কতেকগুলো যুক্তিসঙ্গত তথ্যাবলী থেকেও পূর্বাপর যাবতীয়مَاكَانَ وَمَايَكَوْنُ বিষয়ের জ্ঞানের যৌক্তিকতা প্রমাণিত হয়। সে সমস্ত দলীলপ্রমাণ নিম্নে দেয়া গেল।
হুযুর সায়্যিদুল আলম (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) হলেন খোদার রাজত্বের উযীরে আ’যম তথা ‘খলীফায়ে আযম’। হযরত আদম (আলাইহিস সালাম) কে আল্লাহর ‘খলীফা’ মনোনীত করা হয়েছিল। তাহলে নিঃসন্দেহে হুযুর আলাইহিস সালাম সেই রাজত্বের ‘খলীফায়ে আযম’ এবং পৃথিবীতে বিশ্বনিয়ন্তার প্রতিনিধি। রাজ্যে নিযুক্ত শাসকের দু’টো গুণ থাকা আবশ্যক- এক, জ্ঞান, দুই, ইখতিয়ার বা কাজ করার স্বাধীনতা। এ পার্থিব রাজত্বের শাসকগণ যতবড় পদমর্যাদার অধিকারী হন, সে অনুপাতে তাদের জ্ঞান কর্মক্ষমতাও বেশী থাকে। কালেকটর বা জিলা প্রশাসকের সম্পূর্ণ জিলা সম্পর্কে জ্ঞান ও সমগ্র জিলার নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা থাকা প্রয়োজন। ভাই সরয় বা গভর্নরের সমগ্র দেশের জ্ঞান ও অধিকার প্রয়োগের ক্ষমতা থাকা জরুরী। কেননা এ দু’টি গুণ ব্যতীত তিনি শাসন করতে পারেন না, রাজকীয় ফরমানও প্রজাদের মধ্যে জারী করতে পারবেন না। অনুরূপ, নবীগণের মধ্যে যার যতবড় পদমর্যাদা রয়েছে, তাঁর সে অনুপাতে জ্ঞান ও ক্ষমতা রয়েছে। মহাপ্রভু আল্লাহ আদম (আলাইহিস সালাম) এর খেলাফত প্রমাণ করেছেন, তাঁর জ্ঞানেরই ফলশ্রুতি রূপে। অর্থাৎ আদম (আলাইহিস সালাম) কে এত ব্যাপক জ্ঞান দান করেছেন, যা’ আল্লাহর প্রতিনিধিত্বের সহিত সঙ্গতিপূর্ণ। আর ফিরিশতাগণের দ্বারা সিজদা করানো, তাঁর বিশেষ ক্ষমতার প্রমাণবহ। ফিরিশতাগণও তাঁর কাছে মাথা নত করেছেন। অতএব, নবী করীম আলাইহিস সালাম যেহেতু সমগ্র সৃষ্টি জগতের নবী এবং আসমান যমীনের সমস্ত লোক তাঁর উম্মত, সেহেতু তাঁকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) অন্যান্য সমস্ত নবীগণের তুলনায় বেশী জ্ঞান ও ক্ষমতা দেয়ার প্রয়োজন ছিল। এজন্যই তাঁর থেকে অনেক মুজিযা’ প্রকাশ পেয়েছে। যেমন তিনি আঙ্গুলের ইঙ্গিতেই চন্দ্রকে দ্বিখন্ডিত করেছেন। ডুবন্ত সূর্যকে ফিরিয়ে এনেছেন, মেঘকে নির্দেশ দেওয়ার সাথে সাতে পানি বর্ষণ করেছে, আবার সেই মেঘ খন্ডকে হুকুম করার সাথে সাথে বর্ষণ বন্ধ হয়ে গেছে। এগুলো হলো তাঁর খোদা প্রদত্ত ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ।
মৌলভী কাসেম নানুতবী সাহেব ‘তাহযীরুন নাস’ কিতাবে লিখেছেন ‘নবীগণ জ্ঞানের দিক দিয়ে উম্মত থেকে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হয়ে থাকেন, আর বাহ্যিকভাবে আমলের দিক দিয়ে অনেক সময় উম্মত নবীকেও অতিক্রম করে যায়” এতে বোঝা গেল যে আমলের ক্ষেত্রে উম্মত নবীকে অতিক্রম করতে পারে, কিন্তু জ্ঞানের দিক থেকে নবীর জ্ঞান অপেক্ষাকৃত বেশী হওয়া প্রয়োজন। হুযুর আলাইহিস সালামের উম্মতের মধ্যে ফিরিশতাও অন্তভুর্ক্ত। কুরআনেই বলা হয়েছে
لِيكَوْنَ لِلْعُلَمِيْنَ نَذِيْرًا
