মুফতী কিসের ভিত্তিতে ফাওয়া দিবেন, যে নীতিমালা মুফতীকে সে পথ নির্দেশ করে তাকে (رسم المفتی) বা মুফতীর পথ নির্দেশিকা বলা হয়। (রাদদুল মুহতার, ১ম খণ্ড, ৪৮ পৃষ্ঠা)
যে ফিকহ্ তত্ত্ববিদ বিভিন্ন ঘটনা ও বিভিন্ন সমস্যা সংক্রান্ত প্রশ্নের উত্তর দিয়ে থাকেন তাঁকে মুফতী বলা হয়। মুফতীর জন্য উসূলে শরী'আত হতে মাসআলা ইস্তিম্বাতের যোগ্যতা থাকা বাঞ্ছনীয়। (মাজমুয়াতু কাওয়াইদুল ফিকহ, ৪৯৮ পৃষ্ঠা)
আল্লামা শামী (র.) বলেন, মুফতীই মুস্তাহিদ। মুজতাহিদ নন এমন কোন ব্যক্তি মুজতাহিদের কথা মুখস্থ করলে তিনি মুফতী হতে পারেন না। এমন ব্যক্তির কাছে যখন কোন প্রশ্ন করা হয় তখন তার উচিৎ তার ঐ কথাটি কোন মুজতাহিদের উক্তি তা উল্লেখ করা। এমন ব্যক্তি মুলত ফাওয়া নকলকারী হিসাবে গণ্য হন। (রাদদুল মুহতার, ১ম খণ্ড, ৪৯ পৃষ্ঠা)
হানাফী ফিকহের কিতাবে 'আল-ইমাম' অথবা 'আল-ইমামুল আযম' শব্দের প্রয়োগ হলে তদ্দ্বারা হানাফী মাযহাবের ইমাম হযরত আবূ হানীফা (র.) কে বুঝান হয়ে থাকে। (মুকাদ্দামাতু উমদাতির রিয়ায়াহ, ১৬ পৃষ্ঠা)
রাষ্ট্রীয় নেতৃত্বের ক্ষেত্রে দীনি ও দুনিয়াবী সকল ব্যাপারে যাঁর সঠিক কর্তৃত্ব থাকে তাঁকেও ইমাম বলা হয়। ইমামাতে কুরা-যাঁরা দীনী আক্বিদা-বিশ্বাস নিয়ে আলোচনা করেন উক্ত ইমামকে খলীফা বলে থাকেন। তদ্রুপ নামাযের জামা'আতে যাঁর ইক্তিদা করা হয় তাঁকেও ইমাম বলা হয়, এই হলো ইমামতে সুগরা'। (মাজমুয়াতু কাওয়াইদুল ফিকহ, ১৯০ পৃষ্ঠা)
ফিকহের কিতাবে 'সাহিবাইন' صاحبين শব্দ দ্বারা একত্রে আবূ ইউসুফ (র.) ও ইমাম মুহাম্মদ (র.)-কে বুঝান হয়ে থাকে। অনুরূপভাবে 'শায়খাইন' (شيخين) শব্দ দ্বারা একত্রে ইমাম আবু হানীফা (র.) ও ইমাম আবূ ইউসুফ (র.)-কে বুঝান হয় এবং তারফাইন طرفین শব্দ দ্বারা একত্রে ইমাম আবু হানীফা (র.) ও ইমাম মুহাম্মদ (র.) কে বুঝান হয়ে থাকে। (মুকাদ্দামাতু উমদাতির রিয়ায়াহ, ১৬ পৃষ্ঠা)
'আস্-সানী' 'আল-ইমামুস্-সানী' শব্দদ্বয় হানাফী ফিকহের কিতাবে ইমাম আবূ ইউসূফ (র.)-কে বুঝান হয়ে থাকে। (মাজমুয়াতু কাওয়াইদুল ফিকহ, ১৯০ পৃষ্ঠা) । এভাবে 'আল-ইমামুর রাব্বানী' শব্দের প্রয়োগ দ্বারা ইমাম মুহাম্মদ (র.) কে বুঝান হয়ে থাকে। (মাজমুয়াতু কাওয়াইদুল ফিকহ, ৫৭৫ পৃষ্ঠা; মুকাদ্দামাতু উমদাতির রিয়ায়াহ, ১৬ পৃষ্ঠা)
আমাদের হানাফী ফিকহের কিতাবে প্রথমোক্ত কথার ব্যবহার দ্বারা ইমাম আবু হানীফা (র.) ইমাম আবু ইউসুফ (র.) ও ইমাম আহমাদ (র.) ইমামত্রয়কে বুঝানো হয়ে থাকে এবং চার ইমামের মত বলে প্রসিদ্ধ ইমাম চতুষ্টয় যথা ইমাম আবূ হানীফা (র.) ইমাম শাফি'ঈ (র.) ইমাম মালিক (র.) ও ইমাম আহমাদ ইবন হাম্বল (র.)-কে বুঝানো হয়। (মুকাদ্দামাতু উমদাতির রিয়ায়াহ, ১৬ পৃষ্ঠা)
হানাফী মাযহাবের কিতাবে কোন বিশেষণ যুক্ত ছাড়াই যখন 'শামসুল আইম্মা' শব্দের ব্যবহার হয় তখন তা দ্বারা শামসুল আইম্মা সারাসী (র.)-কে বুঝান হয়। অন্যদের ক্ষেত্রে যখন এ শব্দের ব্যবহার হয় তখন তা বিশেষ কোন বিশেষণ যুক্ত করে ব্যবহার করা হয়। যেমন 'শামসুল আইম্মা হালওয়ায়ী' 'শামসুল আইম্মা কিরদারী' ইত্যাদি। (মুকাদ্দামাতু উমদাতির রিয়ায়াহ, ১৬ পৃষ্ঠা)
যখন হানাফী মাযহাবের কোন কিতাবে কোন বিশেষণ যুক্ত না করে 'ফাযলী' বলা হয় তখন তা দ্বারা আবু বকর মুহাম্মদ ইবনুল ফঘল আল কামারী আল-বুখারী (র.) কে বুঝান হয়। (মুকাদ্দামাতু উমদাতির রিয়ায়াহ, ১৬ পৃষ্ঠা)
আমাদের ফিরে কিতাবে কোথাও 'মুহীত' কিতাব থেকে সংগৃহীত এমন উল্লেখ থাকলে তা যাখীরা কিতাবের লেখক ইমাম বুরহান উদ্দীন (র.)-এর কিতাব 'মুহীতে বুরহানী'-কে বুঝায়। ইমাম রাযি উদ্দীন সারাঙ্গী (র.)-এর 'মুহীত' নামক কিতাব বুঝায় না।' (প্রাগুক্ত, ১৬ পৃষ্ঠা)
