম আবূ হানীফা (র) বলেনঃ হযরত আলী (রা) না হলে আমরা খারিজীদের চরিত্র সম্পর্কে অবহিত হতে পারতাম না।
সাহাবায়ে কিরাম সম্পর্কে মুসলিমদের আকীদা হলো, তাঁরা রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সঙ্গী ছিলেন, তাঁরা ইসলাম কায়িমে তাঁকে সাহায্য করেছেন, কষ্ট করেছেন, তাঁরা মানুষ হিসাবে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সঙ্গী হওয়ার দরুণ পরবর্তী সকল মানুষের চাইতে উত্তম, তাঁদের জন্য সকল মু'মিনের রয়েছে ভালবাসা ও গভীর শ্রদ্ধাবোধ। তাঁদের সম্পর্কে কোন অশোভন উক্তি মু'মিনরা বরদাশত করে না ।