‘মিশকাত শরীফের’ কিতাবুত ইমারাতে’ মুসলিম শরীফের হযরত আরফাজা (رضي الله عنه) উদ্ধৃতি দিয়ে বর্ণিত আছে যে হুজুর (ﷺ) ইরশাদ ফরমান,
مَنْ أَتَاكُمْ وَأَمْرُكُمْ جَمِيعٌ عَلَى رَجُلٍ وَاحِدٍ يُرِيدُ أَنْ يَشُقَّ عَصَاكُمْ أوْ يُفرِّقَ جماعتكم فَاقْتُلُوهُ
-‘‘তোমরা সর্ব সম্মতিক্রমে কোন এক জনের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেছ, এমতাবস্থায় যদি অন্য কেউ তোমাদের নিকট এসে তোমাদের লাঠি (ঐক্য) ভেঙ্গে দিতে ও তোমাদের মাঝে দলাদলি সৃষ্টির প্রয়াস পায়, তাহলে তোমরা তাকে হত্যা করে দাও।’’
এখানে ব্যক্তি বিশেষ বলতে ইমাম ও উলামায়ে দ্বীনকে বোঝানো হয়েছে। কেননা শরীয়ত বিরোধী কাজে সমকালীন শাসকের আনুগত্য জায়েয নয়।
بَابُ وُجُوْبِ طَاعَةِ اْلاُمَرَاءِ فِىْ غُيْرِ مَعْصِيَةٍ.
-‘‘পাপাচার ব্যতীত অন্যান্য বিষয়ে শাসকের আনুগত্য করা ওয়াজিব নামে একটি পৃথক অধ্যায় রচনা করেছেন। এ থেকে বোঝা যায় একজনের আনুগত্য করার প্রয়োজনীয়তা কতটুকু।’’
{মুসলিমঃ আস-সহীহঃ ২/১২৪ পৃ.}
মিশকাত শরীফে কিতাবুল ‘বুয়ূ’ ‘বাবুল ফারাইযে’ বুখারী শরীফের উদ্ধৃতি দিয়ে বর্ণনা করা হয়েছেঃ হযরত আবু মুসা আশআরী (رضي الله عنه) হযরত ইবনে মাসউদ (رضي الله عنه) সম্পর্কে বলছিলেন,
لاَ تَسْأَلُونِي مَا دَامَ هَذَا الحَبْرُ فِيكُمْ
-‘‘যতদিন এ হযরত ইবন মাসউদ (رضي الله عنه) আপনাদের মধ্যে থাকবেন, ততদিন আমার নিকট মাসাইল জিজ্ঞাসা করবেন না।’’
এতে বোঝা যায় সর্বোত্তম ব্যক্তির উপস্থিতিতে অপেক্ষাকৃত কম মাহাত্ম্যের অধিকারী ব্যক্তির আনুগত্য করতে নেই এবং প্রত্যেক অনুসারী ব্যক্তির দৃষ্টিতে স্বীয় ইমাম সর্বশ্রেষ্ঠ বিবেচিত হন।
ফাত্হুল কাদীরে আছেঃ
مَنْ تَوَلىَّ اَمْرَ الْمُسْلِمِيْنَ شَيْئًا فَاسْتَعْمَلَ عَلَيْهِمْ رَجَلًا وَّيَعْلَمُ اَنَّ فِيْهِمْ مَنْ هُوَ اَوْلَى بِذَلِكَ وَاَعْلَمَ مِنْهُ بِكِتَابِ اللهِ وَسُنَّةِ رَسُوْلِهِ فَقَدْ خَانَ اللهَ وَرَسُوْلَهُ وَجَمَاعَةَ الْمُسْلِمِيْنَ.
অর্থাৎ মুসলমানদের শাসনকর্তা যখন জেনে শুনে মুসলমানদের জন্য এমন একজন প্রশাসক নিয়োগ করলেন, যা’র থেকে অগ্রাধিকার পাওয়ার উপযুক্ত ও কুরআন হাদীছে। অপেক্ষাকৃত অভিজ্ঞ ব্যক্তি রয়েছেন, তখন তিনি আল্লাহ, রাসূল (ﷺ) এবং সাধারণ মুসলমানদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করলেন।
মিশকাত শরীফে ‘কিতাবুল ইমারাত’ এর ১ম পরিচ্ছেদে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত আছেঃ
وَمَنْ مَاتَ وَلَيْسَ فِي عُنُقِهِ بَيْعَةٌ، مَاتَ مِيتَةً جَاهِلِيَّةً
-‘‘যে ব্যক্তি মারা গেল, অথচ তাঁর গলে বায়’আত বন্ধন রইল না, সে অজ্ঞতার মৃত্যুবরণ করলো।’’
এখানে বায়’আত বলতে ইমামের বায়’আতের অর্থাৎ তাকলীদ বা অনুসরণ ও আওলিয়া কিরামের হাতে বায়’আত গ্রহণ- এ উভয় প্রকারের বায়’আতকে অন্তভুর্ক্ত করা হয়েছে। এখন বলুন, এ যুগে ভারতীয় ওহাবীগণ কোন্ সুলতানের বায়’আত গ্রহণ করেছেন?
