এ পরিচ্ছেদে আমি ক্রমিক সংখ্যা দিয়ে হাদীছসমূহ বর্ণনা করেছি। অতঃপর তৃতীয় পরিচ্ছেদে সেই সংখ্যানুসারেই হাদীছসমূহের ব্যাখ্যা প্রদান করবো।
(১) বুখারী শরীফের بَدْءِ الْخَلْقِ শীর্ষক আলোচনায় ও মিশকাত শরীফের بَدْءِ الْخَلْقِ وَذِكْرُ الْاَنْبِيَاءِ শীর্ষক অধ্যায়ে হযরত উমর ফারুক (رضى الله تعالي عنه) থেকে বর্ণিত,
قَامَ فِيْنَا رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَقَامًا فَاَخْبَرَ نَا عَنْ بَدْءِ الْخَلْقِ حَتَّى دَخَلَ اَهْلُ الْجَنَّةِ مَنَازِ لَهُمْ وَاَهْلُ النَّارِ مَنَازِ لَهُمْ حَفِظَ ذَلِكَ مَنْ حَفِظَهُ وَنَسِيَهُ مَنْ نَسِيَهُ.
-‘‘হুজুর (ﷺ) এক জায়গায় আমাদের সাথে অবস্থান করেছিলেন, সেখানে তিনি (ﷺ) আমাদেরকে আদি সৃষ্টির সংবাদ দিচ্ছিলেন, এমন কি বেহেশতবাসী ও দোযখবাসীগণ নিজ নিজ মনযিলে বা ঠিকানায় পৌঁছে যাওয়া অবধি পরিব্যাপ্ত যাবতীয় অবস্থা ও ঘটনাবলীর র্বণনা প্রদান করেন। যিনি ওসব স্মরণ রাখতে পেরেছেন, তিনি তো স্মরণ রেখেছেন, আর যিনি স্মরণ রাখতে পারেন নি, তিনি ভুলে গেছেন।
এখানে হুজুর (ﷺ) দু’ধরনের ঘটনাবলীর খবর দিয়েছেন-
(২) মিশকাত শরীফের اَلْمَعْجِزَاتِ অধ্যায়ে হযরত আমর ইবনে আখতাব (رضى الله تعالي عنه) থেকে একই কথা বর্ণিত, সেখানে আছে,
فَأَخْبَرَنَا بِمَا كَانَ وَبِمَا هُوَ كَائِنٌ فَأَعْلَمُنَا أَحْفَظُنَا
-‘‘আমাদেরকে সেই সমস্ত ঘটনাবলীর খবর দিয়েছেন, যেগুলো কিয়ামত পর্যন্ত ঘটতে থাকবে। আমাদের মধ্যে সব চেয়ে বড় ‘আলিম হলেন তিনি, যিনি এসব বিষয়াদি সর্বাধিক স্মরণ রাখতে পেরেছেন।’’
(৩) মিশকাত শরীফের اَلْفِتُنٌُ শীর্ষক অধ্যায়ে বুখারী ও মুসলিম শরীফের বরাত দিয়ে হযরত হুযাইফা (رضى الله تعالي عنه) থেকে বর্ণিত হয়েছে,
مَا تَرَكَ شَيْئًا يَكُونُ فِي مَقَامِهِ ذَلِكَ إِلَى قِيَامِ السَّاعَةِ، إِلَّا حَدَّثَ بِهِ حَفِظَهُ مَنْ حَفِظَهُ وَنَسِيَهُ مَنْ نَسِيَهُ،.
-‘‘হুজুর (ﷺ) সে জায়গায় কিয়ামত পর্যন্ত যা কিছু ঘটবে, সব কিছুর খবর দিয়েছেন, কোন কিছুই বাদ দেননি। যাদের পক্ষে সম্ভব, তাঁরা সব স্মরণ রেখেছেন, আর অনেকে ভুলেও গেছেন।’’
(এ হাদিসগুলোর মোট ৮টিরও বেশী সনদে বর্ণিত যা মুতাওয়াতিরের মর্যাদা সম্পন্ন। বাকি সনদগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে বাতিল পন্থীদের জবাবে হাদিস শাস্ত্রের উপর শহিদুল্লাহ বাহাদুরের গভেষনামূলক অনবদ্য গ্রন্থ ‘‘প্রমাণিত হাদিসকে জাল বানানোর স্বরুপ উন্মাচন’’ ১ম খন্ডের ১৮৬-১৯০পৃষ্ঠা দেখুন।)
(৪) মিশকাত শরীফের ‘ফযায়েলে সায়্যিদুল মুরসালীন’ শীর্ষক অধ্যায়ে ‘মুসলিম শরীফের’ বরাত দিয়ে হযরত ছওবান (رضى الله تعالي عنه) থেকে বর্ণনা করা হয়েছে,
إِنَّ اللهَ زَوَى لِي الْأَرْضَ، فَرَأَيْتُ مَشَارِقَهَا وَمَغَارِبَهَا،.
-‘‘আল্লাহ তা’আলা আমার সম্মুখে গোট পৃথিবীকে এমনভাবে সঙ্কুচিত করে দিয়েছেন যে, আমি পৃথিবীর পূর্বপ্রান্ত ও পশ্চিমপ্রান্ত সমূহ স্বচক্ষে অবলোকন করেছি।’’
(৫) মিশকাত শরীফের ‘মাসাজিদ’ অধ্যায়ে হযরত আবদুর রহমান ইবন আয়েশ (رضى الله تعالي عنه) থেকে বর্ণিত আছে,
رَأَيْتُ رَبِّيَ عَزَّ وَجَلَّ فِي أَحْسَنِ صُورَةٍ قَالَ: فَبِمَ يَخْتَصِمُ الْمَلَأُ الْأَعْلَى؟ قُلْتُ: أَنْتَ أَعْلَمُ قَالَ: فَوَضَعَ كَفَّهُ بَيْنَ كَتِفِيَّ فَوَجَدْتُ بَرْدَهَا بَيْنَ ثَدْيَيَّ فَعَلِمْتُ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ.
-‘‘আমি আল্লাহ তা’য়ালাকে সুন্দরতম আকৃতিতে দেখেছি।....তিনি স্বীয় কুদরতের হাতখানা আমার বুকের উপর রাখলেন, যার শীতলতা আমি স্বীয় অন্তঃস্থলে অনুভব করেছি। ফলে, আসমান যমীনের সমস্ত বস্তু সম্পর্কে অবগত হয়েছি।’’
(৬) হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (رضى الله تعالي عنه) থেকে বর্ণিত আছে,
إِنَّ اللهَ عَزَّ وَجَلَّ قَدْ رَفَعَ لِيَ الدُّنْيَا فَأَنَا أَنْظُرُ إِلَيْهَا وَإِلَى مَا هُوَ كَائِنٌ فِيهَا إِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ كَأَنَّمَا أَنْظُرُ إِلَى كَفِّي هَذِهِ،.
-‘‘আল্লাহ তা’আলা আমার সামনে সারা দুনিয়াকে তুলে ধরেছেন। তখন আমি এ দুনিয়াকে এবং এতে কিয়ামত পর্যন্ত যা’ কিছু হবে এমনভাবে দেখতে পেয়েছি, যেভাবে আমি আমার নিজ হাতকে দেখতে পাচ্ছি।’’
( এ হাদিসটির সনদের ব্যাপারে অনেক বাতিল পন্থী আপত্তি তুলেছেন। তাদের আপত্তির দাঁতভাঙ্গা জবাব সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে হাদিস শাস্ত্রের উপর শহিদুল্লাহ বাহাদুরের গভেষনামূলক অনবদ্য গ্রন্থ ‘‘প্রমাণিত হাদিসকে জাল বানানোর স্বরুপ উন্মাচন’’ ১ম খন্ডের ৫০৭-৫০৮পৃষ্ঠা দেখুন।)
(৭) মিশকাত শরীফের ‘মাসাজিদ’ অধ্যায়ে ‘তিরমিযী শরীফের’ উদ্ধৃতি দিয়ে হযরত মুয়াজ বিন জাবাল (رضى الله تعالي عنه) হতে বর্ণিত আছে,
فَتَجَلَّى لِي كُلُّ شَيْءٍ وَعَرَفْتُ
-‘‘তখন প্রত্যেক কিছু আমার কাছে উন্মুক্ত হয়েছে এবং আমি এগুলো চিনতে পেরেছি।
(এ হাদিসটির সনদের ব্যাপারে অনেক বাতিল পন্থী আপত্তি তুলেছেন। তাদের আপত্তির দাঁতভাঙ্গা জবাব সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে হাদিস শাস্ত্রের উপর শহিদুল্লাহ বাহাদুরের গভেষনামূলক অনবদ্য গ্রন্থ ‘‘প্রমাণিত হাদিসকে জাল বানানোর স্বরুপ উন্মাচন’’ ১ম খন্ডের ৫০৮-৫১০পৃষ্ঠা দেখুন।)
(৮) হযরত আবু যর গিফারী (رضى الله تعالي عنه) থেকে বর্ণিত আছে,
لَقَدْ تَرَكْنَا رَسُولَ اللَّهِ - صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ - وَمَا يُحَرِّكُ طَائِرٌ جَنَاحَيْهِ فِي السَّمَاءِ إِلَّا ذَكَّرَنَا مِنْهُ عِلْمًا.
