জিকির শব্দের উদ্দেশ্য স্মরণ। কেবল উচ্চারণ নয়। একথা না বুঝতে পেরে অপূর্ণ (নাকেস) পীরেরা সশব্দে জিকির করতে থাকেন। স্মরণ বা জিকির কলব বা অন্তরের সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যাপার। সুতরাং জিকির মানেই অন্তরের জিকির বা গোপন জিকির ।
আল্লাহ্পাক এরশাদ করেন-
‘ওয়াজকুর রব্বাকা ফি নাফসিকা' (তুমি তোমার সত্তার মধ্যে গোপনে আল্লাহ্তায়ালার জিকির করো)।
সুরা আ'রাফ ২০৫ আয়াত
হজরত মোজাদ্দেদে আলফে সানি র. বলেন ‘নকশবন্দী বুজর্গগণ জিকিরে জিহর বা উচ্চস্বরে জিকির করাকে ‘বেদাত' বলে জানেন এবং এ ব্যাপারে নিষেধ করে থাকেন। এর দ্বারা যে ফল লাভ হয়, সেদিকে ভ্রূক্ষেপই করেন না। একদিন আমাদের পীর কেবলা হজরত খাজা বাকী বিল্লাহ্ র. এর খানার মজলিশে আমি উপস্থিত ছিলাম । শায়েখ কামাল নামক জনৈক বিশিষ্ট ব্যক্তি আহারের শুরুতে তাঁর সামনে সশব্দে ‘আল্লাহ্' নাম উচ্চারণ করলেন। আমাদের পীর কেবলা এতে ভয়ানক অসন্তুষ্ট হয়ে সবাইকে লক্ষ্য করে বললেন ‘তোমরা তাকে আমার খানার মজলিশে উপস্থিত হতে নিষেধ করে দিয়ো'। আমার পীর কেবলার নিকটেই আমি শুনেছি যে, খাজা নকশবন্দ র. বোখারার আলেমগণকে সঙ্গে নিয়ে হজরত আমীর কুলাল র. এর খানকা শরীফে গিয়েছিলেন এই উদ্দেশ্যে, যেনো সকলে তাঁকে জিকিরে জিহর পরিত্যাগের আবেদন করেন। আলেমগণ হজরত আমির কুলাল র.কে বলেন জিকিরে জিহর বেদাত। এটা আপনি করবেন না'। তদুত্তরে তিনি বলেছিলেন ‘আর করবো না' ।
এই তরিকার উচ্চস্তরের বুজর্গবৃন্দ জিকিরে জিহরের ব্যাপারেই যখন এমন কঠোর, তখন নৃত্যগীত, লম্ফ-ঝম্প ইত্যাদির ব্যাপারে আর কি বলবো? শরিয়তবিগর্হিত কাজ দ্বারা যে সকল হালের উদ্ভব হয়, এ ফকির তাকে এস্তেদরাজ বা ছলনামূলক উন্নতি বলে জানে। কেননা, আহলে এস্তেদরাজ বা ছলনামগ্ন ব্যক্তিদেরও এক ধরনের আত্মিক অবস্থা ও প্রেরণা লাভ হয়ে থাকে এবং তওহীদে অজুদী (একবাদ দর্শন) সম্পর্কিত আত্মিক বিকাশ (কাফ) হয় এবং বিশ্বের সকল বস্তুর আকার-আকৃতির আয়নায় আল্লাহ্তায়ালার প্রতি প্রতিচ্ছায়াতুল্য তাজাল্লি (আবির্ভাব) দৃষ্ট হয়ে থাকে। গ্রীকদেশীয় দার্শনিক এবং ভারতের যোগী- সন্ন্যাসীরাও এ বিষয়ে তাদের সমতুল। শরিয়তের এলেমসমূহের আনুকূল্য এবং হারাম ও সন্দিগ্ধ বিষয় থেকে বহির্ভূতিই আত্মিক অবস্থা সত্য হওয়ার প্রমাণ। জানবেন যে, নৃত্য ও সঙ্গীত প্রকৃতপক্ষে খেলাধুলার মতো। আল্লাহ্তায়ালার এরশাদ
