চিরস্থায়ী দোজখের অগ্নিবাস কুফরের প্রতিফল। কোনো ব্যক্তি ইমান অন্তরে রাখা সত্ত্বেও যদি কুফরী রীতিনীতি প্রতিপালন করে এবং কাফের মুশরিকদের ব্রতাচার ইত্যাদির সম্মান করে, আলেমগণ তাকে মুরতাদ বা পথভ্রষ্ট বলে গণ্য করেন। আলেমগণের এই ফতোয়া অনুযায়ী তাদের চিরস্থায়ী আজাব হওয়া উচিত। অথচ সহি হাদিসে এসেছে ‘যার অন্তরে রাই সরিষা পরিমাণ ইমান থাকবে, সে দোজখ থেকে মুক্তি পাবে। তার চিরস্থায়ী আজাব হবে না' ।
এরূপ জটিলতার সমাধান এই যে, আল্লাহ্ না করুন ওই ব্যক্তি যদি নিছক কাফের হয়, তবে তার জন্য চিরস্থায়ী আজাব অবশ্যম্ভাবী। কিন্তু বিধর্মীদের নিয়মাবলী বাহ্যিকভাবে পালন করা সত্ত্বেও যদি সামান্য পরিমাণ ইমান তার অন্তরে থাকে, তবে সে দোজখের শাস্তি ভোগ করা সত্ত্বেও কোনো এক সময়ে পরিত্রাণ লাভ করবে। এই পরিত্রাণ হবে তার ওই অনুপরিমাণ ইমানের বরকতেই ।
হজরত মোজাদ্দেদে আলফে সানি র. বলেন ‘এই ফকির একদিন এক পীড়িত ব্যক্তিকে দেখতে গিয়েছিলেন। সে ছিলো মৃত্যুপথযাত্রী। আমি তার আত্মিক অবস্থার দিকে লক্ষ্য করে দেখলাম, তার কলব খুবই অন্ধকারাচ্ছাদিত। অন্ধকার দূর করবার জন্য আত্মিক তাওয়াজ্জোহ্ নিক্ষেপ করলাম। কিন্তু কোনো ফল হলো না। পরে বুঝলাম, এই অন্ধকার কুফরের অন্ধকার। কুফর এবং কাফেরদের সঙ্গে বন্ধুত্বের কারণেই এই কঠিন অন্ধকার জমা হয়েছে তার কলবে। এই অন্ধকার তাওয়াজ্জোহতে দূর হবে না। এই তমসামুক্তির জন্য তার অগ্নিবাস নিশ্চিত। তবে আমি এটাও জানতে পারলাম যে, এই কঠিন অন্ধকারের মধ্যেও তার অন্তরে অণু পরিমাণ ইমান আছে, যার বরকতে অবশেষে সে নাজাত লাভ করবে। এরকম অবস্থা দেখে ভাবলাম, এ ব্যক্তির জানাজার নামাজে শামিল হবো কিনা। কিন্তু সাথে সাথেই বুঝলাম, জানাজা পড়তে হবে। বুঝলাম, যে মুসলমান ইমান রাখা সত্ত্বেও বিধর্মী কাফেরদের রীতিনীতি প্রতিপালন করে এবং তাদের নির্দিষ্ট দিনসমূহের সম্মান করে, তার জানাজা পড়তে হবে। যেরূপ ইদানীং প্রচলিত, সেরকমভাবে তাদেরকে কাফেরদের অন্তর্ভুক্ত মনে করা চলবে না। আশান্বিত হয়ে থাকতে হবে যে, ওই সামান্যতম ইমানের বরকতে আল্লাহ্পাক তাকে চিরস্থায়ী দোজখের আযাব থেকে মুক্তিদান করবেন । সুতরাং জানা গেলো, কাফেরদের জন্য ক্ষমা নেই ।
আল্লাহ্পাক এরশাদ করেছেন-
‘নিশ্চয় আল্লাহ্পাক শিরিককারীকে ক্ষমা করবেন না' ।
সূরা নিসা, ৪৮ আয়াত