হানাফী মাযহাবের কিতাব 'লাফযুল-কিতাব' অথবা 'ফিল-কিতাবে' শব্দের ব্যবহার করা হয়ে থাকে। আর তা দ্বারা ইমাম মুহাম্মদ (র.)-এর 'মাবসূত'কে বুঝান হয়। (কাশফুল আসরার, ৩য় খণ্ড, ৩৫ পৃষ্ঠা)
হানাফী মাযহাবের কোন কিতাবে যদি কোন বিশেষণে বিশেষিত না করে কেবল 'হাসান' থেকে বর্ণিত এমন বলা হয়, তাহলে তা দ্বারা ইমাম আবু হানীফার (র.) সাগরিদ ইমাম হাসান ইব্ন যিয়াদকে বুঝায়। যেমন হাদীস, তাফসীরের কিতাবে হাসান হতে বর্ণিত, এমন উক্তি থাকলে তা দ্বারা হযরত হাসান বাসরী (র.)-কে বুঝায়। (মুকাদ্দামাতু উমদাতির রিয়ায়াহ, ১৬ পৃষ্ঠা)
ফিরে কিতাবে নবী (র.) ও তৎপরবর্তী দুই যুগের ক্ষেত্রে 'সাদরে আওয়ালা' কথাটি ব্যবহৃত হয়ে থাকে। (কাফুল আসরার, ৩য় খণ্ড, ২০ পৃষ্ঠা)
ফিরে কিতাবে মুতাকাদ্দিমীন (পূর্ব যুগের উলামা) বলতে সাধারণত তাঁদেরকে বুঝান হয়, যাঁরা ইমামত্রয় অর্থাৎ ইমাম আবূ হানীফা, ইমাম আবূ ইউসুফ ও ইমাম মুহাম্মদ (র.)-এর সাহচর্য লাভে ধন্য হয়েছেন। এদের পরবর্তীগণকে মুতাআখিরীন (পরবর্তী যুগের উলামা) বলে আখ্যায়িত করা হয়। 'জামিউল উলুম' গ্রন্থে 'আল- বিয়ালাতুল লতীকা' হতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ইমাম হালাওয়ায়ী হতে ইমাম হাফীযুদ্দীন বুখারীর মধ্যবর্তী সময়ে যে সব উলামায়ে কিরাম অতীত হয়েছেন, তাঁদেরকে 'মুতাআখিরীন' বলা হয়। আল্লামা যাহাবী (র.) 'মিযানুল ইতিদাল' কিতাবের শুরুতে লিখেছেন যে, উলামায়ে মুতাকাদ্দিমীন ও মুতাআখিরীনের মাঝে যে সময়সীমা তাঁদেরকে পৃথক করে থাকে তা হল দ্বিতীয় হিজরী শতকের সমাপ্তি ও তৃতীয় হিজরী শতকের সূচনা কাল। (মুকাদ্দামাতু উমদাতির রিয়ায়াহ, ১৬ পৃষ্ঠা)
যাঁর মাযহাবের তাকলীদ করা হয় অর্থাৎ মতের অনুসরণ করা হয় তাঁকে 'সালাফ' বলে। যেমন ইমাম আবূ হানীফা (র.) অন্যান্য ইমাম ও তাঁদের সহচরবৃন্দ। তাঁরা আমাদের 'সালাফ', যেমন সাহাবায়ে কিরাম ও তাবিঈন তাঁদের 'সালাফ'। তাঁদের পরবর্তীগণকে 'খালাফ' বলা হয়। কখনও কখনও 'সালাফ' শব্দটি দ্বারা সাহাবা, তাবিঈন ও তৎপরবর্তী চতুর্থ শতক পর্যন্ত উলামায়ে কিরামকে আখ্যায়িত করা হয়। আর চতুর্থ হিজরীর পরবর্তীদেরকে 'খালাফ' বলা হয়। (মাজমুয়াতু কাওয়াইদুল ফিকহ, ১৯০ পৃষ্ঠা)
আবদুন্ নবী (র.) বলেন, ফিক্হ্ন তত্ত্ববিদগণের মতে ইমাম মুহাম্মদ ইবন হাসান (র.) এরপর হতে শামসুল আইম্মা হালওয়ায়ী (র.) পর্যন্ত সময়কালের উলামায়ে কিরাম 'খালাফ' বলে আখ্যায়িত। ইমাম আবূ হানীফা (র.) হতে ইমাম মুহাম্মদ (র.) পর্যন্ত সময়কালের উলামায়ে কেরামকে 'সালাফ' বলা হয়। (মুকাদ্দামাতু উমদাতির রিয়ায়াহ, ১৬ পৃষ্ঠা)
ইমাম আবূ হানীফা (র.)-এর সাক্ষাৎ পান নি এমন পরবর্তী উলামায়ে কিরামকে 'মাশাইখ' বলা হয়। ( প্রাগুক্ত, ১৬ পৃষ্ঠা)। হিদায়া কিতাবে উল্লিখিত 'মাশাইখ' শব্দ দ্বারা বুখারা, সমরকন্দের আলিমগণকে বুঝান হয়েছে। (মুকাদ্দামাতু উমদাতির হিদায়া, ৩ পৃষ্ঠা)
হানাফী মাযহাবের মাসাইল সমূহ তিন স্তরভূক্ত। প্রথম স্তরের মাসাইলকে 'যাহিরুর রিওয়ায়িত' এবং 'মাসাইলুল উসূল' বলা হয়। এ স্তরের মাসাইল সাধারণত ইমাম আবূ হানীফা (র.) ও সাহিবাইন থেকে প্রাপ্ত। অবশ্য উল্লিখিত ইমামত্রয়-এর সাথে ইমাম যুফার ও ইমাম হাসান ইব্ন যিয়াদ সহ ইমাম আবূ হানীফা (র.)-এর অন্যান্য শাগরিদগণকেও অন্তর্ভূক্ত করা হয়। কিন্তু সর্বাধিক প্রসিদ্ধ এই যে, 'আইম্মা সালাসা' অর্থাৎ ইমাম আবূ হানীফা (র.), ইমাম আবূ ইউসুফ (র.) ও ইমাম মুহাম্মদ (র.) থেকে প্রাপ্ত মাসাইলের ক্ষেত্রে 'মাসাইলুল উসূল' এবং 'যাহিব্রুর রিওয়ায়িত' শব্দের প্রয়োগ হয়ে থাকে।" (রাদ্দুল মুহতার, ১ম খণ্ড, ৪৯ পৃষ্ঠা; মাজমুয়াতু কাওয়াইদুল ফিকহ, ৩৮৭ পৃষ্ঠা ও ৫৭ পৃষ্ঠা; মুকাদ্দামাতু উমদাতির রিয়ায়াহ, ১৬ ও ১৭ পৃষ্ঠা)
