হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) বর্ণনা করেন-যখন নবী করিম (দঃ)-এর বয়স ছয় বৎসর, তখন বিবি আমেনা (রাঃ) আপন দাসী উম্মে আয়মন (রাঃ) ও নিজ পুত্র মোহাম্মদ (দঃ) কে নিয়ে মদিনায় গমন করেন। উদ্দেশ্য ছিল স্বামীর কবর যিয়ারত করা ও নিজ পুত্রকে মাতুলালয়ে পরিচিত করা। মদিনার বনী আদী ইবনে নাজজার ছিল নবী করিম (দঃ)-এর মাতুলালয় এবং আবু আইউব আনসারী (রাঃ) ছিলেন সে বংশের লোক। 'দারুন নাবেগা' নামক স্থানে (বর্তমানে মসজিদে নববীর পশ্চিমাংশ) হযরত আবদুল্লাহ (রাঃ)-এর কবর। সেখানে তাঁরা একমাস অবস্থান করেন। উম্মে আয়মন (বারাকাহ) বলেন- আমরা যখন মদিনায়, তখন মদিনার প্রতিবেশী একদল ইহুদী পালাক্রমে এসে নবী করিম (দঃ)-এর দিকে বার বার দৃষ্টি দিতে থাকে। ইহুদীদের মধ্যে একদল বলে উঠলো-
"ইনিই বর্তমানকালের নবী এবং মদিনাতেই তিনি হিজরত করে চলে আসবেন। এখানে বহু হতাহত হবে এবং যুদ্ধবন্দীর ঘটনা ঘটবে"।
তাদের একথা শুনে বিবি আমেনা নিজ পুত্র ও উম্মে আয়মনকে নিয়ে মক্কায় রওনা হয়ে যান। পথিমধ্যে 'আবওয়া' নামক গ্রামে পৌঁছলে হঠাৎ বিবি আমেনা (রাঃ) অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং এখানেই ইনতিকাল করেন। ইন্নালিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজিউন (বেদায়া-নেহায়া)।
আল্লামা জালালুদ্দীন সুযুতি (রহঃ) তারিখুল খোলাফা নামক প্রসিদ্ধ গ্রন্থে লিখেছেন- অসুস্থ অবস্থায় বিবি আমেনা (রাঃ) উম্মে আয়মনকে লক্ষ্য করে যে কয়টি হৃদয়বিদারক উপদেশ দিয়েছিলেন, তার মর্মার্থ এই- "হে উম্মে আয়মন, আমি বিদায় নিচ্ছি। আমার পর তুমিই তাঁর মা। তাঁকে তুমি আদর-যত্ন করে রাখবে। আর শুন, তাঁর জন্মকাল থেকে যেসব ঘটনা আমি প্রত্যক্ষ করেছি, তাতে আমার দৃঢ় বিশ্বাস জন্মেছে যে, তিনি হবেন শেষ যামানার নবী। এটাই আমার চূড়ান্ত স্বাক্ষ্য"! একথা বলেই বিবি আমেনা (রাঃ) জান্নাতবাসিনী হয়ে যান।
পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে, বিবি আমেনা (রাঃ) ও হযরত আবদুল্লাহ (রাঃ) মিল্লাতে ইব্রাহিমীর উপর ইনতিকাল করেছেন। সুতরাং তাঁরা মুমিন ও জান্নাতবাসী। বিবি আমেনা (রাঃ)-এর মন্তব্যে বুঝা গেল-তিনি নবীজীর নবুয়তে বিশ্বাসী ছিলেন। পরবর্তীতে দশম হিজরী সনে বিদায় হজ্বের সময় তাঁদেরকে পুনরায় জীবিত করে নবী করিম (দঃ)-এর সামনে পেশ করা হয় এবং উভয়ে হানিফ হওয়া সত্ত্বেও পুনরায় ইসলাম ধর্মে দিক্ষীত হয়ে সাহাবী হন। আল্লামা সোহায়লী ও হাফেয নাসিরূদ্দীন খতীব বাগদাদী হযরত আয়েশা (রাঃ) থেকে এই হাদীসখানা রেওয়ায়াত করেন। ফতোয়া শামী সহ বেদায়া-নেহায়া, মাওয়াহেব, আনওয়ারে মোহাম্মদীয়া-প্রভৃতি নির্ভরযোগ্য কিতাবে এই রেওয়ায়াতখানা বর্ণিত হয়েছে। সনদের ক্ষেত্রে সামান্য দুর্বল হলেও অনেক বিখ্যাত মোহাদ্দেস কর্তৃক গৃহীত হওয়ার কারণে এটা সবল হয়ে হাসান পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে। হাদীসের শিক্ষক ও মোহাদ্দেসগণ এই নীতিমালা সম্পর্কে ওয়াকিফহাল রয়েছেন। সুতরাং যঈফ বলে হাদীসখানাকে উড়িয়ে দেয়ার মানসিকতা ওহাবীপন্থী আলেমগণের পরিত্যাগ করা উচিত।
