হুজুর আকরম (সঃ) এর বিস্ময়কর গুণাবলীর মধ্যে দেহ মুবারক থেকে নির্গত পবিত্র সুরভি অন্যতম। এহেন গুণটি তাঁর সত্তাগত ছিলো। তিনি দেহ মুবারকে কোনোরূপ সুগন্ধি ব্যবহার না করলেও দেহ থেকে যে সুঘ্রাণ বের হতো, পৃথিবীর কোনো সুগন্ধি তার সমতুল্য হতে পারতোনা। সায়্যিদুনা হজরত আনাস (রাঃ) বর্ণনা করেন, যতো প্রকারের সৌরভ আছে চাই তা মেশক হোক বা আম্বর, আমি তার ঘ্রাণ গ্রহণ করেছি। কিন্তু নবীকরীম (সঃ) এর পবিত্রতম দেহের সৌরভের সমতুল্য কিছুই হতে পারে না । উতবা ইবন ফারকাজ সালমী (রাঃ) এর স্ত্রী হজরত উম্মে আসেম (রাঃ) বর্ণনা করেন, আমরা চার মহিলা উতবার স্ত্রী ছিলাম। আর আমরা চার সতীন প্রত্যেকেই চেষ্টা করতাম কে কার চেয়ে বেশী খোশবু ব্যবহার করে উতবার নিকটে যেতে পারি। এহেন প্রয়াসে আমরা প্রত্যেকেই খোশবু খুব বেশী ব্যবহার করতাম। কিন্তু বিস্ময়ের ব্যাপার যে, আমাদের সকলের খোশবুই উতবার দেহের খোশবুর কাছে ম্লান হয়ে যেতো। আর উতবা (রাঃ) এর খোশবু ব্যবহারের অভ্যাস এরকম ছিলো যে, তিনি হাতে স্বাভাবিকভাবে একটু তেল মালিশ করে দাড়িতে মেখে নিতেন এর বেশী কিছু নয়। কিন্তু তবুও দেখা যেতো, তাঁর খোশবুই আমাদের সকলের খোশবুর উপর প্রবল হয়ে গেছে। এদিকে হজরত উতবা (রাঃ) যখন বাইরে যেতেন, তখন লোকেরা বলাবলি করতো, আমরাও তো সুগন্ধি ব্যবহার করে থাকি। কিন্তু উতবার সুগন্ধির তুলনায় আমাদের খোশবু তেমন তেজস্কর নয় । হজরত উম্মে আসেম (রাঃ) বলেন, আমি একদিন আমার স্বামী উতবাকে বললাম, আমরাতো সকলেই সুগন্ধী ব্যবহার করে তার সুঘ্রাণ ছড়াতে যথাসাধ্য চেষ্টা করি, কিন্তু আমাদের খোশবু তো আপনার সুবাসের ধারে কাছেও পৌঁছাতে পারে না। এর কারণ কি? তখন তিনি বললেন, রসূলে খোদা (সঃ) এর জীবদ্দশায় আমার সমস্ত শরীরে একবার অত্যধিক গরমের কারণে ফোস্কা পড়ে গিয়েছিলো। (এর কারণে মনে হতো সমস্ত শরীরে যেনো আগুন লেগে গেছে)। এতে অস্থির হয়ে আমি হুজুর আকরম (সঃ) এর খেদমতে হাজির হয়ে আমার অসুস্থতার অবস্থা বর্ণনা করলাম । তখন তিনি এর চিকিৎসা করে দিলেন। বললেন, “তোমার শরীরের কাপড় খুলে ফেলো।” আমি কাপড় খুলে তাঁর সামনে বসে গেলাম। হুজুর পাক (সঃ) স্বীয় হস্ত মুবারক আমার গায়ের উপর বুলিয়ে দিলেন। পেট ও পিঠেও হাত বুলিয়ে দিলেন। সে সময় থেকেই আমার শরীরে এ সৌগন্ধের সৃষ্টি। এই ঘটনা ইমাম তিবরানী ‘মু’জামায়ে সগীর' নামক কিতাবে বর্ণনা করেছেন ।
একব্যক্তি তার কন্যাকে বিয়ে দিয়ে স্বামীর ঘরে পাঠানোর সময় সুগন্ধি খোঁজাখুজি করছিলেন। কিন্তু কোনোখানে জোগাড় করতে পারছিলেন না । অবশেষে লোকটি হুজুর পাক (সঃ) এর খেদমতে হাজির হয়ে সমস্যার কথা বর্ণনা করলেন। তখন হুজুর (সঃ) তাকে খোশবুর ব্যবস্থা করে দিলেন। কিন্তু নবী করীম(সঃ) এর নিকট তখন কোনো খোশবু ছিলো না । তিনি লোকটিকে বললেন, “একটি শিশি নিয়ে এসো।” লোকটি শিশি নিয়ে এলে তিনি নিজের শরীর মুবারক থেকে নির্গত ঘাম দিয়ে শিশি পুরে দিয়ে বললেন, এই ঘাম তোমার মেয়ের গায়ে মেখে দিও। –ঐ শিশি থেকে নবী করীম (সঃ) এর পবিত্র ঘাম নিয়ে যখন কন্যাটির গায়ে মেখে দেয়া হলো, তখন সমস্ত মদীনা মুনাওয়ারা তার সুরভিতে সুরভিত হয়ে গেলো। এর পর থেকে সে বাড়িটির নাম রাখা হয়েছিলো ‘বাইতুলমুতিযীন' বা আতর ভবন।