যাহিরুর রিওয়ায়িতের মাসাইল যে সমস্ত কিতাবে সন্নিবেশিত হয়েছে, এমন কিতাবসমূহকে জাহিরুর রিওয়ায়িতের কিতাব বলা হয়। এ কিতাবসমূহকে উসূলও বলা হয়। ইমাম মুহাম্মদ (র.) কর্তৃক প্রণীত ছয়খানি কিতাব মাবসূত, যিয়াদাত, জামি' সাগীর, জামি' কাবীর, সিয়ারে সাগীর, সিয়ারে কাবীর হল যাহিরুর রিওয়ায়িতের কিতাব। আল্লামা শামী (র.) বলেন, উল্লিখিত কিতাব সমূহের 'যাহিরূর রিওয়ায়িত' নাম করণের কারণ এই যে, ঐ সকল কিতাবের মাসাইল ইমাম মুহাম্মদ (র.) হতে নির্ভরযোগ্য বর্ণনাকারীদের বর্ণনায় মুতাওয়াতির, মাশহুর সূত্রে প্রাপ্ত হয়েছে।
বাহরুর রাইক গ্রন্থে যাহিরুর রিওয়ায়িতের কিতাব ছয়টি উল্লেখ করার পর বলা হয়েছে যে, কেউ কেউ সিয়ারে সাগীরকে যাহির রিওয়ায়িতের কিতাব হিসাবে স্বীকার করেন নাই। এমত অনুসারে জাহির রিওয়ায়িতের কিতাব মোট পাঁচখানা। দুরুল মুখতার কিতাবের হাশিয়া তরীকুল আনোয়ার-এ উক্ত মন্তব্য করা হয়েছে। কেউ কেউ সিয়ারদ্বয়কে উহার অন্তর্ভুক্ত করেন নাই। 'তাহতাবী' কিতাবে এ জাতীয় মন্তব্য করা হয়েছে। অতএব, যাহিরুর রিওয়ায়িতের কিতাব চারখানিতে সীমিত হয়ে যায়। 'ইনায়া' কিতাবে আছে, উসূল বলে 'জামি' সাগীর 'জামি' কাবীর' 'যিয়াদাত' ও মাবসূতকে বুঝান হয়। এ সমস্ত কিতাবকে যাহিরুর রিওয়ায়িতের কিতাবও বলা হয়।
'মিস্তাহুস সা'আদাত' কিতাবে আছে, ফিকহ তত্ত্ববিদগণ মাবসূত, যিয়াদাত, 'জামি সাগীর ও জামি' কাবীরকে উসূল এবং মাবসূত, জামি' সাগীর ও সিয়ারে কাবীরকে যাহিরূর রিওয়ায়িত ও মাশহুর রিওয়ায়িত বলেন।' (মুকাদ্দামাতু হিদায়া, ৪ পৃষ্ঠা)
কাফাবী (র.) বলেন, মাসাইলুল উসূল ও যাহিরূর রিওয়ায়িতের মাসাইল মাবসূত কিতাবের মাসাইলকে বলা হয় এবং মাবসূত কিতাবকে 'আসল' বলে উল্লেখ করা হয়। (মুকাদ্দামাতু উমদাতির হিদায়া, ৯ পৃষ্ঠা ও হাশিয়া তাহতাবী ৯ পৃষ্ঠা)
মুফতী সাইয়েদ মহাম্মদ আমীমুল ইহসান (র.) বলেন, শহীদ হাকিমের 'কিতাবুল কাফী' ও 'কিতাবুল মুনতাকা' উক্ত শ্রেণীর কিতাব। (মাজনুয়াতু কাওয়াইদুল ফিকহ, ৫৭০ পৃষ্ঠা: মুকাদ্দামাতু উমদাতির রিয়ায়াহ, ১৬ পৃষ্ঠা; রাদ্দুল মুহতার, ৪৯ পৃষ্ঠা)
যাহিরূর রিওয়ায়েতের কিতাব ব্যতীত আমাগণে ইমামদের মাসাইল আরও কতিপয় কিতাবে সংগৃহীত হয়েছে। এ শ্রেণীর কিতাবকে নাওয়াদির বলে আখ্যায়িত করা হয়।
এ এমন সব মাসাইল সমৃদ্ধ কিতাব যা ইমাম মুহাম্মদ (র.) ফোরাত নদীর তীরে অবস্থিত রাক্কাহ নামক স্থানে বিচারপতি থাকাকালে লিপিবদ্ধ করেন। মুহাম্মদ ইব্ন সামা'আ ইমাম মুহাম্মদ (র.) হতে এর মাসাইল রিওয়ায়িত করেছেন।
ইমাম মুহাম্মদ (র.) আবু আমর সুলাইমান ইব্ন শুআইব আল-কাইসানীকে যে সব মাসাইল লিখিয়ে দিয়েছিলেন তাকে 'কাইসানিয়াত' বলা হয়। 'মিত্তাহুস সা'আদাত' কিভাবে উল্লেখ রয়েছে যে, কায়সা নামী জনৈক ব্যক্তির জন্য ইমাম মুহাম্মদ (র.) কর্তৃক সংগৃহীত কিতাবকে 'কায়সানিয়াত' বলা হয়।
তাহতাবী (র.) বলেন, খলীফা হারুনুর রশীদের শাসনামলে ইমাম মুহাম্মদ (র.) যে সকল মাসাইল একত্রিত করেছিলেন তা 'হারুনিয়াত' নামে আখ্যায়িত হয়ে থাকে। এ সকল মাসাইলকে গায়েরে জাহিরে রিওয়ায়েত বা নাওয়াদির এ জন্য বলা হয় যে, তা ইমাম মুহাম্মদ (র.) হতে পূর্বের কিতাব সমূহের ন্যায় সুস্পষ্ট ও বিশুদ্ধ বর্ণনা সহকারে পাওয়া যায় নি।' (মুকাদ্দামাতু হিদায়া, ৪ পৃষ্ঠা; মুকাদ্দামাতু উমদাতির রিয়ায়াহ, ৯ পৃষ্ঠা)