এখানে অগ্রীম ঈমান আনয়ন প্রসঙ্গে একটি বিষয় উল্লেখযোগ্য যে, নবী করিম (দঃ)-এর আবির্ভাবের চৌদ্দশত বৎসর পূর্বে ইয়েমেন-এর বাদশাহ তিববা আবি কুরাব মদিনা ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে এসে ইহুদী পন্ডিতদের নিকট আখেরী নবীর গুণাগুণ শুনে নবী করিম (দঃ)-এর রিসালাতের উপর বিশ্বাস স্থাপন করেছিলেন। নবী করিম (দঃ) এরশাদ করেছেন- "তোমরা তিববাকে গালি দিওনা, কেননা সে আমার উপর পূর্বেই অগ্রীম ঈমান এনেছে এবং আমি তাকে মে'রাজ রাতে বেহেস্তে বিচরন করতে দেখেছি" (ইবনে কাছির-বেদায়া ও নেহায়া)।
হযরত আবদুল্লাহ এবং বিবি আমেনার (রাঃ) ব্যাপারটিও অনুরূপ। পরবর্তীকালে নবী করিম (দঃ) সাহাবীগণসহ মায়ের কবরস্থান যিয়ারত করেন এবং ছোট শিশুর ন্যায় ফুঁফিয়ে ফুঁফিয়ে কাঁদেন। বেদায়া ও নেহায়া এবং মাওয়াহেবে লাদুন্নিয়া গ্রন্থদ্বয়ে বর্ণিত নিম্নোক্ত হাদীসখানা প্রতিধানযোগ্য।
عن سُلَيْمَانَ بْنِ بَرِيدَةَ عَنْ أَبِيهِ قَالَ انْتَهَى النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِلَى رَسُمٍ قَبْرٍ فَجَلَسَ وَجَلَسَ النَّاسُ حَوْلَهُ فَجَعَلَ يُحْرِكُ رَأْسَهُ كَالْمُخَاطِبَ ثُمَّ بَكَى فَاسْتَقْبَلَهُ عُمَرُ فَقَالَ مَا يُبْكِيكَ يَا رَسُولَ اللَّهِ؟ قَالَ: هَذَا قَبْرُ آمِنَةَ بِنْتِ وَهْبٍ، اسْتَأْذَنْتُ رَبِّي فِي أَنْ أَزُورَ قَبْرَهَا فَأَذِنَ لِي، وَاسْتَأْذَنْتُهُ فِي الِاسْتِغْفَارِ لَهَا فَأَبَى عَلَيَّ، فَأَدْرَكَنِي رِقَّتُهَا فَبَكَيْتُ. قَالَ: فَمَا رُؤْيَتْ سَاعَةٌ أَكْثَرَ بَاكِيًا مِّنْ تِلْكَ السَّاعَةِ.
অর্থ- “হযরত সোলায়মান ইবনে বোরায়দা (রাঃ) তাঁর পিতা বোরায়দা (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেছেন যে, একদিন নবী করিম (দঃ) আবওয়ায় একটি পুরাতন কবরের পার্শ্বে গিয়ে বসলেন এবং তাঁর সঙ্গীগণও কবরের পার্শ্বে বসে পড়লেন। হুযুর পাক (দঃ) যেন কাউকে সম্বোধন করার মত মাথা নেড়ে নেড়ে কাঁদতে লাগলেন। হযরত ওমর (রাঃ) সামনে এসে আরয করলেন, হে আল্লাহর রাসূল, আপনি কেন কাঁদছেন? নবী করিম (দঃ) জবাব দিলেন- এটা আমার আম্মা বিবি আমেনা বিন্তে ওয়াহাব-এর কবর! আমি আমার রবের নিকট মায়ের কবর যিয়ারত করার অনুমতি চাইলে তিনি আমাকে কবর যিয়ারতের অনুমতি দেন। পুনরায় মায়ের জন্য মাগফিরাত কামনার প্রার্থনা করতে গেলে আমাকে নিষেধ করেন। মায়ের অনাবিল স্নেহের কথা স্মরণ করে আমি কেঁদেছি। বর্ণনাকারী সাহাবী বলেন, ঐ সময়ের চেয়ে এত দীর্ঘ সময় ধরে কাঁদতে রাসুল (দঃ) কে আর কোনদিন দেখা যায়নি।"
(বেদায়া-নেহায়া-ইবনে কাছির)
উপরে বর্ণিত হাদীসখানায় তিনটি বিষয় লক্ষণীয়-
