হযরত সৈয়দা যয়নাব (রাঃ) যখন ঘোড়ার কান্না ও চিৎকার শুনলেন, তখন তিনি হযরত সখিনা (রাঃ)কে ডেকে বললেন, বেটি! একটু দাঁড়াও, আমি বের হয়ে দেখে আসি, সম্ভবতঃ তোমার আব্বা এসেছেন। মজলুম বোন বের হয়ে দেখলেন, ঘোড়ার জীন খালি এবং ঘোড়ার কপাল রক্তে রঞ্জিত। তা দেখে হযরত যয়নাব (রাঃ) বুঝতে পারলেন, হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) শাহাদাত বরণ করেছেন এবং তিনি চিৎকার দিয়ে বলে উঠলেন-
واه حسينا ‘ওয়াহ্ হুসাইনা’ واه غريبا ‘ওয়াহ্ গরীবা।’
তাঁর এ আওয়াজ শুনার সাথে সাথে তাঁবুর অভ্যন্তরে ক্রন্দনের রোল পড়ে গেলো। হযরত যয়নাব (রাঃ) ডাক দিয়ে বললেন, শহরবানু! সখিনাকে থামিয়ে রেখ, আমি ভাইয়ের খবর নিতে যাচ্ছি। হযরত ফাতিমাতুয্ যাহরা (রাঃ)এর কন্যা হযরত যয়নাব (রাঃ), যার মাথার ওড়নাও কোন অপরিচিত ব্যক্তি কখনো দেখেনি, যিনি ঘরের চৌহদ্দি থেকে কখনো বের হননি, আজ পরদেশে অসহায় অবস্থায় মুখের উপর পর্দা ফেলে ভাইয়ের লাশকে দেখার জন্য কারবালার ময়দানের দিকে ছুটে চললেন। যেতে যেতে তিনি বলতে লাগলেন,
'ওহে যালিমেরা! পথ ছেড়ে দাও, আমার ভাইকে দেখতে দাও।’
ওরা বলল, তুমি ওকে কি দেখবে ? ওর মাথা শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়েছে।
হযরত সৈয়দা যয়নাব (রাঃ) গিয়ে ভাইয়ের লাশকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলেন, আর বলতে লাগলেন, ভাইজান! তুমিতো আমাদেরকে যালিমদের হাওলা করে চলে গেলে।
আল্লাহ্ ! আল্লাহ্ !হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) এর নিস্প্রাণ দেহ মুবারক কারবালার যমীনে পড়ে রইল। যেসব লোকেরা হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) এর লাশ দাফন করেছিলেন, তারা বলেছেন যে, হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) এর শরীরে চৌঁত্রিশটি বর্শার ছিদ্র , চল্লিশটা তলোয়ারের আঘাত এবং একশত একুশটি তীরের জখম ছিল। হযরত সৈয়দ যয়নাব (রাঃ) নিজের ভাইয়ের লাশ মুবারকের পাশে বিভোর হয়ে পড়ে রইলেন; এদিকে হযরত সৈয়দা সখিনা (রাঃ), হযরত সৈয়দা শহরবানু (রাঃ) থেকে নিজেকে মুক্ত করে কারবালার ময়দানের দিকে অঝোর নয়নে ক্রন্দনরত অবস্থায় ছুটে গেল এবং চিৎকার করে বলতে লাগলো, ফুফু! তুমি কোথায়? আব্বু আমার কোথায়? আওয়াজ শুনে ফুফু ডাক দিলেন, বেটি! এদিকে এসো, তোমার মজলুম ফুফু তোমার আব্বুর পাশে বসে আছে। হযরত সৈয়দা সখিনা (রাঃ) যখন নিজের আব্বাজানকে দেখলো, চিনতে পারলো না। কারণ তাঁর (রাঃ) সমস্ত শরীর মুবারক রক্তে রঞ্জিত ছিল এবং মস্তক মুবারক শরীর থেকে বিছিন্ন ছিল। মা’ছুমা সখিনা আব্বাজানের লাশের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে বেহুঁশ হয়ে গেল। হযরত সৈয়দা যয়নাব (রাঃ) হযরত সখিনার হাত টেনে ধরে বলল, মা সখিনা! ওঠ, আমি তোমাকে তাঁবুতে দিয়ে আসি। আমার ভাই, আমাকে বলেগেছেন যে, তোমাকে সান্ত্বনা দেয়ার জন্য। উনি জোর করে হযরত সখিনাকে হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) এর বুক থেকে ছাড়িয়ে তাঁবুতে নিয়ে গেলেন। আল্লাহ! আল্লাহ! হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) ও তাঁর অন্যান্য সঙ্গী সাথীদের লাশ কারবালার ময়দানে পড়ে রইলো। ইয়াজিদী বাহিনী তাদের লোকদের লাশগুলো খুঁজে খুঁজে দাফন করলো । কিন্তু হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) ও আহলে বায়তের লাশ যেভাবে ছিল, সে ভাবেই পড়ে রইল । আল্লাহ! আল্লাহ! এরা এক রাত সেখানে অবস্থান করলো । পরের দিন তাদের চলে যাওয়ার কথা । ইয়াযীদী বাহিনীরা, যারা ভ্রান্ত ধারণার বশবর্তী হয়ে মনে করেছিল তারা বিজয়ী হয়েছে, বাস্তবে তাদের এমন পরাজয়ই হয়েছে যা আর কারো হয়নি। যাক, যখন তারা শুয়ে পড়ল, হযরত সৈয়দা যয়নাব (রাঃ) মুখে পর্দা ফেলে তাঁবু থেকে পুনরায় বের হলেন। দেখলেন, হযরত ফাতিমাতুয যাহরা (রাঃ) এর বাগানের জান্নাতী ফুল কারবালার প্রান্তরে পড়ে রয়েছেন। নবী পাক (ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)এর নয়নের মণি চকমক করছে। হযরত যয়নাব (রাঃ) এক পলক সকল প্রিয়জনকে দেখলেন। ছবর ও ধৈর্যে অটল থাকা সত্ত্বেও অঝোরে কাঁদতে লাগলেন। কাঁদতে কাঁদতে এক এক জনকে দেখে দেখে শেষে ভাইয়ের দেহ মুবারকের পাশে আসলেন এবং বসে পড়ে বললেন,
‘ওগো আমার ভাইয়া ! আমি অসহায়, অপারগ, ভিন-দেশের মুসাফির। মদীনা মুনাওওয়ারা অনেক দূর। আমি কিভাবে ওখানে তোমার খবর পৌঁছাবো? আমি কিভাবে তোমার দাফন করবো?’ আহ! হযরত ফাতেমাতুয যুহরা (রাঃ) এর কলিজার টুকরা, নবী করিম (সঃ) এর আদরের দৌহিত্র কারবালার প্রান্তরে বেওয়ারীশের মত পড়ে রইল ।
হযরত সৈয়দা যয়নাব (রাঃ) মদীনার দিকে মুখ করে ক্রন্দনরত অবস্থায় হাত তুলে বলতে লাগলেন,
ইয়া রসূলাল্লাহ (ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! আপনার দৌহিত্র হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) কাফন ও দাফন বিহীন রক্তে রঞ্জিত অবস্থায় পড়ে রয়েছেন।
আর এদিকে রুগ্ন হযরত যাইনুল আবিদীন (রাঃ) হাত তুলে বলছেন-
للعالـمين- ادركنى زين العابدين يارحمة
ইয়া রহমতাল্লিল আলামীন! আদরিকী যাইনাল আবিদীন’
অর্থাৎ ‘হে রহমাতুল্লিল আলামীন (ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! আমার উপর রহম করুন।’
আল্লাহ্ ! আল্লাহ ! এভাবে রাত্রি অতিবাহিত করলেন। উলামায়ে কিরাম লিখেছেন যে, ‘হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) এর শাহাদাতের সময় সূর্যগ্রহণ হয়েছিল, আসমান ঘোর অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল, ফলে দিনে তারকারাজি দৃষ্টিগোচর হয়েছিল। কিছুক্ষণ পর আকাশ কালো থেকে লাল বর্ণে পরিণত হয়েছিল এবং আসমান থেকে রক্ত বর্ষিত হয়েছিল। সাতদিন পর্যন্ত এ রক্ত বর্ষণ অব্যাহত ছিল। সমস্ত ঘর বাড়ির দেয়াল রক্তে লাল হয়ে গিয়েছিল এবং যেসব কাপড়ের উপর রক্ত পতিত হয়েছিল, সেসব কাপড় ছিড়ে টুকরো টুকরো হওয়ার পরও সেই রক্তের লালিমা যায়নি। যমীনও কান্নাকাটি করেছিল। বায়তুল মুকাদ্দাসে যে পাথরটা উঠানো হতো, সেই পাথরের নিচ থেকে তাজা রক্ত বের হতো। পানি ভর্তি কলস রক্তে লাল হয়ে গিয়েছিল। ইয়াযীদী বাহিনীরা যখন উট যবেহ করেছিল তখন সে উটের ভিতর থেকে রক্তের পরিবর্তে আগুনের লেলিহান শিখা বের হয়েছিল। জিনদের মধ্যেও শোক-বেদনা ছড়িয়ে পড়েছিল। এক অদ্ভুত ও বিস্ময়কর অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল। অনেক দূর্লভ, লোমহর্ষক ঘটনার কথা আমরা শুনেছি। কিন্তু হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) এর শাহাদাতের ঘটনা অতুলনীয় । এর নকশা চোখের সামনে ভেসে উঠলে মন-প্রাণ শিউরে ওঠে।
পূর্ববর্তী পেইজ | পরবর্তী পেইজ |
(২৪) হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) এর বীর বিক্রম আক্রমণ | (২৬) হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) এর শাহাদাত |
সূচীপত্র | এরকম আরো পেইজ |