খারিজীরা ইসলামের সর্বপ্রথম বিপথগামী সম্প্রদায়। আকীদা, আমল ও খিলাফত সম্পর্কে অযৌক্তিক বিতর্ক সৃষ্টি করে তারা নিজেদেরকে মুসলিম উম্মাহ্ থেকে আলাদা করে ফেলে।
রাজনীতি ক্ষেত্রে তারা প্রধান যে ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল তা ছিল পুনপুন বিদ্রোহ করে সাময়িকভাবে খিলাফতে রাশিদার শেষ দু'বছর এবং উমাইয়া আমলে মুসলিম রাষ্ট্রের পূর্বাংশে অশান্তি সৃষ্টি করে; হযরত আলী (রা.)-এর বিরুদ্ধে আব্বাসীগণকে যুদ্ধে পরক্ষভাবে সাহায্য করেছিল। (সংক্ষিপ্ত ইসলামী বিশ্বকোষ, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩৮৬-৩৮৭, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ)। 'আল-মিলাল ওয়ান নাহল 'গ্রন্থে উদ্ধৃত হয়েছে-
كل من خرج على الإمام الحق الذي إنفقت الجماعة عليه يمسمى خارجياً سواء كان الخروج أيام الصحابة على الأئمة الراشدين أو كان بعدهم على التابعين بإحسان والأئمة في كل زمان
খারিজী ঐ সম্প্রদায়ের লোকদের বলা হয় যারা এমন নিয়মতান্ত্রিক ইমামের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে তাঁর আনুগত্য থেকে বের হয়ে যায়; যার ইমামতের আনুগত্যের প্রতি মুসলিম জনগণ ঐক্যমত পোষণ করেছেন। তাই এ বিদ্রোহ সাহাবায়ে কিরামের যামানার আইম্মায়ে রাশিদীনের বিরুদ্ধে হোক কিম্বা তাবিঈনের সময়কার মুসলিম জনগণ স্বীকৃত ইমামগণের বিরুদ্ধে হোক অথবা পরবর্তী যুগের প্রতিষ্ঠিত ইমামগণের বিরুদ্ধে হোক। সকলেই খারিজীদের অন্তর্ভূক্ত।
(الملل والنحل ১ম খন্ড ১৪৪ পৃঃ)
খারিজী শব্দটির অর্থ হল দলত্যাগী। মুসলিম জামা'আতকে পরিত্যাগ করায় খারিজীরা উক্ত নামে অভিহিত হয়।
ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায় ৬৫৭ খ্রীস্টাব্দে হযরত আলী (রা.) ও হযরত মু'আবিয়া (রা.) -এর মধ্যে সিফফীন নামক স্থানে এক তুমুল যুদ্ধ বাঁধে। যুদ্ধে হযরত মু'আবিয়া (রা.) নিশ্চিত পরাজয় অনুধাবণ করেন। ফলে তাঁর দলের কতক লোক কুরআন শরীফ উর্ধ্বে উত্তোলণ করে হযরত আলী (রা.) -এর কাছে সন্ধির প্রস্তাব করেন। হযরত আলী (রা.) ও তাঁর অধিকাংশ সংগী সন্ধি প্রস্তাবে সম্মত হন এবং দু'দল থেকে এতে দু'জন সালিশ নিযুক্ত করা হয়। কিন্তু হযরত আলীর (রা.) একদল সমর্থক এ সালিশী প্রস্তাবের বিরোধিতা করে এবং আল্লাহ তা'আলা ব্যতীত অন্য কারও ফয়সালা চলবে না; এ আওয়াজ তুলে তাঁর দল পরিত্যাগ করে। এ দলত্যাগী খারিজীরা আবদুল্লাহ্ ইব্ন ওয়াহাবকে তাদের দলপতি নির্বাচন করে, তার নেতৃত্বে নাহরাওয়ান নামক স্থানে শিবির স্থাপন করে। পরে খারিজীরা বিপুল উদ্দীপনা নিয়ে হযরত আলী (রা.)-এর বিরুদ্ধে প্রচারণা চালাতে থাকে। হযরত আলী (রা.) এ সংবাদ পেয়ে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করেন। নাহরাওয়ানে সংঘটিত যুদ্ধে খারিজীদের নেতা আবদুল্লাহ্ ইব্ন ওয়াহাব সহ বহু সংখ্যক খারিজী নিহত হয়। এতে খারিজীরা অতিশয় ক্রোধান্বিত হয়ে হযরত আলী (রা.) হযরত মু'আবিয়া (রা.) ও তাঁর উপদেষ্টা মিসরের শাসনকর্তা আমর ইব্ন আস (রা.)-কে ইসলামের শত্রু হিসেবে স্থির করে এ তিনজনকে হত্যা করার জন্য বদ্ধপরিকর হয়। হযরত মু'আবিয়া ও হযরত আমর ইব্ন আস (রা.) কোনক্রমে বেঁচে যান। কিন্তু হযরত আলী (রা.) আততায়ী আবদুর রহমান ইব্ন মূলযিমের হাতে শহীদ হন। হযরত আলী (রা.) এর শাহাদাতের পর খারিজীরা নীরবে বসে থাকেনি। উমাইয়া শাসকদের বিরুদ্ধে দীর্ঘকাল ধরে প্রচারণা চালাতে থাকে এবং আববাসীয়দের সহিত যোগাযোগ করে উমাইয়াদের পতন ত্বরান্বিত করে। আববাসীয় শাসকগণ যখন মসনদে সমাসীন হন। তখন খারিজীরা তাঁদেরও বিরোধিতা শুরু করে। এবং মেসোপটেমিয়া পূর্ব আরব ও উত্তর আফ্রিকার উপকূল ভাগে অশান্তির সৃষ্টি করে। অবশেষে মিশরের ফাতেমী শাসকগণ খারিজীদের শক্তি সমূলে ধ্বংস করে দেন। ফলে রাজনৈতিক প্রচারণা বর্জন করে তারা শুধু একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়ে পরিণত হয়।
সাহাবায়ে কিরামের বর্ণনায় খারিজীদেরকে হারুরিয়াহ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কেননা খারিজীরা হযরত আলী (রা.)-এর বিরুদ্ধে প্রথম বিদ্রোহের আওয়াজ তুলেছিল হারুরা নামক স্থানে। তাই খারিজীরা 'হারুরিয়া' নামেও অভিহিত।
عن عبد الله بن عمر رضى الله تعالى عنه وذكر الحرورية فقال قال النبي صلى الله عليه وسلم يمرقون من الإسلام مروق السهم من الرمية.
আবদুল্লাহ্ ইবন উমর (রা.) হারুরিয়াদের সম্পর্কে বর্ণনা প্রসংগে বলেন, নবী করীম (সা.) বলেছেন, তারা ইসলাম থেকে এমনভাবে বেরিয়ে যাবে যেমন তীর শিকার ভেদ করে বের হয়ে যায়।
(বুখারী শরীফ, ৬ম খণ্ড, হাদীস নং ৬৪৫১)
উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা এ কথা প্রতীয়মান হয় যে, হযরত আলী (রা.) -এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে তাঁর আনুগত্য থেকে যারা বেরিয়ে পড়ে তাদেরকেই প্রথমত খারিজী নামে অভিহিত করা হয়।
পূর্ববর্তী পেইজ | পরবর্তী পেইজ |
(০২৬) বিপথগামী ফিরকাসমূহ | (০২৮) খারিজীদের আকীদা ও মতবাদসমূহ |
সূচীপত্র | এরকম আরো পেইজ |