এ প্রসঙ্গের সমাপ্তি টানা হচ্ছে সুদীর্ঘ একটি হাদীছ দ্বারা, যা আহলে বাইতের মাধ্যমে বর্ণিত হয়েছে। হাদীছখানা সাইয়্যেদুনা ইমাম হাসান (রাঃ) ও সাইয়্যেদুনা ইমাম হুসায়ন (রাঃ) বর্ণনা করেছেন। এতে হুজুর আকরম (সঃ) এর হুলিয়া মুবারক, তাঁর চরিত্র ও অভ্যাস সমূহের বর্ণনা রয়েছে। ইমাম হাসান (রাঃ) বলেন, আমি একদা আমার ফুফু হজরত হিন্দ বিনতি আবী হালা (রাঃ) এর নিকট হুজুর আকরম (সঃ) এর হুলিয়া মুবারক সম্পর্কে প্রশ্ন করলাম। আর মনে মনে আমি এটাও কামনা করছিলাম যে, আমার সাথে যা সম্পৃক্ত সে সকল কথাগুলিও এই বর্ণনার মাধ্যমে এসে যাক। অর্থাৎ আমি মনে করলাম, হুজুর পাক (সঃ) এর হুলিয়া মুবারকের আকৃতিগত মিল হয়তো আমার মধ্যেও আছে। কেননা ইমাম হাসান (রাঃ) এর আকৃতি হুজুর পাক (সঃ) এর হুলিয়া মুবারকের সাথে এতো বেশী সাদৃশ্যপূর্ণ ছিলো যে, তখন এমন একটি প্রচলন ছিলো, কেউ যদি স্বপ্নযোগে হুজুর (সঃ) কে দেখতো তখন তাঁকে জিজ্ঞেস করা হতো, হুজুরকে কি রকম আকৃতিতে দেখেছো। সে যদি বলতো ইমাম হাসান (রাঃ) এর মতো, তখন বলা হতো, সে ঠিকই দেখেছে। ইমাম হাসান (রাঃ) এর প্রশ্নের পরিপ্রেক্ষিতে হিন্দ বিনতি আবী হালা (রাঃ) বললেন, হুজুর পাক (সঃ) আযীম, বুযুর্গী ও শান শওকতময় দেহের অধিকারী ছিলেন। পূর্ণিমার চাঁদের কিরণের ন্যায় তাঁর চেহারা মুবারক জ্যোতির্ময় ছিলো। হজরত ইমাম হাসান (রাঃ) বলেন, এরপর আমি আবার হিন্দ বিনতি আবী হালা (রাঃ) কে বললাম, হুজুর পাক (সঃ) এর কথা বলার ভঙ্গিমা কিরকম ছিলো, কথা শেষে কিভাবে চুপ থাকতেন ও কীরকম বলিষ্ঠ ছিলো তাঁর বাক্যাবলী এ সম্পর্কে আমাকে বলুন। তিনি বললেন, হুজুর পাক (সঃ) সর্বদাই ধ্যানমগ্ন এবং চিন্তাযুক্ত থাকতেন। বিনা প্রয়োজনে কোনো কথা বলতেন না। নীরবতা দীর্ঘক্ষণ পর্যন্ত স্থয়ী থাকতো। বাক্যের প্রারম্ভ ও সমাপ্তি মুখগহ্বরের কোণ থেকে তা। অর্থাৎ পরিপূর্ণ, সুস্পষ্ট ও বিশুদ্ধভাবে মুখের ভিতর থেকে শব্দ বের করে আনতেন। ভাঙ্গা ভাঙ্গা ও অপূর্ণ কথা তিনি কখনও বলতেন না। তাঁর বাক্যের বৈশিষ্ট্য ছিলো 'জামেউল কালাম' । ভাবের গভীরতায় পরিপূর্ণ সংক্ষিপ্ত কথা । এমর্মে হাদীছ শরীফে এরকম উক্ত হয়েছে, আমাকে ‘জামেউল কালাম' প্রদান করা হয়েছে এবং বাক্যকে আমার জন্য সংক্ষিপ্ত করা হয়েছে। পরিচ্ছন্ন ও ঝরঝরে কথা বলতেন হজরত। তাঁর কথার মধ্যে কোনো কিছুর কমতিও থাকতো না আবার অতিরিক্ত কিছু থাকতো না। তিনি নরোম স্বভাবের ও প্রফুল্ল মেযাজের ছিলেন। কর্কশ ও বদমেযাজী ছিলেন না। নেয়ামত সে যতো অল্পই হোক না কেনো তার সম্মান