‘মানুষের মধ্যে কেউ কেউ বাক্যের ক্রীড়া ক্রয় করে'
সূরা লোকমান, ৬ আয়াত
এই আয়াত গানবাজনা নিষেধ উপলক্ষে অবতীর্ণ হয়েছে। হজরত ইবনে আব্বাস রা. এর ছাত্র শ্রেষ্ঠ তাবেয়ী হজরত মুজাহিদ র. বলেছেন ‘বাক্যের ক্রীড়া অর্থ কিস্সাকাহিনী অর্থাৎ সঙ্গীত'। তাফসীরে মাদারেকে আছে, বাক্যের ক্রীড়া অর্থ কল্পকথা এবং সঙ্গীত। হজরত ইবনে আব্বাস রা. এবং হজরত ইবনে মাসউদ রা. সাহাবীদ্বয় শপথ করে বলতেন, এর অর্থ সঙ্গীত। মুজাহিদ র. বলেছেন, আল্লাহ্তায়ালার ফরমান ‘যারা মিথ্যার মজলিশে হাজির হয় না' অর্থাৎ গানের জলসায় উপস্থিত হয় না'। ইমাম আবুল মনসুর মাতুরিদি র. থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেছেন ‘যে ব্যক্তি আমাদের এ যুগের কোরআন পাঠকারীকে বলে ‘সুন্দর আবৃত্তি করলো’– সে কাফের হবে এবং তার স্ত্রী তালাকে বায়েন হবে। তার সকল সৎকাজ ও সওয়াব আল্লাহ্তায়ালা ধ্বংস করবেন।
ইমাম আবু নসর দবুছী র. কাজী জহিরউদ্দিন খাওয়ারজামী র. থেকে বর্ণনা করেছেন ‘যে ব্যক্তি গায়কদের নিকট থেকে গান শুনবে, কিংবা কোনো হারাম কাজ দেখে সন্তোষ প্রকাশ করবে- একাজ সে বিশ্বাসের সঙ্গে করুক অথবা অবিশ্বাসের সঙ্গে, মোরতাদ হয়ে যাবে। কারণ, সে শরিয়তের হুকুমকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করলো। শরিয়তের হুকুম বাতিলকারী মুজতাহিদ ইমামগণের মতে ইমানদার থাকে না। এদের ইবাদত আল্লাহ্পাক কবুল করেন না এবং এদের সকল সৎকাজকে আল্লাহ্তায়ালা ধ্বংস করে দেন। আল্লাহ্পাক রক্ষা করুন। সঙ্গীত হারাম ও অবৈধ। এ বিষয়ে কোরআন মজীদ, হাদিস শরীফের গ্রন্থাবলী এবং ফেকাহর পুস্তকসমূহে এত বেশী বিবরণ রয়েছে যে, তা অপসারিত করা কঠিন। এতদসত্ত্বেও যদি কোনো ব্যক্তি মনসুখ বা পরিত্যক্ত হাদিস কিংবা সাজ বা কদাচিৎ বর্ণিত রেওয়ায়েতকে সঙ্গীত বৈধ করার পক্ষে বর্ণনা করে, তবে তা ধর্তব্যই নয় । কেননা, কোনো ফেকাহবিদ ইমাম কোনো যুগেই সঙ্গীতকে মোবাহ বা বিধেয় বলে অভিমত ব্যক্ত করেননি এবং নৃত্য ও পদক্রীড়া জায়েয রাখেননি । ইমাম জিয়াউদ্দিন শামী র. এর ‘মুলতাকাত’ পুস্তকে এরকম বলা হয়েছে ।
