اتْلُ مَا أُوحِيَ إِلَيْكَ مِنَ الْكِتٰبِ وَ أَقِمِ الصَّلوةَ إِنَّ الصلوةَ تَنْهَى عَنِ الْفَحْشَاءِ وَالْمُنْكَرِ وَلَذِكْرُ اللَّهِ أَكْبَرُ * ط وَاللَّهُ يَعْلَمُ مَا تَصْنَعُوْنَ
তুমি আবৃত্তি কর কিতাব হইতে যাহা তোমার প্রতি প্রত্যাদেশ করা হয়। এবং সালাত কায়েম কর। সালাত অবশ্যই বিরত রাখে অশ্লীল ও মন্দ কার্য হইতে। আর আল্লাহ্ স্মরণই তো সর্বশ্রেষ্ঠ। তোমরা যাহা কর আল্লাহ্ তাহা জানেন।
সুরা আনকাবুত, আয়াত ৪৫
'আল্লাহর স্মরণই সর্বশ্রেষ্ঠ' কথাটির গুরুত্ব অপরিসীম। এরকম মন্তব্য করেছেন ইবনে আতা। কোনো পাপই জিকিরের সম্মুখে তিষ্ঠাতে পারে না। আর এখানে 'জিকরুল্লাহ্' অর্থ ওই নামাজ, যা পাপপ্রতিরোধক। নামাজ সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদত। তাই এখানে নামাজকেই সরাসরি বলা হয়েছে 'জিকরুল্লাহ্'।
জিকিরের মহিমা-মাহাত্ম্য সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে অনেক হাদিস। তন্মধ্যে কিছুসংখ্যকের উল্লেখ করা হলো এখানে এভাবে-
হজরত আবু দারদা রা. বর্ণনা করেছেন, একবার রসুলেপাক স. উপস্থিত সাহাবীগণকে লক্ষ্য করে বললেন, আমি কি তোমাদেরকে এমন আমলের কথা জানাবো না, যা তোমাদের কর্তা-বিধাতার নিকট সর্বাপেক্ষা প্রিয়, পবিত্র ও সর্বোত্তম। যা আল্লাহর পথে স্বর্ণ-রৌপ্য দান করা অপেক্ষা অধিক গুরুত্বপূর্ণ? এমনকি অধিক পুণ্যার্জক রণক্ষেত্রে শত্রুনিধনের চেয়েও? সাহাবীগণ বললেন, হে আল্লাহর বার্তাবাহক! অবশ্যই দয়া করে বলুন। তিনি স. বললেন, তা হলো আল্লাহর জিকির।
আহমদ, মালেক, তিরমিজি, ইবনে মাজা
হজরত আবু সাঈদ খুদরী রা. বর্ণনা করেছেন, আমি একবার রসুলে করীম স.কে জিজ্ঞেস করলাম, হে আল্লাহর প্রিয়তম বাণীবাহক! আল্লাহর দাসগণের মধ্যে তাঁর নিকট কে অধিক মর্যাদাসম্পন্ন? তিনি স. বললেন, যে আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ধর্মযোদ্ধার চেয়েও কি? তিনি স. বললেন, হ্যাঁ, যদিও সেই ধর্মযোদ্ধা যুদ্ধ করতে করতে তার তরবারী ভেঙে ফেলে এবং রক্তাক্ত হয়।
আহমদ, তিরমিজি
হজরত আবদুল্লাহ্ ইবনে বিশর রা. বর্ণনা করেছেন, এক ব্যক্তি একবার রসুলে আকরম স. সকাশে হাজির হয়ে বললো, হে দয়াল নবী! কোন্ ব্যক্তি সবচেয়ে বেশী সৌভাগ্যবান? তিনি স. বললেন, যার আয়ুষ্কাল দীর্ঘ ও পুণ্যকর্মশোভিত। লোকটি জানতে চাইলো, সর্বাধিক নন্দিত কর্ম কোনটি? তিনি স. বললেন, ওই জিকির, যা অন্তিমযাত্রার প্রাক্কালে সিক্ত করে রাখে রসনা।
আহমদ, তিরমিজি
হজরত আবু হোরায়রা রা. বর্ণনা করেছেন, রসুল স. একবার মক্কার হামাদান পাহাড়ের পাশ দিয়ে পথ অতিক্রম করছিলেন। চলতে চলতে বললেন, তোমরা আরও অগ্রসর হও। শোনো, এই পাহাড়ের নাম হামাদান। আর 'তাকরীদ' তো আগেই এপথ অতিক্রম করেছে। সহচরবৃন্দ বললেন, হে আল্লাহর রসুল! 'তাকরীদ' কে? তিনি স. বললেন, অত্যধিক জিকিরকারী নারী-পুরুষ।
মুসলিম
