আলোচ্য মাসআলা প্রসঙ্গে লা-মযহাবীরা নিম্ন বর্ণিত আপত্তিগুলো করে থাকে। ইন্শাআল্লাহ, তাদের পক্ষে এর থেকে আর কিছু বেশী বলার নেই। এমন কি সাধারণ লা-মাযহাবীরা এতটুকুও জানে না, যা আমি তাদের হয়ে উত্থাপন করেছি।
আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ ফরমান
الطَّلَاقُ مَرَّتَانِ فَإِمْسَاكٌ بِمَعْرُوفٍ أَوْ تَسْرِيحٌ بِإِحْسَانٍ
সূরা বাক্বারা, আয়াত নং-২২৯, আয়াত নং-২৩১।
একটু পরে আরও ইরশাদ করেন-
فَإِنْ طَلَّقَهَا فَلَا تَحِلُّ لَهُ
مَرَّتَانِ শব্দ দ্বারা এবং فان এর ف দ্বারা বোঝা গেল যে তালাকসমূহ পৃথক পৃথক হওয়া চাই। কিন্তু এক সঙ্গে তিন তালাক বলার সময় আলাদা আলাদা কোথায় হলো।
এ আপত্তির কয়েক ধরনের জবাব দেয়া যায়।
{الطَّلَاق} أَيْ التَّطْلِيق الَّذِي يُرَاجِع بَعْده مَرَّتَانِ
¶ ইমাম সুয়ূতি, তাফসিরে জালালাইন, ৪৯ পৃ:
ارْجِعِ الْبَصَرَ كَرَّتَيْنِ
আসমানের দিকে বার বার দেখুন।’’
¶ সূরা মুুলুক, আয়াত নং-৪।
এ আয়াতের ভাবার্থ এ নয় যে আসমানের দিকে মাসে এক বার তাকাও; তিন, আপনাদের তাফসীর দ্বারাও আয়াতের ভাবার্থ এটাই প্রকাশ পায় যে তালাকসমূহ পৃথক পৃথক প্রদান করা বাঞ্ছনীয়। আমরাও তাই বলি যে এক সঙ্গে তিন তালাক দেয়া একান্ত নিষেধ; পৃথক পৃথক দেয়াটাই বাঞ্ছনীয়। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, যদি কেউ বোকামী করে রাগের মাথায় এক সঙ্গে তিন তালাক দিয়ে দেয়, তাহলে তিন তালাক কার্যকরী হবে কিনা? এ প্রসঙ্গে আলোচ্য আয়াত নীরব।
মুসলিম শরীফের কিতাবুত তালাকে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস থেকে বর্ণিত আছে যে, হুযূর (ﷺ) ও সিদ্দীক আকবরের যুগে, এমনকি হযরত উমর ফারুকের যুগের প্রারম্ভেও এটাই বিধান ছিল যে এক সংগে তিন তালাক দিলে এক তালাকই পতিত হবে। হাদীছের ইবারতটা হচ্ছে নিম্নরূপ
عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ، قَالَ: كَانَ الطَّلَاقُ عَلَى عَهْدِ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، وَأَبِي بَكْرٍ، وَسَنَتَيْنِ مِنْ خِلَافَةِ عُمَرَ، طَلَاقُ الثَّلَاثِ وَاحِدَةً
¶ ইমাম মুসলিম, আস-সহীহ, পৃষ্ঠা-৫৬০, হাদিস-১৪৭২, দারুল কুতুব ইলমিয়্যাহ, বয়রুত, লেবানন।
°মুসলিম শরীফের একই জায়গায় আরও বর্ণিত আছে, হযরত আবু সাহাবা হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস থেকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন- আপনি কি জানেন নবীজী ও সিদ্দীকে আকবরের যুগে তিন তালাককে এক তালাকই মনে করা হতো? তিনি বললেন হ্যাঁ। হাদীছের আরবী ইবারতটা হচ্ছে -৬৯২