করতেন। কোনো জিনিসের দোষ বর্ণনা করতেন না। খানা যে ধরনের হোকনা কেনো গ্রহণ করতেন। কারও বা কোনোকিছুর দোষ বর্ণনা করতেন না। মন্দ হলে তার প্রশংসাও করতেন না, যেমন চাটুকার লোকদের অভ্যাস। তাঁর রাগত অবস্থার সামনে কেউ দাঁড়িয়ে থাকার সাহস পেতোনা। যখন কেউ কোনো অন্যায়ের ক্ষেত্রে সীমা লংঘন করে ফেলতো তখন তিনি রাগান্বিত হতেন। কারও হক বা অধিকার সংক্রান্ত ব্যাপার হয়ে থাকলে তার বদলা তিনি নিয়েই ছাড়তেন। তবে তিনি নিজের হকের ব্যাপারে কখনও কারও প্রতি রাগ করতেন না এবং প্রতিশোধও গ্রহণ করতেন না— যদি সেটা দুনিয়াবী ব্যাপারে হয়ে থাকতো। হুজুর পাক (সঃ) কোনোকিছুর প্রতি ইশারা করলে পুরা হাত দিয়েই করতেন। শুধুমাত্র হাতের আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করতেন না। বিস্ময় প্রকাশকালে হুজুর (সঃ) স্বীয় হাত মুবারককে ঐ রকম আকৃতি করে বের করতেন, মানব সন্তান ভূমিষ্ঠকালে হাত যেরকম আকৃতির থাকে। কথাবার্তা বলার সময় ডান হাতের আঙ্গুল বাম হাতের তালুর উপর স্থাপন করতেন। হুজুর আকরম (সঃ) এর এ সমুদয় অভ্যাসসমূহ আল্লাহ্তায়ালার নিকট বড়ই পছন্দনীয় ছিলো। এ সমস্ত সম্মানিত স্বভাবগুলির ভিতরে নিঃসন্দেহে কোনো না কোনো সূক্ষ্ম হেকমত নিহিত, যার ভেদ ও রহস্য সম্পর্কে অবহিত হতে মানুষের জ্ঞান বুদ্ধি অক্ষম হতে বাধ্য। আল্লাহ্পাকই ভাল জানেন ।
তিনি যখন রাগান্বিত হতেন তখন চেহারা মুবারক ও পার্শ্ব সেদিক থেকে ফিরিয়ে নিতেন । আনন্দ ও উৎফুল্লতার সময় এবং যখন কোনো কাম্য জিনিস পেয়ে যেতেন, তখন মুবারক চক্ষুদ্বয়কে বন্ধ করে দিতেন। অধিকাংশ সময় তিনি যখন হাসতেন তখন তাবাসসুম (মুচকি হাসতেন । মুচকি হাসির সময় হুজুর (সঃ) এর স্বচ্ছ পরিষ্কার পবিত্র দন্তরাজি শ্বেতশুভ্র তুষারখন্ডের মতো ঝকমক করতো।
সাইয়্যেদুনা ইমাম হাসান (রাঃ) বলেন, আমি উপরোক্ত হাদীছখানা হিন্দ বিনতি আবী হালা (রাঃ) থেকে শোনার পর বেশ কিছুদিন পর্যন্ত তা আমার ভাই ইমাম হোসেন (রাঃ) থেকে গোপন রাখি। পরবর্তীতে তা যখন আমার ভাইয়ের কাছে বর্ণনা করলাম, তখন বুঝতে পারলাম যে তিনি এ হাদীছ সম্পর্কে পূর্ব থেকেই অবহিত আছেন। শুধু তাই নয়, তিনি আমার পিতা সাইয়্যেদুনা আলী (কাঃ) এর কাছে এই হাদীছ সম্পর্কে বহুবার জিজ্ঞাসাবাদও করেছিলেন। হুজুর আকরম (সঃ) এর গমনাগমন, আকৃতি প্রকৃতি উঠাবসা—সবকিছুই তিনি জেনে নিয়েছিলেন। এ সম্পর্কে হজরত ইমাম হোসাইন বর্ণনা করেন, আমি আমার সম্মানিত পিতা আলী (রাঃ) কে হুজুর আকরম (সঃ) এর ঘরে প্রবেশ করা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম । বললাম, হুজুর আকরম (সঃ) যখন ঘরে প্রবেশ করতেন, তখন তিনি কি করতেন? তিনি (হজরত আলী (রাঃ) বললেন, হুজুর (সঃ) যখন তাঁর পবিত্র গৃহাঙ্গনে প্রবেশ করতেন, তখন তাঁর সময়কে তিনটি ভাগে বিভক্ত করতেন । একভাগ আল্লাহর জন্য অর্থাৎ এক ভাগে ইবাদত করতেন। যদিও সর্বদা তিনি ইবাদতেই মশগুল থাকতেন। এখানে এ ইবাদতের অর্থ হচ্ছে বিশেষভাবে আল্লাহর ইবাদত করতেন। এই সময়ের মধ্যে পরিবার পরিজনের, নিজের এবং অন্য কারো হক অন্তর্ভূত থাকতো না । দ্বিতীয় অংশ পরিবার পরিজনের জন্য রাখতেন। অর্থাৎ এসময় তাঁদের হক আদায় করতেন। তাঁদের সঙ্গে কথাবার্তা বলতেন, কোনো অভাব অভিযোগ থাকলে তা পূরণ করতেন এবং তাঁদের সঙ্গে সহঅবস্থান করতেন। তাঁদেরকে সঙ্গ প্রদান করতেন। আর তৃতীয় অংশ নিজের জন্য রাখতেন। এ সময়ে তিনি নিজের পবিত্র শরীরের হক আদায় করতেন। অর্থাৎ বিশ্রাম গ্রহণ করতেন। নিদ্রা যেতেন বা এজাতীয় কাজ করতেন। অতঃপর এ অংশকেও দুভাগে ভাগ করতেন। একভাগ নিজের জন্য আরেকভাগ অন্যান্য মানুষের জন্য। এ অংশে তিনি অন্য লোকদেরকেও শরীক করে নিতেন। এ বন্টনের প্রকৃতিটি ছিলো এরকম—হুজুর (সঃ) তাঁর খাছ খাছ সাহাবীগণকে সময় দিতেন। সাধারণ মানুষের প্রয়োজনাদির কথা শুনতেন এবং তার বিধিব্যবস্থা করে দিতেন। খাছ খাছ সাহাবীগণকে তাঁর মুবারক মজলিশের ফায়দা প্রদান করতেন। যাতে তাঁদের মাধ্যমে অন্যরা উপকৃত হতে পারে। মোটকথা, প্রথমে একবার খাছ সাহাবীগণকে কোনো মাধ্যম ব্যতিরেকে সরাসরি ফায়দা প্রদান করতেন। এরপর সাধারণ লোকদেরকে উপলক্ষ্য করে পুনর্বার তাঁদেরকে ফায়দা প্রদান করতেন। এহেন ফায়দা প্রদান ও নসীহত করার ক্ষেত্রে হুজুর (সঃ) কৃপণতা বশতঃ ঐ সমস্ত লোকদের থেকে কিছুই অবশিষ্ট রেখে দিতেন না, অবারিত ধারায় ফায়দা প্রদান করে যেতেন। লোকদের অবস্থা ও যোগ্যতা অনুসারে তিনি তাঁদেরকে অনুগ্রহ প্রদান করতেন ।
হুজুর আকরম (সঃ) এর পূতপবিত্র জীবন ও মহিমান্বিত স্বভাবের মধ্যে যে সমস্ত মহানজন নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন তাঁদের বেলায় এবং আলেম ফাযেল ও পরিশোধিত ও সোহবতধন্য ব্যক্তিবর্গের বেলায় হুজুর (সঃ) এর গৃহাভ্যন্তরে প্রবেশ করার অনুমতি ছিলো। উপরোক্ত গুণের অধিকারীগণের বেলায় হুজুর (সঃ) তাঁর পবিত্র মজলিশে যোগদান করার ব্যাপারে বিশেষত্ব প্রদান করতেন। তাঁদের সম্মান ও মর্যাদা অনুসারে দ্বীনী কাজে তাঁদেরকে দায়িত্ব প্রদান করতেন। মোটকথা এই, যে ব্যক্তি হুজুর (সঃ) এর মজলিশে বা দ্বীনদারীতে যতো বেশী