ইমান বাড়ে কমে কি না এ ব্যাপারে আলেমগণের মধ্যে মতভেদ আছে। ইমামে আজম র. বলেন, “ইমান বাড়েও না। কমেও না'। ইমাম শাফী র. বলেন ‘ইমান বাড়ে এবং কমে'। ব্যাপারটি নিঃসন্দেহ যে, কলব বা অন্তরের দৃঢ় বিশ্বাসকে ইমান বলা হয়, যাতে বাড়া-কমার কোনো অবকাশই নেই। যা বাড়ে কমে তা প্রকৃতপক্ষে জন্ন বা সন্দেহ। সন্দেহ তো ইমানবিরোধী বিষয় ।
সৎআমল ইমানকে নির্মল ও নূরানী করে। আর অসৎ আমল ইমনাকে করে অপরিচ্ছন্ন। অতএব পরিষ্কৃতি ও নির্মলতার দিক দিয়ে ইমান বাড়ে অথবা কমে- একথা অবশ্য বলা যেতে পারে। কিন্তু অস্তিত্বগতভাবে বাড়ে কমে না। অনুজ্জ্বল ইমান অপেক্ষা উজ্জ্বল ইমান বড়ো— এরকম কথা কেউ কেউ বলে থাকেন । আবার কেউ অনুজ্জ্বল, অপরিচ্ছন্ন ইমানকে ইমান বলেই গণ্য করেন না। তাঁরা নূরানী একিনকে প্রকৃত একিন বলেন এবং অস্বচ্ছ ইমানকে অপূর্ণ ধারণা করে থাকেন। এঁদের মধ্যে আবার যাঁরা তীক্ষ্ণদৃষ্টিসম্পন্ন তাঁরা দেখলেন, এই কমবেশী হওয়া একিনের গুণাবলীর তারতম্য মাত্র। নিছক একিনের মধ্যে ন্যূনাধিক্য হওয়া নয় । তাই তাঁরা ‘একিন বাড়ে না, কিন্তু অপূর্ণ’ একথা বলে থাকেন। যেমন স্বচ্ছতার তারতম্যবিশিষ্ট দু'টি সমআকারের আয়না দেখে কেউ বললো ‘উজ্জ্বল ও পরিচ্ছন্ন আয়নাটি অপরিষ্কার আয়নাটি থেকে বড়ো'। আবার কেউ বললো ‘আয়না দু’টি আকার আয়তনে বড় ছোটো নয়। তবে এদের স্বচ্ছতার মধ্যে কম বেশী আছে'। এক্ষেত্রে দ্বিতীয় ব্যক্তির লক্ষ্য ও বক্তব্যই অধিকতর সঠিক বলা যাবে। প্রথম ব্যক্তির লক্ষ্য আকৃতির প্রতি । প্রকৃত তত্ত্বের প্রতি নয় ।
আল্লাহ্পাক এরশাদ করেছেন—
‘তোমাদের মধ্যে যারা ইমান এনেছে এবং এলেম প্রাপ্ত হয়েছে, তাদের মর্যাদাসমূহকে আল্লাহ্তায়ালা উচ্চ করে থাকেন' ।
হজরত মোজাদ্দেদে আলফে সানি র. বলেন ‘এই ফকির যে সমাধান প্রকাশ করতে সক্ষম হলেন, তার দ্বারা ‘ইমান বাড়ে কমে না' মতাবলম্বীদের বিরুদ্ধবাদীদের অভিযোগ খণ্ডন করা হয়েছে। সাধারণ মুমিনের ইমান পয়গম্বর আ.গণের ইমানের মতো নয়। কেননা, তাদের বিশ্বাস কমবেশী তমসাচ্ছাদিত। পয়গম্বর আ.গণের ইমান পূর্ণ নূরানী এবং বহুগুণ বেশী ফলদায়ক। ‘হজরত আবু বকর সিদ্দীক রা. এর ইমান এই উম্মতের সকলের ইমান অপেক্ষা ওজনে বেশী –এই হাদিসের অর্থও এভাবে বুঝতে হবে যে, এই বেশী হওয়ার অর্থ উজ্জ্বলতা, স্বচ্ছতা এবং পূর্ণতা গুণের দিক থেকে বেশী হওয়া। পয়গম্বর আ. মানুষ হিসাবে সাধারণ মানুষের মতো। উভয়ের বাহ্যিক এবং অভ্যন্তরীণ অঙ্গ-প্রতঙ্গ সবই এক। কিন্তু কামালিয়াত ও ফযীলতের দিক দিয়ে পয়গম্বরগণই শ্রেষ্ঠ । বরং অন্যান্য মানুষ যেনো তাঁদের তুলনায় কিছুই নয়। অথচ মানুষ হিসাবে আকার আয়তনের দিক থেকে সবাই এক । সুতরাং একথা বলা যাবে না যে, মানুষ হওয়ার মধ্যে কমবেশী হয় । আল্লাহ্তায়ালাই প্রকৃত তত্ত্ব অবগত ।