যাতে নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) সমস্ত জগৎবাসীদের জন্য ভীতি প্রদর্শনকারী হন।
{সূরাঃ ফুরকান, আয়াতঃ ১, পারাঃ ১৮}
তাহলে নিঃসন্দেহে হুযুর আলাইহিস সালামের জ্ঞান ফিরিশতাগণের তুলনায় বেশী হওয়া প্রয়োজন। অন্যথায়, কোন গুণের দিক দিয়ে হুযুর আলাইহিস সালাম উম্মত থেকে শ্রেষ্ঠ হবেন? লওহে মাহফুজের দায়িত্বে নিযুক্ত ফিরিশতাগণেরতো যা কিছু হয়েছে ও হবে مَاكَانَ وَمَايَكَوْنُ সে সব কিছুর জ্ঞান রয়েছে। সুতরাং হুযুর আলাইহিস সালামের আরও অধিক জ্ঞানের অধিকারী হওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য।
কয়েক বছর উপযুক্ত শিক্ষকের সান্নিধ্যে থাকলে মানুষ জ্ঞানী হয়ে যায় হুযুর আলাইহিস সালাম জন্মগ্রহণের আগে কোটি কোটি বছর আল্লাহর মহা দরবারে অবস্থা করেছেন। এমতাবস্থায় হুযুর পূর্ণ আলেম হবেন না কেন?
‘তাফসীরে রুহুল বয়ানে’ لَقَدْ جَاءَكُمْ الخ এর তাফসীরে বলা হয়েছে যে, একদা হযরত জিব্রাইল (আলাইহিস সালাম) হুযুরের সমীপে আরয করলেন, ‘একটি নক্ষত্র সত্তর হাজার বছর পর পর উদিত হয়। আমি এটিকে বাহাত্তর হাজার বার আলোকে উদ্ভাসিত দেখেছি।’ তখন হুযুর আলাইহিস সালাম ইরশাদ ফরমানঃ ‘আমিই ছিলাম সেই নক্ষত্র’।
{এই হাদিসটিকে বাতিলপন্থীগণ জাল বলে উড়িয়ে দিতে চান তার জবাব আমি অধম 'সহিহ হাদিসকে জাল বানানোর স্বরুপ উন্মোচন' গ্রন্থে জবাব দিয়েছি} হিসেব করে দেখুন কত কোটি বছর মহান আল্লাহর দরবারে অবস্থান করেছিলেন রাসূল(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)।
ছাত্র বা শিষ্যের জ্ঞানের মধ্যে অপূর্ণতা থাকলে তা কেবল চারটি কারণেই হতে পারে। এক, শাগরিদ অনুপযুক্ত ছিল; উস্তাদ থেকে পূর্ণ ফয়েয লাভ করতে পারেন নি। দুই, উস্তাদ কামিল ছিলেন না, যার ফরে পরিপূর্ণ শিক্ষা দিতে পারেন নি। তিন, উস্তাদ হয়ত কৃপণ ছিলেন, পরিপূর্ণ জ্ঞান সেই শাগরিদকে দান করেন নি, কিংবা তার থেকে বেশী প্রিয় অন্য শাগরিদ ছিল, যাকেই সব কিছু শিখায়েছেন। চার, যে কিতাবটি পড়ানো হয়েছিল, সেটি পূর্ণাঙ্গ ছিল না। এ চারটি কারণ ছাড়া অন্য কোন কারণ থাকতেই পারে না। এখানে শিক্ষক হলেন স্বয়ং আল্লাহ, আর ছাত্র হলেন মাহবুব আলাইহিস সালাম, এবং যা শিক্ষা দিয়েছেন, তা হলো কুরআন ও স্বীয় বিশেষ জ্ঞান সমূহ। এখন বলুন, মহাপ্রভু আল্লাহ কি কামিল শিক্ষক নন? বা রাসূল আলাইহিস সালাম কি উপযুক্ত শাগরিদ নন? বা রাসূল আলাইহিস সালামের চেয়েও বেশী প্রিয় আর কেউ আছেন, অথবা কুরআন কি পূর্ণ কিতাব নয়? যখন এগুলোর মধ্যে কোন কারণই বিদ্যমান নেই অর্থাৎ আল্লাহ তা’আলা পরিপূর্ণ জ্ঞান প্রদানকারী, মাহবুব আলাইহিস সালামও পরিপূর্ণ গ্রহণকারী এবং কুরআন হলো একটি পরিপূর্ণ কিতাব, যেখানে উক্ত হয়েছে- اَلرَّحْمَنُ عَلَّمَ الْقُرْاَنَ (দয়াময় আল্লাহ কুরআন শিখিয়েছেন), আর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) হলেন আল্লাহর দরবারে বেশী ‘মকুবল’ বান্দা, তখন তাঁর জ্ঞান কেন অপূর্ণ হবে?
