নবী করিম (দঃ) অসুস্থ অবস্থায়ই নিজের ইন্তিকাল পরবর্তীকালের সমস্ত অনুষ্ঠানাদির বিস্তারিত বিবরণ অগ্রিম বলে' যান। কখন ইন্তিকাল হবে, কে গোসল দেবে, কোন্ দেশীয় কাপড় দিয়ে কাফন দেয়া হবে, কোন্ স্থানের পানি দিয়ে গোসল করানো হবে, কে প্রথম জানাযার সালাত আদায় করবে, কোন্ ধরনের জানাযা বা সালাত পড়া হবে, কে হুযুর (দঃ) কে রওযা মোবারকে নামাবে- ইত্যাদি বিষয়ে হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ)-এর প্রশ্নের জবাবে নবী করিম (দঃ) অগ্রিম বলে গেছেন। ইমাম বায়হাকী কর্তৃক সংগৃহীত ইবনে মাসউদ (রাঃ) বর্ণিত ইলমে গায়েব সম্বলিত এই হাদীসখানা ইবনে কাছির- ইবনে তাইমিয়ার অনুসারী হয়েও, আল বেদায়া ওয়ান নেহায়া গ্রন্থে সন্নিবেশিত করেছেন- তার অনুবাদ নিম্নে পেশ করা হলো।
হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ)-এর বর্ণনাঃ
"হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) বর্ণনা করেন- যখন নবী করিম (দঃ) অসুস্থতার কারণে দুর্বল হয়ে পড়লেন, তখন আমরা কতিপয় ঘনিষ্ট সাহাবী হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রাঃ)-এর গৃহে একত্রিত হলাম। আমাদেরকে দেখে নবী করিম (দঃ) এর দুচোখ পানিতে ভরে উঠলো। তিনি আমাদেরকে লক্ষ্য করে বললেন-
"বিদায়কাল অতি নিকটবর্তী। তোমাদের আগমন শুভ হোক। আল্লাহ তোমাদেরকে উত্তমভাবে জীবিত রাখুন। আল্লাহ তোমাদেরকে হেদায়াত দান করুন। তিনি তোমাদেরকে সাহায্য করুন। তোমাদেরকে উপকৃত করুন। তোমাদেরকে উত্তম কাজের তৌফিক দিন। দ্বীনের পথে তোমাদেরকে দৃঢ় রাখুন। তোমাদেরকে তিনি হেফাযত করুন। তোমাদেরকে সাহায্য করুন। তোমাদেরকে কবুল করুন। আমি তোমাদেরকে আল্লাহর প্রতি ভয়-ভীতির জন্য অসিয়ত করে যাচ্ছি। আমার ইন্তিকালের পর তোমাদের জন্য আল্লাহকে হেফাযতকারী রেখে গেলাম। আমি তোমাদের জন্য তাঁর পক্ষ হতে সুস্পষ্ট সতর্ককারী। তোমরা আল্লাহর বান্দার ব্যাপারে এবং আল্লাহর রাজত্বে আল্লাহর নির্দেশ লঙ্ঘন করবে না"।
তারপর তিনি পরকালের শাস্তি ও শাস্তি সম্পর্কিত দুটি আয়াত তিলাওয়াত করলেন। ইবনে মাসউদ (রাঃ) বলেন, আমরা আরয করলাম- ইয়া রাসুলাল্লাহ! আপনার ইন্তিকাল কখন হবে? উত্তরে নবী করিম (দঃ) বললেন "নির্ধারিত সময় নিকটবর্তী। উত্তম বিছানা, পরিপূর্ণ পানপাত্র, সিদরাতুল মোন্তাহা এবং আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তনের সময় ঘনিয়ে আসছে"।
আমরা পুনরায় আরয করলাম- ইয়া রাসুলাল্লাহ! আপনাকে গোসল দেবে কে? হুযুর (দঃ) বললেন-"আমার আহলে বাইতের পুরুষগণ; অতি নিকটজন, তারপর ক্রমান্বয়ে অন্যরা। সাথে থাকবে অনেক ফেরেস্তা। তারা তোমাদেরকে দেখেন, কিন্তু তোমরা তাদেরকে দেখোনা"।
আমরা আরয করলাম- ইয়া রাসুলাল্লাহ! কোন্ ধরনের কাপড় দিয়ে আপনার কাফন পরানো হবে? এরশাদ করলেন, "আমার পরিধানের জামা দ্বারা এবং ইয়ামেন দেশীয় কাপড় দ্বারা অথবা মিশরীয় সাদা কাপড় দ্বারা"।