বিশেষত্ব ও স্বাতন্ত্র্যের অধিকারী হতেন, তিনি ঐ পরিমাণে হুজুর আকরম (সঃ) এর দান এবং অনুগ্রহের অধিকতর উপযোগী হতেন। তিনি মানুষের অভাব পূরণ করা ও আসহাবগণের উদ্দেশ্য অর্জিত হওয়ার ব্যাপারে সতর্ক থাকতেন এবং তাঁদেরকে উদ্দেশ্য করে বলতেন, তোমাদের মধ্যে যাঁরা এ পবিত্র মজলিশে উপস্থিত আছো তাদের উপর কর্তব্য যাঁরা উপস্থিত নেই তাঁদের কাছে আমার বাণী পৌঁছে দেয়া। তিনি তাঁদেরকে উদ্দেশ্য করে আরও বলতেন, যাঁরা আমার দরবারে উপস্থিত হয়ে আপন আপন প্রয়োজনের কথা ব্যক্ত করতে পারে না, তাদের পক্ষ থেকে সে সমস্ত প্রয়োজনের কথা আমার কাছে পৌঁছিয়ে দাও। এটা তোমাদের উপর ফরজ।
হুজুর আকরম (সঃ) এরশাদ করেছেন, প্রয়োজন পূরণ করতে পারে এমন ব্যক্তির কাছে যদি কেউ নিজের প্রয়োজনের কথা ব্যক্ত করতে না পারে তখন অপর কেউ যদি অক্ষম ব্যক্তিটির পক্ষ থেকে তাঁর প্রয়োজনের কথাটি পৌঁছিয়ে দেয়, তাহলে কিয়ামতের দিন আল্লাহ্পাক সেই ব্যক্তিকে কদমের দৃঢ়তা দান করবেন। উপরোক্ত বর্ণনা দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, হুজুর আকরম (সঃ) ব্যক্তিগত প্রয়োজন পেশ করার কথা উল্লেখ করেননি। হুজুর আকরম (সঃ) এর দরবারে এমন হাজত পেশ করা হতো দ্বীন ও দুনিয়া উভয় দিক দিয়েই যার প্রয়োজন রয়েছে। এছাড়া তাঁর পবিত্র মজলিশে অন্য কোনো প্রসঙ্গে আলোচনা হতো না। বিশেষ করে অনর্থক কথাবার্তা হতোনা । মানুষ তাঁর দরবারের এলেম, খায়ের ও বরকত থেকে ফয়েজ প্রাপ্ত হয়ে অন্য লোকদের কাছে যেতেন এবং তাঁদের পথপ্রদর্শনের কাজে নিয়োজিত হতেন।
সাইয়্যেদুনা হজরত ইমাম হোসেন (রাঃ) তাঁর ওয়ালেদ সাহেব হজরত আলী মুর্তজা (রাঃ) এর কাছে হুজুর আকরম (সঃ) এর বাইরে তশরীফ নেয়া এবং সাহাবাগণের সঙ্গে উপবেশনের ধরন কি রকম ছিলো, এ সম্পর্কে প্রশ্ন করলেন। হজরত আলী (রাঃ) বললেন, রসূলুল্লাহ (সঃ) স্বীয় জিহ্বা মুবারককে বন্ধ রাখতেন এবং তার হেফাযত করতেন। তবে যে সমস্ত কথায় মানুষের উপকার হতো তা তিনি ব্যক্ত করতেন। [আরবী] শব্দটি [আরবী] থেকে উৎপত্তি, যার অর্থ ভাণ্ডারে মাল সংরক্ষণ করা। এ কথাটি অই দিকই ইঙ্গিত করছে যে, হুজুর আকরম (সঃ) এর পবিত্র হৃদয় যা হাকীকত ও মারেফতে পরিপূর্ণ ছিলো, তার কুঞ্জি ছিলো তাঁর পবিত্র রসনা । উম্মতের জন্য যা উপকারী ও কল্যাণকর সে সমস্ত বিষয়ে তিনি জবান মুবারক খুলতেন। অন্যথায় মুখ বন্ধ রাখতেন। তিনি উম্মতের মনোরঞ্জন করতেন এবং নিজের সাহচর্য থেকে যাতে দূরে সরে না যায় তা থেকে উম্মতকে রক্ষা করতেন। প্রকৃতপ্রস্তাবে এ মহৎ কাজটি