أَنَّ أَبَا الصَّهْبَاءِ، قَالَ لِابْنِ عَبَّاسٍ: أَتَعْلَمُ أَنَّمَا كَانَتِ الثَّلَاثُ تُجْعَلُ وَاحِدَةً عَلَى عَهْدِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، وَأَبِي بَكْرٍ، وَثَلَاثًا مِنْ إِمَارَةِ عُمَرَ؟ فَقَالَ ابْنُ عَبَّاسٍ: :نَعَمْ
¶ ইমাম মুসলিম, আস-সহীহ, পৃষ্ঠা-৫৬০, হাদিস-১৪৭২, দারুল কুতুব ইলমিয়্যাহ, বয়রুত, লেবানন।
উপরোক্ত হাদীছসমূহ থেকে সুস্পষ্টভাবে বোঝা গেল যে এক সংগে তিন তালাক দিলে এক তালাকই কার্যকরী হয়। এটাই হচ্ছে লা-মযহাবীদের সবচেয়ে জোরালো আপত্তি।
এ আপত্তির কয়েকটি উত্তর দেয়া যায়। এক, এ হাদীছটি মনসুখ (রহিত) কেননা সৈয়্যদুনা ইবনে আব্বাস থেকেই বর্ণিত আছে এবং এটা তাঁরই প্রদত্ত ফত্ওয়া যে এক সংগে তিন তালাক দিলে তিন তালাকই কার্যকরী হয় যার বর্ণনা প্রথম অধ্যায়ে করা হয়েছে এবং যখন রিওয়ায়েত কারীর আমল স্বীয় রিওয়ায়েতকৃত হাদীছের বিপরীত হয়, তখন ধরে নিতে হবে যে রিওয়ায়েতকারীর দৃষ্টিতে হাদীছটি মনসুখ। অধিকন্তু সাহাবায়ে কিরামের বর্তমানে হযরত উমর ফারুক কর্তৃক এক সঙ্গে তিন তারাক দিলে তিন তালাক হওয়ার হুকুম জারী করা এবং সবাই সে অনুযায়ী আমল করা এবং কোন সাহাবী এমন কি স্বয়ং সৈয়্যদুনা আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস এ প্রসংগে কোন আপত্তি না করার দ্বারা সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে উক্ত হাদীছটি হয়তো মনসুখ বা ব্যাখ্যা সাপেক্ষ। কেননা সাহাবায়ে কিরাম কখনও হাদীছের বিপরীত ঐক্যমত হতে পারে না।’ দুই, এ হাদিছে ওই ধরনের মহিলাকে তালাক দেয়া বুঝানো হয়েছে, যার সাথে দৈহিক সর্ম্পক হয়নি এবং বাস্তবিকই যদি কোন ব্যক্তি নিজের স্ত্রীকে তোমাকে তালাক, তালাক, তালাক এভাবে এক সংগে তিন তালাক দেয়, তাহলে এক তালাকই কার্যকরী হবে; শেষের দু’তালাক ধর্তব্য নয়। যেমন আবু দাউদ শরীফে কিতাবুত তালাকের- نسخ المراجعه بعد النطليقات الثلث শীর্ষক অধ্যায়ে বর্ণিত আছে যে হযরত আবু সাহাবা হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস থেকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন- আপনি কি জানেন যে হুযূর ও সিদ্দীক আকবরের যুগে ও উমর ফারুকের খিলাফতের প্রারম্ভে যে কেউ নিজ স্ত্রীকে তিন তালাক দিলে নাকি এক তালাকই ধরা হতো? এর উত্তরে তিনি বলেছিলেন- হ্যাঁ। দৈহিক সর্ম্পকহীন স্ত্রীকে তিন তালাক দিলে এক তালাকই কার্যকরী হতো। হাদীছের ইবারতটা হচ্ছে