আমরা আরয করলাম- ইয়া রাসূলাল্লাহ! কে আপনার উপর সালাত বা জানাযা আদায় করবে? একথা শুনে তিনি কাঁদলেন। আমরাও কাঁদলাম। অতঃপর তিনি বললেন- "এ প্রসঙ্গ বাদ দাও। আল্লাহ তোমাদের ক্ষমা করুন এবং তোমাদের নবীর পক্ষ থেকে তোমাদেরকে তিনি উত্তম পুরস্কার দান করুন। শুন! যখন তোমরা আমাকে গোসল দিয়ে সুগন্ধি লাগাবে এবং কাফন পরাবে, তখন তোমরা আমাকে আমার রওযার কিনারে রেখে কিছুক্ষণের জন্য ঘর থেকে বের হয়ে যাবে। কেননা, এ সময়ে আমার দুই বন্ধ-জিব্রাঈল ও মিকাঈল, এরপর ইস্রাফীল, তারপর মালাকুল মউত অন্যান্য ফেরেস্তাগণকে সাথে নিয়ে আমার উপর দুরুদ পাঠ করবে। এরপর প্রথমে আমার আহলে বাইত বা পরিবারবর্গের পুরুষেরা আমার উপর দুরুদ পাঠ করবে। এরপর আমার পরিবারের মহিলাগণ দুরুদ পড়বে। এরপর তোমরা ভাগে ভাগে আমার গৃহে প্রবেশ করে দুরুদ পড়বে অথবা একা একা এসে দুরুদ পড়বে। রোনাজারীকারিনী কোন মহিলা দ্বারা আমাকে কষ্ট দিও না। আমার যেসব সাহাবী উপস্থিত হতে পারবে না-তাদের কাছে আমার সালাম পৌঁছিয়ে দিও। আমি তোমাদেরকে সাক্ষী রেখে বলছি- যারা ইসলামে প্রবেশ করেছে এবং কেয়ামত পর্যন্ত করবে-যারা আমার দ্বীনের বিষয়ে আমার অনুসরণ করবে, আমি তাদের সকলকে সালাম দিয়ে গেলাম"।
আমরা পুনরায় আরয করলাম- ইয়া রাসুলাল্লাহ। কে আপনাকে রওযা মোবারকে নামাবে? নবী করিম (দঃ) এরশাদ করলেন- "আমার পরিবারস্থ পুরুষ লোকজন, নিকটতম ব্যক্তি, তার ক্রমানুসারে অন্যরা। সাথে অনেক ফেরেস্তা প্রবেশ করবে-যারা তোমাদেরকে দেখছেন, কিন্তু তোমরা তাদেরকে দেখে পাচ্ছোনা"। (বায়হাকী সূত্রে আলবেদায়া ও নেহায়া ৫ম খন্ড ২৫৩ পৃষ্ঠা)।
পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, নবী করিম (দঃ)-এর গোসল ও কাফন-দাফনের পূর্বে খলিফা নির্বাচন করা ছিল রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ ফরয কাজ। খলিফা নির্বাচনের পূর্বে এসব কাজ কার নেতৃত্বে করা হবে- এ নিয়ে বিভিন্ন সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে। তদুপরি, খলিফা নির্বাচন না করে কাফন-দাফন করে ফেললে প্রশাসনে শূন্যতা দেখা দিবে। তাই খলিফা নির্বাচন করা ছিল প্রথম গুরুত্বপূর্ণ কাজ। বিলম্বের ইহাই একমাত্র কারণ। সোমবারের অর্ধদিন এবং মঙ্গলবারের প্রথমভাগে উক্ত রাষ্ট্রীয় কাজ সমাধা করে হযরত আবু বকর (রাঃ)-এর নেতৃত্বে এবং তাঁর আদেশে গোসল ও কাফন-দাফনের দিকে মনোযোগ দেয়া হয়। নবী করিম (দঃ) এরশাদ করেছেন, "নবীগণ যেস্থানে ইন্তিকাল করেন-সেখানেই তাঁদেরকে দাফন করা হয়"।
সে মোতাবেক হযরত আবু বকর (রাঃ) হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রাঃ)-এর হুযরার ভিতরে রওযা মোবারক তৈরীর নির্দেশ দিলেন। হযরত আব্বাস (রাঃ) মদিনা শরীফের আবু তালহা ইবনে সহল আনসারী (রাঃ) কে রওযা মোবারক খনন করার জন্য আনয়ন করেন। তিনি মদিনাবাসীদের অনুকরণে বগলী কবর খনন করেন এবং উপরে কাঁচা ইটের টাইল্স দ্বারা রওযা মোবারককে আবৃত করেন।
হযরত আলী (রাঃ), হযরত আব্বাস (রাঃ), তাঁর ছেলে হযরত ফযল (রাঃ), অপর ছেলে কুসাম (রাঃ), নবী করিম (দঃ)-এর পালিত পুত্রের ছেলে হযরত উসামা (রাঃ) এবং তাঁর আশ্রিত হযরত সালেহ (রাঃ) গোসল দেওয়ার জন্য নির্ধারিত হলেন। মদিনার জনৈক আনসার সাহাবী হযরত আউছ ইবনে আওলা (রাঃ) হযরত আলীর (রাঃ) অনুমতি নিয়ে গোসলে শরীক হন। নবী করিম (দঃ)-এর পূর্ব নির্দেশ মোতাবেক কোবার 'গারছ' নামক কূপ থেকে পানি আনা হলো। পানির সাথে বরই পাতা ও কাপুর দেয়া হলো।