আল্লাহতায়ালার কাজ। যেমন আল্লাহ্পাক এরশাদ করেছেন, আল্লাহতায়ালা এতই মেহেরবান যে, তিনি তোমাদের অন্তঃকরণে প্রেম ভালোবাসা সৃষ্টি করে দিয়েছেন। তিনি দুর্বল ইমানদার লোকদের প্রতি বড়ই অনুগ্রহ করতেন । এ শ্রেণীর লোকদেরকে পবিত্র কুরআনের ভাষায় 'মুআল্লাফাতুল কুলুব' বলা হয়। প্রত্যেক সম্প্রদায়ের সম্মানিত ব্যক্তিকে তিনি সম্মান করতেন। এ জাতীয় লোককে সেখানকার জনসাধারণের জন্য হাকিম বা সরদার হিসাবে নিয়োজিত করতেন। এভাবে তাদেরকে সামনে রেখে হুজুর (সঃ) জনসাধারণ থেকে কিছুটা পরোক্ষে থাকতেন। ইসলামের দুশমন যারা তাদের সম্পর্কে তিনি যথেষ্ট হুঁশিয়ার থাকতেন এবং তাদের আচরণের প্রতি লক্ষ্য রাখতেন। মুসলমানদের যাতে কোনোরূপ ক্ষতি করতে না পারে সেজন্য তিনি সদাসচেতন দৃষ্টি রাখতেন। এটা অবশ্য তিনি করতেন ‘আল্লাহতায়ালা আপনাকে মানুষ থেকে হেফাযত করবেন' আয়াতখানা নাযিল হওয়ার পূর্বে। অথবা সতর্ক দৃষ্টি রাখার মধ্যে এলেম ও হেকমত রয়েছে। এতে উম্মতকে শিক্ষা দেয়াই উদ্দেশ্য ।
সাধারণ লোকদের থেকে যে হুজুর (সঃ) পরোক্ষে থাকতেন, তা প্রকৃতপ্রস্তাবে হুজুরের আত্মমর্যাদা ও শানশওকত প্রতিষ্ঠিত রাখার দিকে ইঙ্গিত বহন করে। যাতে করে তারা ভয়ভীতিহীন ও উন্নাসিক হতে না পারে। এই যে তিনি সতর্কতার সাথে চলতেন, মানুষের মেলামেশা থেকে নিজকে কিঞ্চিত দূরেত্ব রাখতেন, এ স্বত্বেও আত্মার প্রশস্ততা এবং সদাচরণের যে স্বভাবগত অভ্যাস তাঁর ছিলো, তা তিনি কখনও বর্জন করতেন না। তিনি স্বীয় সাহাবী বা সাথীগণকে তাঁদের হাল অবস্থা জিজ্ঞেস করতেন, তাঁদের মনকে খুশী রাখার জন্য চেষ্টা করতেন। মানুষদের কাছ থেকে পারস্পরিক হালঅবস্থা জেনে নিতেন, যাতে করে কারও কোনো সমস্যা না থাকে। সকলেই ভালো অবস্থায় দিনযাপন করতে পারে এবং একে অপরের প্রতি সদাচরণ করে। হুজুর (সঃ) ভালো কাজের জন্য সাহাবীগণকে উৎসাহ দিতেন, শক্তি যোগাতেন এবং প্রয়োজনমতো সাহায্য সহযোগিতা প্রদান করতেন। আর কাজ যদি যথাযথ না হতো তবে তা সংশোধন করে দিতেন এবং মন্দ কাজের নিন্দা করতেন এবং তা থেকে বিরত থাকার শিক্ষা দিতেন। তাঁর মহিমান্বিত স্বভাবই ছিলো এরূপ যে, তিনি ভালো কিছু দেখলে তার প্রশংসা করতেন এবং মন্দের নিন্দা করতেন। মন্দ কাজ যে কেউ করুক, তাকে তিনি র্ভৎসনা করতেন। এতে কেউ কোনো ক্ষতি করতে পারে এরকম মনে রেখে করতেন না। যে যতো বড়ো শক্তিধর এবং বাহ্যিক মর্যাদার অধিকারী লোক হোক না কেনো তাকে বিন্দু পরিমাণ ভয় করতেন না ।
