এ পর্যন্ত হুযুর আলাইহিস সালামের ইলমে গায়ব সম্পর্কে আলোচনা করা হল। এখন এও জানা দরকার যে, হুযুর আলাইহিস সালামের মাধ্যমে আওলিয়া কিরামও ইলমে গায়ব লাভ করে থাকেন। তবে তাঁদের জ্ঞান নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর মাধ্যমেই অর্জিত হয় ও উহা নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর জ্ঞান সমুদ্রের এক ফোঁটার সমতুল্য।
মিশকাত শরীফের ব্যাখ্যামূলক গ্রন্থ ‘মিরকাতে’ শাইখুল কবীর আবু আবদুল্লাহ সিরাজী (রহ.) কর্তৃক সংকলিত ‘মু‘তাক্বদীহ’ এর উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে-
أَنَّ الْعَبْدَ يُنْقَلُ فِي الْأَحْوَالِ حَتَّى يَصِيرَ إِلَى نَعْتِ الرُّوحَانِيَّةِ فَيَعْلَمَ الْغَيْبَ
-‘‘নিশ্চয় বান্দার, আধ্যাত্মিক অবস্থার পরিবর্তন হতে থাকে, শেষ পর্যন্ত যখন ‘রূহানীয়তের’ গুণ প্রাপ্ত হয়, তখনই গায়ব সম্পর্কে অবগত হয়।’’
মোল্লা আলী ক্কারীঃ মেরকাতঃ কিতাবুল ঈমানঃ প্রথম পরিচ্ছেদঃ ১/২২৮ হাদিসঃ ২
‘মেরকাতের আর এক জায়গায় উক্ত “কিতাবে আকায়িদ’ গ্রন্থের বরাত দিয়ে বর্ণনা করা হয়েছে-
وَيَطَّلِعَ الْعَبْدُ عَلَى حَقَائِقِ الْأَشْيَاءِ، وَيَتَجَلَّى لَهُ الْغَيْبُ، وَغَيْبُ الْغَيْبِ
-‘‘কামিল বান্দা যাবতীয় বস্তুর নিগূঢ় তত্ত্ব ও রহস্য সম্পর্কে অবহিত হন এবং তাঁর কাছে অদৃশ্যের বিষয়ও প্রকাশিত হয়ে যায়।’’
{মোল্লা আলী ক্কারীঃ মেরকাতঃ কিতাবুল ঈমানঃ প্রথম পরিচ্ছেদঃ ১/১১৯ হাদিসঃ ২}
মিরকাতের দ্বিতীয় খন্ডের ৬ষ্ঠ পৃষ্ঠায়- اَلصَّلَوةُ عَلَى النَّبِىِّ وَفَضْلِهَا. শীর্ষক অধ্যায়ে লিপিবদ্ধ আছে-
قَالَ الطِّيبِيُّ: وَذَلِكَ أَنَّ النُّفُوسَ الزَّكِيَّةَ الْقُدُسِيَّةَ إِذَا تَجَرَّدَتْ عَنِ الْعَلَائِقِ الْبَدَنِيَّةِ عَرَجَتْ وَوَصَلَتْ بِالْمَلَأِ الْأَعْلَى، وَلَمْ يَبْقَ لَهَا حِجَابٌ، فَتَرَى الْكُلَّ كَالْمُشَاهَدِ بِنَفْسِهَا، أَوْ بِإِخْبَارِ الْمَلِكِ لَهَا
-‘‘ইমাম তিববী (রহ.) বলেন-পূত পবিত্র আত্মা সমূহ যখন সীমাবদ্ধ শারীরিক গন্ডির বাহিরে আসে তখন আধ্যাত্মিক উন্নতি সাধন করে সুউচ্চ স্তরে উপনীত হয় এবং তাঁদের সামনে কোনরূপ আবরণ অবশিষ্ট থাকে না। তখন সমস্ত বস্তুকে নিজের সামনে উপস্থিত ও স্থূল বস্তু সদৃশ দেখতে পায়। এ ধরনের অনুভূতি আপনা আপনিই কিংবা ফিরিশতার ‘ইলহাম’ দ্বারা অর্জিত হয়।’’