-‘‘হুজুর (ﷺ) আমাদেরকে এমনভাবে অবহিত করেছেন যে, একটা পাখীর পালক নাড়ার কথা পর্যন্ত তাঁর বর্ণনা থেকে বাদ পড়েনি।’’
(৯) মিশকাত শরীফের ‘বাবুল ফিতান’ নামক অধ্যায়ের দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে হযরত হুযাইফা (رضى الله تعالي عنه) থেকে বর্ণিত আছে,
مَا تَرَكَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مِنْ قَائِدِ فِتْنَةٍ، إِلَى أَنْ تَنْقَضِيَ الدُّنْيَا، يَبْلُغُ مَنْ مَعَهُ ثَلَاثَ مِائَةٍ فَصَاعِدًا، إِلَّا قَدْ سَمَّاهُ لَنَا بِاسْمِهِ، وَاسْمِ أَبِيهِ، وَاسْمِ قَبِيلَتِهِ -
-‘‘হুজুর (ﷺ) পৃথিবীর মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে যাওয়া পর্যন্ত অনুষ্ঠিতব্য কোন ফিতনা পরিচালনাকারীর কথা বাদ দেন নি, যাদের সংখ্যা তিনশত কিংবা ততোধিক হবে; এমন কি তাদের নাম, তাদের বাপের নাম ও গোত্রের নামসহ আমাদের নিকট বর্ণনা করেছেন।’’
(১০) মিশকাত শরীফের ذِكْرُ الْاَنْبِيَاءِ শীর্ষক অধ্যায়ে হযরত আবু হুরাইরা (رضى الله تعالي عنه) থেকে বর্ণিত,
خُفِّفَ عَلَى دَاوُدَ عَلَيْهِ السَّلاَمُ القُرْآنُ، فَكَانَ يَأْمُرُ بِدَوَابِّهِ فَتُسْرَجُ، فَيَقْرَأُ القُرْآنَ قَبْلَ أَنْ تُسْرَجَ دَوَابُّهُ،.
-‘‘হযরত দাউদ (عليه السلام) এর জন্য কুরআনকে (যবুর গ্রন্থ) এমনভাবে সহজ করে দেয়া হয়েছিল যে, তিনি নিজ ঘোড়াদেরকে যীন’ দ্বারা সজ্জিত করার হুকুম দিতেন আর ইত্যবসরে তিনি যীন পরানোর আগেই ‘যবুর শরীফ’ পড়ে ফেলতেন।’’
এ হাদীছটি এখানে এজন্যই বর্ণনা করা হলো যে যদি হুজুর (ﷺ) একই ভাষণে সৃষ্টির আদ্যোপান্ত যাবতীয় ঘটনাবলী বর্ণনা করে থাকেন, তাহলে এও তাঁর মুজিযা ছিল, যেমন হযরত দাউদ (عليه السلام) এক মুহুর্তের মধ্যে সম্পূর্ণ ‘যবুর’ শরীফ পড়ে ফেলতেন।
(১১) মিশকাত শরীফের مَنَاقِبِ اَهْلَ الْبَيْتِ শীর্ষক অধ্যায়ে হযরত আবি আম্মার সাদ্দাদ বিন আব্দুল্লাহ (رضى الله تعالي عنه) তিনি হযরত উম্মে ফযল বিনতে হারেস (رضى الله تعالي عنها) হতে বর্ণিত আছে তিনি একদা স্বপ্ন দেখেছিলেন; আর রাসূল (ﷺ) তার ব্যাখ্যায় বলে দিলেন,
رَأَيْتِ خَيْرًا تَلِدُ فَاطِمَةُ إِنْ شَاءَ اللَّهُ غُلَامًا يَكُونُ فِي حِجْرِكِ