হুজুর আকরম (সঃ) যে একজন থেকে অন্যজনের সংবাদ সংগ্রহ করতেন, তা কিন্তু গুপ্তচরমূলক প্রবণতার অন্তর্ভুত ছিলোনা। কেননা গুপ্তচরবৃত্তির উদ্দেশ্য হচ্ছে কারও গোপন দোষ অন্যের নিকট প্রকাশ করে দেয়া। হুজুর আকরম (সঃ) যে একজনের দ্বারা অপরজনের অবস্থা জেনে নিতেন, তা ছিলো প্রকাশ্য অবস্থা। কারও গোপন কোনো দোষ নয় । তাও তিনি প্রতিপালন ও সংশোধনের উদ্দেশ্যে করতেন। তিনি সবক্ষেত্রেই ভারসাম্য রক্ষাকারী ছিলেন। অর্থাৎ তাঁর যাবতীয় মহান কর্মধারা, সম্মানিত গুণাবলী— —এ সবকিছু ভারসাম্যময় ও স্বাতন্ত্র্যশোভিত ছিলো। তাঁর কাজের মধ্যে কখনও নিম্নগতি আবার কখনও ঊর্ধগতি হতো না। কাজের অবস্থার বিভিন্নতায় কখনও অতিরিক্ততা আবার কখনও স্বল্পতা ইত্যাদি অবস্থার সৃষ্টি হতো না। তিনি কখনও উম্মতের সৌজন্য, শালীনতা ও ভদ্রতা শিক্ষা দিতে উদাসীন হতেন না। সর্বদাই তাদেরকে পরিচালনা, পথপ্রদর্শন ও যত্ন নেয়ার ব্যাপারে মশগুল থাকতেন । তারা উত্তম আমল থেকে কখনও গাফেল হয়ে যায় কিনা এ ব্যাপারে সতর্ক থাকতেন। উম্মতের উপর ফরজ হয়ে যায় কিনা এ আশংকায় কঠিন কোনো ইবাদত চাপিয়ে দিতেন না অথবা সর্বদাই করার জন্য বলতেন না। হুজুর (সঃ) সর্বাবস্থায় সব কাজের জন্য প্রস্তুত থাকার ব্যাপারে উৎসাহ প্রদান করতেন। যেমন সমরাস্ত্র এবং যুদ্ধের আসবাবপত্র প্রস্তুত রাখতে উৎসাহ দিতেন। শুধু তাই নয়, এগুলির সরবরাহ ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য যা যা প্রয়োজন তার ব্যবস্থা করতেন। হক বা অধিকার সংক্রান্ত ব্যাপারে কোনোরূপ কার্পণ্য করতেন না এবং এসব ব্যাপারে অতিরঞ্জিত কিছু করতেন না। সর্বদাই হক প্রতিষ্ঠা করা এবং প্রতিষ্ঠিত রাখার মধ্যে নিয়োজিত থাকতেন। তাঁর দরবারে নৈকট্যপ্রাপ্তগণ এবং সোহবতগ্রহণকারী হজরতগণ সকলেই ছিলেন সৎকর্মশীল। এ মহান দরবারে অধিকতর মর্যাদাবান এবং নৈকট্য লাভকারী তাঁরাই হতেন, যাঁরা ছিলেন আপামর মানুষের জন্য অধিকতর কল্যাণকামী ।
সাইয়্যেদুনা হজরত ইমাম হোসেন (রাঃ) বলেন, আমি আমার পরম শ্রদ্ধেয় পিতা সাইয়্যেদুনা হজরত আলী মুর্তা (রাঃ) কে হুজুর আকরম (সঃ) এর দরবারের নিয়ম কানুন ও আদব সম্মান কি রকম ছিলো, এ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম। হুজুর আকরম (সঃ) এর সঙ্গে তাঁর সাহচর্য কি রকম ছিলো এ সম্পর্কেও আমি আমার ওয়ালেদ সাহেবকে জিজ্ঞেস করলাম। তিনি জবাব দিলেন, হুজুর আকরম (সঃ) উঠতে বসতে এমনকি সর্বাবস্থায় আল্লাহতায়ালার জিকিরে রত থাকতেন। যখন কোনো মজলিশে যোগদান করতেন, যেখানে জায়গা পেতেন সেখানেই বসে যেতেন। কোনো উঁচু আসন বা বিশেষ কোনো