সুফীগণের আমল হালাল হারাম প্রতিপন্ন করার ক্ষেত্রে দলিল নয়। এইমাত্র যে, আমরা তাঁদেরকে তাঁদের আত্মিক অবস্থার প্রাবল্যের (মাগলুবুল হাল) কারণে তাঁদেরকে মাজুর বা অক্ষম বলে জানি, তাঁদেরকে ভর্ৎসনা করা থেকে বিরত থাকি এবং তাঁদের শেষ অবস্থা আল্লাহ্তায়ালার প্রতি সোপর্দ করি। এ সকল ক্ষেত্রে ইমাম আবু হানিফা র., ইমাম আবু ইউসুফ র. এবং ইমাম মোহাম্মদ র. এর কথার মূল্য আছে। কিন্তু স্বনামধন্য সুফী হওয়া সত্ত্বেও শায়েখ আবু বকর শিবলী র. অথবা শায়েখ আবুল হাসান নূরী র. এর কাজ এক্ষেত্রে মূল্যবান নয়। এ যুগের অপক্ক সুফীরা নিজ পীরদের কাজকে উপলক্ষ করে নাচ গানকে ইবাদততুল্য করে নিয়েছে। কালাম মজীদের বর্ণনা এ অবস্থারই ইঙ্গিত— ‘উহারাই ওই ব্যক্তি, যারা ক্রীড়া-কৌতুককে নিজেদের ধর্ম করে নিয়েছে'। সূরা আনআম, ৭০ আয়াত ।
পূর্ববর্তী বর্ণনাসমূহ থেকে জানা গেলো যে, যে ব্যক্তি হারাম কাজকে উত্তম জানে, সে ইসলামের গণ্ডি থেকে বের হয়ে যায় এবং ‘মোরতাদ' এ পরিণত হয়। অতএব, চিন্তা করে দেখা দরকার যে, নৃত্যসঙ্গীতের মজলিশের সম্মান করা এবং তাকে আবার উপাসনাতুল্য জানা কিরূপ কদর্য এবং দূষণীয় কাজ। আল্লাহ্তায়ালার অনুগ্রহ যে, আমাদের পীরানে কেরাম (রহমাতুল্লাহি আলাইহিম) এরকম কাজে লিপ্ত নন এবং আমরা যাঁরা তাঁদের অনুসরণকারী, তাঁরাও এ ব্যাপারে মুক্ত।
আলহামদুলিল্লাহি আলা জালিক। সকল প্রকার উৎকৃষ্ট দরূদ ও সালাম বর্ষিত হোক রসুলশ্রেষ্ঠ হজরত মোহাম্মদ মোস্তফা আহমদ মুজতবা সল্লাল্লহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি । তাঁর নবী ভ্রাতৃবৃন্দের প্রতি। তাঁর সম্মানিত সহচরবৃন্দ, পবিত্র বংশধর, পরিবার-পরিজন এবং তাঁর একনিষ্ঠ অনুসরণকারী আউলিয়া সম্প্রদায়ের প্রতি । আল্লাহুম্মা আমিন ।
বহুদিন থেকে অন্তরে একান্ত ইচ্ছা ছিলো যে, একমাত্র উদ্ধারপ্রাপ্ত দল আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের অটুট, অকাট্য এবং অক্ষয় আকিদা বিশ্বাস সমকালীন সহজ ভাষায় পুস্তকাকারে লিপিবদ্ধ করি। আল্লাহ্পাক নগণ্যাতিনগণ্য এই অযোগ্য ফকিরের ইচ্ছা আজ ফলবতী করলেন। ‘ইসলামী বিশ্বাস’ রচনার কাজ আজ শেষ হলো। আল্লাহ্পাক গ্রন্থকারের সিলসিলার সকল পীরানে কেরামের মতো তাঁকে এবং তাঁর কওমের সকল অধিবাসীকে আহলে সুন্নত জামাতের আকিদা বিশ্বাসের উপর অটল রাখুন এবং কাদিয়ানি, মওদুদী, ওহাবী, শিয়া, বাহাই ইত্যাদি গোমরাহ ফেরকাদের নিশ্চিহ্ন করে দিন । আমিন ।
পূর্ববর্তী পেইজ | পরবর্তী পেইজ |
(৩২) এখলাছঃ তরিকা প্রসঙ্গ | |
সূচীপত্র | এরকম আরো পেইজ |