দীর্ঘ ৫০ বৎসর পর নবী করিম (দঃ) কর্তৃক মরুভূমির মধ্যে মায়ের কবর অনুসন্ধান করে বের করা খুবই দূরূহ ব্যাপার ছিল। ইলমে গায়েব না হলে এটা সম্ভব হতোনা।
দ্বিতীয় বিষয়টি হলো-সকলে সমবেত হয়ে কবরের পাশে বসে যিয়ারত করার অনুমতি দান। এটা বৈধ এবং নবী করিম (দঃ)-এর সুন্নাত। বিবি আমেনার (রাঃ) কবর যিয়ারত করার অনুমতিদানের ঘটনার দ্বারা পরিষ্কারভাবে প্রমাণিত হলো যে, তিনি মোমেন ছিলেন। কেননা, কাফেরের কবর যিয়ারত করা জায়েয নয়।
তৃতীয় বিষয়টি হলো-মাগফিরাত পার্থনার অনুমতি না দেওয়ার কারণ কি? জবাব হলো- বিবি আমেনা (রাঃ) গুনাহগার ছিলেন না- সুতরাং গাগফিরাত কামনা করা নিরর্থক। উল্লেখ্য যে, নবী করিম (দঃ) নিজের জন্য এবং পিতা-মাতার মাগফিরাতের জন্য পরবর্তীতে যে দোয়া করতেন- তা ছিল উম্মতের শিক্ষার উদ্দেশ্যে। পরবর্তীতে মাগফিরাতের জন্য দোয়া করার দ্বারা আরো প্রমাণিত হয় যে, তাঁরা মোমেন ছিলেন। মাগফিরাতের ৩টি অর্থ ৪র্থ অধ্যায়ে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। তদুপরি- তিনি ছিলেন নবীজীর মা। তাঁর মর্যাদা অন্যান্য মায়ের মত নয়। আল্লামা মানাভী, শেখ আবদুল হক মোহাদ্দেছ দেহলভী (রহঃ) প্রমুখ মোহাদ্দেসগণ বর্ণিত হাদীসের এই অর্থই গ্রহণ করেছেন।
কিন্তু ওহাবীপন্থী আলেমগণ হাদীসে বর্ণিত "যিয়ারতের অনুমতি প্রদানের" অংশটির গুরুত্ব না দিয়ে দ্বিতীয় বিষয়টির অপব্যাখ্যা করে বলেছেন যে, "যেহেতু আল্লাহ তায়ালা মাগফিরাত প্রার্থনা করতে নিষেধ করেছেন, সেহেতু বুঝা যায় যে, নবী করিম (দঃ)'র মাতা-পিতা মোমেন ছিলেন না"। নাউযু বিল্লাহ। হাদীসের প্রথম অংশটি পরিস্কার বলে দিচ্ছে যে, যার কবর যিয়ারত করা হয়, তিনি কখনও কাফের হতে পারেন না। কেননা, কাফেরের কবর যিয়ারত করা শরীয়তে নাজায়েয। এটাই আহলে সুন্নাতের আকিদা।
উপরে বর্ণিত হাদীসে বিশেষ কারণে ঐদিন নবীজীর মায়ের জন্য ইসতিগফারের অনুমতি না পাওয়ার প্রমাণ পাওয়া গেলেও অন্য হাদীসে পরবর্তী সময়ে পিতা- মাতার জন্য এবং নিজের জন্য নবী করিম (দঃ) নিম্নরূপ দোয়া করতেন বলে প্রমাণ পাওয়া যায়:
اللَّهُمَّ اغْفِرْ لِي وَلِوَا لِدَى وَلِلْمُؤْمِنِينَ يَوْمَ يَقُوْمُ الْحِسَابُ
"হে আল্লাহ! তুমি আমাকে, আমার পিতা মাতাকে এবং সকল মুমিনকে মাগফিরাত করে দিও"।
(দোয়ায়ে মাছুরা)
ইহা ছিল উম্মতের তালিমের উদ্দেশ্যে। মাগফিরাতের ব্যাখ্যা ৪র্থ অধ্যায়ে দেখুন।
উক্ত হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হলো যে নবীজী পরবর্তী সময়ে নিজের জন্য এবং পিতা-মাতার মাগফিরাতের জন্য দোয়া করতেন। সুতরাং বিরুদ্ধবাদীদের ব্যাখ্যাটি সম্পূর্ণ ভুল এবং মনগড়া। তবে মাগফিরাত কামনা করা শুধু গুণাহের জন্য নয়- বরং দীনতা প্রকাশের জন্য এবং উচ্চ মর্তবা লাভের জন্যও হয়ে থাকে।
পূর্ববর্তী পেইজ | পরবর্তী পেইজ |
(০২০) বক্ষ বিদারণ | (০২২) দাদা আবদুল মোত্তালিব- এর প্রতিপালনে কিশোর নবী (দঃ) |
সূচীপত্র | এরকম আরো পেইজ |