হজরত আবু মুসা আশয়ারী রা. বর্ণনা করেছেন, রসুলেপাক স. বলেছেন, যারা জিকির করে এবং যারা জিকির করে না, তাদের দৃষ্টান্ত জীবিত ও মৃত।
বোখারী, মুসলিম
হজরত আবু হোরায়রা রা. বর্ণনা করেছেন, রসুলে আকরম স. বলেছেন, আল্লাহর এক দল ফেরেশতা আছে, যারা জিকিরকারীদের সমাবেশ সন্ধান করে ফেরে। কোথাও জিকিরের সমাবেশ দেখতে পেলে একজন আর একজনকে ডেকে বলে, এসো এসো এই যে এখানে। তখন সকলে সেখানে সমবেত হয়। ঘিরে ফেলে জিকিরের মজলিশ। একজনের উপরে একজন- এরকম করতে করতে ফেরেশতাবৃন্দ পৌঁছে যায় আকাশের কাছাকাছি। আল্লাহ্ সর্বজ্ঞ হওয়া সত্ত্বেও জিজ্ঞেস করেন, আমার দাসেরা কী বলে? ফেরেশতারা জবাব দেয়, বর্ণনা করে তোমার পবিত্রতা, শ্রেষ্ঠত্ব ও মহিমা। আল্লাহ্ বলেন, তারা কি আমাকে দেখেছে? ফেরেশতারা বলে, না। আল্লাহ্ বলেন, যদি দেখতো? ফেরেশতারা বলে, তবে তো তাদের জিকির ও ইবাদতে প্রকাশ পেতো আরো বেশী আবেগ, উদ্দীপনা ও উচ্ছ্বাস। তোমার পবিত্রতা, শ্রেষ্ঠত্ব ও মহিমা প্রকাশ করতো আরো অধিক উৎসাহভরে। আল্লাহ্ প্রশ্ন করেন, তারা কী চায়? ফেরেশতারা বলে, জান্নাত। আল্লাহ্ বলেন, তারা কি জান্নাত দেখেছে? ফেরেশতারা জবাব দেয়, না। আল্লাহ্ বলেন, যদি দেখতো? ফেরেশতারা বলে, তাহলে তো তাদের জান্নাতলাভের কামনা হতো আরো অধিক প্রবল। আল্লাহ্ পুনরায় প্রশ্ন করেন, তারা পরিত্রাণ চায় কোন্ বস্তু থেকে? ফেরেশতারা বলে, জাহান্নাম থেকে? আল্লাহ্ বলেন, তারা কি কখনো জাহান্নাম দেখেছে? ফেরেশতারা জবাব দেয়, না। আল্লাহ্ বলেন, যদি দেখতো? ফেরেশতারা বলে, তাহলে তো তারা হয়ে যেতো আরো বেশী ভীতসন্ত্রস্ত। আল্লাহ্ তখন বলেন, হে ফেরেশতামণ্ডলী! তোমরা সাক্ষী থাকো, আমি তাদেরকে ক্ষমা করে দিলাম। জনৈক ফেরেশতা বলে, কিন্তু ওদের মধ্যে একজন তো ঘটনাক্রমে সেখানে উপস্থিত হয়েছে। জিকিরের উদ্দেশ্য তার ছিলোই না। আল্লাহ্পাক বলেন, আমার জিকিরকারী বান্দাগণের সঙ্গে যারা উপবেশন করে, তারা কখনো হতভাগ্য নয়। বোখারী। মুসলিমও হাদিসটি বর্ণনা করেছেন। তবে তাঁর বর্ণনার শেষাংশটি এরকম- জনৈক ফেরেশতা তখন বলে, হে আমাদের প্রভুপালনকর্তা! একজন পথিক ভুলক্রমে সেখানে বসে পড়েছে। আল্লাহ্ বলেন, আমি তাকেও মার্জনা করলাম। জিকিরকারীদের দলভুক্তরা সৌভাগ্যবঞ্চিত হয় না। হজরত আনাস বর্ণনা করেছেন, রসুলুল্লাহ্ স. আজ্ঞা করেছেন, স্বর্গোদ্যানের পাশ দিয়ে গমন করার সুযোগ পেলে স্বর্গস্বাদ গ্রহণ না করে চলে যেয়ো না। সাহাবীগণ বললেন, হে আল্লাহর রসুল! স্বর্গোদ্যান আবার কী? তিনি স. বললেন, জিকিরের অধিবেশন।
হজরত মুয়াবিয়া রা. থেকে মুসলিম বর্ণনা করেছেন, একবার সাহাবীগণের এক সমাবেশ দেখে রসুলেপাক স. থামলেন। বললেন, তোমরা এখানে কেনো সমবেত হয়েছো? সাহাবীগণ জবাব দিলেন, আমাদেরকে প্রদত্ত অনুগ্রহরাজির স্মৃতিচারণার্থে। আমরা অনুগ্রহদাতার স্তব-স্তুতি বর্ণনা করছি। তিনি দয়া করে আমাদেরকে বানিয়েছেন মুসলমান। এ যে তাঁর সীমাহীন কৃপা। তিনি স. বললেন, আল্লাহ্ তোমাদের মতো বান্দাকে নিয়ে গর্ব করেন।
