হুজুর পাক (সঃ) এর দেহ মুবারকের বর্ণ ছিলো উজ্জ্বল ও দ্যুতিময় । সাহাবা সমাজের একতাবদ্ধ মত এই যে, তাঁর দেহের বর্ণে শুভ্রতার আধিক্য ছিলো। সাহাবাগণ শুভ্রতা দ্বারাই তাঁর প্রশংসা ও বর্ণনা পেশ করেছেন। কেউ কেউ এরকম বলেছেন [আরবী] 'কানাআবইয়াদু মালীহান'—লাবণ্যময় শুভ্র ছিলো। এক বর্ণনায় এসেছে, চেহারা মুবারকে লাবণ্যময় শুভ্রতা ছিলো। এ জাতীয় বর্ণনা দ্বারা বুঝানো হয়েছে যে, তাঁর দেহ মুবারক শুভ্র এবং লাবণ্যময় ছিলো । বস্তুতঃ তাঁর রূপসৌন্দর্য প্রকাশার্থে দীদারের উদগ্র বাসনায় উন্মুখজনের চিত্তাকর্ষণের জন্য চরম ও পরম আস্বাদ প্রদানের বর্ণনা প্রকাশার্থে লাবণ্য তাঁর দেহ মুবারকের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য। অথবা নিরেট শুভ্রতা যাকে ‘আবহাক' বলা হয়, তা না বুঝানোর জন্য লাবণ্যের বিশেষণ উপস্থাপন করা হয়েছে। ‘আবহাক' এর ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, এটা এমন শুভ্রতা যার মধ্যে লাল, হলুদ বা বাদামী রং কোনোটিরই সংমিশ্রণ নেই। এ জাতীয় শুভ্রতার সাদৃশ্য দেখা যায় স্বেতী বা ধবল রোগীর চেহারার মধ্যে ।
অন্য আর এক বিবরণে মাছে, তাঁর চেহারা আনওয়ার খুব শুভ্র ছিলো। আর শ্মশ্রু মুবারক ছিলো গাঢ় কৃষ্ণ। আবু তালেব নবী করীম (সঃ) এর প্রশংসায় বলেছেন, ‘তাঁর চেহারা মুবারকের শুভ্রতার কাছে বর্ষণকারী শুভ্র মেঘমালাও ভিক্ষা তালাশ করে। তিনি এতীম ও বিধবাদের প্রতিপালনকারী।' হজরত আলী মুর্তজা (রাঃ) এর হাদীছে বর্ণিত হয়েছে, তাঁর বর্ণ সাদা মাশরাবী সদৃশ। আর মাশরাব ঐ শরাবকে বলা হয়, যার এক বর্ণের সাথে অন্য বর্ণের মিশ্রণ ঘটে। যেমন নাকি এক রঙের শরাব পান করার সঙ্গে সঙ্গে অন্য বর্ণের শরাবও পান করানো হয়েছে। এখানে মাশরাব এর অর্থ করা হয়েছে লাল বর্ণ। অন্য বর্ণনায় মাশরাবের ব্যাখ্যাও এসেছে। যেমন তাঁর বর্ণ সাদা মাশরাবের মতো যাতে লাল রঙও মিশ্রিত । আবার কোনো কোনো হাদীছে [আরবী] ‘আযহারুল্লাউন' বর্ণনা এসেছে। যেমন হজরত আনাস (রাঃ) এর হাদীছ। এর ব্যাখ্যাও উপরোক্ত ব্যাখ্যার ন্যায়। বস্তুতঃ বর্ণনাসমূহ দ্বারা তাঁর অঙ্গসৌষ্ঠবের চাকচিক্য ও দ্যুতিময়তাকে বুঝানো হয়েছে ।
নাসায়ী শরীফে হজরত আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, একদা হুজুর আকরম (সঃ) সাহাবায়ে কেরামগণের সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন। এক বেদুইন ব্যক্তি দূত হয়ে এলো। সে সরলতা, মহব্বত ও বিস্ময়ের সাথে জিজ্ঞেস করলো, আব্দুল মুত্তালীবের বেটা কোথায়? আর তোমাদের মধ্যে তিনি কোন ব্যক্তি? অর্থাৎ ঐ সুমহান ব্যক্তিত্ব যার রূপ ও সৌন্দর্যের সুখ্যাতি পৃথিবীকে বেষ্টন করে নিয়েছে, যার শান শওকতের কলতান সারা পৃথিবীতে গুঞ্জরিত হচ্ছে-তিনি কোথায়? সাহাবাগণ বলতে লাগলেন, সাদা ও লাল বর্ণের ঐ লোকটি যিনি স্বীয় কনুইয়ে ভর করে বসে আছেন। অভিধান গ্রন্থে [আরবী] ‘আমগার' বলা হয় ঐ ব্যক্তিকে যাঁর চেহারায় লাল ও সাদা বর্ণের মিশ্রিত আভা, পরিলক্ষিত হয়। তাঁর ‘মুরাফফেক' বলা হয় ঐ ব্যক্তিকে যে স্বীয় কনুইয়ে ভর করে বসে। বুখারী শরীফে হজরত আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে, তিনি শ্বেতী রোগীর ন্যায় সাদা ছিলেন না। অভিধানের ভাষায় [আরবী] ‘আবহাক' এর