আল্লাহর প্রিয় হাবীব (দঃ)-এর বয়স যখন পঁয়ত্রিশ অতিক্রম করলো- তখন থেকেই তিনি নির্জনতা বেশী পছন্দ করতেন এবং কয়েক দিনের খাদ্য সাথে নিয়ে মক্কার ৩ মাইল পূর্বে হেরা পর্বতের চূড়ায় চলে যেতেন। তিনি পর্বতের সর্বোচ্চ চূড়া গীরিগুহায় একাকী বসে বসে ইবাদত বন্দেগী ও ধ্যান করতেন। উক্ত গুহায় নির্জন ইবাদতের কারণ ছিল এই-সেখান থেকে খানায়ে কা'বা দৃষ্টিগোচর হতো। উপরে আকাশের নিলীমা এবং সম্মুখে আল্লাহর ঘর, আর নির্জন নিথর প্রকৃতি-সব মিলিয়ে তিনি ধ্যানের রাজ্যে ডুবে যেতেন। এটা ছিল নবী করিম (দঃ)-এর পবিত্র চিল্লা।
[বর্তমানে এক ধরনের চিল্লাতে বের হয় তাবলীগ জামাত। তারা মসজিদে থাকে, বারান্দায় রান্না করে ও খায় এবং মানুষের ঘরে ঘরে গাত করে। এটাকে তারা নাম দিয়েছে চিল্লা। কোন নবী, কোন সাহাবী বা কোন অলী-গাউস এ ধরনের চিল্লা করেননি। সুতরাং এ নাম গ্রহণ করে তারা মানুষকে ধোকা দিচ্ছে। তাদের চিল্লার কোন ভিত্তি নেই।]
নবী করিম (দঃ)-এর খাদ্য ফুরিয়ে গেলে তিনি গৃহে প্রত্যাবর্তন করে খাদ্য নিয়ে পুনরায় চলে যেতেন হেরা গুহায়। একাজে সহায়তা করতেন পতিপ্রাণা বিবি হযরত খাদিজা (রাঃ)। যতই দিন যেতে লাগলো, হুযুর আকরাম (দঃ)-এর ধ্যানের গভীরতাও ততই বাড়তে লাগলো। পূর্ণিমার চাঁদের আকর্ষণে সাগরের পানি যেভাবে উল্লে উঠে, আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের প্রেমাকর্ষণে নবী করিম (দঃ)-এর হৃদয় সাগরেও তেমনিভাবে প্রেমের জোয়ার উল্লে উঠতে থাকে। প্রেমিক আর প্রেমাস্পদ ছাড়া এ আকর্ষণ অন্য কেউ অনুভব করতে পারবেনা। এ যেন মহান দায়িত্ব গ্রহণের পূর্বপ্রস্তুতি পর্ব। ৪০ বৎসর পূর্ণ হওয়া মাত্রই ১২ই রবিউল আউয়াল থেকে ওহীর সাতটি স্তরের প্রথম স্তর অবতীর্ণ হওয়া শুরু হলো- অর্থাৎ "সত্যস্বপ্ন দর্শন"। এভাবে ছয়মাস কেটে গেল। এই ৬ মাসকে নবী করিম (দঃ) নবুয়তের ৪৬ ভাগের এক ভাগ বলে হাদীসে উল্লেখ করেছেন-অর্থাৎ ৪৬ ভাগের একভাগ ছিল ৬ মাস "সত্যস্বপ্ন দর্শন" (মিরকাত)। ৭ম মাসে অর্থাৎ রমযানের শবে ক্বদর সোমবার রাত্রে প্রথম প্রত্যক্ষ ওহী (কোরআন) নাযিল শুরু হয়। বোখারী শরীফের প্রারম্ভে হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রাঃ) থেকে বর্ণিত হাদীসে দেখা যায়- ওহী নাযিলের সূচনা হয় সত্যস্বপ্ন দ্বারা। নবী করিম (দঃ) যে কোন স্বপ্ন দেখতেন, দিনের বেলার সূর্যালোকের ন্যায় তা বাস্তবে ঘটে যেত। এটা হলো ওহী নাযিলের সাতটি প্রক্রিয়ার মধ্যে একটি অন্যতম প্রক্রিয়া। এটা জিব্রাইলের মাধ্যম ছাড়াই সরাসরি আল্লাহর পক্ষ হতে হতো। নবীগণের স্বপ্নও ওহী। এজন্য তাঁদের স্বপ্নের মাধ্যমে প্রাপ্ত নির্দেশ শরীয়তের অংশ হতো। অন্যকোন অলী বা গাউছের স্বপ্ন সত্য হলেও তা শরীয়ত বলে গণ্য হবে না এবং নবুয়তের অংশও হবেনা।
সুতরাং স্বপ্নে প্রাপ্ত তাবলীগের ৬ অছুল বা নিয়মকে শরীয়ত বলে প্রচার করা এবং স্বপ্নের এই ছয় অছুলকে 'পূর্ণাঙ্গ ইসলামের রূপ' বলে প্রচার করা হারাম। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, ছয় অছুলী তাবলীগ জামাত তাদের ছয় অছুলকে ইসলামের পূর্ণরূপ বলে "দাওয়াতে তাবলীগ" নামক পুস্তকে উল্লেখ করেছে। মূলতঃ তাবলীগ জামাতের ছয় অছল স্বপ্নে প্রাপ্ত। মৌলভী ইলিয়াছ (প্রতিষ্ঠাতা তাবলীগ জামাত) নিজেই বলেছেন যে, "তাবলীগের পূর্ণাঙ্গ তরিকাটি আমার স্বপ্নে প্রাপ্ত"। (মলফুযাত ৫০নং)। স্বপ্নপ্রাপ্ত জিনিসকে দ্বীন নাম দিয়ে প্রচার করা বেদ্বীনী কাজ এবং মসজিদ ব্যবহার করা অবৈধ।
পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা তাঁর তরফ থেকে অবতীর্ণ হুকুম আহকামের তাবলীগ করার জন্য নবী করিম (দঃ) কে নির্দেশ করেছেন। (সূরা মায়েদা) সুতরাং তাবলীগ করতে হলে ওহীর মাধ্যমে প্রাপ্ত ইসলামের ৫ অছুলের তাবলীগ করতে হবে-দিল্লীর স্বপ্নেপ্রাপ্ত তাবলীগ নয়। কেননা, এটা আসমান থেকে অবতীর্ণ নয়। কারও ব্যক্তিগত নীতিমালা বা অছুলকে তাবলীগ নাম দেওয়া হারাম। নবী করিম (দঃ) ও সাহাবাগণের তাবলীগ ছিল কাফেরদের নিকট ওহীপ্রাপ্ত দ্বীনের দাওয়াত। এ ধরনের তাবলীগের হুকুমই কোরআনে দেয়া হয়েছে। দিল্লীর তাবলীগ জামাত মুসলমানকে কাফের মনে করেই তাদের নিকট দ্বীনের দাওয়াত দেয়। দ্বীনের দাওয়াত হয় কাফেরের কাছে। তাবলীগ জামাতের ৪২নং মলফুষ মোতাবেক "তাবলীগ জামাত ও তাদের সাহায্যকারী ব্যতিত অন্য কোন তৃতীয় মুসলমান নেই" (দেখুন মলফুজাতে ইলিয়াছ-৪২নং)। তারা সুন্নী মুসলমানকে অমুসলিম জ্ঞান করে দ্বীনের দাওয়াত পৌছায়। প্রমাণ হলো ৪২ নং মলফুজ।
মূলতঃ চিল্লা হচ্ছে তরিকতপন্থীদের নির্জন সাধনার নাম। হযরত বড়পীর আব্দুল কাদের জিলানী (রঃ) চিল্লা করেছেন নির্জন জঙ্গলে ও বিরান মরুভূমিতে। হযরত খাজা গরীব নওয়ায (রাঃ) চিল্লা দিয়েছিলেন হযরত দাতাগঞ্জ বখশ (রাঃ)-এর মাযারে একাধারে ৪০ দিন। হযরত নিজামুদ্দীন আউলিয়া (রহঃ) চিল্লা করেছিলেন যমুনা নদীর তীরে দিল্লীর অদূরে। হযরত মুছা (আঃ) চিল্লা করেছিলেন ৪০ দিনের জন্যে তুর পর্বতে নির্জনে। আমাদের প্রিয় নবী (দঃ) চিল্লা করেছেন গারে হেরায়। লোকালয় থেকে দূরে একাকী নির্জন সাধনাকেই তরিকতের ভাষায় চিল্লা বলা হয়। আজকাল চিল্লা দিচ্ছে দলবেধে মসজিদে মসজিদে। এটা চিল্লার অবমাননা ও প্রতারণা ছাড়া আর কিছুই নয়। তাবলীগ জামাত কর্তৃক মসজিদে মসজিদে গাঠুরী বোঝা নিয়ে ঘুরা ফেরা করতে চৌদ্দশত বৎসর পূর্বেই নবী করিম (দঃ) নিষেধ করেছেনঃ,
لا تَشَدُّوا الرِّجَالُ إِلَّا إِلَى ثَلَاثَةِ مَسَاجِدَ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ والْمَسْجِدِ الْأَقْصَى وَمَسْجِدِي هَذَا رَوَاهُ الْبُخَارِيُّ .
অর্থ-"তোমরা মক্কা, মদিনা ও বাইতুল মোকাদ্দাস-এই তিন মসজিদ ব্যতিত অন্য কোন মসজিদের উদ্দেশ্যে গাঠুরী বোঝা নিয়ে সফর করোনা"
(বুখারী)
[সেই ভবিষ্যৎবানী ১৩৩৩ হিজরীতে বাস্তবে প্রমাণিত হয়েছে। ওহাবীরা তাবলীগ জামাতের মাধ্যমে মসজিদগুলো সফর করে তা দখল করে এলাকায় ওহাবী আক্বিদা প্রতিষ্ঠিত করার গোপন স্কীম হাতে নিয়েছে। এই স্কীম বাস্তবায়ন করতে প্রথমে ৬ অছুলের বয়ান করে। পরে তাদেরকে কেন্দ্রে নিয়ে ওহাবী আক্বিদা শিক্ষা দেয়।]
পূর্ববর্তী পেইজ | পরবর্তী পেইজ |
(০২৬) হজরে আসওয়াদ স্থাপনে নবীজীর ভূমিকা ও প্রজ্ঞা | (০২৮) নবুয়্যতের অভিষেক বা দায়িত্ব অর্পণ |
সূচীপত্র | এরকম আরো পেইজ |