আল্লাহ তা’আলা প্রত্যেক কথা কেন লওহে মাহফুজে লিখলেন? লিখার প্রয়োজন হয় স্মরণ রাখার জন্য, যাতে ভুলবার উপক্রম না হয় বা অন্যদেরকে জানানোর জন্য। আল্লাহ তা’আলা ভুলত্রুটি থেকে পূতঃ পবিত্র। কাজেই তিনি অন্যদের জন্য লিখেছেন। অন্যদের মধ্যে হুযুর আলাইহিস সালামই হলেন সর্বাধিক প্রিয়। সতুরাং, সেই লেখাটা হুযুর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর উদ্দেশ্যেই সম্পন্ন হয়েছে।
অদৃশ্য বিষয় সমূহের মধ্যে সর্বাধিক অদৃশ্য হলো আল্লাহর সত্ত্বা। হযরত মুসা (আঃ) যখন আল্লাহকে স্ব’চক্ষে দেখার কামনা করেছিলেন, তখন বলা হয়েছিল- لَنْ تَرَانِىْ (তুমি আমাকে দেখতে পাবে না।) আর যখন মাহবুব আলাইহিস সালাম মিরাজের সময় স্বীয় পবিত্র চর্মচক্ষু দ্বারা আল্লাহকে দেখলেন, তখন সৃষ্টি জগত কি তাঁর দৃষ্টির আড়ালে গোপন থেকে যেতে পারে?
اور كوئى غيب كياتم سے نهاں هوبهلا
جب نه خداهى چهپاتم په كردڑون درود
অর্থাৎ খোদাই যখন আপনার দৃষ্টি থেকে গোপন রইল না, তখন আর কিইবা আছে, যা’ অদৃশ্য থাকতে পারে? আপনার হাবীব (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) প্রতি কোটি কোটি দরূদ।
{রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আল্লাহর দর্শন লাভের বর্ণনা আমার রচিত ‘শানে হাবীবুর রহমানে’ দেখুন।}
‘মিরকাত শরহে মিশকাতের’ الايمان بالقدر অধ্যায়ের প্রথম পরিচ্ছেদের শেষে উল্লেখিত আছে
كَمَا أَنَّ النَّبِيَّ - عَلَيْهِ الصَّلَاةُ وَالسَّلَامُ - رَآهُ فِي الدُّنْيَا لِانْقِلَابِهِ نُورًا
-‘‘হুযুর আলাইহিস সালাম ইহ জগতেই আল্লাহকে দেখেছিলেন, কেননা, রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) নিজেই নূরে পরিণত হয়েছিলেন।’’
{মোল্লা আলী ক্কারীঃ মেরকাতঃ ঈমান বিল ক্বদরঃ ১/২৬৬ পৃ. হাদিসঃ ৯১}
শয়তান হলো দুনিয়াবাসীদের পথভ্রষ্টকারী আর নবী আলাইহিস সালাম হলেন সৎপথের দিশারী। শয়তান হলো মহামারীর মত আর নবী আলাইহিস সালাম হলেন সর্বরোগের সর্ববিশেষজ্ঞা ডাক্তার স্বরূপ। আল্লাহ তা’আলা শয়তানকে পথভ্রষ্ট করার সহায়ক এত ব্যাপক ও সুদূর প্রসারী জ্ঞান দান করেছেন যে, পৃথিবীর কেউ তার দৃষ্টির অগোচরে থাকে না। তার কাছে এ খবরও আছে যে কাকে পথভ্রষ্ট করা যাবে, আর কাকে করা যাবে