অর্থ নিছক সাদা বর্ণ যাতে লাল বর্ণের কোনোরূপ মিশ্রণ নেই এবং তাতে রঙের কোনোরূপ দ্যুতিও নেই। এ ছাড়াও তাঁর দেহের বর্ণের বর্ণনায় ‘আসমার’ শব্দও এসেছে। ‘সামুরাহ্’ সাদা ও কালো বর্ণের মাঝামাঝি এক প্রকার রঙকে বলা হয়। ‘সামরা' বলা হয় বাদামী রঙকে। তবে ‘সাররাহ’ গ্রন্থে ‘সামুরাহ' বলা হয়েছে বাদামী রঙকে। বলা হয়েছে এ ‘সামরা' বর্ণটি মাশরাবী শুভ্রতার সাথে মিলে। আরববাসীরা আবার উক্ত রঙ বুঝানোর জন্য ‘সামরা' শব্দ ব্যবহার করে থাকে। অন্য এক হাদীছে এসেছে [আরবী] ‘আবইয়াদ’ মানে [আরবী] ‘মায়েল বসামুরাহ’ ––– সাদা বর্ণ যা বাদামীর দিকে যায়। বলা হয় [আরবী] ‘মুশাররাব’ বর্ণ যখন [আরবী] ‘মুবাশশা’ এর সঙ্গে মিলিত হয় তখন তাতে [আরবী] ‘আসমার' বর্ণের সাদৃশ্য হয়। তবে হুজুর পাক (সঃ) এর দেহের বর্ণে [আরবী] উদমাহ' কে রহিত করা হয়েছে। ‘উদমাহ' বলা হয় মিশমিশে কাল বর্ণকে । সুতরাং এখানে তিরমিযী শরীফের এক হাদীছে এসেছে তাঁর দেহের বর্ণ শ্বেতীর মতো সাদাও ছিলো না আবার সম্পূর্ণ কালোও ছিলোনা। সারারাহ্ নামক অভিধান গ্রন্থে ‘উদমাহ’ এর ‘সামুরাহ’ এবং [আরবী] ‘আদম' অর্থ ‘আসমার’ করা হয়েছে। এ কথার পরিপ্রেক্ষিতে বুঝা যায় যে لا بالادم ‘লাবিল আদম' এর অর্থ “উদমাহ’ । অর্থাৎ খুব কালো ছিলো না। এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, ‘সামুরার' এর সাথে মিশ্রিত সাদা বর্ণ এবং ঐ সাদা বর্ণ যার মধ্যে রক্তিমতার মিশ্রণ থাকে। নিছক সাদা বর্ণ যা কে [আরবী] ‘আবহাক’ বা এবং এর ‘মাবরুস' (শ্বেতী রোগীর ন্যায় সাদা বর্ণ) বলা হয়, তা না বুঝানোই এর উদ্দেশ্য। এই বর্ণনা দ্বারা আল্লামা ইবন জাওযীর বক্তব্য রহিত হয়ে যায়। হাদীছের ব্যাখ্যায় যেখানে তিনি বলেছেন [আরবী] 'কানা আসমার'—এটি ভুল বলে প্রতীয়মান হয় । কারণ, এ বক্তব্যটি হাদীছের বর্ণনার বিরোধী। যেহেতু হাদীছ শরীফে সুষ্পষ্ট ভাবে ‘রক্তিম শুভ্রতা' এবং 'কাল নয়' বর্ণনা রয়েছে। উক্ত ‘আদম' শব্দটির অর্থ হবে ‘আসমার’ অর্থাৎ বাদামী রঙ । ইবন জাওযী যা বলেছেন, তা সাদা ও বাদামী রঙের মিশ্রণের পরিপ্রেক্ষিতে বলেছেন। তিনি তাঁর বক্তব্য দ্বারা এটাই বুঝাতে চেয়েছেন যে, হুজুর আকরম (সঃ) দেহের যে অংশে রোদের প্রতিক্রিয়া পড়তো, সে অংশ ‘বাদামী’ দেখা যেতো। আর যে অংশ কাপড়ের নীচে থাকতো তা সাদা দেখা যেতো। কিন্তু আলেমগণ এতেও একমত হননি। কেননা সূর্যের কিরণ ও বায়ুর তাছীর তাঁর দেহ মুবারকের বর্ণে কোনোরূপ পরিবর্তন আনতে পারতোনা। যেমন ‘আনওয়ারুল মুতাজাররাদ' এ ইবন আবী হালা (রাঃ) থেকে হাদীছ এসেছে, হুজুর আকরম (সঃ) এর পবিত্র বদনের যে অংশ পোশাকের বাইরে অনাচ্ছাদিত অবস্থায় থাকতো, সে অংশ সাধারণ মানুষের মতো ছিলো না। বরং তার বিপরীত ছিলো। উজ্জল ও শুভ্র ছিলো। হাকীকত হচ্ছে এই যে, মহব্বত ও ভালোবাসা সেতো তাঁর দরজার নগণ্য এক খাদেম তুল্য। নতুবা কেউ কি নবী করীম (সঃ) এর শানে এমন বিশেষণ প্রয়োগ করতে পারে—যা তাঁর মধ্যে ছিলোনা। কেউ কেউ আবার এরকম বলেছেন, জীবনের শেষভাগে তাঁর দেহের বর্ণ গাঢ় হয়ে গিয়েছিলো। সে সময়ই বাদামীর দিকে টানটান লাল বর্ণ পরিলক্ষিত হতো ।
পূর্ববর্তী পেইজ | পরবর্তী পেইজ |
(০৩০) ছায়াহীনতা | (০৩২) পবিত্র পদবিক্ষেপ |
সূচীপত্র | এরকম আরো পেইজ |