নামাজের শুরুতে তাকবীরে তাহরীমার সময় কান পর্যন্ত হাত উঠানো সুন্নাত । নামাযের মধ্যে অন্য সময় রফে’ ইয়াদাইন বা হাত উঠানো জায়েজ নয় (সুন্নাত নয়) । নিম্নে এর দলীল পেশ করা হলোঃ
عنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ مَسْعُودٍ رَضِ قَالَ أَلَا أُصَلِّي بِكُمْ صَلَاةَ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَصَلَّى فَلَمْ يَرْفَعُ يَدَيْهِ إِلَّا فِي أَوَّلِ مَرَّةٍ
অর্থাৎ হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ (রাঃ) হতে বর্নিত হয়েছে যে, তিনি (একদিন উপস্থিত লোকদের) বললেন, আমি কি তোমাদের নিয়ে রাসুলুল্লাহ (সঃ) এর নামাযের মত নামায পড়বো ? অতঃপর তিনি নামায পড়লেন এবং প্রথমবার অর্থাৎ তাকবীর তাহ্রীমা ব্যতীত অন্য কোন সময় হস্ত উত্তোলন করলেন না ।
ইমাম আবু ঈসা তিরমিযী (রহঃ) বলেন, ইবনে মাসঊদ (রাঃ) বর্নিত এই হাদিসটি হাসান, একাধিক সাহাবী ও তাবীঈগণ এই অভিমত ব্যক্ত করেছেন । ইযরত ইবনে মাসঊদ (রাঃ) এর হাদীস সম্পর্কে কেউ কেউ আপত্তি করেছেন । কিন্তু ইমাম ও আলিমগণের অভিমত যে, প্রকৃতপক্ষে তিনি (ইবনে মাসঊদ) নবী করীম (সঃ) এর সফরে ও মুকীমে হালতে সকাল-সন্ধ্যায় হার হামেশা দীর্ঘদিন তাঁর সঙ্গে নামায আদায় করেছেন । তিনি ভুল করেছেন, এটা গ্রহণযোগ্য নয় । (তানযীমুল আশতাত, ১ম খন্ড (ঊর্দূ), পৃঃ ২৯২)
عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ مَسْعُودٍ رَض أَنَّ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَانَ لَا يَرْفَعُ يَدَيْهِ إِلَّا عِنْدَ افْتِتَاحِ الصَّلَوٰةِ ثُمَّ لَا يَعُودُ لِشَيْ مِّنْ ذلِكَ
অর্থাৎ হযরত ইবনে মাসঊদ (রাঃ) হতে বর্নিত হয়েছে যে, নবী করীম (সঃ) শুধু নামায শুরু করার সময় তাকবীরে তাহরীমার জন্য হাত উঠাতেন । অতঃপর আর কোথাও (নামাজে) উঠাতেন না ।
(বুখারী শরীফের ১ম খণ্ডের টীকা, পৃঃ ১০২)
إِنَّ عَبْدَ اللهِ بْنَ زُبَيْرٍ رَض رَأَى رَجُلًا رَفَعَ يَدَيْهِ فِي الصَّلوة عِنْدَ الرُّكوعِ وَعِنْدَ رَفعَ رَأْسِهِ مِنَ الرَّكُوعِ فَقَالَ لَا تَفْعَلْ فَإِنَّ هَذَا شَيْ فَعَلَهُ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ثُمَّ تَرَكَهُ
অর্থাৎ হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে যুবাইর (রাঃ) জনৈক ব্যক্তিকে রুকুতে যাওয়ার সময় ও রুকু হতে মাথা উঠাবার সময় ‘রফে ইয়াদাইন’ করতে দেখলেন । তখন তিনি তাঁকে বললেন, তুমি এরূপ করিও না । কারন, এটা এমন বিষয় যা রাসুলুল্লাহ (সঃ) করিয়াছিলেন, কিন্তু অতঃপর এটা পরিত্যাগ করেছেন ।