গোসলের সময় শরীর মোবারক থেকে পরিধানের কাপড় পৃথক করা হবে কিনা-এ নিয়ে বিভিন্ন মত প্রকাশ করা হলো। হঠাৎ করে তাঁদের মধ্যে তন্দ্রার ভাব দেখা দিল। এমতাবস্থায় তাঁরা শুন্তে পেলেন-কে যেন বলছে-"নবী করিম (দঃ)-এর বদন মোবারক থেকে কাপড় সরানো যাবে না"। তাই করা হলো। কাপড়ের উপরেই পানি ঢেলে হযরত আলী (রাঃ) ডান হাত দিয়ে ধৌত করে দিলেন। নবী করিম (দঃ)-এর নির্দেশ ছিল- "আলী ছাড়া অন্য কেউ যেন আমাকে গোসল না দেয়”। (গোসলের বিলম্ব সম্পর্কে শিয়াদের প্রচারণা মিথ্যা। কেননা, হযরত আলী (রাঃ) এ কাজের একক ক্ষমতাপ্রাপ্ত ছিলেন)।
সেমতে হযরত আলী (রাঃ) একা গোসলের কাজ সামাধা করেন। হযরত আব্বাস, ফযল ও কুসাম পিতা-পুত্রগণ নবী করিম (দঃ)-এর দেহ মোবারক এদিক সেদিক ডান-বাম করানোর কাজে সহায়তা করেন। পানি ঢালার কাজে সহায়তা করেন উসামা ও সালেহ; মতান্তরে উসামা ও আব্বাস (রাঃ)। হযরত আলী (রাঃ) বলেন- মৃত ব্যক্তির মলমুত্র পরিষ্কার করার প্রয়োজন হয়। কিন্তু নবী করিম (দঃ)-এর ক্ষেত্রে তেমন হয়নি। কেননা, তিনি ইন্তিকালের পূর্বে ও পরে-সর্বাবস্থায়ই পাক পবিত্র ছিলেন। হযরত আলী (রাঃ) ডান হাত দিয়ে হুযুর (দঃ)-এর শরীর মোবারক ধৌত করেছিলেন। এর বরকতে তাঁর ডান হাতে সব সময় আতরের মত সুগন্ধি পাওয়া যেত (সুবহানাল্লাহ)।
নবী করিম (দঃ) কে গোসল দেয়ার পর কাফন মোবারক পরিধান করা হয়। চেহারা মোবারক, কনুই মোবারক, হাঁটু মোবারক এবং প্রতি অঙ্গের জোড়ায় জোড়ায় কাপুর লাগানো হয়। তারপর তিনখানা কাপড় দিয়ে কাফন পরানো হয়। হযরত আয়েশা (রাঃ), হযরত আবদুল্লাহ (রাঃ), হযরত ফযল (রাঃ) ও হযরত আলী (রাঃ) থেকে কাফনের কাপড়ের নমুনা সম্পর্কে বিভিন্ন রেওয়ায়াত
পাওয়া যায়। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত হাদীসে দেখা যায়, নবী করিম (দঃ) তিন ধরনের কাপড়ের মধ্যে যেকোন কাপড় দিয়ে কাফন দেয়ার কথা পূর্বেই বলে গেছেন- কাফনের কাপড় হবে ইয়েমেনের তৈরী অথবা মিশরীয় সাদা কাপড়। সে মতে দু'খানা সাদা কাপড় এবং হুযুর (দঃ)-এর নিজ গায়ের জামা মোবারক দিয়ে কাফন পরিধান করানো হয়।
হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ)-এর বর্ণনা মতে হুযুর (দঃ)-এর ইন্তিকালের সময় গায়ের জামা এবং ইয়েমেন দেশীয় দু'খানা কাপড় (একজোড়া) দিয়ে হুযুর (দঃ) কে কাফন পরিধান করানো হয়। পাগড়ী পরিধান করানো হয়নি। হযরত আলী (রাঃ) বলেন- আমি নিজহাতে হুযুর আকরাম (দঃ) কে দু'খানা সাদা কাপড় ও একখানা চাদর দ্বারা কাফন পরিধান করিয়েছি। হযরত আয়েশা (রাঃ)-এর রেওয়ায়াত মোতাবেক তিনখানা সাদা 'সাহুলী' কাপড় দ্বারা কাফন পরানো হয়। ফযল (রাঃ)-এর বর্ণনা মতে দু'খানা সাদা সাহুলী কাপড়ের উল্লেখ পাওয়া যায়। মোট কথা নিজ জামাসহ তিন খানা কাপড়েরই উল্লেখ পাওয়া যায়।
পূর্ববর্তী পেইজ | পরবর্তী পেইজ |
(০৮৩) বাইআতে আবু বকর (রাঃ) | (০৮৫) হুযুরের জানাযার ধরন |
সূচীপত্র | এরকম আরো পেইজ |