না; এবং যে পথভ্রষ্ট হওয়ার আছে, তাকে কিভাবে পথভ্রষ্ট করতে হবে? অনুরূপভাবে সে প্রত্যেক ধর্মের প্রতিটি মাসআলা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল, যার ফলে সে প্রতিটি সৎকাজ থেকে মানুষকে বিরত রাখে ও প্রতিটি নীতি বিগর্হিত কাজ করানোর মদদ যোগায়। সে আল্লাহর কাছে দম্ভোক্তি করে বলেছিল-
وَلَأُغْوِيَنَّهُمْ أَجْمَعِينَ - إِلَّا عِبَادَكَ مِنْهُمُ الْمُخْلَصِينَ
-‘‘আমি তোমার বিশুদ্ধ চিত্ত বিশিষ্ট নেককার বান্দাগণ ছাড়া বাকী সবাইকে পথভ্রষ্ট করেই ছাড়বো।’’
{সূরাঃ হিজরঃ আয়াতঃ ৩৯-৪০, পারাঃ ১৪}
পথভ্রষ্টকারীকে যখন এতটুকু জ্ঞান দান করা হলো, তখন সর্ববিশেষজ্ঞ ডাক্তার সদৃশ হুযুর আলাইহিস সালামের সঠিক পথের দিশা প্রদানের জন্য এর চেয়ে অনেক বেশী জ্ঞান থাকা একান্ত প্রয়োজন, যাতে তিনি প্রত্যেক ব্যক্তির রোগ নির্নয় ও আরোগ্য লাভের যোগ্যতার পরিমাপ করে চিকিৎসা করতে পারেন। অন্যথায়, সঠিক পথ নির্ধারণের কাজ পরিপূর্ণ হবে না। এবং মহাপ্রভু আল্লাহর সম্পর্কে এ আপত্তি উত্থাপন করা হবে যে, তিনি পথভ্রষ্টকারীকে শক্তিশালী করেছেন আর পথপ্রদর্শনকারীকে দূর্বল রেখেছেন। সেজন্য পথভ্রষ্টতা পরিপূর্ণতা লাভ করল, আর হেদায়েত অপরিপূর্ণ রয়ে গেল।
মহান প্রভু হুযুর আলাইহিস সালামকে ‘নবী’ বলে সম্বোধন করেছেন। যেমন يَا اَيُّهَاا لنَّبِىُّ ‘নবী’ শব্দের অর্থ হলো খবরদাতা। যদি খবর বলতে শুধু দ্বীনের খবরই লক্ষ্যার্থ হয়, তাহলে বলতে হয় প্রত্যেক মৌলভীই নবী; আর যদি পার্থিব ঘটনাবলীর খবর ধরে নেওয়া হয়, তাহলে প্রত্যেকটি সংবাদপত্র, রেডিও টি,ভি ও তারবার্তা প্রেরণকারী সবাই ‘নবী’রূপে পরিগণিত হবে। সুতরাং, বোঝা গেল যে, ‘নবী’ শব্দের মধ্যে অদৃশ্য বিষয়াদির খবরাখবরই গুরুত্বপূর্ণ। অর্থাৎ নবী হলেন ফিরিশতাগণ ও আরশ সম্পর্কে খবরদাতা, যেখানে তারবার্তা ও সংবাদপত্র সমূহ কোন কাজেই আসবে না। সেখানে একমাত্র নবীর জ্ঞানই কার্যকরী ভূমিকা পালন করতে পারে। এতে বোঝা গেল যে, ‘ইলমে গায়ব’ নবী শব্দের অন্তভুর্ক্ত বা অঙ্গীভূত।
পূর্ববর্তী পেইজ | পরবর্তী পেইজ |
(২২) বিরুদ্ধমতাবলম্বীগণের ভাষ্য থেকে ‘ইলমে গায়ব’ এর সমর্থন প্রসঙ্গ | (২৪) আওলিয়া কিরামের ইলমে গায়েবের বর্ণনা |
সূচীপত্র | এরকম আরো পেইজ |