ইমাম মালেক বলেছেন, আমার নিকটে এই তথ্যটি পৌঁছেছে যে, রসুলুল্লাহ্ স. বলেছেন, জিকিরমগ্ন ও জিকিরবিচ্যুতদের দৃষ্টান্ত হচ্ছে যথাক্রমে সত্যপ্রত্যাখ্যানকারীদের বিরুদ্ধে অকুতোভয় যোদ্ধা এবং ধর্মযুদ্ধ থেকে পলাতক কাপুরুষ।
রাযীন বর্ণনা করেছেন, আল্লাহর স্মরণ থেকে উদাসীন ব্যক্তিদের মধ্যে জিকিরকারী যেনো বিরসবৃক্ষকাণ্ডে পল্লবিত শাখা। যেনো অন্ধকার গৃহমধ্যে প্রদীপের আলো। যারা অমনোযোগীদের মধ্যে আল্লাহর স্মরণে রত, মৃত্যুর পূর্বে আল্লাহ্ দেখিয়ে দেন তাদেরকে তাদের জান্নাতের ঠিকানা। তাদের পাপ মানব- দানব-প্রাণী-পাখির সমতুল হলেও আল্লাহ্ তা মাফ করে দেন।
হজরত মুয়াজ ইবনে জাবালের বর্ণনায় এসেছে, রসুল স. বলেছেন, আল্লাহ্ শাস্তি থেকে নিষ্কৃতিপ্রদায়ক একমাত্র আমল হচ্ছে জিকির।
মালেক, তিরমিজি, ইবনে মাজা
হজরত আবু সাঈদ খুদরীর বর্ণনায় এসেছে, রসুল স. বলেছেন, ফেরেশতারা জিকিরের মহফিলকে বৃত্তকারে ঘিরে রাখে। আল্লাহ্ করুণার বিরতিহীন বর্ষণ হয় ওই মহফিলের উপর। অবতীর্ণ হয় সাকিনা (আত্মিক প্রশান্তি)। আর আল্লাহ্ জিকিরকারীদের আলোচনা করেন তাঁর নৈকট্যভাজন ফেরেশতাদের সঙ্গে।
মুসলিম
হজরত আবু হোরায়রার বর্ণনায় এসেছে, রসুল স. বলেছেন, আল্লাহ্ বলেন, আমার বান্দা আমার সম্পর্কে যে ধারণা পোষণ করে, তার কাছে আমি তেমনই। আর আমাকে যখন সে স্মরণ করে, তখন আমি হই তার অঙ্গ। যদি সে আমাকে মনে মনে স্মরণ করে, তবে আমিও তাকে স্মরণ করি সঙ্গোপনে। আর যদি সে আমাকে স্মরণ করে বৃন্দবদ্ধ হয়ে, তখন আমিও তাকে স্মরণ করি ফেরেশতাদেরকে সঙ্গে নিয়ে।
বোখারী, মুসলিম
কোনো কোনো তাফসীরকার বলেছেন, এখানকার 'আল্লাহর স্মরণই সর্বশ্রেষ্ঠ' কথাটির মর্মার্থ হচ্ছে- তোমরা আমাকে স্মরণ করলে আমিও তোমাদেরকে স্মরণ করবো। মানুষ মুখাপেক্ষী। তাই আল্লাহর জিকির তার কর্তব্য ও প্রয়োজন। কিন্তু আল্লাহ্ চির অমুখাপেক্ষী। সুতরাং অন্যের জিকির করা তাঁর কর্তব্য, প্রয়োজন কোনোটাই নয়। অথচ তিনি দয়া করে জিকিরকারীদের জিকির করেন। সুতরাং বুঝতে হবে আল্লাহর জিকির করার বিষয়টিই সর্বশ্রেষ্ঠ। এরকম তাফসীর বর্ণিত হয়েছে মুজাহিদ, ইকরামা এবং সাঈদ ইবনে যোবায়ের থেকে। আরেক বর্ণনা অনুসারে হজরত ইবনে আব্বাসের বর্ণনাও এরকম।
বাগবী লিখেছেন, নাফেয়ের মধ্যস্থতায় মুসা ইবনে উকবার বিবরণে এসেছে, হজরত ওমরও সর্বোন্নত সূত্রে রসুলেপাক স. থেকে সরাসরি এরকম ব্যাখ্যা উপস্থাপন করেছেন। এমতাবস্থায় আলোচ্য আয়াতের মর্মার্থ দাঁড়াবে এরকম- তোমরা আল্লাহ্ জিকির করতে কার্পণ্য কোরো না। কারণ জিকিরকারী আল্লাহ্পাকের অতুলনীয় স্মরণভূত হওয়ার সৌভাগ্য লাভ করে। মনে রেখো, তোমাদের স্মরণের তুলনায় আল্লাহর স্মরণ অনেক অনেক বেশী শ্রেষ্ঠ, মহিমান্বিত ও গৌরবের।