এ বিয়ের সময় খাদিজা (রা)-এর বয়স ছিল চল্লিশ আর রাসূলুল্লাহ্ (সা)- এর বয়স ছিল পঁচিশ। ধরবতী, সম্ভ্রান্ত, রুচিশীলা, আত্মমর্যাদাসম্পন্না, সারা মক্কায় বিখ্যাত বিদুষী ও চল্লিশ বছরের প্রায় বিগত যৌবনা মহিলার পক্ষে প্রায় কপর্দকহীন নবীন যুবক হযরতকে বিয়ে করার প্রস্তাব প্রদানের মাঝে অস্বাভাবিকতা রয়েছে বৈকি ! খাদিজা (রা) যেমন ছিলেন সম্ভ্রান্ত ও ধনাঢ্য মহিলা, তেমনি ছিলেন অসাধারণ দূরদৃষ্টিসম্পন্না ও বুদ্ধিমতী।মক্কায় তাঁর প্রভাব-প্রতিপত্তি ছিল অসাধারণ। এরকম একজন মহিলার পক্ষে এ অসম বিবাহের জন্য স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে প্রস্তাব প্রেরণের পিছনে যথার্থ কারণ ছিল। এমন কিছু তিনি জানতে ও বুঝতে পেরেছিলেন, যে কারণে খাদিজা রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর পবিত্র জীবনের সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত করার জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়েছিলেন। সে ব্যাকুলতার মাঝে পবিত্র ও মহত্তমের সাথে মিলিত হওয়ার আকাংক্ষাই ছিল একমাত্র কারণ। অন্য কিছু নয়। তাঁদের বিবাহিত জীবনের দীর্ঘ পঁচিশ বছরের প্রতিটি মুহূর্তই তা প্রামাণ করে। পূর্বেই বলা হয়েছে খাদিজা (রা) প্রচুর ধনৈশ্বর্যের মালিক ছিলেন। এসব ধন-সম্পত্তি তিনি লোকেরা দ্বারা ব্যবসায় খাটাতেন। তাতে তাঁর ধন-দৌলত বেড়েই যাচ্ছিল। এজন্য তাঁর বিশ্বসী ও বুদ্ধিমান লোকের প্রয়োজন হতো।
মক্কা নগরীতে তখন রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর বুদ্ধিমত্তা, বিশ্বস্ততা ও ন্যায়নিষ্ঠার কাহিনী লোকের মুখে মুখে। তাতে উৎসাহিত হলেন খাদিজা (রা) এবং তাঁর মালামাল নিয়ে সিরিয়ায় বাণিজ্যে যাওয়ার দায়িত্ব গ্রহণ করতে হযরতকে তিনি অনুরোধ করে পাঠালেন। সে প্রস্তাব হযরত গ্রহণ করলেন। মাইসরা নামক খাদিজার এক বিশ্বস্ত ও বুদ্ধিমান গোলামসহ তাঁর মালামাল নিয়ে হযরত ব্যবসায়ী হিসাবে সিরিয়া গেলেন।
সিরিয়ার একদিন ক্লান্ত অবস্থায় একটি অতি পুরাতন বৃক্ষের নিচে রাসূলুল্লাহ্ (সা) বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। কাছেই ছিল একটি প্রাচীন গির্জা। গির্জার পুরোহিত পাদ্রী হযরতের মনোযোগের সাথে নিরীক্ষণ করল। সঙ্গী পরিচয় জানতে চাইলেন। মাইসারা বললঃ ইনি কাবার কাছে বসবাসকারী একজন সম্ভ্রান্ত কুরায়শী। পদ্রী বললেনঃ আশ্চর্য, এ গাছের নিচে নবী ছাড়া কখনও কেউ বিশ্রাম গ্রহণ করেনি। এ সাধক পাদ্রীর নাম ছিল নাসতুরা। রাসূল (সা) এ বৃক্ষের নিচে উপবেশন করার ফলে এই অতি প্রাচীন ও মৃত বৃক্ষটি জীবিত হয়ে পাতায় পাতায় সবুজাভ হয়ে উঠে। (মাদারেজ)
মাইসারা বর্ণনা করেনঃ সফরকালে যখন দুপুর হতো, রোদের তাপ প্রচন্ড হয়ে উঠত, তখন দুজন ফেরেশতাকে তাঁর উপর ছায়া বিস্তার করতে দেখতাম।
বর্ণিত আছে- এরপর নাসতুরা মাইসারাকে জিজ্ঞেস করলঃ তাঁর চোখে কোন লালিমা আছে কি ? মাইসারা বললঃ হ্যাঁ আছে। এ লালিমা কখনও হ্রাস পায় না। তখন পাদ্রী বললেনঃ সম্ভবত ইনিই প্রতিশ্রুত শেষ নবী।
রাসূলুল্লাহ্ (সা) কেনাবেচায় লিপ্ত হলেন। ঘটনাক্রমে ব্যবসায়িক ব্যাপারে এক ব্যক্তি তাঁর সাথে তর্ক বাধিয়ে দিল। শেষে বলল- আপনি লাত ও উজ্জার কসম খেয়ে বলুন!
