[আরবী]
(পারাঃ ৩ সূরা আলে-ইমরান, রুকু ৯)
অর্থাৎঃ 'স্মরণ কর, যখন আল্লাহ নবীদের অংগীকার নিয়েছিলেন, তোমাদেরকে কিতাব ও হিকমত যা কিছু দান করেছি, আর তোমাদের কাছে যা আছে, তার সমর্থকরূপে যখন একজন রাসুল আসবেন, তখন নিশ্চয় তোমরা তাঁকে বিশ্বাস করবে এবং তাঁকে সাহায্য করবে। তিনি বললেন, তোমরা কি স্বীকার করেছো? এবং এই সম্পর্কে আমার অংগীকার তোমরা কি গ্রহণ করেছো? তারা বলল, 'আমরা স্বীকার করলাম। তিনি বললেন, তবে তোমরা সাক্ষী থাক এবং আমি ও তোমাদের সাথে সাক্ষী রইলাম।”
এই আয়াতে সেই অংগীকারের ইতিহাসই তুলে ধরা হয়েছে, যা মিছাক বা প্রতিশ্রুতির দিবসে সমস্ত নবীদের থেকে নেয়া হয়েছিল। কিন্তু এ আয়াত দ্বারা হুযুর আকরম (দঃ) এর সেই সুমহান মর্যাদাই প্রকাশ হচ্ছে, যা চিন্তারও বাইরে।
আল্লাহর সাথে ওয়াদাবদ্ধ হওয়ার ইতিহাস এরূপ যে, হযরত আদম (আঃ)কে বেহেশত থেকে হিন্দুস্থানের লমবু পাহাড়ে পাঠানো হয়েছিল। অপরদিকে হযরত হাওয়া (আঃ) আরবের জেদ্দাতে অবতরণ করেছিলেন। তিনশত বৎসর কান্নাকাটির পর হুযুর পাক (দঃ) এর নামের বরকতে তাঁদের তওবা কবুল হয়েছিল, যে ঘটনা ইতোপূর্বে বণিত হয়েছে। তখন নোমান পর্বতের উপর তাঁর পিষ্ঠ হতে সমস্ত সন্তানদের রুহু বের করা হল। এ রুহগুলো হতে তিন ধরণের ওয়াদা নেয়া হয়েছিল। প্রথমতঃ সমস্ত মাখলুককে জিজ্ঞাসা করা হলো,
أَلَسْتُ بِرَبِّكُمُ ؟
অর্থাৎ আমি কি তোমাদের প্রভু নই?
সবাই আরয করেছে, 'হাঁ'। দ্বিতীয় দফায় আলেমদের নিকট থেকে এ মর্মে ওয়াদা নেয়া হয়েছে যে, তাঁরা সুষ্ঠভাবে আল্লাহর হুকুম আহকামের প্রচার করবে। আর তৃতীয় দফায় অংগীকার নেয়া হয়েছে নবীগণ থেকে, যার বর্ণনা উপরোক্ত আয়াতে এসেছে। এ মহান ওয়াদা অনুষ্ঠানটির বর্ণনা এভাবে হয়েছে যে, রাবুল আলামীন সেদিন নবীগণের উদ্দেশ্যে ইরশাদ করলেন- হে নবীগণ। আমি যখন তোমাদেরকে কিতাব প্রদান করব এবং তোমাদেরকে নবুয়্যতের তাজ পরিধান করাব এবং আমার বান্দাদেরকে তোমাদের উম্মত বানিয়ে দেব, আর এ অবস্থায় যখন তোমাদের নবুয়্যতের সূর্য পূর্ণভাবে উদিত হবে, এবং তোমাদের নামের ডঙ্কা বাজতে থাকবে, ঠিক তখন যদি তোমাদের মাঝে আমার শেষ নবী (দঃ) তাশরীফ আনয়ন করেন, তোমাদের উপর ফরয হবে, আপন উম্মত সহ খাতামুন নবী (দঃ) এর উপর ঈমান আনয়ন করা। তিনি আগমন করা মাত্র তোমাদের স্ব স্ব দ্বীন রহিত হয়ে যাবে। তোমাদের কিতাব সমূহও রহিত হয়ে যাবে। আর তাঁর খাদেম এবং সাহায্যকারী