উস্তাদ হাম্মাদ (র) জীবিত থাকাকালীন অবস্থায় ইমাম সাহেব ইজতিহাদের স্তরে উপনীত হলেও তিনি কার্যত: তা করেননি। ১২০ হিজরীতে তাঁর ইন্তিকালের পর বাগদাদে তিনি উস্তাদের স্থলাভিষিক্ত হন । তিনি শিক্ষাদানের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে উপলব্ধি করলেন যে, মুসলিম মিল্লাতের জন্য শরীয়তের বিধি-বিধানের একটি সংকলন থাকা আবশ্যক । তখন পর্যন্ত লিখিত আকারে প্রয়োজনীয় বিধিমালা প্রণীত হয়নি। তিনি স্থির করলেন যে, কুরআন ও হাদীস থেকে মুসলমানদের দৈনন্দিন জীবনের মাসআলা সমূহ বের করে একত্রিত করবেন, যাতে প্রয়োজনের সময় সহজে সমস্যার সমাধানের নির্দেশ লাভ করা যায় । এ কাজ খুব সহজসাধ্য ছিল না। তিনি এ কাজ সম্পন্ন করার দৃঢ় সঙ্কল্প করলেন । আল্লাহ্ তা'আলা তাঁকে মুসলিম মিল্লাতের এ দায়িত্ব পালনের যোগ্য করে প্রস্তুত করেছিলেন ।
রিসালাতের যামানা ও খুলাফায়ে রাশেদীনের যামানা থেকেই ফিক্হ ইসলামীর প্রচলন হয় । কুরআন ও হাদীস থেকে সাহাবায়ে কিরাম ফিকহের প্রশ্নের উত্তর দিতেন। সাহাবাদের মধ্যে এ ব্যাপারে প্রসিদ্ধ ছিলেন হযরত আলী (রা), হযরত উসমান (রা) হযরত আবদুল্লাহ্ ইব্ন আব্বাস (রা), হযরত আবদুল্লাহ্ ইবন মাসউদ মধ্যে হযরত আলী (রা) ছিলেন মাসআলা ইস্তিম্বাতের দিক দিয়ে অগ্রণী । হযরত উমর (রা) বলেনঃ “আল্লাহ্ যেন এমন না করেন যে, কোন কঠিন মাসআলা আমাদের সামনে আসবে আর আলী (রা) তখন আমাদের মধ্যে থাকবে না।” হযরত আবদুল্লাহ্ ইব্ন আব্বাস (রা) বলেনঃ “কোন মাসআলায় আমি যরত আলী (রা)-এর ফাতওয়া পেলে অন্য কিছুর প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না। ”
ইমাম আবূ হানীফা (র)-এর সময়কাল পর্যন্ত উল্লিখিত সাহাবায়ে কিরাম ও অন্যান্য ফিক্হবিদদের মাধ্যমে কুরআন ও হাদীস থেকে অনেক মাসআলা সংগ্রহ করা হয়েছিল। কিন্তু তা ছিল অবিন্যস্ত ও অলিখিত। ইমাম আবূ হানীফা (র) চাইলেন সালফে সালিহীনের পথ ধরে পূর্ণাঙ্গ ফিকহ বিন্যস্ত করতে ।এজন্য তিনি এজন্য তার শাগরিদদের মধ্য থেকে কয়েকজন বিজ্ঞ ও দক্ষ ব্যক্তির পরিষদ গঠন করলেন। যাদের তিনি এ দায়িত্বে নিয়োজিত করেছিলেন তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন কাযী আবূ ইউসুফ (র), দাউদ ত্বাই (র),মুহাম্মদ শায়বানী (র) ও যুফার (র)। এরা ১২১ হি. থেকে কাজ আরম্ভ করেন এবং ১৫০ হিজরীতে ইমাম সাহেবের মৃত্যু পর্যন্ত তা চালু রাখেন । এ সময়ের মধ্যে ফিক্বহী মাসআলার এক সুবৃহৎ সংকলন তৈরি হয়ে যায়, যাতে ত্বাহারাতের অধ্যায় থেকে মীরাছের অধ্যায় পর্যন্ত শামিল করা হয় । এতে ইবাদতের মাসআলা ছাড়াও দিওয়ানী, ফৌজদারী