তাকলীদের সমর্থনে এ কয়েকটি আয়াত ও হাদীছের বর্ণনা করা হলো। এগুলো ছাড়া আরও অনেক আয়াত ও হাদীছ উল্লেখ করা যেতে পারে। কিন্তু বক্তব্য সংক্ষেপ করার উদ্দেশ্যে এখানে ইতি টানা হলো। এখন উম্মতের আমল পর্যালোচনা করে দেখুন, তবে ‘তাবিয়ীনদের যুগ থেকে আজ পর্যন্ত সমস্ত উম্মত তাকলীদের পথে চলে আসছে অর্থাৎ যে নিজে মুজতাহিদ নয়, সে অপর একজন মুজতাহিদের অনুসরণ করছে। উম্মতের ইজমা’র উপর আমল করার বিষয়টা কুরআন হাদীছ থেকে প্রমাণিত ও আবশ্যকীয়ও বটে।
আল্লাহ তা’লা কুরআন মজীদে ইরশাদ করেছেনঃ
وَمَنْ يُشَاقِقِ الرَّسُولَ مِنْ بَعْدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُ الْهُدَى وَيَتَّبِعْ غَيْرَ سَبِيلِ الْمُؤْمِنِينَ نُوَلِّهِ مَا تَوَلَّى وَنُصْلِهِ جَهَنَّمَ وَسَاءَتْ مَصِيرًا
-‘‘সঠিক পথ প্রকাশিত হওয়ার পরেও যে ব্যক্তি রাসূলের (ﷺ) বিরোধিতা করে, মুসলমানদের পথ ছেড়ে ভিন্ন পথে চলে, তাকে আমি তার স্বীয় অবস্থায় ছেড়ে দিব, এবং তাকে জাহান্নামে প্রবেশ করাবো। এটা কতই না নিকৃষ্ট স্থান।’’
সূরাঃ নিসা, আয়াতঃ ১১৫, পারাঃ ৫
এ আয়াত থেকেও বোঝা গেল, সাধারণ মুসলমানদের জন্য মনোনীত যে পথ, সে পথ অবলম্বন করা ফরয বা অবশ্য কর্তব্য। তাকলীদের ব্যাপারে মুসলমানদের সার্বিক সম্মতি বা ইজমা রয়েছে।
মিশকাত শরীফের ‘আল ইতিসাম বিল কিতাব ওয়াস্সুল্লাহ’ অধ্যায়ে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত আছে, আঁকা (আঃ) বলেন,
اتَّبِعُوا السَّوَادَ الْأَعْظَمَ فَإِنَّهُ مَنْ شَذَّ شَذَّ فِي النَّارِ
-‘‘সর্ববৃহৎ দলের পদাঙ্ক অনুসরণ কর। কেননা, যে মুসলমানদের দল তেকে পৃথক রয়েছে, তাকে পৃথকভাবে জাহান্নামে পাঠানো হবে।’’
অন্য এক হাদীছে আরও আছে, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত,
مَا رَآهُ الْمُؤْمِنُونَ حَسَنًا فَهُوَ عِنْدَ اللَّهِ حَسَنٌ
-‘‘যে পথ ও মতকে মুসলমানরা ভাল জানেন, উহা আল্লাহর কাছেও ভাল ও পছন্দনীয় হিসেবে গণ্য।’’
উক্ত হাদিসের সনদ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে আমার লিখিত “প্রমাণিত হাদিসকে জাল বানানোর স্বরুপ উন্মাচন ১ম খন্ডের ৩৮৭-৩৯১পৃষ্ঠা” পর্যন্ত দেখুন।
এখন ভেবে দেখুন, বর্তমানে এবং এর আগেও সাধারণ মুসলমানগণ ব্যক্তি বিশেষের তাকলীদকে ভাল জ্ঞান করে আসছেন; মুকালিদ বা অনুসারী হয়ে কালাতিপাত করছেন। এখনও আরব, ‘আজমের মুসলমানগণ ব্যক্তি বিশেষের তাকলীদ বা অনুসরণ করে থাকেন। সুতরাং, যে লা-মাযহাবী হল, সে ‘ইজমায়ে উম্মত’কে অস্বীকার করলো। ইজমা বা সর্বসম্মত মতকে স্বীকার না করলে, হযরত আবু বকর সিদ্দিক (رضي الله عنه) ও হযরত ‘উমর ফারুক (رضي الله عنه) এর খিলাফতকে কিরূপে প্রমাণ করবেন? তাঁদের খিলাফতও ইজমায়ে উম্মত থেকেই প্রমাণিত। যে ব্যক্তি এ দু’জনের মধ্যে যে কোন একজনের খিলাফতকে অস্বীকার করে, সে কাফির হিসেবে গণ্য। (ফাতওয়ায়ে শামী ইত্যাদি কিতাব দেখুন) একইভাবে তাকলীদের ব্যাপারেও উম্মতের ঐক্যমত প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