হওয়াই তোমাদের কর্তব্য হবে। আমার এই আদেশ কি তোমরা মেনে নিয়েছ? উত্তর দাও। সমস্ত নবীগণ আনন্দের সাথে সম্মতি জানাল। এখানেই শেষ নয়। আল্লাহ বললেন, ওয়াদার উপর তোমরা একে অপরের সাক্ষী হয়ে যাও। অর্থাৎ হযরত আদম (আঃ) হযরত নুহ (আঃ) এবং অন্যান্যদের জন্য সাক্ষী, আর অন্যান্য নবীগণ হযরত আদম (আঃ) এর সাক্ষী। এরপরও শেষনয়। এরশাদ হলো, আমার মহান সাক্ষীও এর সাথে যোগ হলো। অর্থাৎ আমিও তোমাদের এই অংগীকারের উপর সাক্ষী হয়ে রইলাম। আল্লাহ রাবুল আলামীন নিজের একত্ববাদের উপর অংগীকার নিয়েছেন, কিন্তু সাক্ষী ইত্যাদির অনুসরণ করেননি। সবাই শুধু 'হাঁ, বলেই সমাপ্ত করলেন। অথচ স্বীয় হাবীব, (দঃ) এর ব্যাপারে অংগীকারও নিয়েছেন, সাক্ষীও নিলেন, উপরন্তু এই সমুদয় ঘটনার উপর স্বীয় শাহী সাক্ষীও হাজির করলেন। আল্লাহই ভাল জানেন, এর মধ্যে কি গোপন রহস্য নিহিত রয়েছে। এই সকল নবীরা যে হযুর আকরম (দঃ) এর সময়কাল পাবেন না, তা রাবুল আলামীন জানতেন, তা সত্ত্বেও এধরণের ইকরারনামা এ জন্যই নিয়েছেন, যাতে কমপক্ষে একথার উপর তাঁদের ঈমান থাকুক যে, হুযুর আকরম (দঃ) যদি আমাদের সময় আসতেন, আমরা তাঁর উম্মত হয়ে যেতাম। উপরন্তু তাঁদের উম্মতদের মধ্যে কেউ যদি প্রিয় নবী (দঃ) এর জামানা পায়, এ ঘটনা শুনে যেন তাঁর উপর ঈমান আনয়ন করে। আর মহান মিরাজের রাত্রিতে সকল নবীগণ তাঁদের সেই স্বীকৃতি নামার বাস্তব প্রতিফলনও ঘটিয়েছেন। কেননা সে রাত্রিতে সবাই বায়তুল মুকাদ্দসের মধ্যে ইমামুল হারামাঈন (দঃ) এর পেছনে মুকতাদি হয়ে নামায আদায় করেছিলেন।
[উর্দূ]
অর্থাৎঃ হুযুর আকরম (দঃ)ই প্রথম এবং শেষ। এ সত্যকে সুস্পষ্ট করাই ছিল (মিরাজের পথে বায়তুল মুকাদ্দসে) আসরার নামাযের মূলভেদ। কেননা যাঁরা অতীতে বাদশাহী করে গিয়েছিলেন, তারাও সেদিন হাত বেঁধে প্রিয় নবী (দঃ) এর পেছনে উপস্থিত ছিলেন।
সুবহানাল্লাহ! সেই নামায কেমন মজার 'নামায ছিল, যেই নামাযের মুকতাদি হচ্ছেন নবীগণ আর ইমাম হচ্ছেন সাইয়েদুল আম্বিয়া মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ (দঃ)। এদিকে ফেরেশতাগণ তাঁর মিরাজের সফরের তৈরীতে ব্যতিব্যস্ত। বস্তুতঃ মহাধুমধামেই এ নামায আদায় হচ্ছিল। আর উপরোক্ত প্রতিশ্রুতি রক্ষার জন্যই হযরত ঈসা (আঃ) খাতামুন নবী (দঃ) এর উম্মত হয়ে পুনঃ দুনিয়ায় তাশরীফ আনবেন এবং হুযুর আকরম (দঃ) এর দ্বীনের হেফাজতকারী ও সাহায্যকারী হবেন। এই উম্মতে মুহাম্মদী (দঃ)কে বাতিলের চক্রান্ত থেকে রক্ষা করবেন। এসকল নবীগণের উপর সালাত ও সালাম বর্ষিত হোক।
