হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) হযরত আব্বাস (রাঃ)-এর শহীদী দেহ মুবারকের কাছ থেকে ফিরে এসে দেখেন, তাঁর আঠারো বছরের ছেলে হযরত আলী আকবর (রাঃ) যিনি আপাদমস্তক প্রিয় নবী (সঃ) এর প্রতিচ্ছবি ছিলেন, তিনি যুদ্ধে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে আছেন এবং হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ)কে বললেন, আব্বাজান! আমাকেও বিদায় দিন। আমি চাই না, আপনার পর জীবিত থাকতে। হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) বললেন, বেটা শোন! তুমিতো মুস্তাফা (সঃ) এরই প্রতিচ্ছবি । তোমাকে যখন কেউ দেখে, দিলের তৃষ্ণা মিটে যায়। তুমিতো আমার নানাজান (সঃ)এরই প্রতিচ্ছবি । তোমাকে দেখলেই আমার নানাজান (সঃ)এর আকৃতি সামনে ভেসে ওঠে। তোমাকে যদি আজ বিদায় দিই, আমাদের ঘর থেকে আমার নানাজান (সঃ)এর প্রতিচ্ছবি চলে যাবে। বাবা! তুমি যেয়ো না। ওরা আমারই রক্তের পিপাসু। আমার রক্তের দ্বারাই ওদের পিপাসা নিবারণ হবে। কিন্তু হযরত আলী আকবর (রাঃ) বললেন, আব্বাজান! আমিও ওখানে যেতে চাই যেখানে আমার ভাই ক্বাসিম গেছেন, যেখানে আমার চাচাজান গেছেন। আমি কাপুরুষের মত পিছনে পড়ে থাকতে চাই না। আমিও জান্নাতুল ফিরদাউসে গিয়ে তৃষ্ণা নিবারণের জন্য ব্যাকুল। আমাকেও আপনার হাতে বিদায় দিয়ে জান্নাতুল ফিরদাউসে পৌঁছে দিন। আমাকে যালিমদের হাতে সোপর্দ করে যাবেন না। হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) বাধ্য হয়ে তাঁর আঠারো বছরের ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন এবং বিদায় দিলেন।
হযরত আলী আকবর (রাঃ) রওয়ানা হলেন। আল্লাহু ! আল্লাহ ! ইনি কে যাচ্ছেন? মুস্তাফা (সঃ) এর প্রতিচ্ছবি যাচ্ছেন । হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) এর জানের জান যাচ্ছেন। হযরত ফাতিমাতুয্ যাহরা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা-এর বাগানের ফুল যাচ্ছেন। ইনি হুযূর (সঃ)এর বাগানের ফুলের কলি যাচ্ছেন। হযরত আলী আকবর যেতে যেতে এটা পড়তে ছিলেন-
انا على بن الحسين بن على + نحن اهل البيت اولى بالنبى.