তাফসীরে খাযিনে وَكُوْنُوْا مَعَ الصَّادِقِيْنَ আয়াতের {সূরাঃ তাওবাহ, আয়াতঃ ১১৯, পারাঃ ১১} ব্যাখ্যা প্রসঙ্গক্রমে বলা হয়েছে,
যে হযরত আবু বকর (رضي الله عنه) আনসারদেরকে লক্ষ্য করে বলেছিলেন, কুরআন শরীফে মুহাজিরগণকে صَادِقِيْنَ(সত্যবাদী) আখ্যায়িত করা হয়েছে। ইরশাদ করা হয়েছে, اُولَئِكَ هُمُ الصَّادِقُِوْنَ (তাঁরাই সত্যবাদী) এরপর তিনি বলেছিলেন, وَكُوْنُوْا مَعَ الصَّادِقِيْنَ (সত্যবাদীদের সাথে থাকুন) সুতরাং আপনারাও পৃথক খিলাফত কায়েম করবেন না, আমাদের সাথে থাকুন।
অনুরূপ আমিও লা-মাযহাবীদেরকে বলছি সত্যবাদীরা তাকলীদ করেছেন, আপনারাও তাদের পথ অনুসরণ করুন অর্থাৎ মাযহাবের অনুসারী হোন।
এ পৃথিবীতে কোন লোক অপরের অনুসরণ ছাড়া কোন কাজই করতে পারে না। প্রত্যেক পেশা ও বিদ্যার নির্ধারিত রীতিনীতির ক্ষেত্রে অভিজ্ঞ লোকদের নির্দেশ পালন করতেই হয়। ধর্মীয় বিষয়সমূহ পার্থিব কর্মকান্ডের তুলনায় অনেক জটিল ও সমস্যাসঙ্কুল। অতএব, এতেও অভিজ্ঞ ধর্মীয় মনীষীদের অনুসরণ করতে হবে বৈকি। ইলমে হাদীছের মধ্যেও তাকলীদের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। যেমন, বলা হয় অমুক হাদীছটি যঈফ (দুর্বল), কেননা ইমাম বুখারী (رحمة الله) বা অমুক মুহাদ্দিছ অমুক বর্ণনাকারীকে য’ঈফ (দুর্বল) বলেছেন। এখানে তাঁর অভিমতটা গ্রহণ করাটাই হলো তাকলীদ। কুরআনের কিরা’তের ব্যাপারেও ক্বারীদের তাকলীদ করা হয়। যেমন, বলা হয়ে থাকে, অমুক ক্বারী অমুক আয়াতটাকে এভাবে পড়েছেন। কুরআনের স্বরচিহ্ন, اِعْرَاب আয়াত ايات ইত্যাদির ব্যাপারেও তাকলীদ করা হয়। যখন জামাআতে নামায আদায় করা হয়, তখন সমস্ত মুক্তাদী ইমামেরই তাকলীদ করেন। ইসলামী রাজ্যে সমস্ত মুসলমান একজন বাদশাহের তাকলীদ করে থাকেন। রেলগাড়ীর সমস্ত যাত্রী এক ইঞ্জিনেরই তাকলীদ করেন। মোট কথা, মানুষ প্রত্যেকটি কাজেই অপরের অনুসারী বা মুকালিদ।
স্মর্তব্য যে, উল্লেখিত সব ক্ষেত্রে ব্যক্তি বিশেষের তাকলীদের বিষয়টি পরিস্ফুট হয়েছে। নামাযের মধ্যে ইমাম একজন ছাড়া দু’জন হয় না, ইসলামী রাজ্যের বাদশাহ দু’জন হয় না। সুতরাং শরীয়তের ইমামও এজন ছাড়া দুইজন কি করে সম্ভব?
إِذَا كَانَ ثَلَاثَةٌ فِي سَفَرٍ فَلْيُؤَمِّرُوا أحدهم
-‘‘যখন তিনজন লোক ভ্রমণে বের হয়, একজনকে আমীর বা নেতা মনোনীত করা বাঞ্ছনীয়।’’
পূর্ববর্তী পেইজ | পরবর্তী পেইজ |
(১০) তাকলীদ ওয়াজিব হওয়ার দলীলাদির বিবরণ | (১২) তাকলীদ সম্পর্কে উত্থাপিত আপত্তিসমূহ এবং উহাদের উত্তর |
সূচীপত্র | এরকম আরো পেইজ |