ইমাম আবু হানিফা (রহঃ) এর প্রতি আরপিত গ্রন্থের সংখ্যা ২০ টি । এর অধিকাংশই পৃথিবীর বিভিন্ন মিউজিয়ামে ও গ্রন্থাগারে পাণ্ডুলিপি আকারে সংরক্ষিত । কয়েকটি মুদ্রিত হয়েছে । কয়েকটির একাধিক শরাহ রচিত হয়েছে । গ্রন্থ গুলোর বেশির ভাগই আকাইদ সংক্রান্ত । এগুলোর নাম ও অবস্থানঃ
১) আল–ফিকহুল আকবর
এই গ্রন্থটির কয়েকটি রেওয়াত আছে । তার মধ্যে ২ টি প্রসিদ্ধ ।
শেষোক্তটি আল ফিকাহুল আবসাত নামে পরিচিত । ফিকাহুল আকবরের অসংখ্য কপি পৃথিবীতে বড় বড় মিউজিয়ামে ও কুতুব খানায় পাণ্ডুলিপি আকারে আছে । তাছাড়া বিভিন্ন স্থান থেকে বহুবার ছাপা হয়েছে । এর আছে বহু তরজমা ও শরাহ ।
২) আল ফিক হুল আবসাত
আবুল মুতি আল হাকাম ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে সালামা ( ১৯৯/৮১৪) , ইমাম আবু হানিফা (রহঃ) এর শাগরেদ , তিনি ইমাম সাহেবের থেকে রেওয়াত করেছেন ।কায়রো , লাইডেন , ইস্তাম্বুলে পাণ্ডুলিপি সংরক্ষিত । কায়রো তে ১৩০৭ ও ১৩১৪ হি প্রকাশিত । এর কয়টি শরাহ রয়েছে।
৩) কিতাবুল আলিম ওয়াল মুতা আল্লিম
১) ইমাম সাহেবের শাগরেদ আবুল মুকাতিল হাফস ইবনে সাল ম আল সামার কান্দি (২০৮/৮২৩ ) রিওয়াত করেন। কায়রো , রামপুর , ইস্তাম্বুল , লাই ডে ন ইত্যাদি স্থানে সংরক্ষিত । ১৩৪৯ হি হায়দারাবাদে প্রকাশিত । ২) মুহাম্মাদ জাহেদ আল কাওসারি ১৩৬৮ হিজরি কায়রো তে প্রকাশ করেন । আবু বকর মুহাম্মদ ইবনে হাসান ইবনে আল ফুরাক ( ৪০৬ হিজরি /১০১৫) এর শরাহ লিখেন । ইস্তাম্বুলে সংরক্ষিত ।
৪) আল অয়াসিয়াত
এই নামের কয়েকটি রচনাই ইমাম সাহবের প্রতি আরপিত ।ইসলামের মৌলিক বিষয় সম্বলিত তার অন্তিম অয়াসিয়াত এতে রয়েছে। দুইটি রিওয়াতে এটি পাওয়া যায় । ইস কুরিয়াল , লাই ডে ন , লন্ডন , বার্লিন , কায়রো , ইস্তাম্বুল , রামপুর , বাঁকি পুর, কাবুল, হায়দারাবাদ ইত্যাদি স্থানে সংরক্ষিত । ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে কায়রো তে প্রকাশিত । ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে তুর্কী ভাষায় অনুদিত । এর চারটি শরাহ রয়েছে ।
৫) আর রিসালা
এ নামের কয়েকটি পুস্তক ইমাম সাহেবের প্রতি আরপিত ।
৬) অসিয়া ইলা ইবনিহি হাম্মাদ
ইমাম সাহেব স্বীয় পুত্র হাম্মাদ (রহঃ) কে অসিওত লিখেছেন । উসমান উবনে মুস্তফা ১০৫৭/১৬৪৯ তে জুব্দাতুন নাসায়েহ ‘ নামে এর শরাহ লেখেন । ন্রিতিশ মিউজিয়ামে , ইস্তাম্বুল বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরী , আল আযহার ও অন্যান্য প্রসিদ্ধ কুতুব খানায় এর পাণ্ডুলিপি বিদ্যমান ।