উল্লেখিত বর্ণনায় যাহির রিওয়ায়িত ও নাওয়াদির সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী হিসাবে প্রকাশ পেয়েছে। কিন্তু বিষয়টি ভিন্নতর। কারণ অনেক সময় নাওয়াদিরের মাসআলা যাহির রিওয়ায়িতও হতে পারে। প্রমাণ স্বরূপ বলা যায়, মুহীত ও যখীরা কিতাব প্রণেতাদ্বয় বহু স্থানে বলেছেন, এ মাসআলা আবূ হানীফা (র.) হতে হাসান (র.) বর্ণনা করেছেন। এ জাতীয় রেওয়ায়িত যাহির রেওয়ায়িতের বিপরীত নয়। কারণ ঐ একই মাসআলা ইমাম মুহাম্মদ (র.) ও হাসান ইব্ন যিয়াদ (র.) ইমাম আবূ হানীফা (র.) হতে বর্ণনা করেছেন। অতএব যাহির রিওয়ায়েতের কিতাবে না থাকলেও তা তার অন্তর্ভুক্ত হতে পারে এ কথা যুক্তিগ্রাহ্য। (শারহু উকুদি রাসমিল মুফতী,১১ পৃষ্ঠা)
আমালী 'ইমলা' শব্দের বহুবচন। ইমলা অর্থ লেখা। কোন আলিম আল্লাহ্ প্রদত্ত জ্ঞান নিজে না লিখে যদি ছাত্রদের সম্মুখে বিভিন্ন মজলিসে তা বর্ণনা করেন এবং তারা তা লিখে কিতাব আকারে প্রকাশ করে তবে তাকে 'আমালী' বলা হয়। আল্লামা শামী (র.) বলেন, সালাফের অভ্যাস সাধারণত এ রূপই ছিল। (মুকাদ্দামাতু হিদায়া, ৪ পৃষ্ঠা)
জায়িয শব্দটি বিভিন্ন রূপান্তর সহকারে ফিকহের কিতাবে ব্যবহার করত শরয়ী দৃষ্টিতে নিষিদ্ধ নয় এমন কথাকে বুঝান হয়। অতএব, জায়িয শব্দটি মুবাহ্, মাকরূহ, মুস্তাহাব ও ওয়াজিবকে অন্তর্ভূক্ত করে থাকে। (মুকাদ্দামাতু উমদাতির রিয়ায়াহ, ১৫ পৃষ্ঠা)
'উমদাতুর রিয়ায়াহ' কিতাবের মুকাদ্দামায় (ভূমিকায়) লিখিত আছে, 'ইয়াজুযু' শব্দ ইয়াসিহহু শব্দের অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। ইমাম নববী (র.) লিখিত 'শারহুল মুহায্যাব' গ্রন্থে রয়েছে কখনও কখনও তা ইয়াহিলু অর্থাৎ 'হালাল হয়' অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এ কারণেই মাকরূহ নামাযের ক্ষেত্রে ফুকাহায়ে কিরামকে 'جاز ذالك' এটি জায়িয, صح ذالك' এটি সহীহ্ এমন কথা ব্যবহার করতে দেখা যায়। তাঁরা এ জাতীয় শব্দ দ্বারা কেবলমাত্র বাতিলের বিপরীত সহীহ বা সঠিক হওয়া বুঝিয়ে থাকেন। মুবাহ বা মাকরূহ নয় এমন কথা বুঝান তাঁদের উদ্দেশ্য থাকে না। এ কারণে অধিকাংশ ব্যাখ্যাকার ও টীকা লেখক صح جاز শব্দের ব্যাখ্যা করেছেন جاز مع الكراهة মাকরূহের সাথে জায়িয صح مع الكراهة মাকরূহের সাথে সহীহ্। 'মুনিয়াতুল মুসাল্লী' কিতাবের ব্যাখ্যা 'হিলয়াতুল মুহাল্লীর' লেখক বলেন, ফিক্সের কিতাবে জায়িয শব্দটি ব্যবহার করা হয় এবং তা দ্বারা শরয়ী দৃষ্টিতে নিষিদ্ধ নয় এ কথা বুঝানো হয়। এ কারণে জায়িয শব্দটি মুবাহ্ মুস্তাহাব, মাকরূহ ও ওয়াজিবকেও অন্তর্ভুক্ত করে থাকে।( মুকাদ্দামাতু উমদাতির রিয়ায়াহ, ১৭ পৃষ্ঠা)
হিদায়া কিতাবে 'قال ' (তিনি বলেন) শব্দের ব্যবহার অধিক দেখা যায়। 'গায়াতুল বয়ান' কিতাবে উল্লেখ রয়েছে যে, হিদায়া প্রণেতা যখন قال 'শব্দ উল্লেখ করেন তখন তা দ্বারা তিনি বুঝিয়ে থাকেন যে, মাস'আলাটি জামি' সাগীর, কুদূরী অথবা বিদায়া কিতাবে উল্লেখ আছে। কাযী মাহমুদুল আইনী (র.) বলেন, প্রকৃত প্রস্তাবে হিদায়া কিতাব ইমাম মুহাম্মদ (র.)-এর জামি' সাগীর এবং আবুল হাসান (র.)-এর কুদূরীর ব্যাখ্যা। মিফতাহুস সা'আদাত কিতাবে রয়েছে, 'قال ' শব্দটি এমন সব মাসআলার শুরুতে উল্লেখ করা হয় যা কুদূরী, জামি' সাগীর অথবা বিদায়ায় উল্লেখিত হয়েছে। যদি তা বর্ণিত তিনটি কিতাবে উল্লেখ না হয়ে থাকে সেক্ষেত্রে 'قال' শব্দ ব্যবহার করা হয় না।