‘আনা আলিই-ইব্নুল হুসাইনিব্নু আলিইয়ি-নাহ্নু আহ্্লুল বাইতি আওলা বিন্নাবিইয়ি’
অর্থাৎ- ‘আমি আলী আকবর, হযরত হুসাইন (রাঃ)এর বেটা, যে হুসাইন (রাঃ) হযরত আলী মর্তুজা (রাঃ)এর বংশধর। আমরাই হলাম আহলে বাইত, রসূলে খোদা (সঃ)এর সবচেয়ে প্রিয় বংশধর।’
এ ‘শে’র’ পড়তে পড়তে ইমাম আলী আকবর সামনে অগ্রসর হলেন এবং ইয়াযীদী বাহিনীর সামনে গিয়ে বললেন, আমার দিকে লক্ষ্য করো! আমি ইমাম হুসাইন (রাঃ)এর সন্তান। আলী আকবর আমার নাম। হে নবী পাক (সঃ)এর ঘরকে উজাড়কারী! হযরত ফাতিমাতুয্ যাহ্রা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা-এর বাগানের ফুল ও কলিসমূহকে কারবালার উত্তপ্ত বালিতে ছিন্ন-ভিন্নকারীরা! আমার রক্ত দ্বারাও তোমাদের হাতকে রঞ্জিত করো, আমার প্রতিও তীর নিক্ষেপ করো।’ হযরত ইমাম আলী আকবর (রাঃ) বলছেন, যালিমদের সাহস নেই, এ নওজোয়ানের প্রতি তীর নিক্ষেপ করার বা তরবারী চালানোর। আমর বিন সাআদ নিজ সৈন্যদেরকে বলল, হে কাপুরুষের দল! তোমাদের কি হলো? সত্ত্বর একেও বর্শায় উঠিয়ে নাও। আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, যে সকলের আগে এ নওজোয়ানকে কতল করতে পারবে, আমি তাকে ‘মোছিল’-এর রাজত্ব প্রদান করবো। এমন কোন ব্যক্তি আছে কি? যে মোছিলের শাসক হতে চায়? মোছিলের রাজত্ব পেতে চায়?
তারিক বিন শিশ্ নামক এক বদবখত্ পালোয়ান ছিল। ওর মনে আমরের কথায় প্রভাব সৃষ্টি করল এবং সে আগে বাড়ল, দেখি ভাগ্যে মোছিলের গভর্নরগিরি আছে কিনা। সে তীর হাতে নিয়ে হযরত ইমাম আলী আকবর (রাঃ)কে লক্ষ্য করে এগিয়ে গেল। হযরত আলী আকবর (রাঃ) দৃঢ় স্তম্ভের মত দাঁড়িয়ে রইলেন। যখনই সে কাছে আসলো, হযরত আলী আকবর ঘোড়াকে ফিরায়ে ওর পিছনে এসে গেলেন এবং এমন জোরে আঘাত হানলেন যে একপলকে ওর মাথাকে শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিলেন।
এই দৃশ্য দেখে ওর ছেলে উমর বিন তারিক রাগে প্রজ্জ্বলিত হয়ে তলোয়ার উচু করে এগিয়ে আসলো। যখন উভয়ের তলোয়ার একটার সাথে আর একটা আঘাতে ঝনঝনিয়ে উঠল, তখন যারা অবলোকন করেছে তারা দেখছিল, ওর লাশ মাটিতে পড়ে ছটফট করছে। দ্বিতীয় পুত্র তল্হা বিন তারেক সেও বাপ-ভাইয়ের খুনের বদলা নেয়ার জন্য অগ্নিশর্মা হয়ে হযরত আলী আকবর (রাঃ)এর উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। হযরত আলী আকবর (রাঃ) একেও জাহান্নামে পাঠিয়ে দিলেন। এ তিনজনকে হত্যা করার পর হযরত ইমাম আলী আকবর (রাঃ) ঘোড়া ফিরিয়ে তাঁর আব্বাজানের খিদমতে হাজির হলেন।
হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) দেখলেন, তাঁর কলিজার টুকরা জিহাদের ময়দান থেকে আসছেন। তিনি এগিয়ে এলেন, এগিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করলেন, বাবা কি খবর! হযরত ইমাম আলী আকবর ঘোড়া থেকে অবতরণ করে আব্বাজানের কাছে আরজি পেশ করলেন। আব্বাজান! তৃষ্ণা খুব কষ্ট দিচ্ছে। খুবই তৃষ্ণা অনুভব করছি। যদি এক গ্লাস পানি পাওয়া যায়, তাহলে এদের সবাইকে জাহান্নামে পাঠিয়ে দিতে পারবো ইনশাআল্লাহ। আব্বাজান! আমি ওদের তিন বদবখত্ যোদ্ধাকে হত্যা করে এসেছি, কিন্তু আমার মুখ শুকিয়ে গেছে, আমার গলাও শুকিয়ে গেছে, আমার নিশ্বাসটাও সহজভাবে আসছে না। আমি খুবই কাহিল হয়ে গেছি।
হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) বললেন, প্রিয় বৎস! ধৈর্য ধারণ কর। কিছুক্ষণের মধ্যেই তুমি জান্নাতুল ফিরদাউসে পৌঁছে যাবে এবং হাউজে কাওছারের পানি দ্বারা তোমার তৃষ্ণা মিটাবে। কিন্তু বাবা! তুমি যখন আমার কাছে এসেছ, এসো, হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন এবং বললেন, মুখ খোল! হযরত আলী আকবর (রাঃ) মুখ খুললেন এবং হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) এর শুষ্ক জিহ্বা মুবারক ছেলের মুখের ভিতর প্রবেশ করিয়ে দিয়ে বললেন, ‘আমার জিহ্বাটা চুষে নাও, হয়তো কিছুটা আরামবোধ করবে। হযরত আলী আকবর (রাঃ) এর আব্বাজানের জিহ্বা চুষতে লাগলেন। জিহ্বা চুষে কিছুটা আরামবোধ করলেন।
এরপর হযরত ইমাম আলী আকবর (রাঃ) পুনরায় জিহাদের ময়দানের দিকে এগিয়ে গেলেন। হযরত ইমাম আলী আকবর (রাঃ) জিহাদের ময়দানে প্রমাণ করে দিয়েছেন, তিনি শেরে খোদার দৌহিত্র। তাঁর শিরা-উপশিরায় হযরত আলী মর্তূজা (রাঃ)এর রক্ত রয়েছে এবং তাঁর চোখে হযরত আলী মর্তূজা (রাঃ) এর শক্তি কাজ করছে। তিনি আশি জন ইয়াযীদী বাহিনীকে হত্যা করে নিজে আঘাতে জর্জরিত হয়ে ঘোড়া থেকে পড়ে গিয়ে শাহাদাত বরণ করার আগ মুহূর্তে ডাক দিয়ে বললেন-
يا ابتاه ادركنى
‘ইয়া আবাতাহ! আদ্রিক্নী’
অর্থাৎ ‘ওহে আব্বাজান! আমাকে ধরুন, আমাকে নিয়ে যান, আপনার আলী আকবর পড়ে যাচ্ছে।'
এ আহবান শুনে হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) দৌঁড়ে যান। তিনি ছেলের কাছে পৌঁছার আগে যালিমরা হযরত আলী আকবর (রাঃ)এর শরীর থেকে মাথা বিচ্ছিন্ন করে ফেললো। জওয়ান ছেলের লাশের পাশে দাঁড়িয়ে তিনি চোখের পানি ফেলছিলেন এবং অশ্রু সজল নয়নে তাঁর (রাঃ) এর জওয়ান ছেলের লাশ কাঁধে উঠিয়ে তাঁবুর পার্শ্বে নিয়ে আসলেন। হযরত আলী আকবর (রাঃ) এর এ শাহাদাতে প্রত্যেকেই দারুণভাবে আঘাত পেলেন। হযরত যয়নাব (রাঃ) তাঁবু থেকে বের হয়ে এসে হযরত ইমাম আলী আকবর (রাঃ) এর লাশ দেখে চিৎকার করে বলে উঠলেন, আহ! যালিমরা প্রিয় নবী (ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)এর প্রতিচ্ছবিকেও শেষ করে দিল। এ জালিমরা প্রিয় নবী করিম (ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)এর চিহ্নকেও নিচিহ্ন করে দিল । নবী করিম (ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)এর প্রতিচ্ছবিকে মাটির সাথে মিশিয়ে দিল ।
পূর্ববর্তী পেইজ | পরবর্তী পেইজ |
(২০) হযরত আব্বাস (রাঃ) এর শাহাদাত | (২২) হযরত আলী আসগর (রাঃ) এর শাহাদাত |
সূচীপত্র | এরকম আরো পেইজ |