হজরত আনাস (রাঃ) বর্ণনা করেন, একদিন হুজুর আকরম (সঃ) আমার বাড়িতে তশরীফ নিয়ে এলেন। দুপুর বেলায় তিনি কায়লুলা করছিলেন। নিদ্রিত অবস্থায় হুজুর আকরম (সঃ) এর দেহ মুবারক থেকে খুব ঘাম নির্গত হচ্ছিলো। আমার আম্মাজান উম্মে সুলায়াম একখানা শিশিতে ঘাম মুবারক জমা করতে লাগলেন । হুজুর পাক (সঃ) এর ঘুম ভেঙে গেলো । তিনি চোখ মেলে তাকালেন। বললেন, ওহে উম্মে সুলায়াম ! তুমি কি করছো? তিনি আরয করলেন, ইয়া রসূলাল্লাহ্! আপনার স্বেদ মুবারক জমা করছি। আমি এগুলো খোশবু হিসাবে ব্যবহার করবো। কেননা আপনার পবিত্র স্বেদের খোশবু তো সবচেয়ে উত্তম খোশবু। হাদীছখানা মুসলিম শরীফে বর্ণিত হয়েছে।
হজরত আনাস (রাঃ) থেকে এও বর্ণিত আছে, সাহাবীগণ হুজুর পাক (সঃ) এর দর্শনের প্রত্যাশী হয়ে এসে তাঁকে না পেলে রাস্তায় নেমে খোশবু শুঁকতে থাকতেন। তাঁর অতিক্রমণের ফলে রাস্তায় যে সুবাস ছড়িয়ে পড়তো, তার অনুসরণ করতেন। মদীনা মুনাওয়ারার যে অলি গলিতে সে খোশবু অনুভব করতেন, সেদিকেই তাঁরা ছুটে যেতেন ।
এখন পর্যন্ত মদীনা মুনাওয়ারার দেয়ালে দেয়ালে তাঁর মনোহর সুরভির আঘ্রাণ অনুভূত হয়। যার সুবাস আশেক মজনুদেরকে উতলা করে। যেনো সেই খোশবুর মৃদু সমীরণ ফকীর দরবেশ, প্রেমিক মোসাফিরগণকে এখনো স্বগীয় তৃপ্তির পরশ বুলিয়ে যাচ্ছে। মদীনা তাইয়্যেবার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে আবু আবদুল্লাহ আত্তার কেমন প্রাণের আকুতির বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন তাঁর কবিতার মাধ্যমে
بطيب رسول الله قطاب نسيمها
فما المشك والكافو المندل الرطب
অর্থাৎ রসূলুল্লাহ (সঃ) এর খোশবুতে মদীনা তাইয়্যেবার পরিবেশ সুরভিত। মেশক ও কাঙ্কুরের সুগন্ধি কোন্ ছার? সেরকম সুগন্ধিতো সেখানকার খেজুরের ভিতরেও বিদ্যমান ।
জাগ্রত অনুভূতিসম্পন্ন আলেম হজরত শোবাইলী (রঃ) বলেন, মদীনা তাইয়্যেবার পবিত্র মৃত্তিকায় এক বিশেষ ধরনের সুঘ্রাণ নিহিত আছে। যার উপস্থিতি মেশক আম্বরের মধ্যেও পাওয়া যায় না। মদীনা তাইয়্যেবার মাটিতে এরকম খোশবু সত্যিই এক বিস্ময়কর ব্যাপার ।
আবু নঈম হজরত আয়েশা সিদ্দীকা (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেন, নবী করীম (সঃ) এর নূরানী চেহারার উপর নির্গত স্বেদবিন্দু মোতির দানার মতো চকচক করতো। আর তার খোশবু মেশকের চেয়েও বেশী ছিলো ।
পূর্ববর্তী পেইজ | পরবর্তী পেইজ |
(০৩২) পবিত্র পদবিক্ষেপ | (০৩৪) পবিত্র হস্তের সুঘ্রাণ |
সূচীপত্র | এরকম আরো পেইজ |