অনেকে এরকমও বলে থাকেন যে, ‘তাসদীক্ব' বা বিশ্বাসের অর্থ তর্কশাস্ত্রের পারিভাষিক ‘তাসদীক্ব'- যার মধ্যে বিশ্বাস ও সন্দেহ দু'টোই থাকতে পারে । অতএব, প্রকৃত ইমানের মধ্যেই কমবেশী হওয়ার অবকাশ আছে। কিন্তু প্রকৃত ব্যাপার এই যে, ‘তাসদীক্ব' শব্দের অর্থ একিন বা কলবের দৃঢ় বিশ্বাস। সাধারণ অর্থে যেখানে ‘সন্দেহ' শামিল থাকে, তা নয় ৷
ইমামে আজম র. বলেছেন ‘আনাল হক মুমিন-আমি সত্য ইমানদার'। আর ইমাম শাফী র. বলেন, “ইনশাআল্লাহ্ আমি মুমিন'। উভয় বাক্যের মধ্যে শব্দগত তারতম্য থাকলেও উদ্দেশ্য এক। প্রথম বাক্য বর্তমান ইমানজ্ঞাপক । দ্বিতীয় মত ইমানের শেষ অবস্থার অনুকূল। তবে বাহ্যত ‘ইনশাআল্লাহ্’ (যদি আল্লাহ্ চান) শব্দ পরিত্যাগ করাই শ্রেয়। কারণ ইমান তার নিঃসন্দিগ্ধ স্বীকৃতি চায় ।
আমল ইমানের অংশ নয় । এটাই আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের বিশ্বাস। শুধু জানা বা চেনার নামও ইমান নয়। যেমন মদীনার ইহুদীরা রসুলে আকরম স.কে জানতো, চিনতো। কিন্তু বিশ্বাস করতো না । আল্লাহ্পাক এরশাদ করেছেন-
‘তারা নবীকে এমনভাবে চিনে, যে রকম চিনে তাদের সন্তানকে’।
সূরা আনআম, ২০ আয়াত
শায়েখ আবদুল হক দেহলভী র. বলেন ‘আমল ব্যতীত ইমান অসম্পূর্ণ থাকে । কিন্তু প্রকৃত ইমানতো অন্তরের বিশ্বাসই। ইমান ওই বৃক্ষের মতো যার কাণ্ড বিশ্বাস এবং আমল-আনুগত্য ফুল ও ফসল। যে গাছে পত্রপল্লব-ডালপালা নেই প্রকৃতপক্ষে তাকে পূর্ণ বৃক্ষ বলা যায় না। সুতরাং পূর্ণাঙ্গ ইমান ওটাই, যা নেক আমলের পত্রপুষ্প দ্বারা সজ্জিত থাকে। বেআমল ব্যক্তি অসম্পূর্ণ ইমানের অধিকারী। তবুও অসম্পূর্ণ ইমানকে ইমানই বলতে হবে। কোরআনুল করীমের বহু স্থানে ইমান ও আমলকে ভিন্ন ভিন্নভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন এরশাদ হয়েছে—
‘যারা ইমান এনেছে এবং নেক আমল করে'
সূরা আসর, ২ আয়াত
এই আয়াতের মাধ্যমে একথা পরিষ্কার যে, মূল ইমান হচ্ছে অন্তরের অটল বিশ্বাস । আর নেক আমল অন্য জিনিস ।
পূর্ববর্তী পেইজ | পরবর্তী পেইজ |
(২৪) দোজখের শাস্তি | (২৬) আউলিয়াগণের কারামত |
সূচীপত্র | এরকম আরো পেইজ |