স্থানে বসার ইচ্ছা পোষণ করতেন না। নিজের বসার জন্য বিশেষ কোনো জায়গা নির্ধারিত করে রাখতেন না। তিনি উম্মতকেও এরূপ শিক্ষা প্রদান করতেন। উঁচু আসন বা বিশেষ স্থানের আকাংখা করতে নিষেধ করতেন। হুজুর আকরম (সঃ) স্বীয় অনুগ্রহ, আত্মিক মনযোগ ও লক্ষ্য প্রদানের মাধ্যমে মজলিশের সকলকে ধন্য করতেন। কেউ এরকম মনে করার অবকাশ পেতো যে, অমুক ব্যক্তি হয়তো তুলনামূলকভাবে রসূল (সঃ) এর নিকট অধিকতর সম্মানিত, অধিকতর নৈকট্যপ্রাপ্ত বা তাঁর সাহচর্যে অধিকতর ধন্য। তিনি মানুষ যোগ্যতা ও অবস্থা অনুসারে গুরত্ব প্রদান করতেন। কোনো লোক যে কোনো প্রয়োজনে হুজুর আকরম (সঃ) এর কাছে আসার পর প্রয়োজন মিটে গেলেও চলে যাওয়ার জন্য তাগিদ দিতেন না বরং স্বেচ্ছায় চলে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতেন। এমন কি তারা স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে উঠে না যাওয়া পর্যন্ত তিনি তাঁদেরকে রেখে কোথাও বেরও হতেন না। কেউ যদি তাঁর কাছে কোনো কিছু চাইতে বা কোনো প্রয়োজন নিয়ে উপস্থিত হতো, তিনি তাঁদেরকে মানা করতেন না বা ফিরিয়ে দিতেন না। বরং প্রয়োজন পূরণ করে দিতেন। আর ঐ সময় প্রয়োজন মিটানোর মতো কোনো কিছু যদি না থাকতো, তাহলে সুন্দর আচরণের মাধ্যমে তার মন জয় করার পর মিষ্টিকথা বলে তাঁকে বিদায় করতেন। এরকম মহিমান্বিত স্বভাব সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে হুজুর আকরম (সঃ) এর আখলাক অধ্যায়ের দানশীলতা ও মহানুভবতা অধ্যায়ে। তিনি সমগ্র মানুষের জন্য পিতৃতুল্য ছিলেন। অধিকারের দিক দিয়ে সকলেই তাঁর নিকট সমান ছিলো। তাঁর মজলিশ ছিলো বিদ্যা, সহিষ্ণুতা, লজ্জাশীলতা, ধৈর্য ও বিশ্বস্ততার মজলিশ । উক্ত মহতী মজলিশে উচ্চস্বরে কোনো আওয়াজ হতোনা। অবৈধ ও অশালীন কোনো কথাবার্তাও হতো না। মজলিশে অংশগ্রহণকারীগণের ভিতরে কখনও কারও দ্বারা কোনো অশোভন তৎপরতা ঘটে গেলে তিনি তা প্রকাশ করতেন না। মোটকথা, মানবীয় স্বভাবপ্রসূত কোনোরূপ অশোভন কাজ যদি কারও দ্বারা সম্পাদিত হয়েই যেতো তাহলে সে ব্যাপারে গোপনীয়তা বজায় রাখা হতো। মজলিশের সকল সদস্য পরস্পরে মুওয়াফেক ও সমান ছিলেন। বড়রা ছোটদের প্রতি স্নেহশীল থাকতেন । আর বড়দেরকে ছোটরা সম্মান করতেন। দরিদ্র অভাবীদের প্রতি সকলেই আত্মত্যাগী ছিলেন। অসহায় ও মোসাফিরদের প্রতি সকলেই ছিলেন যত্নবান ।
صلى الله عليه وسلم ورضى الله تعالى عنهم
পূর্ববর্তী পেইজ | পরবর্তী পেইজ |
(০৩৮) স্বপ্নদোষ থেকে নিরাপদ থাকা | |
সূচীপত্র | এরকম আরো পেইজ |