-‘‘হুজুর (ﷺ) হযরত উম্মুল ফযল (رضى الله تعالي عنها) এর নিকট ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে, তুমি ভাল স্বপ্ন দেখেছ। হযরত ফাতিহা তুয যুহরা (রাদিআল্লাহু আনহা) এর ঘরে এক পুত্র সন্তান জন্মগ্রহণ করবে, সে তোমারই হযরত উম্মুল ফযল (رضى الله تعالي عنها) কোলে লালিত পালিত হবে।’’
(১২) বুখারী শরীফে اِثْبَاتِ عَذَابِ الْقَبْرِ শীর্ষক অধ্যায়ে হযরত ইবনে আব্বাস (রহমতুল্লাহে আলাইহে) থেকে বর্ণিত (এছাড়া অন্য অনেক সাহাবী হতেও) আছে,
مَرَّ بِقَبْرَيْنِ يُعَذَّبَانِ، فَقَالَ: إِنَّهُمَا لَيُعَذَّبَانِ، وَمَا يُعَذَّبَانِ فِي كَبِيرٍ، أَمَّا أَحَدُهُمَا فَكَانَ لاَ يَسْتَتِرُ مِنَ البَوْلِ، وَأَمَّا الآخَرُ فَكَانَ يَمْشِي بِالنَّمِيمَةِ، ثُمَّ أَخَذَ جَرِيدَةً رَطْبَةً، فَشَقَّهَا بِنِصْفَيْنِ، ثُمَّ غَرَزَ فِي كُلِّ قَبْرٍ وَاحِدَةً، فَقَالُوا: يَا رَسُولَ اللَّهِ، لِمَ صَنَعْتَ هَذَا؟ فَقَالَ: لَعَلَّهُ أَنْ يُخَفَّفَ عَنْهُمَا مَا لَمْ يَيْبَسَا.
-‘‘হুজুর (ﷺ) একদা দুটো কবরের পার্শ্ব দিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন কবর দুটোতে আযাব হচ্ছিল। তিনি (ﷺ) বললেন, এ দু’জনের আযাব হচ্ছে কিন্তু কোন গুরুতর অপরাধের জন্য নয়। তাদের মধ্যে একজন প্রশ্রাবের সময় সতর্কতা অবলম্বন করতো না। অপরজন চোগলখুরী করে পরস্পরের ম্েযধ ঝগড়া সৃষ্টি করত। তখন তিনি (ﷺ) খেজুরের একটি কাঁচা ডাল নিয়ে তা’ দুভাগে ভাগ করলেন ও অংশ দু’টো উভয় কবরে একটি করে পুঁতে দিলেন এবং ইরশাদ করলেন ততক্ষণ পর্যন্ত ডাল দু’টো শুকিয়ে না যাবে, ততক্ষণ পর্যন্ত তাদের শাস্তি লাঘব হবে।’’
(এ হাদিসটি অগণিত সনদে বর্ণিত যা দ্বারা মুতাওয়াতির প্রমাণিত হয়; আর এ পর্যায়ের হাদিসকে ইনকার করা কুফুরী।)
(১৩) বুখারী শরীফের كِتَابُ الْاِعْتِصَامِ بِالْكِتَاِب وَالسُّنَّةِ এ ও তাফসীরে খাযেনে لاَ تَسْئَلُوْا عَنِ الْاَشْيَاءِ اِنْه تُبْدَ لَكُمْ. আয়াতের ব্যাখ্যায় উল্লেখিত আছে,