মোল্লা আলী ক্কারীঃ মেরকাতঃ ১/২২৮ পৃঃ দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
‘শাহ আবদুল আযীয মুহাদ্দিস দেহলভী সাহেব (রহমতুল্লাহে আলাইহে) তাফসীরে আযীযী’তে সূরা জ্বিনের তাফসীরে ফরমান-
اطلاع بر لوح محفوظ وديدن نقوش نيزاز بعضے ولياء بتواتر منقول است
অর্থাৎ- লওহে মাহফুজ সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন এবং উহার লিপিদর্শন করা সম্পর্কে কোন কোন ওলী থেকেও ‘মুতওয়াতির’ পর্যায়ের বর্ণনা পাওয়া যায়।
শায়খ আব্দুল আজীজ মুহাদ্দিস দেহলভীঃ তাফসীরে আযীযী (ফার্সি)- সূরা জিনঃ ২১৬-২১৭ পৃ. পারাঃ ২৯
ইমাম ইবনে হাজর মক্কী (রহমতুল্লাহে আলাইহে) তাঁর রচিত ‘কিতাবুল এ’লামে এবং আল্লামা শামী (রহমতুল্লাহে আলাইহে) তাঁর রচিত ‘সুলুক হুস্সামে উল্লেখ করেছেন-
اَلْخَوَاصُّ يَجُوْزُ اَن يَّعْلَمُ الْغَيْبَ فِىْ قَضْيَةٍ اَوْقَضَاءٍ كَمَا وَقَعَ لِكثِيْرٍ مِّنْهُمْ وَاشْتَهَرَ
অর্থাৎ- এটা বৈধ যে বিশিষ্ট ব্যক্তিগণ (আওলিয়া কিরাম) কোন ঘটনা বা সিদ্ধান্তের ব্যাপারে গায়বী ইলম অর্জন করেন, যেমন অনেক আওলিয়া কিরাম থেকে ধরনের ঘটনা প্রকাশ পেয়েছে এবং তা’ সাধারন্যে প্রচারিত ও প্রকাশিত হয়েছে।
শাহ ওলীউল্লাহ সাহেব (রহমতুল্লাহে আলাইহে) ‘আলতাফুল কুদস’ নামক কিতাবে লিখেছেন
نفس كليه بجائے جسد عارف مى شود وذات عارف بجائے روح اوهمه عالم بعلم حضورى مى بيند
অর্থাৎ- ‘আরিফের’ আত্মা একেবারে তাঁর দৈহিক আকৃতির রূপ পরিগ্রহ করে থাকে এবং তাঁর সত্ত্বা ‘রূহের’ সঙ্গে একাকার হয়ে যায়। তখন তিনি ‘হুযুরী’ জ্ঞানের সাহায্যে সমগ্র জগত দেখতে পান।
আল্লামা যুরকানী (রহমতুল্লাহে আলাইহে) তাঁর রচিত ‘শরহে মওয়াহেব গ্রন্থের সপ্তম খন্ডের ২২৮ পৃষ্ঠায় লিখেছেন
قاَلَ فِىْ لَطَائِفِ الْمِنَنْ اِطِّلاَعُ الْعَبْدِ عَلَى غَيْبِ مِنْ غَيَوْبِ اللهِ بِدَلِيْلِ خَبَرِ اتَّقُوْا مِنْ فَرَاسَةَ الْمُؤْمِنِ فَاِنَّهُ يَنْظُرُ بِنُوْرِ اَللهُ لاَ يَسْتَغْرَبَ وَهُوَ مَعْنَى كُنْتَ بَصَرَهُ الَّذِىْ يُبْصِرُ بِهِ فَمِنَ الْحَقِّ بَصِرُهُ فَاِطِّلاَعُهُ عَلَى الْغَيْبِ لاَيُسْتَغْرَبَ
অর্থাৎ- ‘লাতায়েদুল মেনান’ কিতাবে উল্লেখিত আছে যে, কোন কামিল বান্দা কর্তৃক আল্লাহ তা’আলার অদৃশ্য বিষয় সমূহ থেকে কোন অদৃশ্য বিষয়ের জ্ঞান লাভ আশ্চর্যের বিষয় নয়।
আল্লামা জুরকানীঃ শরহুল মাওয়াহেবঃ ৭/২২৮ পৃ.