হযরত বললেনঃ ‘আমি লাত ও উজ্জার কসম খাই না। কখনও খাইনি। কোন কারণে এ প্রতিমাদের কাছ দিয়ে যদি যেতে হয়, মুখ ফিরিয়ে নেই এবং পথের অন্য কিনার ধরে চলে যাই।’ একথা শুনে লোকটি বললঃ তাহলে আপনার কথাই সত্য। পরে মাইসারাকে লোকটি বললঃ আল্লাহর কসম! ইনি নবী। এরম মর্যাদা ও গুণাবলি আমাদের ধর্মবেত্তাগণ ধর্ম গ্রন্থাদিতে পাঠ করেন।
মাইসারা এসব কিছু নিজের স্মৃতিতে জমা রাখলেন যত্নের সাথে। তারপর তাঁরা সফলভাবে তাঁদের ব্যবসার কাজ শেষ করে সিরিয়া থেকে ফিরে চললেন। মক্কা নগরীতে তাঁরা যখন প্রবেশ করছিলেন তখন ভরদুপুর। খাদিজা (রা) তাঁর বাড়ির দোতলায় বসে জানালা দিয়ে পথের দিকে তাকিয়ে অপেক্ষায় ছিলেন। হঠাৎ দূরে পথের দিকে খাদিজার চোখ আটকে গেল। দেখলেন, তাঁর বাণিজ্য বহর ফিরে আসছে। উটের পিঠে মুহাম্মদ (সা) বসে আছেন। অবাক হয়ে দেখতে পেলেন, দু’জন ফেরেশতা তাঁর উপর ছায়াদান করে আছেন। তাঁর সাথে বসে থাকা অন্যান্য মহিলাকে তিনি ঘটনাটি দেখালেন। সকালে বিস্মিত হয়ে গেল।
বাণিজ্য বহর বাড়ি পৌঁছল। যেসব মাল ক্রয় করে হযরত নিয়ে এসেছিলেন মক্কায় সেসব বিক্রয় করে তাঁরা আশাতীত মুনাফা পেলেন।
প্রখর বুদ্ধিমতী খাদিজা (রা) গোলম মাইসারাকে একান্তে ডেকে ফেরেশতাদের ছায়াদান সংক্রান্ত ব্যাপারটি সম্পর্কে কথা বললেন। মাইসার বলল- আমাদের রওয়ানা হওয়ার পর থেকেই ঘটনাটি আমি দেখে আসছি। তারপর সফরকালীন সংঘটিত সকল ঘটনা তাঁকে অবহিত করলেন।
খাদিজা তাঁর নিজের দেখা ও মাইসারার মুখেশোনা সমস্ত কিছু মিলিয়ে অভিভুত হয়ে পড়লেন। (ইবন ইসাহাক, খাসায়েসুল কোবরা ও মাদারেজুন্নাবুয়াত)
খাদিজা বিনতে খোয়াইলিদের জ্ঞানবৃদ্ধ এক চাচাত ভাই ছিলেন ওয়ারাকা ইব্ন নাওফেল। পার্থিব ও ধর্মীয় জ্ঞানে তিনি সমস্ত আরবে বিখ্যাত এবং সর্বজন-মান্য ছিলেন। খাদিজা তাঁর কাছে গেলেন। মুহাম্মদ (সা)-এর ব্যাপারে তাঁর কাছে সবকিছু খুলে বললেন।