قَامَ عَلَى المِنْبَرِ، فَذَكَرَ السَّاعَةَ، وَذَكَرَ أَنَّ بَيْنَ يَدَيْهَا أُمُورًا عِظَامًا، ثُمَّ قَالَ: مَنْ أَحَبَّ أَنْ يَسْأَلَ عَنْ شَيْءٍ فَلْيَسْأَلْ عَنْهُ، فَوَاللَّهِ لاَ تَسْأَلُونِي عَنْ شَيْءٍ إِلَّا أَخْبَرْتُكُمْ بِهِ مَا دُمْتُ فِي مَقَامِي هَذَا، قَالَ أَنَسٌ: فَأَكْثَرَ النَّاسُ البُكَاءَ، وَأَكْثَرَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَنْ يَقُولَ: سَلُونِي، فَقَالَ أَنَسٌ: فَقَامَ إِلَيْهِ رَجُلٌ فَقَالَ: أَيْنَ مَدْخَلِي يَا رَسُولَ اللَّهِ؟ قَالَ: النَّارُ، فَقَامَ عَبْدُ اللَّهِ بْنُ حُذَافَةَ فَقَالَ: مَنْ أَبِي يَا رَسُولَ اللَّهِ؟ قَالَ: أَبُوكَ حُذَافَةُ، قَالَ: ثُمَّ أَكْثَرَ أَنْ يَقُولَ: سَلُونِي سَلُونِي
-‘‘একদিন হুজুর (ﷺ) মিম্বরের উপর দাঁড়ালেন। অতঃপর কিয়ামতের উল্লেখপূর্বক এর আগে যে সমস্ত ভয়ানক ঘটনাবলী ঘটবে, সে সম্পর্কে বর্ণনা দিলেন। এরপর তিনি (ﷺ) বললেন, ‘যার যা খুশী জিজ্ঞাসা করতে পার।’ খোদার শপথ, এ জায়গা অর্থাৎ এ মিম্বরে আমি যতক্ষণ দন্ডায়মান আছি, ততক্ষণ তোমরা যা কিছু জিজ্ঞাসা কর না কেন, আমি অবশ্যই উত্তর দেব।’ জনৈক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে আরয করলেন, ‘পরকালে আমার ঠিকানা কোথায়?’ ইরশাদ ফরমালেন জাহান্নামের মধ্যে।
আবদুল্লাহ ইবনে হুযায়ফা দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসা করলেন ‘আমার বাপ কে? ইরশাদ করেন, হুযায়ফা।’ এরপর রাসূল (ﷺ) বার বার ইরশাদ ফরমান, জিজ্ঞাসা করো, জিজ্ঞাসা করো।’’
মনে রাখা দরকার যে কারো ‘জাহান্নামী’ বা ‘জান্নাতী’ হওয়া সম্পর্কে জানা পঞ্চ জ্ঞানের (علوم خمسه) অন্তভুর্ক্ত। সৌভাগ্যবান কিংবা হতভাগা হওয়ার বিষয় সম্পর্কিত জ্ঞানও পঞ্চ জ্ঞানের অন্তভুর্ক্ত। অনুরূপ কে কার ছেলে এ সম্পর্কিত জ্ঞানও উক্ত’ পঞ্চ বিষয়ের জ্ঞানের আওতাভুক্ত। অধিকন্তু এটা এমন একটি বিষয় যা শুধু ব্যক্তি বিশেষের মা ছাড়া আর কেউ বলতে পারে না। রাসূল (ﷺ) এহেন দৃষ্টির জন্য সবকিছুই উৎসর্গকৃত, যে দৃষ্টিতে আলো-অন্ধকার, দুনিয়া, আখিরাত সবকিছুই দৃষ্টিগোচর হয়।
(১৪) মিশকাত শরীফের مناقب على رضى الله عنه অধ্যায়ে বর্ণিত হযরত সাহল বিন সা‘দ (رضى الله تعالي عنه) হতে বর্ণিত আছে -
قَالَ يَوْمَ خَيْبَرَ: لَأُعْطِيَنَّ هَذِهِ الرَّايَةَ غَدًا رَجُلًا يَفْتَحُ اللَّهُ عَلَى يَدَيْهِ يُحِبُّ اللَّهَ وَرَسُولَهَ وَيُحِبُّهُ اللَّهُ وَرَسُولُهُ.