এটা সেই হাদীছেই ব্যক্ত হয়েছে, যেখানে বলা হয়েছে, “মুমিনের জ্ঞানকে ভয় কর, কেননা, তিনি আল্লাহর নুরে দেখেন।” এটাই অপর এক হাদীছেরও অর্থ জ্ঞাপন করে, যেখানে বলা হয়েছে আল্লাহ তা’আলা বলেন, “আমি তাঁর চোখ হয়ে যাই যদ্বারা তিনি দেখেন। সুতরাং তাঁর দেখা আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রাপ্ত অসাধারণ শক্তির বলেই সম্পন্ন হয়ে থাকে। তাই তাঁর গায়ব সম্পর্কে অবগত হওয়াটা বিস্ময়কর কোন ব্যাপার নয়।
আল্লামা ইমাম শারানী (রহমতুল্লাহে আলাইহে) তাঁর রচিত اليواقيت والجو اهر নামক কিতাবে উল্লেখ করেছেন
لِلْمُجْتَهِدِيْنَ الْقَدْمُ فِىء عُلُوْمِ الْغَيْبِ
-‘‘গায়বী ইলম সমূহের ক্ষেত্রে মুজতাহিদগণেরও দৃপ্ত পদচারণা রয়েছে।’’
ইমাম আব্দুল ওয়াহাব শা’রানীঃ আল-ইয়াকুত ওয়াল জাওয়াহির ফি বয়ানে আকায়েদে আকাবিরঃ ২/৪৮০ পৃ.
হুযুর গাউছে পাক (রহমতুল্লাহে আলাইহে) ফরমান
نَظَرْتُ اِلَى بِلاَدِ اللهِ جَمْعًا – كَخَرْدَلَةٍ عَلَى حُكْمِ اتِّصَالِىْ
অর্থাৎ- আমি আল্লাহ তা’আলার সমস্ত শহরগুলোকে এভাবে দেখেছি, যেমন কয়েকটি তৈলবীজ পরস্পর সন্নিবেশিত হয়ে আছে।
শাইখ আবদুল হক মুহাদ্দিছ দেহলবী (রহমতুল্লাহে আলাইহে) তাঁর রচিত ‘যুবদাতুল আসরার’ গ্রন্থে হযরত গাউছে পাকের (রহমতুল্লাহে আলাইহে) একটি গুরুত্বপূর্ণ ও প্রণিধানযোগ্য উক্তির বর্ণনা দিয়েছেন-
قاَلَ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ يَااَبْطَالُ يَااَطْ قَالَ هَلَمُّو وَخُذُوْا عَنْ هَذَا الْبَحْرِ الَّذِىء لَاسَاحِلَ لَهُ وَعِزَّةِ رَبِّىْ اِنَّ السُّعَدَاءُ وَالْاَشْقِيَاءَ يُعْرَضُوْنَ عَلَىَّ وَاَنَّ بُوْبُوْ ءَةَ عَيْنِىْ فِى اللَّوْحِ الْمَحْقُىْظِ وَاَنَا غَائِصٌُ فِىْ بِحَارِ عِلْمِ اللهِ
অর্থাৎ- গাউছে পাক (রহমতুল্লাহে আলাইহে) ফরমান- হে সাহসী ভক্তগণ! হে আমার সন্তানগণ! এসো আমার এ অকুল সমুদ্র থেকে কিছু আহরণ কর। খোদার কসম, নেক্কার ও বদ্কার লোকদেরকে আমার সামনে উপস্থিত করা হয় আর আমার চোখের কোনা লওহে মাহফুজের দিকে নিবদ্ধ থাকে। আমি আল্লাহ তা’আলার অপার জ্ঞান সমুদ্রে ডুব দিয়ে থাকি।
{শায়খ আব্দুল হক মুহাদ্দিস দেহলভীঃ যুবদাতুল আসরারঃ১৮০পৃ.}
আল্লামা জামী (রহমতুল্লাহে আলাইহে) তাঁর রচিত نفحات الانس কিতাবে হযরত খাজা বাহাউদ্দিন নক্শবন্দী (কুঃ সিঃ) এর একটি উক্তি উল্লেখ করেছেন। উক্তিটি হলো-
حضرت عزيزاں عليه الرحمة گفته اند كه زمين درنظر ايں طائفه چوں سفره ايست ومامى گويم نه چوں ناخنے است هيچ چيز ازنظر ايشاں غائب نيست
অর্থাৎ- হযরত আযীযান (রহমতুল্লাহে আলাইহে) বলেন যে, একদল আওলিয়া কিরামের সামনে পৃথিবীটা দস্তরখানার মত আর আমি মনে করি, আঙ্গুলের নখের মত। কোন বস্তুই তাঁদের দৃষ্টি বহির্ভুত নয়।
{আল্লামা আব্দুল রহমান জামীঃ নুহফাতুল উনস্ঃ ৩৮৭-৩৮৮ পৃ.}
ইমাম শা’রানী (রহমতুল্লাহে আলাইহে) كبريت الاحمر গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন-