একথাও অনুধাবন করা প্রয়োজন, হুযুর আকরম (দঃ) এর আগমনে সকল নবীদের দ্বীন কেন রহিত হয়ে গেছে? দুনিয়ার স্বাভাবিক নিয়ম এই যে, প্রত্যেক বস্তু তার আসল অবস্থায় এসে স্থির হয়ে যায়। বরঞ্চ নিজেকে মূল সত্তার মাঝে বিলীনই করে দেয়। সারা রাত তারকা সমূহ ঝলমল করে, কিন্তু যখনই সূর্য উদিত হয় সমস্ত তারকা গোপন হয়ে যায়। কেননা সকল তারকার মধ্যে নিহিত আলো সূর্যেরই ছিল। নদীগুলো সমুদ্রের প্রতিই ধাবিত, কেননা সকল নদীর উৎপত্তি সমুদ্রই। সমুদ্র হতে পানি বাষ্প হয়ে তা পাহাড়ের মধ্যে বৃষ্টি অথবা বরফ আকারে পতিত হলো। আর তা হতেই নদীর সৃষ্টি হয়ে তা স্বীয় মূল সমুদ্রের দিকে এভাবে প্রবাহিত হতে লাগল যে, তার গতি পথে যদি ব্রীজ, বৃক্ষাদি বা কোন বিশাল ইমারতও বাঁধার সৃষ্টি করে নদী সেগুলোকেও। ভেঙ্গে দেয়, কিন্তু যখন সে সমুদ্রের নিকটবর্তী হলো, তরঙ্গ ধ্বনি নিঃশেষ হয়ে গেল তার গতিবেগও কমে আসল। আর যখন সে সমুদ্রের মাঝে গিয়ে পড়ল, এভাবে হারিয়ে গেল, যেন কোন কালে সে ছিলই না। এমতাবস্থায় তার মুখে উচ্চারিত হলো-
[উর্দূ]
অর্থাৎও 'আমি তোমার হয়েছি, আর তুমি আমার। আমি দেহ আর তুমি আত্মা, যাতে কেউ এরপর বলতে না পারে যে, আমি ও ভিন্ন তুমিও ভিন্ন।"
একইভাবে সকল নবীগণ হচ্ছেন তারকা বা নক্ষত্রের মত। আর হুযুর পাক (দঃ) সূর্য। প্রিয় নবী (দঃ) কে কুরআন করীমে 'সিরাজাম মুনিরা' বা 'উজ্জল প্রদীপ, রূপে আখ্যায়িত করা হয়েছে। অথবা সকল নবীগণ হচ্ছেন নদীর মত আর প্রিয় নবী (দঃ) হচ্ছেন সমুদ্রের মত। সকল নবুয়াতের মূল প্রিয় নবী (দঃ)। এ কারণে সকলই প্রিয় নবী মুখী। পথে ফেরাউন, হামান, নমরুদের মত হাজারো শক্তি জানপ্রান বাধা দিয়ে নবুয়্যতের তরঙ্গ শক্তিতে ভেসে গেল। কিন্তু নবুয়্যতের এ সমস্ত নদীগুলো যখনই তাদের আসল সত্ত্বা আখেরী নবী (দঃ) এর নবুয়্যতের সমুদ্রের সাক্ষাৎ পেলো, নিজেদেরকে সেখানে বিলীন করে দিল। কবির ভাষায়-
[উর্দূ]
অর্থাৎঃ 'অন্য সব নবী এবং রাসূলগণ হচ্ছেন তারকারাজী আর (হে রাসূল (সঃ)) আপনি হচ্ছেন সূর্য। সবাই রাতভর ঝলমল করছিল, কিন্তু আপনার আগমনে আর কারও দ্বীপ্তি রইলো না।'
এই আয়াত দ্বারা বুঝা গেল যে, সকল নবীগণই হুযুর পাক (দঃ) এর উম্মত আর তিনি হচ্ছেন নবীগণেরও নবী।
পূর্ববর্তী পেইজ | পরবর্তী পেইজ |
(০১৬) আয়াতঃ ১৩ | |
সূচীপত্র | এরকম আরো পেইজ |