قَالَ ابْنُ عَبَّاسٍ: بَلَى، كَانَ الرَّجُلُ إِذَا طَلَّقَ امْرَأَتَهُ ثَلَاثًا قَبْلَ أَنْ يَدْخُلَ بِهَا، جَعَلُوهَا وَاحِدَةً
¶ ইমাম আবু দাউদ, আস্-সুনান, কিতাবুত-তালাক, খণ্ড-২, পৃষ্ঠা-৪৫০, হাদিস-২১৯৯।
এ হাদীছ থেকে সুস্পষ্ট বোঝা যায় যে, মুসলিম শরীফের বর্ণিত হাদীছেল ভাবার্থ তা-ই হবে। এবং এ হুকুমটা এখনও বলবৎ আছে, যেমন আমি ভূমিকায় আলোকপাত করেছি। তিন, হুযূর (ﷺ) ও সিদ্দীক আকবরের যামানার লোকেরা তিন তালাক এভাবে দিতেন, তোমাকে তালাক, তালাক, তালাক। সম্ভবতঃ শেষের দু’তালাক প্রথম তালাকের প্রতি জোর দেয়ার জন্য বলা হতো। কিন্তু উমর ফারুকের যুগে লোকের এ রীতি পরিবর্তন হয়ে যায় এবং তারা এক সংগে তিন তালাকই দিতে শুরু করলেন। সুতরাং মাসআলার আকৃতি পরিবর্তিত হওয়ার কারণে হুকুমেরও পরিবর্তন হয়ে গেছে।
নববী শরীফে বর্ণিত আছে
فَالْأَصَحُّ أَنَّ مَعْنَاهُ أَنَّهُ كَانَ فِي أَوَّلِ الْأَمْرِ إِذَا قَالَ لَهَا أَنْتِ طَالِقٌ أَنْتِ طَالِقٌ أَنْتِ طَالِقٌ وَلَمْ يَنْوِ تَأْكِيدًا وَلَا اسْتِئْنَافًا يُحْكَمُ بِوُقُوعِ طَلْقَةٍ لِقِلَّةِ إِرَادَتِهِمُ الِاسْتِئْنَافَ بِذَلِكَ فَحُمِلَ عَلَى الْغَالِبِ الَّذِي هُوَ إِرَادَةُ التَّأْكِيدِ فَلَمَّا كَانَ فِي زَمَنِ عُمَرَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ وَكَثُرَ اسْتِعْمَالُ النَّاسِ بِهَذِهِ الصِّيغَةِ وَغَلَبَ مِنْهُمْ إِرَادَةُ الِاسْتِئْنَافِ بِهَا حُمِلَتْ عِنْدَ الْإِطْلَاقِ عَلَى الثَّلَاثِ عَمَلًا بِالْغَالِبِ السَّابِقِ إِلَى الْفَهْمِ مِنْهَا فِي ذَلِكَ الْعَصْرِ
¶ ইমাম নববী, শরহে সহীহ মুসলিম, খণ্ড-১০, পৃষ্ঠা-৭১, হাদিস-১৪৭২ এর আলোচনা।
-যেহেতু হুযূর (ﷺ) এর যুগে সাধারণতঃ লোকেরা তিন তালাকের মধ্যে প্রথম তালাক দ্বারা তালাকের নিয়ত করতেন এবং পরবর্তী তালাক দ্বারা (প্রথম তালাকের প্রতি) জোর দিতেন। এ জন্য যে কেউ বিনা নিয়তে এক সংগে তিন তালাক দিলে, এক তালাকই ধরা হতো। ওই সময় অধিকাংশ (তালাকঘটিত) ব্যাপার এ রকমই ছিল। কিন্তু হযরত উমর ফারুকের যুগে লোকেরা সাধারণতঃ তিন তালাক দ্বারা তিনেরই নিয়ত করতেন। এজন্য তিন তালাক কার্যকরী হওয়ার কথা ঘোষণঅ করা হলো। মাসআলার আকৃতি পরিবর্তনের সাথে সাথে হুকুমেরও পরিবর্তন হয়ে গেছে। দেখুন কুরআন শরীফে যাকাতের হকদার আট বর্ণিত আছে। অর্থাৎ মোয়ালেফাতুল কুলুব ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট কাফিরগণকে)কেও যাকাত দেয়ার অনুমতি দেয়া হয়েছিল। কিন্তু হযরত উমর ফারুকের যুগে সাহাবায়ে কিরাম সর্বসম্মতিক্রমে যাকাতের