৭) অসিয়া ইলা তিল্মিজিহি ইউসুফ ইবনে খালিদ আল বাসরী
এই পুস্তকের শরাহ রচনা করেন আহমদ ইবনে মুহাম্মদ কিইয়াজারি ১২০০ হিজরি তে । বার্লিন মিউজিয়ামে তা সংরক্ষিত । ইস্তাম্বুল , দামিশক, মিউনিখ ও কায়রোতে সংরক্ষিত ।
৮) অসিয়া ইলা তিল মিজিহি আল কাজী আবি ইউসুফ ইবনে ইব্রাহিম ( ১৮২/৭৯৮)
পৃথিবীর বিভিন্ন মিউজিয়াম ও কুতুব খানায় এই পাণ্ডুলিপি টি মজুদ আছে । এতে ইমাম সাহেব আকাইদের অনেক গুঢ় তত্ত্ব সন্নিবেশিত করেছেন । ফিক হি ও নৈতিক নসিহত ছাড়াও এতে অনেক ব্যাক্তি গত বক্তব্য রয়েছে ।
৯) আল কাসিদা আল কাফিয়া ( আন নুমানিয়া ) ফি মা দ হীন নবী সাল্লল্লাহু আলাইহি অয়া সাল্লাম
১২৬৮ হিজরি ইস্তাম্বুলে প্রকাশিত । ইব্রাহিম ইবনে মুহাম্মদ ১২৭৬ হিজরি তুর্কী ভাষায় কবিতায় ও গদ্যে অনুবাদ করে ইস্তাম্বুলে প্রকাশ করেন । মুহাম্মদ আজম ইবেন মুহাম্মদ । ১৮৯৭ খ্রি ‘ রাহমাতুর রাহমান’ নামে এর উর্দু অনুবাদ দিল্লী থেকে প্রকাশ করেন । কায়রো , ইস্তাম্বুল ও হাই ডেল বারগে এর পাণ্ডুলিপি সংরক্ষিত ।
১০) মুজাদালা লি আহাদিদ দাহরিন
এই পাণ্ডুলিপিটি কায়রোর দারুল কুতুবে সংরক্ষিত । এখনও এর কোন মুদ্রন হয়েছে বলে জানা নেই ।
১১) কিতাব মারি ফাত আল মাযহাব
ভারতের রামপুরে এবং বত্রুম বারগের মিউজিয়ামে সংরক্ষিত ।
১২) আল যাওয়া বিত আস সালাসা
‘আল অসুল ইলাল কাঞ্জিল আকবর অয়া ইলা মাহুয়া আল আনফা মিন আল কিব্রিতিল আহ মার ‘ নামক এর একটি শরাহ ইস্তাম্বুলে র জারিয়াত কুতুব খানায় সংরক্ষিত । এর রচয়িতার নাম জানা নেই । এটি ফিকাহ এর ওপর রচিত।
১৩) দু আউ আবি হানিফা
ভারতের বাঁকি পুরে ২৬ / ৩১ নং ২৭৯১/ ৫ তে সংরক্ষিত ।
১৪) মুখা তাবাতু আবি হানিফা মা’আ জাফর ইবনে মুহাম্মদ ইবনে আহমদ রিজা ( মৃত্যু – ১৪৮/৭৬৫)
মিসরের আলেক জান্দ্রিয়ার মিউনিসিপাল কুতুব খানায় সংরক্ষিত ।
১৫) বা’জু ফাতাওয়াই আবি হানিফা
মুহাম্মদ ইবনে হাসান আশ শায়বানি রিওয়াতে ইমাম সাহেব রচিত এই পাণ্ডুলিপিটি প্যারিসের জাতীয় মিউজিয়ামে সংরক্ষিত ।
১৬) কিতাবুল মাখারিজ ফিল হিয়াল
১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে জসেফ শাখুত ইস্তাম্বুল ও কায়রো তে সংরক্ষিত পাণ্ডুলিপির ভিত্তিতে লিব তিজ থেকে প্রকাশ করেন । এটি ইমাম মুহাম্মদ শায়বানির রিওয়াতে বর্ণিত ।
১৭) কিতাব আল মাক সুদ ফিস সারফ