(বুখারী শরীফের ১ম খণ্ডের টীকা, পৃঃ ১০২)
عَنْ جَابِرٍ رَضِ قَالَ خَرَجَ عَلَيْنَا رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقَالَ مَالِي أَرَاكُمْ رَافِعِى أَيْدِيكُمْ كَأَنَّهَا أَذْنَابُ خَيْلٍ شُمْسٍ أَسْكُنُوا فِي الصَّلوة
অর্থাৎ হযরত জাবির (রাঃ) হতে বর্নিত আছে- একদা রসুলুল্লাহ (সঃ) আমাদের নিকট আগমন করে বললেন, কি হলো ? আমি তোমাদেরকে ‘রফে ইয়াদাইন’ করতে দেখছি । মনে হয় যেন তোমাদের হাতগুলো অবাধ্য ঘোড়ার লেজের মত (উঠাচ্ছো), তোমরা নামাজে এরূপ করিও না- ধীরস্থির থাকো ।
তানযীমুল আশতাত, ১ম খন্ড (ঊর্দূ), পৃঃ ২৯৪
عَنِ الْبَرَاءِ بْنِ عَازِبٍ رَضِ قَالَ كَانَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ إِذَا كَبَّرَ لا فُتِتَاحِ الصَّلوةَ رَفَعَ يَدَيْهِ حَتَّى يَكُونَ إِبْهَامَاهُ قَرِيبًا مِّنْ شَحْمَتَى أُذُنَيْهِ ثُمَّ لَا يَعُودُ
অর্থাৎ হযরত বারা ইবনে আয়েব (রাঃ) হতে বর্নিত হয়েছে যে, নবী করীম (সঃ) নামাযের শুরুতে তাকবীরে তাহরীমার সময় কানের লতি পর্যন্ত হাত উঠাতেন । পুনরায় আর উঠাতেন না ।
তানযীমুল আশতাত, ১ম খন্ড (ঊর্দূ), পৃঃ ২৯৩
عنِ ابْنِ عُمَرَ رَض أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَانَ يَرْفَعُ يَدَيْهِ إِذَا افْتَتَحَ الصَّلوةَ ثُمَّ لَا يَعُودُ -
অর্থাৎ হযরত ইবনে উমর (রাঃ) হতে বর্নিত আছে যে, নবী করিম (সঃ) নামাজের শুরুতে রফে ইয়াদাইন করতেন । পুনরায় আর উঠাতেন না ।
তানযীমুল আশতাত, ১ম খন্ড (ঊর্দূ), পৃঃ ২৯২
عَنِ الْأَسْوَدِ رضِ قَالَ رَأَيْتُ عُمَرَ بْنَ الْخَطَّابِ يَرْفَعُ يَدَيْهِ ثُمَّ لَا يَعُودُ -
অর্থাৎ হযরত আসওয়াদ (রাঃ) হতে বর্নিত আছে, তিনি বলেছেন, আমি হযরত উমর বিন খাত্তাব (রাঃ) কে প্রথম রাফে’ ইয়াদাইন করতে দেখেছি । অতঃপর পুনরাবৃত্তি করেন নাই ।
তানযীমুল আশতাত, ১ম খন্ড (ঊর্দূ), পৃঃ ২৯৫
عَنْ عَاصِمِ بْنِ كُلَيْبٍ عَنْ أَبِيهِ قَالَ رَأَيْتُ عَلِيَّ ابْنَ أَبِي طَالِبٍ رض كَانَ يَرْفَعُ يَدَيْهِ فِي التَّكْبِيرَةِ الأولى مِنَ الصَّلوةِ الْمَكْتُوبَةِ وَلَمْ يَرْفَعْهَا فِيمَا سِوَى ذَلِكَ
অর্থাৎ হযরত আসেম ইবনে কুলাইব (রাঃ) থেকে বর্নিত আছে, তিনি বলেছেন যে, আমি হযরত আলী ইবনে আবূ তালিব (রাঃ) কে ফরয নামাযের প্রথম তাকবীর ব্যতীত আর কোন সময় হাত উঠাতে দেখি নাই ।
মুয়াত্তা ইমাম মুহাম্মাদ (ঊর্দূ), পৃঃ ৫৫; তানযীমুল আশতাত, ১ম খন্ড (ঊর্দূ), পৃঃ ২৯৫
عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ أَنَّهُ قَالَ الْعَشَرَةُ الَّذِينَ شَهِدَ لَهُمُ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بِالْجَنَّةِ مَا كَانُوا يَرْفَعُونَ أَيْدِيَهُمْ إِلَّا فِي افْتِتَاحِ الصلوة -
অর্থাৎ হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্নিত হয়েছে যে, তিনি বলেছেন, আশারায়ে মুবাশশারাহ- যাদেরকে নবী করিম (সঃ) বেহেস্তের সুসংবাদ দিয়েছেন তারা নামায আরম্ভ করার সময় ব্যতীত দুই হাত উঠাতেন না । অর্থাৎ রফে’ ইয়াদাইন করতেন না ।
আইনী গ্রন্থ, ৩য় খন্ড, পৃঃ ৭
হযরত হাম্মাদ ইব্রাহীম নাখয়ী (তাবীঈ) বলেছেন যে,
তোমরা নামাযে তাকবীরে উ’লা ছাড়া অন্য কোন সময় হাত উঠাবে না ।
মুয়াত্তা ইমাম মুহাম্মাদ (ঊর্দূ), পৃঃ ৫৫
১ম যুগে মুসলমানদের রাজধানী ছিল মদিনায় । তখন সেখানে অনেক অনেক সাহাবায়ে কিরাম ও তাব্যীনে এযাম অবস্থান করতেন । মদীনাবাসীদের আমল দেখে ইমাম মালেক (রহঃ) শেষ জীবনে রফে ইয়াদাইন ত্যাগ করেছিলেন । পরে যখন মদিনা হতে কুফায় রাজধানী স্থানান্তরিত হয়ে গেল, তখন লোকেরা সাহাবা ও তাবেঈগনের আমল দেখে রফে’ ইয়াদাইন করা ত্যাগ করেছিলেন । সুতরাং প্রমাণিত হয় যে, তৎকালীন মদিনা ও কুফাবাসীগন রফে’ ইয়াদাইন করতেন না ।
তানযীমুল আশতাত, ১ম খন্ড (ঊর্দূ), পৃঃ ২৯৬
হযরত মুজাহিদ হতে বর্নিত আছে- তিনি বলেছেন যে, আমি হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রাঃ) এর পশ্চাতে নামায পড়েছি । তিন শুধু প্রথম তাকবীরে তাহরীমার সময় নামাযের মধ্যে হাত উঠিয়েছেন । ইমাম তাহাবী বলেন যে, এই আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রাঃ) ই রাসূল (সঃ) কে প্রথম রফে’ ইয়াদাইন করতে দেখেছিলেন । কিন্তু রাসূল (সঃ) এর ইন্তিকালের পর হজরত ইবনে উমর রফে’ ইয়াদাইন পরিত্যাগ করেছিলেন । এর দ্বারা বুঝা যায় যে, রাসূল (সঃ) এর এই আমলটি মনসূখ বা রহিত হয়ে গেছে । এই জন্যেই হযরত ইবনে উমর পরবর্তী সময়ে এই আমল পরিত্যাগ করেছিলেন ।
আনোয়ারুল মুকাল্লেদীণ, ইফাবা, পৃঃ ৫৫
عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ رض أَنَّ الْعَشَرَةَ الْمُبَشَّرَةَ مَا كَانُوا يَرْفَعُونَ أَيْدِيَهُمْ إِلَّا فِي افْتِتَاحِ الصَّلوة -
অর্থাৎ হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেছিলেন- যে দশজন সাহাবীর বেহেশতী হওয়ার সংবাদ দেয়া হয়েছে, তারা নামায আরম্ভকালে একবার মাত্র রফে’ ইয়াদাইন ব্যতীত তাঁদের হাত উঠাতেন না ।