-‘‘হুজুর (ﷺ) খায়বরের যুদ্ধের দিন ইরশাদ ফরমান, ‘আমি আগামী দিন এ পতাকা এমন এক ব্যক্তিকে অর্পণ করবো, যার হাতে আল্লাহ তা’আলা ‘খায়বরের বিজয় নির্ধারণ করেছেন। তিনি এমন এক ব্যক্তি, যিনি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে ভালবাসেন।’’
(১৫) মিশকাত শরীফের ‘মাসাজিদ’ অধ্যায়ে হযরত আবু যর গিফারী (رضى الله تعالي عنه) থেকে বর্ণিত আছে,
عُرِضَتْ عَلَيَّ أَعْمَالُ أُمَّتِي حَسَنُهَا وَسَيِّئُهَا، فَوَجَدْتُ فِي مَحَاسِنِ أَعْمَالِهَا الْأَذَى يُمَاطُ عَنِ الطَّرِيقِ، -
-‘‘আমার সামনে আমার উম্মতের ভালমন্দ আমলসমূহ পেশ করা হয়েছে। আমি তাদের নেক আমল সমূহের মধ্যে রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক বস্তু সমূহ অপসারণের মত পুণ্য কাজও লক্ষ্য করেছি।’’
(১৬) ‘মুসলিম শরীফের كتاب الجهاد ২য় খন্ড এর ‘বদরের যুদ্ধ’ শীর্ষক অধ্যায়ে হযরত আনাস (رضى الله تعالي عنه) থেকে বর্ণিত আছে,
فَقَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: هَذَا مَصْرَعُ فُلَانٍ، قَالَ: وَيَضَعُ يَدَهُ عَلَى الْأَرْضِ هَاهُنَا، هَاهُنَا، قَالَ: فَمَا مَاطَ أَحَدُهُمْ عَنْ مَوْضِعِ يَدِ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ.
-‘‘হুজুর (ﷺ) ইরশাদ ফরমান, এটা হলো অমুক ব্যক্তির নিহত হয়ে পতিত হওয়ার সুনির্দিষ্ট স্থান’ এবং তিনি (ﷺ) তাঁর পবিত্র হস্ত মুবারক যমীনের উপর এদিক সেদিক সঞ্চালন করছিলেন। বর্ণনাকারী বলেন যে, নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে কেউ হুজুর (ﷺ) এর হাতের নির্দেশিত স্থানের কিঞ্চিত বাহিরেও পতিত হয়নি।’’
লক্ষ্যণীয় যে, কে কোন জায়গায় মারা যাবে, এ বিষয়ের জ্ঞান পঞ্চ জ্ঞানের (علوم خمسة) অন্তভুর্ক্ত। যার সংবাদ বদরযুদ্ধের একদিন আগেই হুজুর (ﷺ) দিচ্ছিলেন।
(১৭) মিশকাত শরীফের ‘মুজিযাত’ অধ্যায়ে হযরত আবু হুরাইরা (رضى الله تعالي عنه) থেকে বর্ণিত আছে,
فَقَالَ الرَّجُلُ: تَاللَّهِ إِنْ رَأَيْتُ كَالْيَوْمِ ذِئْبٌ يَتَكَلَّمُ! فَقَالَ الذِّئْبُ: أَعْجَبُ مِنْ هَذَا رَجُلٌ فِي النَّخَلاتِ بَيْنَ الْحَرَّتَيْنِ يُخْبِرُكُمْ بِمَا مَضَى، وَمَا هُوَ كَائِنٌ بَعْدَكُمْ.
-‘‘জনৈক শিকারী আশ্চর্য হলে বললো, নেকড়ে বাঘকে আজ যেরূপ কথা বলতে দেখলাম সেরূপ ইতিপূর্বে আর কখনও দেখিনি। তখন নেকড়ে বাঘ বলে উঠলো, ‘এর চেয়ে আশ্চর্যজনক বিষয় হলো ঐ দুই উন্মুক্ত প্রান্তরের মধ্যবর্তী মরূদ্যানে (মদীনায়) একজন সম্মানিত ব্যক্তি (হুজুর (ﷺ)) আছেন, যিনি তোমাদের নিকট বিগত ও অনাগত ভবিষ্যতের বিষয় সম্পর্কে সংবাদ পরিবেশ করেন।’’