ব্রকেল ম্যান ও ফুয়াদ মিজগিন উল্লেখ করেন যে , এই পাণ্ডুলিপি টি ইস্তাম্বুলের বহু কুতুব খানায় সংরক্ষিত আছে। তারা আরো বলেন যে, ইমাম সাহেবের প্রতি এটি পরবর্তী সময় আরোপিত । পর আরোপিত।
১৮) মুসনাদু ইমাম আজম আবি হানিফা
১৫ টি ভাষ্য তথা রেওয়াতে এটি পৃথিবীর বিভিন্ন প্রসিদ্ধ মিউজিয়ামে ও কুতুব খানায় সংরক্ষিত । নিম্নে ভাষ্য সমূহ সংক্ষেপে দেওয়া গেলঃ
ইমাম আযম আবূ হানীফা (র) ফিক্হ শাস্ত্রের ক্ষেত্রে তাঁর অবদানের পাশাপাশি আকাইদের ক্ষেত্রে এসব গ্রন্থ রচনা করে মৌলিক ভিত প্রস্তুত করে যান । পরবর্তীকালে তাঁর অনুসারীরা এর ওপর ভিত্তি করে ইল্ম কালামের পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটান। ইমাম আবূ মানসূর আল মাতুরীদী (৩৩৩/৯৪৪) ইমাম সাহেবের পদাঙ্ক অনুরণ করে আকাইদের ক্ষেত্রে যে পদ্ধতির প্রবর্তন করেন, তা যদিও ‘মাযহাবে মাতুরিদীয়া' নামে খ্যাত, তবুও প্রকৃতপক্ষে তা ইমাম সাহেবেরই প্রদর্শিত মাযহাব । ইমাম মাতুরীদি নতুন কিছুই করেন নি। বরং তিনি ইমাম আবূ হানীফা (র)-এর মত ও পদ্ধতির ব্যাখ্যা দিয়েছেন এবং তা বিন্যস্ত করেছেন। ইমাম আবুল মানসূর আল-মাতুরীদি তাঁর বিখ্যাত ‘কিতাব আত তাওহীদ', 'কিতাব আতাল আল সুন্নাহ্' ‘কিতার মা’খায় আল শরিয়া ফি উসূল আলদীন’, ‘কিতাব আল উসূল', 'কিতাব আল মাকালাত' প্রভৃতি গ্রন্থে ইমাম আবূ হানীফা (র) কর্তৃক নির্দেশিত আকাইদের বিষয় সমূহের ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ প্রদান করে একটি অবকাঠামো নির্মাণ করেন, যা আকাইদের ক্ষেত্রে কালজয়ী মাযহাব হিসাবে স্বীকৃত । এখানে ইমাম আবূ হানীফা (র) ও ইমাম আবূ মানসুর আল-মাতুরীদী (র)-এর সম্পর্ক নির্দেশের নিমিত্ত নিম্নে তিনটি ছক দেওয়া গেলঃ
ইমাম আবু হানীফা (র) কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত পদ্ধতিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেন ইমাম আল-মাতুরীদী। পরে তাঁর যোগ্য শাগরিদ ও তাদের অনুগামীরা এ পথে প্রভূত উৎকর্ষ সাধন করেন । এখানে তার কিছু উল্লেখ করা গেল:
১. কাযী আবুল কাসিম হাকিম সমরকন্দী (মৃ. ৩৪০/৯৫১), তাঁর রচিত 'আল মাওয়াদ আল আ'যম' মাতুরীদীর শিক্ষার দর্পণ হিসাবে স্বীকৃত। বহুবার এটি প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া ‘আকীদাতুল ইমাম’, ‘শরহু ফিহিল আর' প্রভৃতি গ্রন্থও তিনি রেখে গেছেন।
২. ইমাম আবূল হাসান আলী ইবন সাইদ আল রুসতাগফিনী, কিতাব ইরশাদ আল মুহতাদী, কিতাব ফিল খিলাফা ও কিতাব যাওয়াইদ ওয়া আল ফাওয়াইদ ফি আনওয়াইল উলুম' রচনা করেন।