হকদার সাত ঘোষণা করলেন এবং মোয়ালেফাতুল কুলুবকে বাদ দিলেন। কেননা কুরআন অবতীর্ণ হওয়ার সময় মুসলমানের জামাত ছোট ও দুর্বল ছিল বিধায় কাফিরদেরকে যাকাত দিয়ে আকৃষ্ট করা হতো। কিন্তু হযরত উমর ফারুকের যুগে মুসলমানেরা কম ছিল না এবং দুর্বলও ছিল না। তাই ওদেরকে যাকাত দেয়া বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। কারণ পরিবর্তনের ফলে হুকুমও পরিবর্তন হয়েছে; রহিত করা হয়নি যতক্ষণ পর্যন্ত যায়েদ গরীব ছিল, ওকে যাকাত দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কিন্তু যখন ধনী হয়ে গেল, তখন যাকাত প্রদানের হুকুম দেয়া হয়েছে; কাপড় যখন নাপাক ছিল, তখন নামায নাজায়েয বলা হয়েছে। কিন্তু যখন পাক হয়ে গেছে তখন জায়েয হয়ে গেছে। আজকাল ভারত বর্ষের লোকেরা তালাকের প্রতি জোর দেয়া বলতে কিছু বুঝে না। এক সঙ্গে তিন তালাকের নিয়তেই তালাক দিয়ে থাকে। আশ্চর্যের বিষয় মাসআলার আকৃতি এক রকম আর হুকুম অন্য রকম! আল্লাহ, লা-মযহাবীদেরকে সঠিক জ্ঞান দান করুন যাতে হাদীছের সঠিক ভাবার্থ বুঝতে পারে।
আবু দাউদ শরীফের প্রথম খণ্ড ও দুর্রে মনসুরের প্রথম খণ্ডের ২৭৯ পৃষ্ঠায় এবং হযরত আবদুর রায়যাক ও বায়হাকী (রহঃ) আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস থেকে বর্ণনা করেছেন যে আবদু ইয়াযিদ আবু রুকানা স্বীয় স্ত্রী উম্মে রুকানাকে তালাক দিলেন। হুযূর (ﷺ) ফরমালেন তালাক প্রত্যাহার করে নাও। তিনি আরয করলেন হুযূর আমিতো তিন তালাকই দিয়ে দিয়েছি। হুযূর ফরমালেন আমি তো জানি; তবুও প্রত্যাহার কর; অতপর- এ আয়াতটি তিলাওয়াত করেন।
يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ إِذَا طَلَّقْتُمُ النِّسَاءَ فَطَلِّقُوهُنَّ لِعِدَّتِهِنَّ
¶ সূূরা তালাক, আয়াত নং-১।
আবু দাউদ ও অন্যান্য গ্রন্থের ইবারতটা হচ্ছে -
فَقَالَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لِعَبْدِ يَزِيدَ: ্রطَلِّقْهَا: فَفَعَلَ، فَقَالَ: ্রرَاجِعِ امْرَأَتَكَ أُمَّ رُكَانَةَ: فَقَالَ: إِنِّي طَلَّقْتُهَا ثَلَاثًا يَا رَسُولَ اللَّهِ قَالَ: ্রقَدْ عِلَمْتُ، رَاجِعْهَا
¶ ইমাম আব্দুর রায্যাক, আল-মুসান্নাফ, ৬/৩৯০ পৃ:, হা/১১৩৩৪, ইমাম আবু দাউদ, আস-সুনান, খণ্ড-২, পৃষ্ঠা-৪৪৮, হাদিস-২১৯৬, ইমাম বায়হাকী, আস-সুনানুল কোবরা, খণ্ড-৭, পৃষ্ঠা-৫৫৫, হাদিস/১৪৯৮৬, এ হাদিসটির সনদে ‘ইবনে জুরাইজ’ নামে একজন রাবী রয়েছেন। আহলে হাদিস আলবানী তাকে সব সময় তাদলীসকারী এবং যঈফ বলে তাহলে এই সনদটিও তো যঈফ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু দেখুন এখানে এসে তার মত থেকে ফিরে এসে সুনানে আবু দাউদের তাহকীকে ‘হাসান’ বলে অভিহিত করেছেন।