(১৮) তাফসীরে খাযেনের ৪র্থ পারায়
ما كانَ اللَّهُ لِيَذَرَ الْمُؤْمِنِينَ عَلى ما أَنْتُمْ عَلَيْهِ
{সূরাঃ আলে ইমরানঃ আয়াতঃ ১৭৯, পারাঃ ৪}
আয়াতের ব্যাখ্যায় ইমাম হযরত সুদ্দি (رضى الله تعالي عنه) হতে বর্ণিত একটি হাদিস উল্লেখ করা হয়েছে,
قاَلَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عُرِضَتْ عَلَىَّ امُّتِىْ فِىْ صُوَرِ هَا فِى الطِّيْنِ كَمَا عُرِضَتْ عَلَى اَدَمَ وَاُعْلِمْتُ مَنْ يُؤْمِنُ بِىْ وَمَنْ يُّكْفُرُ بِىْ فَبَلَغَ ذَلِكَ الْمُنَافِقِيْنَ فَالُوا اِشْتِهْزَاءً زَعَمَ مُحَمَّدٌُ اَنَّهُ يَعْلَمُ مَنْ يُؤْمِنُ بِهِ وَمَنْ يَّكْفُرُ مِمَّنْ لَمْ يُخْلَقْ بَعْدُ وَنَحْنُ مَعَهُ وَمَايَعْرِفُنَا، فَتَلَغَ ذَلِكَ رَسُوْلَ اللهِ عَلَيْهِ السَّلاَمُ فَقَامَ عَلَى الْمِنْبَرِ فَحَمِدَ اللهَ وَاَثْنَى عَلَيْهِ ثُمَّ قَالَ مَابُالُ اَقْوَامٍ طَعَنُوْا فِىْ عِلْمِىْ لاَتَسْئَلُوْنِىْ عَنْ شَيْئٍ فِيْمَا بَيْنَكُمْ وَبَيْنَ السَّاعَةِ اِلاَّ اَنْبَئْتُكُمْ بِهِ.
-‘‘হুজুর (ﷺ) ইরশাদ ফরমান, আমার কাছে আমার উম্মতকে তাদের নিজ নিজ মাটির আকৃতিতে পেশ করা হয়েছে, যেমনভাবে আদম (عليه السلام) এর কাছে পেশ করা হয়েছিল। আমাকে বলে দেয়া হয়েছে কে আমার উপর ঈমান আনবে আর কে আমাকে অস্বীকার করবে। যখন এ খবর মুনাফিকদের কাছে পৌঁছলো, তখন তারা হেসে বলতে লাগলো, ‘হুজুর (ﷺ)’ ওসব লোকদের জন্মের আগেই তাদের মুমিন ও কাফির হওয়া সম্পর্কে অবগত হয়ে গেছেন, অথচ আমরা তাঁর সাথেই আছি কিন্তু আমাদেরকে চিনতে পারেন নি।’ এ খবর যখন হুজুর (ﷺ) এর নিকট পৌঁছলো, তখন তিন মিম্বরের উপর দাঁড়ালেন এবং আল্লাহর প্রশংসা করে ইরশাদ ফরমান, এসব লোকদের কি যে হলো, আমার জ্ঞান নিয়ে বিরূপ সমালোচনা করছে। এখন থেকে কিয়ামত পর্যন্ত যে কোন বিষয় সম্পর্কে তোমরা আমাকে জিজ্ঞাস করো, আমি অবশ্যই বলে দিব।’’
ইমাম খাযেনঃ লুকাবুত তা’ভীলঃ ১/৩২৪ পৃ. দারুল কুতুব ইলমিয়্যাহ, বয়রুত, লেবানন, প্রকাশ.১৪১৫হি.
এ হাদীছ থেকে দু’টি বিষয় সম্পর্কে জানা গেল-
(১৯) মিশকাত শরীফের ‘কিতাবুল ফিতান’ যুদ্ধ বিগ্রহের বর্ণনা শীর্ষক অধ্যায়ের প্রথম পরিচ্ছেদে মুসলিম শরীফের উদ্ধৃতি দিয়ে আব্দুল্লাহ ইবনে মসউদ (رضى الله تعالي عنه) থেকে বর্ণিত আছে,
إِنِّي لَأَعْرِفُ أَسْمَاءَهُمْ وَأَسْمَاءَ آبَائِهِمْ وَأَلْوَانَ خُيُولِهِمْ هُمْ خَيْرُ فَوَارِسَ أَوْ مِنْ خَيْرِ فَوَارِسَ عَلَى ظَهْرِ الأَرْض.