৩. ফখরুল ইসলাম আবূল হাসান আলী ইব্ন মুহাম্মদ ইব্ন আবদুল করীম বাযদাভী (মৃ. ৪৮২/১০৮৯), তিনি প্রসিদ্ধ উলুম আল-বাযদাভী' গ্রন্থের প্রণেতা।
৪. আবুল মু'ঈন মাইমূন ইব্ন মুহাম্মদ ইব্ন মুহাম্মদ আল-মুকহুলী আন্ নাসাফী (৫০৮/১১১৪), তাঁর রচিত গ্রন্থের মধ্যে প্রসিদ্ধ হলো : বাহরুল কালাম, তাবসিরাতুল আদিল্লা, আত্ তামহীদ লি কাওয়াদ আত্ তাওহীদ।
৫. নাজমুদ্দীন আবু হাফস উমার ইবন মুহাম্মদ ইবন আহমদ আন নাসাফী আস - সামারকান্দী-মুতীউস্ সাকালাইন (মৃ. ৫৩৭/১১৪২)। তাঁর রচিত গ্রন্থাবলীর মধ্যে রয়েছে : ‘উমদা ‘আকীদাতু আহল আল সুন্নাহ্ ওয়া আল জামাআ' । এর অনেক শরাহ লেখা হয়েছে, যার মধ্যে সায়াদুদ্দীন তাফতাযানীর শরাহ সর্বাধিক প্রসিদ্ধ। এ ছাড়া শতাধিক গ্রন্থের রচনা তাঁর প্রতি আরোপিত ।
৬. আলাউদ্দীন আবূ বকর মুহাম্মদ ইব্ন আহমদ আবী আহমদ সমরকন্দী (৫৪০/১১৪৫)। তিনি ইমাম মাতুরীদীর তা ভীলাতের শরাহ লিখেন, যার পাণ্ডুলিপি বিভিন্ন মিউজিয়াম ও কুতুবখানায় সংরক্ষিত। তিনি ‘তুহফাতুল ফুকাহা' শীর্ষক একটি ফিক্হী সংকলন তৈরী করে রেখে গেছেন।
৭. নছরুল হক নুরুদ্দীন আহমদ ইব্ন মাহমুদ সাবূনী (৫৮০/১১৮৫) বিদায়া, হিদায়া, উমদা-শীর্ষক কয়েকখানা মূল্যবান গ্রন্থ কালাম ও উসূল বিষয়ে রচনা করেছেন ।
৮. হাফিয উদ্দীন আবুল বারাকাত আবদুল্লাহ্ ইব্ন আহমদ ইব্ন মাহমূদ নাসাফী (৭১০/১৩১০) প্রসিদ্ধ আল-মাদারিক গ্রন্থের প্রণেতা। এ ছাড়া তিনি কানযুদ দাকাইক, আল-ওয়াফী, আল-উমদা, আল-মানার ইত্যাদি গ্রন্থও রচনা করেন ।
৯. আবুল হাসান আলী ইব্ন মুহাম্মদ ইব্ন আলী, যিনি ‘সাইয়েদ শরীফ জুরজানী' নামে খ্যাত, অনেক গ্রন্থ রচনা করেছেন। তাঁর সর্বাধিক প্রসিদ্ধ গ্রন্থ হলো 'শরহুল মাওয়াকিফ’। ‘আত্ তা’রীফাত' তাঁর একটি অনবদ্য অবদান ।
এসব মনীষীরা ও তাঁদের মতো অনেকে ইমাম আবূ হানীফার প্রদর্শিত পথে আকাইদ ও ফিকহের ক্ষেত্রে মুসলিম মিল্লাতের জন্য রেখে গেছেন সিরাতে মুস্তাকিমে চলার সুস্পষ্ট পথনির্দেশ। এরা সবাই ছিলেন তাঁদের সমকালীন সময় বিদ্যা ও জ্ঞানে অতুলনীয় । তবুও তাঁরা ইমাম আবূ হানীফা (র) কর্তৃক নির্দেশিত মূল ভিতের বিপরীতে কোন নতুন সংযোজন বা বিয়োজন করেন নি । তাঁরা শুধু যুগোপযুগী ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ দিয়েছেন ।
পূর্ববর্তী পেইজ | পরবর্তী পেইজ |
(০২) কর্ম | (০৪) ইমাম আবু হানিফা সম্পর্কে লিখিত গ্রন্থাবলী |
সূচীপত্র | এরকম আরো পেইজ |