এক সঙ্গে তিন তালাক দিলে যদি তিন তালাকই কার্যকরী হত, তাহলে প্রত্যাহার করা সম্ভব হত না, তখন দ্বিতীয় বিবাহের প্রয়োজন পড়তো। তাই বোঝা গেল যে এক তালাকই বলবৎ রাখা হয়েছে ও বাকী দু’ তালাক বাতিল করে দেয়া হয়েছে। আরও লক্ষ্যণীয় যে রুকানা স্বয়ং বলছেন ‘আমি তিন তালাকই দিয়েছি’। এতে এক তালাকের প্রতি জোর দেয়া বুঝবার কোন অবকাশ নেই। তথাপি এক তালাকই গণ্য করা হয়েছে।
আফসোস, আপত্তিকারীরা, আবু দাউদ ও বায়হাকীর আংশিক রিওয়ায়েতই উদ্ধৃত করেছে। অথচ যে অংশটি তারা উল্লেখ করেনি, সেখানেই এ আপত্তির যথার্থ উত্তর রয়েছে। একই জায়গায় বায়হাকী ও আবু দাউদে বর্ণিত আছে নাফে ইবনে আজির এবং আবদুল্লাহ ইবনে আলি ইবনে ইয়াযিদ ইবনে রুকানা স্বীয় দাদা রুকানা থেকে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি তাঁর স্ত্রীকে তালাকে বত্তা (দ্বৈত অর্থবোধক তালাক) দিয়েছিলেন। সুতরাং হুযূর (ﷺ) তাঁর স্ত্রীকে তাঁকে ফেরত দিয়ে দেন। এ হাদীছ অন্যান্য হাদীছ থেকে সহীহ কেননা তাঁর ছেলে এবং তাঁর ঘরের অন্যান্যরা তাঁর অবস্থা সম্পর্কে বাইরের লোক অপেক্ষা করে বেশী জানার কথা। রুকানার নাতি বলছে আমার দাদা আমার দাদীকে তালাকে বত্তা দিয়েছেন এবং অন্যান্যরা বলছেন- তিন তালাক দিয়েছেন। নিঃসন্দেহে, নাতির রিওয়ায়েতই বেশী সহীহ বলে গণ্য হবে। উক্ত হাদীছের আরবী ইবারত হচ্ছে
قَالَ أَبُو دَاوُدَ: حَدِيثُ نَافِعِ بْنِ عُجَيْرٍ وَعَبْدِ اللهِ بْنِ عَلِيِّ بْنِ يَزِيدَ بْنِ رُكَانَةَ عَنْ أَبِيهِ عَنْ جَدِّهِ أَنَّ رُكَانَةَ طَلَّقَ امْرَأَتَهُ الْبَتَّةَ فَرَدَّهَا النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَصَحُّ لِأَنَّهُمْ وَلَدُ الرَّجُلِ وَأَهْلُهُ أَعْلَمُ بِهِ أَنَّ رُكَانَةَ إِنَّمَا طَلَّقَ امْرَأَتَهُ الْبَتَّةَ فَجَعَلَهَا النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَاحِدَةً
¶ ইমাম বায়হাকী, আস-সুনানুল কোবরা, খণ্ড-৭, পৃষ্ঠা-৫৫৫, হাদিস/১৪৯৮৬
সার কথা হলো তিন তালাক সম্বলিত সমস্ত রিওয়ায়েত জঈফ। ইমাম বায়হাকী (رضي الله عنه) বলেন যে, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস থেকে আটটি রিওয়ায়েত এর বিপরীত বর্ণিত আছে এবং রুকানার নাতি থেকেও তালাকে বত্তার একটি রিওয়ায়েত বর্ণিত আছে। বলুন, তিন তালাক সম্বলিত এক রিওয়ায়েত, না তালাকে বত্তা সম্বলিত নয় রিওয়ায়েত গ্রহণযোগ্য হবে?