সব শুনে ওয়ারাকা স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। প্রবল উচ্ছ্বাসে বললেনঃ ‘খাদিজা! তুমি যা কিছু বললে, যদি সত্যি হয়ে তাকে তবে নিশ্চিত জেনে রেখো মুহাম্মদ (সা) হবেন শেষ জামানার সর্বশ্রেষ্ঠ নবী। এটাই তার আগমনের যুগ। ইনি হবেন সেই প্রতীক্ষিত নবী যাঁর কথা আমি জানতাম।’ এপর্যন্ত বওে ওয়ারাকা নিজের বৃদ্ধ হয়ে যাওয়া এবং প্রতীক্ষিত নবীর আগমন এত দেরি হওয়ার জন্য আপেক্ষ করতে লাগলেন। আহ্! কত আর দেরি! এরপর তিনি গভীর আক্ষেপে স্বরচিত কিছু কবিতা আবৃত্তি করলেন। যার মর্মার্থ নিম্নরুপঃ
আমি ঔৎসুক্যে এমন এক বস্তু অন্তরে বহন করে চলেছি যা দীর্ঘদিন যাবৎ অনেক লোককে কাঁদিয়ে আসছে। অনেক বিবরণের মাঝ দিয়ে যা আজ খাদিজার কাছে নতুন করে পাওয়া গেল। আসলে ওহে খাদিজা! আমার দঃসহ প্রতীক্ষা বড় দীর্ঘ হয়ে গেছে। আমার জ্ঞানমতে আশা করি মক্কার উচ্চ আর নিম্নভূমির মাঝখান থেকে তোমার কাছে বললে। ঐ ধর্মসাধকের কথায় হেরফের হোক তা আমার সহ্য হবে না। সে ব্যাপারটি হলো এই যে, মুহাম্মদ (সা) হবেন আমাদের সম্মানিত সরদার এবং পরাজিত করবেন বিরুদ্ধবাদীদের। এমন নূর তিনি ছাড়িয়ে দেবেন সর্বত্র যা দ্বারা উদ্ভাসিত হবে সৃষ্টিজগত। যারা তাঁর সাথে লিপ্ত হবে, ধ্বংস হয়ে যাবে তারা। আর যারা মৈত্রী গড়বে তারাই হবে বিজয়ী এবং স্থায়ী। আফসোস! যদি আমি উপস্থিত থাকতাম সে সময় যখন এসব ঘটবে তবে নিশ্চয় বলছি, সবার আগে আমিই অন্তর্ভূক্ত হতাম তাঁর দলে। আমি সেই দলে অন্তভুক্ত হতাম যাদের কুরায়শরা অপছন্দ করত। মক্কা নগরে তারা তাঁর বিরুদ্ধে অপপ্রচার আর চিৎকার করে আকাশ বাতাস মুখরিত করে তুলত।..... (ইব্ন ইসহাক ও খাসায়েসুল কোবরা)
এসব কিছু হযরত খাদিজা (রা)-কে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সাথে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হতে উদ্রগীব করে তুলেছিল।
পূর্ববর্তী পেইজ | পরবর্তী পেইজ |
(০২২) মূর্তিপূজা ও পাপকাজের প্রতি আশৈশব ঘৃণা | (০২৪) নবুওয়াতপ্রাপ্তি ও ওহী নাযিলের প্রাক্কালে |
সূচীপত্র | এরকম আরো পেইজ |