ফুকাহায়ে কিরাম বিভিন্ন স্থানে قيل শব্দ ব্যবহার করে থাকেন। ব্যাখ্যাকার ও টীকা লেখকগণ সে সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন যে, তা দ্বারা লেখক মাসআলাটির দুর্বলতার কথা বুঝাতে চেয়েছেন। 'উমদাতুর রি'য়ায়াহ' প্রণেতা বলেন, সঠিক কথা এই যে, যদি তাঁর লেখক সম্পর্কে জানা যায় যে, তিনি এহেন শব্দ ব্যবহার করে এর দ্বারা দুর্বল হুকুম বুঝিয়ে থাকেন। সেক্ষেত্রে মাসআলাটি সম্পর্কে দুর্বলতার হুকুম দেওয়া যাবে। যেমন মুলতাকাল আবছরের প্রণেতা এরূপ করে থাকেন বলে জানা যায়। কারণ তিনি স্বীয় কিতাবের ভূমিকায় লিখেছেন, যেখানে তিনি 'قيل' অথবা '।' শব্দ ব্যবহার করেছেন তা '।' (অধিকতর সঠিক( শব্দের সাথে সংশ্লিষ্ট হলেও তার বিপরীতের তুলনায় দুর্বল। যদি এরূপ স্পষ্ট জানা না যায়, সে ক্ষেত্রে قيل' শব্দ ব্যবহারের কারণে তা দৃঢ়তার সাথে বলা যাবে না। এ কারণেই আল্লামা শরনাবুলালী (রহঃ) তাঁর স্বীয় : المسائل البهية الزاكية على الأثنى عشرية কিতাবে লিখেছেন , যেখানে আমি قبل শব্দ ব্যবহার করি তা সকল ক্ষেত্রে দূর্বল হবে এমন নয়। এ কথা দ্বারা বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠে যে, 'قبل' অথবা 'يقال' শব্দদ্বয় এমন নয় যে, তা দুর্বল বুঝানোর জন্যই তৈরী হয়েছে। অতএব এ জাতীয় শব্দ দ্বারা দুর্বল হওয়া না হওয়া লেখকের বর্ণনা রীতির উপরে নির্ভর করে।(মুকাদ্দামাতু হিদায়া, ৩ পৃষ্ঠা)
নিহায়া কিতাবের শেষ অধ্যায়ে উল্লেখ রয়েছে قالوا শব্দের ব্যবহার সে সমস্ত মাসআলায় হয়ে থাকে যেখানে মাশাইখে কিরামের মতভেদ রয়েছে। 'কিনায়া' ও 'বিনায়া' কিতাবের 'বাবু মা ইয়ুফসিদুস্ সালাত' অধ্যায়েও অনুরূপ বর্ণিত আছে। ইবনুল হুমাম 'ফাতহুল ক্বাদীর'-এ রোযার অধ্যায়ে লিখেছেন, হিদায়া গ্রন্থকারের নীতি এই যে, قالوا শব্দের ব্যবহার দ্বারা তিনি উলামায়ে দীনের মতভেদ সহ বিষয়টির দুর্বলতার দিকে ইংগিত করেন। আল্লামা সাদুদ্দীন তাফতাযানী কাশশাফের حَتَّى يَتَبَيَّنَ لَكُ তাফসীরের হাশিয়ায় (প্রান্ত টীকায়) উক্ত মত প্রকাশ করেছেন। ( প্রাগুক্ত ১৫ পৃষ্ঠা; মাজমুয়াতু কাওয়াইদুল ফিকহ্, ৫৭৪ পৃষ্ঠা; মুকাদ্দামাতু হিদায়া, ৩ পৃষ্ঠা)
'মিফতাহুস সা'আদাত' কিতাবে উল্লেখ রয়েছে, ফিক্সের কিতাবে যদি 'ইনদা ফোলান' (অমুকের মিতে) বলা হয়, তাহলে, তা দ্বারা তাঁর মাযহাব বুঝায় এবং যদি 'আন ফোলান" (অমুকের মতে থেকে) বলা হয় তা হলে তা দ্বারা তার থেকে বর্ণিত এমন বুঝায়। হিদায়াহ কিতাবের ব্যাখ্যাকার আইনী বলেন 'আন' শব্দ ব্যবহার হয় 'যাহির রিওয়ায়িত নয়'এ কথা বুঝাবার জন্য। ইবনুল হুমাম (র.) বলেন, 'ইন্দা' শব্দ দ্বারা মাযহাব বুঝায়। (মুকাদ্দামাতু হিদায়া, ৩ পৃষ্ঠা ও মুকাদ্দামাতু উমদাতির রিয়ায়াহ, ১৭ পৃষ্ঠা)
'ইন্দাহ' (তার মতে) শব্দের সর্বনামের মারজা (যে বিশেষ্যের পরিবর্তে সর্বনামটি ব্যবহৃত) ফুকাহায়ে কেরামের বাক্যে যেমন هذا الحكم عنده هذا مذهب৯ এ হুকুম তার মতে -এটা তাঁর মাযহাব) উল্লেখ না থাকলে এর দ্বারা ইমাম আবূ হানীফা (র.)-কে বুঝানো হয়। অনুরূপ 'ইন্দাহুমা' (তাঁদের দু'জনের মতে) দ্বারা ইমাম আবূ ইউসুফ ও ইমাম মুহাম্মদ (র.) কে বুঝানো হয়। যদি ইমাম ত্রয়ের কোন একজনের নাম উল্লেখের পর 'ইন্দাহুমা' (তাঁদের দু'জনের মতে) শব্দ উল্লেখ করা হয় তা হলে তা দ্বারা অপর দু'জন ইমামকে বুঝায়। যেমন পূর্বে ইমাম আবূ হানীফা (র.)-এর মত বর্ণনা করার পর 'ইন্দা হুমা' বললে ইমাম আবূ ইউসুফ ও ইমাম মুহাম্মদ (র.)-কে বুঝায়। (মুকাদ্দামাতু উমদাতির রিয়ায়াহ, ১৭ পৃষ্ঠা)
ফিকহ তত্ত্ববিদগণের পরিভাষায় 'লাবা'সা' (কোন দোষ নেই) শব্দের ব্যবহার অধিকাংশ ক্ষেত্রে 'বিষয়টি মুবাহ্' অথবা 'কাজটি পরিত্যাগ করা উত্তম' এ জাতীয় অর্থের জন্য হয়ে থাকে। ফাতহুল কাদীরের 'আদাবুল কাযী' অধ্যায়ে অনুরূপ লিখিত আছে। কিন্তু রাদ্দুল মুহতারের 'তাহারাত' (পবিত্রতা) অধ্যায়ে আছে, 'লাবা'সা' শব্দটির অধিকাংশ ব্যবহার যদিও কাজটি ত্যাগ করা উত্তম অর্থে হয়ে থাকে কিন্তু কোন কোন সময়ে তা দ্বারা মুস্তাহাবও বুঝানো হয়। (প্রাগুক্ত,১৫ পৃষ্ঠা ও মাজমুয়াতু কাওয়াইদুল ফিকহ্, ৫৭৫ পৃষ্ঠা)