ইমাম তাহাবী ও আইনী প্রমাণ করেছেন যে, আবূ হুমায়দের রফে’ ইয়াদাইনের হাদীস কয়েকটি কারনে যয়ীফ সাব্যস্ত হয়েছে । সেই দশজন সাহাবা আবূ হুমায়দের সাক্ষাতে ছিলেন, কিন্তু তাঁদের রফে’ ইয়াদাইনের কথা প্রমাণিত হয় না । ইমাম বুখারী যে ১৭জন সাহাবার রফে’ ইয়াদাইনের হাদীস বর্ননা করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে হযরত উমর, হযরত আলী, ইবনে উমার, আবূ সাইদ ইবনে যুবাইর রফে’ ইয়াদাইন ত্যাগ করেছিলেন। ইমাম তাহাবী হযরত আনাস ও হযরত আবূ হুরায়রায় হাদীস যয়ীফ সাব্যস্ত করেছেন । আল্লামা জায়লাঈ হজর আবূ সাইদ, হযরত ইবনে আব্বাস, হযরত ইবনে যোবায়ের ও হযরত আবূ হুরায়রার হাদিসকে যয়ীফ বলেছেন । সুতরাং ইমাম বুখারীর রফে’ ইয়ায়াদাইনের হাদীস গ্রহণযোগ্য নয় । (সাইফুল মুকাল্লেদীন, প্রণেতা মাওঃ ইব্রাহীম মহব্বতপুরী, পৃঃ ৩৫)
ইমাম আযম আবূ হানীফা (রহঃ) এর মতে রফে’ ইয়াদাইনের হাদীস মনসুখ (রহিত) হয়েছে । এটা হযরত আবুদল্লাহ ইবনে মাসঊদ, হজরত বারা ইবনে আযেব, হযরত জাবের ইবনে সামরা (রাঃ) প্রমুখ সাহাবায়ে কিরামের মত । হজরত উমর, হযরত আলী ও হযরত ইবনে উমর (রাঃ) উক্ত রফে’ ইয়াদাইন ত্যাগ করেছিলেন । কূফাবাসী মুহাদ্দিস, শ্রেষ্ঠ ইমাম সুফিয়ান সওরী, ইবরাহীম নাখয়ী, ইবনে আবী লাইলা, আলকামা, আসওয়াদ, শা’বী, আবূ ইসহাক, খায়ছমা, মুগীরা প্রমুখ মহাবিদ্বান গণের এই অভিমত ।
কামিউল মুবতাদেয়ীন, ৩য় খন্ড, প্রণেতা মাওঃ রুহুল আমীন বসিরহাটী
উপরোক্ত আলোচনায় প্রমাণিত হল যে, নামাযে তাকবীরে তাহ্রীমা ব্যতীত কোন রফে’ ইয়াদাইন বা হস্ত উত্তোলন না করার প্রমাণ হাদিসে বিদ্যমান । সাহাবা ও তাবীঈগণের এক জামায়তও হাত না উঠাবার মত প্রকাশ করেছেন । অতএব, ইমাম আবূ হানীফা (রহঃ) এবং তাঁর অনুসারীগণ নবী করিম (সঃ) এর আমল এবং হাদীস বর্ননাকারীদের মতভেদের উপর পূর্ন দৃষ্টি রেখে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ (রাঃ) এবং তাবীঈগণের বর্ননার উপর গুরুত্ব আরোপ করে রফে’ ইয়াদাইন না করার মত প্রকাশ করেছেন । আমরা হানাফিগণ এই মতের উপর আমল করে থাকি । সর্বশেষ উল্লেখযোগ্য যে, ভারত উপমহাদেশ তোহা মুসলিমজাহানের স্বনামখ্যাত আলিম হযরত শাহ্ ওয়ালিউল্লাহ্ মুহাদ্দিস দেহলভী এবং তাঁর সুযোগ্য পুত্র ও পৌত্রগণ যারা এই উপমহাদেশে হাদিস শাস্ত্রের প্রচার ও প্রসার ঘটিয়েছেন তারা নামাযে রফে’ ইয়াদাইন করেন নাই ।
পূর্ববর্তী পেইজ | পরবর্তী পেইজ |
(০০১) পেশ কালাম | (০০৩) ইমামের পশ্চাতে মুক্তাদির কিরাআত না পড়া সম্পর্কে |
সূচীপত্র | এরকম আরো পেইজ |