وَاَمَّا شَيْخُنَا السَّيِّدُ عَلِىُّنِ الْخَوَّاصُّ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ فَسَمِعْتُهُ يَقُوْلُ لاَيَكْمُلُ الرَّ جُلُ عِندِفَا حَتَّى َيْعَلَم حَرْكَاتِ مُرِيْدِهِ فِىْ اِنَّتِقَالِهِ فِى الْاَصْلَابِ وَهُوَ مِنْ يَوْمِ اَلَسْتُ اِلَى اِسْتِقْرَارِهِ فِى الْجَنَّةِ اَوْفِى النَّارِ
অর্থাৎ- আমি আমার শাইখ সৈয়দ আলী খাওয়াছ (রাদিআল্লাহু আনহু) কে বলতে শুনেছি ‘আমার মতে ওই পর্যন্ত কোন ব্যক্তি কামিল হিসেবে গণ্য হয় না, যতক্ষণ পর্যন্ত না তিনি নিজ মুরীদের পিতার ঔরসে থাকাকালীন গতিবিধি সংক্রান্ত ক্রিয়া প্রক্রিয়া, এমনকি ‘মীছাকের দিন’ থেকে তার বেহেশত কিংবা দোযখ প্রবেশ করা অবধি তার যাবতীয় অবস্থা সম্পর্কে অবহিত হন।
{ইমাম আব্দুল ওয়াহ্হাব শা’রানীঃ আল কাবারিয়্যাতুল আহমারঃ ২/৩৩০ পৃ.}
শাহ ওলিউল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলভী সাহেব (রহমতুল্লাহে আলাইহে) فيوض الحرمين নামক গ্রন্থে লিখেছেন-
ثُمَّ اِنَّهُ يَنْجَذِبُ اِلَى خَيْرِ الْحَقِّ فَيْصِيْرَ عَبْدَ اللهِ فَيَتَجَلَّى لَهُ كُلُّ شَيْئٍ
অর্থাৎ- অতঃপর সেই ‘আরিফ’ ব্যক্তি হক তা’আলার সুমহান দরবারের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে আত্মবিলীন হয়ে যান, এরপর তিনি আল্লাহর প্রিয় বান্দায় পরিণত হন। তখন তাঁর কাছে প্রত্যেক কিছুই উন্মুক্ত ও প্রতিভাত হয়ে যায়।
{শাহ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলভীঃ ফয়জুল হারামাঈনঃ ১৭৫ পৃ.}
মিশকাত শরীফের প্রথম খন্ডে ‘কিতাবুত দাওয়াতের ذكر الله والتقرب শীর্ষক অধ্যায়ে বুখারী শরীফের সূত্রে হযরত আবু হুরাইরা (রাদিআল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত আছে-
فَإِذَا أَحْبَبْتُهُ: كُنْتُ سَمْعَهُ الَّذِي يَسْمَعُ بِهِ، وَبَصَرَهُ الَّذِي يُبْصِرُ بِهِ، وَيَدَهُ الَّتِي يَبْطِشُ بِهَا، وَرِجْلَهُ الَّتِي يَمْشِي بِهَا
-‘‘আল্লাহ তা’আলা ফরমান, সেই প্রিয় বান্দাকে যখন আমি ভালবাসি, তখন আমি তার কান হয়ে যাই, যদ্বারা তিনি শুনেন, চোখ হয়ে যাই, যদ্বারা তিনি দেখেন, হাত হয়ে যাই, যদ্বারা কোন কিছু ধরেন, এবং পা হয়ে যাই যদ্বারা তিনি চলাফেরা করেন।’’
একথা স্মরণ রাখা দরকার যে হযরত খিযির (আলাাইহিস সালাম) ও হযরত ইলিয়াস (আলাইহিস সালাম) এখনও পৃথিবীপৃষ্ঠে জীবিত আছেন। তাঁর এখন উম্মতে মুস্তাফা (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর ওলী হিসেবে গণ্য। হযরত ঈসা (আলাইহিস সালাম) যখন পৃথিবীতে (পুনরায়) তশরীফ আনবেন, তখন তিনিও এ উম্মতের ওলী হিসেবে আসবেন। তাঁদের (হযরত খিযির, ইলিয়াস ও ঈসা (আলাইহিস সালাম) ব্যাপক জ্ঞান সম্পর্কে আমি ইতিপূর্বে আলোচনা করেছি। তাঁদের জ্ঞানও এখন হুযুর আলাইহিস সালামের উম্মতের ওলীগণেরই জ্ঞান হিসেবে পরিগণিত।
পূর্ববর্তী পেইজ | পরবর্তী পেইজ |
(২৩) ইলমে গায়বের সমর্থনে যুক্তিনির্ভর প্রমাণসমূহ | (২৫) অদৃশ্য জ্ঞান সম্পর্কে আপত্তি ও জবাব |
সূচীপত্র | এরকম আরো পেইজ |