-‘‘তাদের নাম, (দাজ্জালের বিরুদ্ধে জিহাদের প্রস্তুতি গ্রহণকারীগণের) তাঁদের বাপ-দাদাদের নাম ও তাদের ঘোড়াসমূহের বর্ণ পর্যন্ত আমার জানা আছে, তাঁরাই হবেন ভূ-পৃষ্ঠের সর্বোৎকৃষ্ট ঘোড়াসওয়ার।’’
(২০) মিশকাত শরীফের مناقب ابي بكر وعمر অধ্যায়ে বর্ণিত আছে,
হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (رضى الله تعالي عنها) হুজুর (ﷺ) এর নিকট জানতে চাইলেন, এমন কেউ আছেন কিনা, যা’র নেকী সমূহ তারকারাজির সমসংখ্যক হবে?” হুজুর (ﷺ) উত্তরে ইরশাদ ফরমান, হ্যাঁ, এবং তিনি হলেন হযরত উমর (رضى الله تعالي عنه)।
এ থেকে বোঝা গেল যে কিয়ামত পর্যন্ত সমস্ত লোকের দৃশ্যমান ও গোপনীয় যাবতীয় কাজ কর্ম সম্পর্কে হুজুর (ﷺ) পূর্ণারূপে অবগত আছেন। আসমানের সমস্ত দৃশ্যমান ও অদৃশ্য নক্ষত্র সমূহেরও বিস্তারিত জ্ঞান তাঁর রয়েছে; অথচ নক্ষত্র সম্পর্কে বৈজ্ঞানিকগণ তাদের বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতির সাহায্যেও এখনও পর্যন্ত কিছুই জানতে পারেন নি।
হুজুর (ﷺ) এ দু’বিষয় (আমল ও নক্ষত্র সম্বন্ধে, সম্যকরূপে অবগত বিধায় বলে ছিলেন যে হযরত উমর (رضى الله تعالي عنه) এর নেকীসমূহ নক্ষত্র রাজির সংখ্যার সমান। দুটো বস্তুর পরিমাণগত, সংখ্যাগত দিক থেকে সমান বা কম বেশী হওয়া সম্পর্কে তিনিই বলতে পারেন, যিনি উভয়টির জ্ঞান রাখেন, উভয় বস্তুর বা পরিমাণ সম্বন্ধেও সম্যকরূপে অবগত হন।
এগুলো ছাড়াও আরও অনেক হাদীছ উপস্থাপন করা যেতে পারে, কিন্তু এ পরিচ্ছেদকে সংক্ষেপ করার উদ্দেশ্যে এতটুকু যথাযথ মনে করা হয়েছে। এ হাদীছ সমূহ থেকে এতটুকু বোঝা গেল যে, সমস্ত জগত হুজুর (ﷺ) এর কাছে নিজ হাতের তালুর মত। লক্ষণীয় যে, عالَم আলম বলতে আল্লাহ ব্যতীত বাকী সবকিছুকেই বোঝায়। সুতরাং, আলমে মালায়িকা’ (স্তুল জগত, সূক্ষ্ম জগত ও সূক্ষ্মাতি সূক্ষ্ম জগৎ সমূহ) আরশ ও ফরশ মোট কথা প্রত্যেক কিছুর উপর হুজুর (ﷺ) এর দৃষ্টি রয়েছে। ‘আলমের’অন্তভুর্ক্ত লওহে মাহফুজও, যেখানে সমস্ত বিষয় লিপিবদ্ধ আছে। দ্বিতীয়তঃ এও বোঝা গেল যে, রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) পূর্বাপর সমস্ত ঘটনাবলী সম্পর্কেও জ্ঞাত। তৃতীয়তঃ ইহাও বোঝা গেল যে রাতের অন্ধকারে নির্জনে নিভৃতে যেসব কাজ সম্পন্ন করা হয়, উহাও মুহাম্মদ মুস্তাফা (ﷺ) এর থেকে লুকায়িত নয়। যেমন আবদুল্লাহের বাপ যে হুযাইফা সে সম্পর্কেও তিনি বলে দিয়েছেন। চতুর্থতঃ এও বোঝা গেল যে, কে, কখন, কোথায় মারা যাবে, কোন অবস্থায় মারা যাবে, কাফির, কি মুমিন হবে, নারীর গর্ভে কি আছে, এ সমস্ত কোন বিষয়ই হুজুর (ﷺ) থেকে লুকায়িত ন। মোট কথা, বিশ্বের অণু-পরমাণু, বিন্দু বিসর্গ সম্পর্কেও হুজুর (ﷺ) এর সম্যক জ্ঞান রয়েছে।