নিছক কাফের হলে চিরস্থায়ী আজাব। আর অতি সামান্য ইমান থাকলেও একসময় দোজখমুক্তি। - এরকমই বিশ্বাস রাখতে হবে। আর অন্যান্য কবীরা গোনাহ্ আল্লাহ্পাক ইচ্ছা করলে ক্ষমাও করতে পারেন, ইচ্ছা করলে সাময়িক আজাবও দিতে পারেন। এই ফকিরের নিকট দোজখের আজাব সাময়িক হোক কিংবা স্থায়ী, কুফরের রীতিনীতির জন্য বিশিষ্ট ।
যে কবীরা গোনাহকারীরা তওবা করেনি, শাফায়াত বা আল্লাহ্তায়ালার অনুগ্রহপ্রাপ্ত হয়নি, যাদের পাপ পার্থিব কষ্টবিপদ কিংবা মৃত্যুকষ্ট দ্বারা সংশোধিত হয়নি, আশা করা যায় তাদের কাউকে কাউকে হয়তো আল্লাহ্পাক কেবল কবরের আজাব দিয়েই ক্ষান্ত হবেন। কাউকে কবর আজাবসহ কিয়ামতের কষ্ট, পেরেশানি ও আতংক দ্বারা গোনাহর ক্ষতিপূরণ করে দিবেন। এরকম কোনো গোনাহ্ অবশিষ্ট রাখবেন না, যাতে অগ্নিকুণ্ডে প্রবেশ করতে হয়।
আল্লাহ্তায়ালা এরশাদ করেছেন—
‘যারা ইমান এনেছে এবং যাদের ইমান জুলুম বা কুফরের সঙ্গে মিশ্রিত হয় নি, তাদের জন্যই শান্তি' ।
সূরা আনআম, ৮২ আয়াত
আল্লাহ্পাকই সকল বিষয়ের প্রকৃত তত্ত্ব অবগত ।
যদি কেউ বলে, কুফর ব্যতীত অন্যান্য গোনাহর জন্যও তো দোজখের আজাবের নির্দেশ এসেছে । যেমন আল্লাহ্তায়ালা এরশাদ করেছেন-
“যে ব্যক্তি কোনো মুমিনকে ইচ্ছা পূর্বক হত্যা করবে, তার শাস্তি জাহান্নাম । চিরদিন সে সেখানে অবস্থান করবে' ।
সূরা নিসা, ৯৩ আয়াত
হাদিস শরীফে এসেছে, যে ব্যক্তি ইচ্ছা করে এক ওয়াক্ত নামাজ কাজা করবে, সে এক হোকবা বা আশি বছর দোজখের শাস্তি ভোগ করবে। এতে করে বোঝা যায় কেবল কাফেরদের জন্য দোজখের শাস্তি নির্দিষ্ট নয়। — এর সমাধান এই যে, মুমিন ব্যক্তিকে ইচ্ছাপূর্বক হত্যা করার অর্থ হত্যাকাণ্ডকে হালাল মনে করা। হারামকে হালাল যে মনে করে সে কাফের, যেমন তাফসীরকারগণ লিখেছেন। কুফর ছাড়া অন্যান্য যে সকল গোনার শাস্তির জন্য দোজখ নির্ধারিত হয়েছে, সে সকল গোনাহ্ কুফরের সংমিশ্রণশূন্য নয়। যেমন, গোনাহকে সামান্য অপরাধ মনে করা, অবাধে ও নির্ভয়ে গোনাহ্ করা এবং শরিয়তের আদেশ-নিষেধকে তুচ্ছ জানা।
হাদিস শরীফে এসেছে ‘আমার শাফায়াত আমার উম্মতের কবীরা গোনাকারীদের জন্য'। আরো এসেছে ‘আমার উম্মত রহমতপ্রাপ্ত উম্মত। পরকালে তাদের জন্য কোনো শাস্তি নেই' ।
পূর্ববর্তী পেইজ | পরবর্তী পেইজ |
(২৩) ইমানের বিবরণ | (২৫) ইমান বাড়ে কমে কি না |
সূচীপত্র | এরকম আরো পেইজ |