'ইয়ামবাগী' (উচিৎ) শব্দটি ফুকাহায়ে কিরামের পরিভাষায় মুস্তাহাব বুঝানোর জন্য ব্যবহৃত হয়। কখনও কখনও তাঁরা এর দ্বারা ওয়াজিবও বুঝিয়ে থাকেন। আর 'লা-ইয়ামবাগী' (অনুচিৎ) শব্দ প্রয়োগে তাঁরা খিলাফে আওলা (উত্তম নয়) বুঝিয়ে থাকেন। আবার কখনও কখনও এর দ্বারা হারাম হওয়াও বুঝিয়ে থাকেন। অতএব কোথায় কোন অর্থে তাঁরা এ শব্দ ব্যবহার করেছেন তা বুঝার জন্য বাক্যের ধারা বিশেষভাবে অনুধাবণ করতে হবে। অথবা ফুকাহায়ে কিরামের সুস্পষ্ট বর্ণনার সহায়তা গ্রহণ করতে হবে। (মাজমুয়াতু কাওয়াইদুল ফিকহ্, ৫৭৫ পৃষ্ঠা)
'উমদাতুর রি'য়ায়া'র ভূমিকায় আছে, 'ইয়ামবাগী' শব্দটি মুতাআখিরীন উলামার পরিভাষায় অধিকাংশ সময়ে মুস্তাহাবের জন্য ব্যবহৃত হয়। কিন্তু মুতাকাদ্দিমীনের পরিভাষায় তার ব্যবহার ছিল ব্যাপক। এমন কি তাঁদের পরিভাষায় তা দ্বারা ওয়াজিবও এর অন্তর্ভুক্ত হত। 'রাদ্দুল মুহতার' এবং 'আল- আশবাহ ওয়ান নাযাইর'-এর টীকায় অনুরূপ বর্ণিত রয়েছে। (মুকাদ্দামাতু উমদাতির রিয়ায়াহ, ১৫ পৃষ্ঠা)
وعليه الفتوى - وبه يفتي - وبه نأخذه - وعليه الاعتماد - وعليه عمل الأمة وهو الصحيح - وهو الأصح - وهو الاظهر - وهو الأشبه وهو الأوجد وهو المختار - وبه جر المعروف - وهو المتعارف - وبه علمائنا
মাসআলা বর্ণনা শেষে মুফতী যদি উপরে বর্ণিত মন্তব্য সংযোগ করেন তাহলে বুঝতে হবে যে, এটাই ফাতাওয়ার গ্রাহ্য মত। যেমন, মাসাআলা বিশ্লেষণ করে মুফতী বললেন, ওয়া আলাইহিল ফাওয়া (এর উপরই ফাতওয়া দেওয়া হয়েছে)। 'ওয়া বিহি ইয়ুক্তা' (এ মতের সাথে ফাওয়া দেওয়া হয়েছে)। 'ওয়া বিহি না'খুযু (এ মতই আমরা গ্রহণ করে থাকি)। 'ওয়া আলাইহিল ই'তিমাদ' (এরই উপর আমাদের আস্থা)। 'ওয়া আলাইহি আমলুল ইয়াওম' (এ মতের উপরে আজকাল আমল রয়েছে)। অবশ্য, আল্লামা শামী (র.) বলেন, আজকাল বলতে কোন নির্দিষ্ট সময় বুঝায় না। 'ওয়া আলাইহি আমলুল উম্মাহ' (এর উপরই উম্মাতের আমল চলছে)। 'ওয়া হুয়াস্ সাহীহ্' (এটাই সঠিক মত)। 'ওয়া হুয়াল আসাহহু' (এটাই অধিকতর বিশুদ্ধ মত)। 'ওয়া হুয়াল আযহারু' (এটাই অধিকতর প্রকাশ্য) 'ওয়া হুয়াল আসবাহু' বায্যাযিয়া কিতাবে এর অর্থে বলা হয়েছে, রিওয়ায়িতের দিক দিয়ে 'নস্' দ্বারা প্রমাণিত রায়ের অধিকারী সামঞ্জস্যপূর্ণ ও জ্ঞানবোধের বিচারে অধিকতর প্রাধান্যের অধিকারী। অতএব এরই উপরে ফাওয়া। 'ওয়া হুয়াল আওজাহ' (এটাই দলীলের দিক দিয়ে অধিকতর স্পষ্ট) 'ওয়া হুয়াল মুগ্ধার' (এটাই গ্রহণীয় মত) 'ওয়া বিহি জারাল উরফু' (এ মতের উপরে সাধারণভাবে ব্যবহার চলেছে)। 'ওয়া হুয়াল মুতা'আরাফু' (এটাই প্রসিদ্ধ)। 'ওয়া বিহি আখাযা উলামাউনা' (এ মত গ্রহণ করেছেন আমাদের মাযহাবের উলামায়ে কিরাম)। ( রাদদুল মুহতার, ১ম খণ্ড, ৫১ পৃষ্ঠা)
ফকীহগণ দু'টি দলীলের মধ্যে শক্তিশালী দলীলের উপরে আমল করাকে 'ইহতিয়াত' বলেন। 'আহ্ওয়াত' শব্দটি যেহেতু তুলনামূলক আধিক্যবোধক, অতএব ফুকাহায়ে কিরাম 'ইহতিয়াত' অপেক্ষা অধিকতর পালনীয় বুঝাবার জন্য 'আহ্ওয়াত' শব্দটি ব্যবহার করে থাকেন। (প্রাগুক্ত ৫২ পৃষ্ঠা)
صحيح' সহীহ্ (বিশুদ্ধ) ও '।ে' আসাহহু (বিশুদ্ধতম) শব্দদ্বয়ের ব্যবহার ফিকহী পরিভাষায় পার্থক্যের দাবীদার। 'আসাহহু' শব্দের ব্যবহার সহীহ্ অপেক্ষা অধিকতর গুরুত্ববহ বুঝাবার জন্য হয়ে থাকে। কারণ সহীহ্ কথাটি যঈফের বিপরীত বুঝাবার জন্য ব্যবহৃত হয়। কিন্তু কোন কোন ক্ষেত্রে 'আসাহহু' শব্দের ব্যবহার যঈফের বিপরীত হওয়ায় সর্বাবস্থায় 'আসাহহু' শব্দটি অধিকতর গুরুত্বের অধিকারী বুঝাবার জন্য ব্যবহৃত হয় একথা বলা সংগত নয়। কিন্তু একই রিওয়ায়িতের শেষে পরস্পর বিরোধীভাবে উল্লেখিত শব্দদ্বয়ের ব্যবহার না হয়ে কেবলমাত্র এককভাবে কোন রিওয়ায়িতের শেষে 'আসাহ্' শব্দের ব্যবহার হলে বুঝতে হয় যে, বিপরীত রিওয়ায়াতটিও সহীহ্। অতএব যে কোনটি অনুসারে মুফতী রায় দিতে পারেন।