দণ্ডবিধি, লাগান, মালগুজারী, শাহাদাত, চুক্তি, উত্তরাধিকার, অসিয়ত ইত্যাদি নানাবিধ বিষয় সংক্রান্ত আইন-কানুন সন্নিবেশিত হয়। ঐতিহাসিক সূত্রে এ সংকলনে মাসআলার সংখ্যা ১২ হাজারের অধিক। হারুন রশীদের বিশাল সাম্রাজ্যের সর্বত্র বিচার-আচার এর অনুকরণে করা হতো। তাঁর পরবর্তীকালেও এ পদ্ধতিই প্রচলিত ছিল। হানাফী ফিক্হ, কুরআন-হাদীসের আলোকে মানুষের মনস্তাত্বিক ও ব্যবহারিক প্রয়োজনের নিরিখে প্রণীত বিধায় তা কালজয়ী হয়েছে। বর্তমানে বিশ্বের মুসলিম জনগোষ্ঠির অর্ধেকের বেশি ফিক্হ হানাফী অনুসরণ করেন। বিশেষ করে বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ভারত, আফগানিস্তান, চীন, মধ্য এশিয়া, তুরস্ক, ইরাক, সিরিয়ায় ফিক্হ হানাফী জনপ্রিয়। ইমাম আ'যম আবু হানীফা (র)-এর কর্ম জীবনের উল্লেখযোগ্য অবদানের মধ্যে ফিক্হ শাস্ত্রের সংকলন ও বিন্যাস অন্যতম শ্রেষ্ঠ অবদান। মুসলিম মিল্লাত চিরদিন তাঁর এ অবদানের কথা কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করবে।
ইমাম আবূ হানীফা (র)-এর উস্তাদের মধ্যে ৭ জন ছিলেন রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সাহাবা এবং ৯৩ জন ছিলেন তাবেঈন। চরিতকারদের মতে তাঁর উস্তাদের সংখ্যা চার হাজারেরও অধিক। তিনি সে সময়কার যাবতীয় জ্ঞান আহরণ করেছিলেন । এমন কোন ক্ষেত্র ছিল না, যেখানে তিনি স্বচ্ছন্দে পদচারণা করতে পারতেন না। প্রকৌশলী ও প্রযুক্তিবিদদের মধ্যে তাঁর স্থান ছিল সর্বোচ্চে। বাগদাদকে মুসলিম সাম্রাজ্যের রাজধানীর উপযোগী করে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তাঁর অবদান চিরদিন ভাস্বর হয়ে থাকবে। জ্ঞান আহরণ ও বিতরণের ক্ষেত্রে তিনি যে নযীর স্থাপন করে গেছেন, তা রীতিমত বিস্ময়কর । ব্যবহারিক জীবনের জন্য ফিক্হী মাস্আলার সংগ্রহ সংকলন করে একদিকে যেমন তিনি মুসলিম মিল্লাতের একটি অভাব পূরণ করেন, ঠিক তেমনি ইলমে কালামের ভিত রচনা করে আর একটি প্রয়োজন মিটান। ফিকহের ক্ষেত্রে তাঁর পদ্ধতি হানাফী মাযহাব এবং কালামের ক্ষেত্রে মাতুরীদিয়া মাযহাব হিসাবে খ্যাত। ইমাম শাফিঈ (র) বলেন, সকল মানুষ তিন জনের অনুগামী। তাফসীরে মুকাতিল ইবনে সুলাইমানের; কবিতায় যুহাইর ইব্ন আবূ সুলমার এবং কালামের ক্ষেত্রে আবূ হানীফা (র)-এর। (ইবন খাল্লিকানঃ অফাইয়াত ৪/৩৪১)। ইবন কাছীর 'আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া' গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, ইমাম শাফিঈ বলেছেনঃ
“যে কেউ ফিক্হ জানতে ইচ্ছা করে, সে আবূ হানীফা (র)-এর মুখাপেক্ষী।”
পূর্ববর্তী পেইজ | পরবর্তী পেইজ |
(০১) জীবন | (০৩) গ্রন্থাবলী |
সূচীপত্র | এরকম আরো পেইজ |