অবশ্য যদি এমন শব্দ ব্যবহৃত হয় যা রিওয়ায়িতটির সিহহাত বা সঠিকতা তারই মধ্যে সীমিত করে, তা হলে সে রিওয়ায়িতই গ্রহণযোগ্য। যেমন রিওয়ায়িতের শেষে সংযুক্ত হল, 'সহীহ্,' 'আ'মালুযূ বিহী' 'বিহি ইউক্তা' 'আলাইহিল ফাওয়া', এরূপ ক্ষেত্রে মুফতী তার বিপরীত ফাওয়া দিবেন না। কিন্তু হিদায়া কিতাবের গ্রন্থকার যদি 'ওয়া হুয়াস সাহীহু' (এটাই সঠিক) বলে মন্তব্য করেন এবং আল্লামা নাসাফির 'কাফী' কিতাবে তার বিপরীত রিওয়ায়িতের শেষে 'ওয়া হুয়াস্ সাহীহু' মন্তব্য সংযুক্ত হয় তা হলে মুফতীর নিকটে যেটি অধিকতর শক্তিশালী, যুগোপযোগী এবং বাঞ্ছনীয় মনে হবে সে অনুপাতে রায় দিবেন। (রাদদুল মুহতার, ১ম খণ্ড, ৫২ পৃষ্ঠা ও শারহু উকুদি রাসমিল মুফতী, ১১ পৃষ্ঠা)
আল্লামা ইব্ন আবেদীন (শামী) (র.) বলেন, আমি 'রিসালায়ে আদাবুল মুফতীতে দেখেছি, লেখক বলেন যে, যখন কোন নির্ভরযোগ্য কিতাবে আসাহ, আওলা, আওফাকু, অথবা অনুরূপ শব্দ কোন রিওয়ায়িতের সাথে সংশ্লিষ্ট দেখবেন, তখন মুফতী ঐ রেওয়ায়িতের ভিত্তিতে অথবা তাঁর বিপরীতের ভিত্তিতে ফাওয়া দিতে পারেন। কিন্তু আস সাহীহু-আল-মা'সখাযু বিহী, বিহী-ইউখায়ু, আলাইহিল ফাওয়া সংশ্লিষ্ট হলে তার বিপরীতের সাথে ফাতাওয়া দেওয়া 'বৈধ হবে না। (রাদদুল মুহতার, ১ম খণ্ড, ৪৮ পৃষ্ঠা)
ফুকাহায়ে কিরাম কখনও কখনও রায় দানকালে বলে থাকেন, 'আলাল মাযহাব', এ জাতীয় উক্তি দ্বারা তাঁরা যাহির রিওয়ায়েত বুঝিয়ে থাকেন। এবং 'মাযহিবুস সালাফ' দ্বারা মুতাকাদ্দিমীন ফুকাহায়ে কিরামকে বুঝিয়ে থাকেন। (মাজমুয়াতু কাওয়াইদিল ফিকহ্, ৫৭৩ পৃষ্ঠা)
উসূলবিদগণের পরিভাষায়, তাকে 'দলীল' বলা হয় যার প্রতি সঠিক নযর করলে কাংখিত বিষয় অর্জন করা যায়। যেমন, যাকাত দেওয়া ওয়াজিব। এক কথার উপরে দলীল আল্লাহর কালাম 'আ'তুয যাকাতা' (তোমরা যাকাত দাও)। কারণ এতে সঠিক নযর করলে যাকাত ওয়াজিব হওয়ার কাংখিত হুকমটি পাওয়া যায়। উক্ত আয়াতে 'আমর' (আদেশ) সূচক শব্দ বিষয়টি ওয়াজিব হওয়ার প্রমাণ করে। অতএব, 'আ'তুয যাকাত' শব্দটি এখানে যাকাত ওয়াজিব হওয়ার দলীল এবং কাংখিত হুকুম অর্থাৎ ওয়াজিবকে 'মাদলুল' বলা হবে। আর দলীল ও মাদলূলের মধ্যকার সম্পর্ককে 'দালালত' বলা হবে। (তাসহিলুল উসূল, ১২ পৃষ্ঠা)
দলীল দু'প্রকার ১. সামঈ ২. আকলী। দলীলে সামঈ এমন দলীলকে বলা হয় যা কুরআনে কারীম, সুন্নাতে রাসূল, ইজমা ও সালাফ থেকে শুনে জানা যায়। আর আক্কের (জ্ঞানবোধের সাহায্যে) গ্রহণ করে যে দলীল উপস্থাপন করা হয় তাকে দলীলে 'আকলী' বলে। (মাজমুয়া কাওয়াইদুল ফিকহ্.৪৯৮ পৃষ্ঠা)
মুজতাহিদের নিকট দলীলের ভিত্তিতে যে মত অগ্রাধিকার লাভের যোগ্য তাকে 'রাজিহ্' বলা হয় এবং এর বিপরীত মতকে 'মারজুহ' বলা হয়।
উসূলীদের পরিভাষায় 'নস্' এমন কথাকে বলা হয় যা শব্দগত প্রকাশ্য অর্থ অপেক্ষা অধিকতর স্পষ্ট হয়ে থাকে। তার স্পষ্টতা শব্দের কারণে নয় বরং কথাটি যে জন্য বলা হয়েছে তা উল্লেখ থাকার কারণে হয়ে থাকে। যেমন মহান আল্লাহর বাণী,
أحَلَّ اللَّهُ الْبَيْعَ وَحَرَّمَ الرِّبوا
অর্থাৎ আল্লাহ্ তা'আলা ক্রয়-বিক্রয়কে হালাল করেছেন এবং রিবা (সুদ) কে হারাম করেছেন।
এ হলো, উক্ত আয়াতের যাহির (প্রকাশ্য) অর্থ। তবে যেহেতু কাফির সম্প্রদায় ক্রয়-বিক্রয় এবং রিবা (সুদ) কে একই পর্যায়ভূক্ত বলে মনে করত, তাই আল্লাহ্ তা'আলা কাফিরদের এই মত খণ্ডন করে, এতদুভয়ের মধ্যে পার্থক্য বুঝানোর জন্য এ আয়াত নাযীল করেছেন। এ পার্থক্য বুঝানোই হলো এ আয়াতের 'নস্'। কারো কারো মতে নস্, এমন কথাকে বলা হয় যে স্বীয় অর্থ বুঝাতে কাঙ্গ (নিশ্চিত) হয়। কখনও কখনও 'নস্' বলে এমন শব্দকে বুঝানো হয় যার অর্থ জানা আছে। শব্দটি যাহির, মুফাস্সার, খাফী, খাস্, 'আম, সারীহ্, কিনায়া, যে প্রকারের হোক প্রয়োগ করা হয়ে থাকে। (নুরূল আনওয়ার, ২২৪ পৃষ্ঠা)
আভিধানিক অর্থে কোন বিষয়ের ঐক্যমত পোষণ করাকে ইজমা বলে। শরী'আতের পরিভাষায় উম্মাতে মুহাম্মদীর সৎকর্মশীল মুজতাহিদীগণের কোন সময়ে কোন কথা বা কাজে ঐক্যমত পোষণ করাকে ইজমা বলে। (তাসহিলুল উসূল, ১৯ পৃষ্ঠা)
ইজমা দু'প্রকার। 'আযীমাত ও রুস্সাত। মুজতাহিদগণের কোন বিষয়ে বা কাজে সকলের ঐক্যমতের সুস্পষ্ট উল্লেখ পাওয়া গেলে তাকে 'আযীমাত' বলা হয়। মুজতাহিদগণের কেউ কেউ কোন বিষয়ে বা কাজে সুস্পষ্ট অভিমত ব্যক্ত করার পরে যখন অন্যান্য মুজতাহিদগণ বিষয়টি জানা সত্ত্বেও নিরবতা অবলম্বন করেন। এভাবে এরূপ নিরবতা দ্বারা ঐক্যমত সূচিত হলে তাকে 'ইজমায়ে রুখসাত' বলে। (নুরুল আনওয়ার)
'কিয়াস' শব্দটি আভিধানিক অর্থে তুলনা করা। পারিভাষিক অর্থে, মূল হুকুমের ইল্লাত (কারণ) অন্য কোন বিষয়ে বিদ্যমান থাকলে উক্ত মূল হুকুম এতে জারি করাকে 'কিয়াস' বলে। উল্লেখ্য পরিভাষায় যে বিষয়ের সাথে তুলনা করা হয় তাকে আসল (মূল) এবং যে বিষয়কে তুলনা করা হয় তাকে 'ফারা' (শাখা) বলা হয়। (উসুলে বযদুবী, ২৩৯ পৃষ্ঠা)
আভিধানিক অর্থে ইসতিহসান বলা হয় কোন কিছুকে ভাল মনে করা। আর উসূলে ফিকহ্ এর পরিভাষায় 'ইসতিহসান' শব্দটি এমন দলীলের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয় যা কিয়াসে জলীর মুকাবিলায় আসে। ইসতিহসান প্রতিষ্ঠিত হয় হাদীস, ইঙ্ক্ষা, যত্নরত, (প্রয়োজনীয়তা) অথবা কিয়াসে খাফীর মাধ্যমে। এ সব ক্ষেত্রে ফুকাহায়ে কিরামের মতে কিয়াসে জলী বাদ দেওয়া পসন্দনীয়, তাই একে 'ইসতিহসান' বলা হয়। উসূলের কিতাবে এ কথা সাধারণভাবে প্রচর্পিত যে, যখন 'ইসতিহসান' শব্দ ব্যবহার করা হয় তখন তা দিয়ে 'কিয়াসে খফী' বুঝায়। যেমন কিয়াস কথাটি বললেই 'কিয়াস জলী' বুঝায়। (প্রাগুক্ত,৩৫২ পৃষ্ঠা)
আভিধানিক অর্থে ইজতিহাদ অর্থ চেষ্টা-সাধনা করা। পরিভাষায় কোন ফকীহ্ আলিমের কোন শরয়ী হুকুম সম্পর্কে সঠিক ধারণা লাভের জন্য শক্তি নিয়োগ করাকে 'ইজতিহাদ' বলে। শরয়ী হুকুম সম্পর্কে প্রাধান্যযুক্ত ধারণা লাভের মানসে সর্বশক্তি পরিচালনাকারীকে 'মুজাহিদ' বলে। (মাজমুয়া কাওয়াইদুল ফিকহ্ ১৬০পৃষ্ঠা)
'তাসহীলুল উসূল' কিতাবে আছে, ইজতিহাদ শব্দটি 'জাহদ' শব্দ থেকে নির্গত। আর 'জাহদ' অর্থ কঠোর পরিশ্রম। অতএব, অত্যন্ত কঠিন কাজে কঠোর পরিশ্রম করাকে 'ইজতিহাদ বলে'। পরিভাষায় শরয়ী দলীল দ্বারা শরয়ী আহকাম ইসতিগ্রাজ-উদ্ঘাটন করার মানসে কঠোর পরিশ্রম করাকে 'ইজতিহাদ' বলে। (তাসহিলুল উসূল, ৩১৮ পৃষ্ঠা)
নুরুল আনওয়ার কিতাবের টিকায় আছে, শরয়ী নযরী (এমন শরয়ী হুকুম যা যুক্তি অবতারণার মাধ্যমে জানা যায়) হুকুম ইসতিখরাজ (বের করা) করতে ফকীহের আপন শক্তি এমনভাবে ব্যয় করাকে ইজতিহাদ বলে যা অপেক্ষা অধিক শক্তি ব্যয় করতে নিজের মধ্যে অক্ষমতা অনুভব করেন। (নুরুল আনওয়ার, ২৪৬ شرح عقود رسم المفتي ام)
জ্ঞানের দাবীর প্রেক্ষিতে যে বিষয়ের উপর মানুষের অন্তর স্থির হয় এবং সঠিক স্বভাব তা স্বতঃস্ফূর্তভাবে গ্রহণ করে থাকে তাকে 'উরফ' বলে। উরফ দু'প্রকার। ১. 'উরফে কাওলী' (عُرف قولی ) যে বিষয়ের উপরে কোন শব্দের ব্যবহার মানুষের নিকট সুপরিচিত এমন ব্যবহৃত শব্দকে 'উরফে কাওলী' বলে। ২. উরফে শরয়ী (عرف شرعی) শরী'আতের ধারক ও বাহকগণ কোন শব্দ হতে যা বুঝে থাকেন এবং তাকে আহকামের ভিত্তি স্থির করে থাকেন তাকে উরফে শরয়ী বলা হয়।
পূর্ববর্তী পেইজ | পরবর্তী পেইজ |
(০২৪) ফিকহ শাস্ত্রে ব্যবহৃত আহকাম | (০২৬) বিপথগামী ফিরকাসমূহ |
সূচীপত্র | এরকম আরো পেইজ |