বায়হাকীর ইবারতটা হচ্ছে
وَهَذَا الْإِسْنَادُ لَا تَقُومُ بِهِ الْحُجَّةُ مَعَ ثَمَانِيَةٍ رَوَوْا عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ رَضِيَ اللهُ عَنْهُمَا فُتْيَاهُ بِخِلَافِ ذَلِكَ وَمَعَ رِوَايَةِ أَوْلَادِ رُكَانَةَ أَنَّ طَلَاقَ رُكَانَةَ كَانَ وَاحِدَةً وَبِاللهِ التَّوْفِيقُ
¶ ইমাম বায়হাকী, আস-সুনানুল কোবরা, খণ্ড-৭, পৃষ্ঠা-৫৫৫, হাদিস/১৪৯৮৭
আমি প্রথম অধ্যায়ে উল্লেখ করেছি যে আবু রুকানা বারগাহে নববীতে আরয করেছিলেন ইয়া হাবিবাল্লাহ, আমি এক তালাকের নিয়তই করেছিলাম। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম তাঁকে এ ব্যাপারে কসমও করায়েছিলেন। অতঃপর তাঁর স্ত্রীকে পুনরায় গ্রহণ করার নির্দেশ দিলেন। ইমাম নব্বী বলেছেন আবু রুকানার তিন তালাক সম্বলিত রিওয়ায়েতটি জইফ (দুর্বল) এবং অপ্রসিদ্ধ লোক থেকে বর্ণিত হয়েছে। ওর তালাকের ব্যাপারে কেবল ওই রিওয়ায়েতটি সহীহ, যেটা আমি বর্ণনা করেছি অর্থাৎ উনি তালাকে বত্তাই দিয়েছিলেন। বত্তা শব্দের মধ্যে এক ও তিন উভয়ের সম্ভাবনা থাকে। সম্ভবতঃ তিন তালাক সম্বলিত হাদীছের বর্ণনাকারী বত্তা বলতে তিন তালাকই মনে করেছেন। এ জন্য বত্তার পরিবর্তে তিন তালাকই বলে দিয়েছেন যার জন্য এ মারাত্মক ভুল বুঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছে। ইমাম নব্বীর মূল ভাষ্যটা হচ্ছে -
وَأَمَّا الرِّوَايَةُ الَّتِي رَوَاهَا الْمُخَالِفُونَ أَنَّ رُكَانَةُ طَلَّقَ ثَلَاثًا فَجَعَلَهَا وَاحِدَةً فَرِوَايَةٌ ضَعِيفَةٌ عَنْ قَوْمٍ مَجْهُولِينَ وَإِنَّمَا الصَّحِيحُ مِنْهَا مَا قَدَّمْنَاهُ أَنَّهُ طَلَّقَهَا أَلْبَتَّةَ وَلَفْظُ أَلْبَتَّةَ مُحْتَمِلٌ لِلْوَاحِدَةِ وَلِلثَّلَاثِ وَلَعَلَّ صَاحِبَ هَذِهِ الرِّوَايَةِ الضَّعِيفَةِ اعْتَقَدَ أَنَّ لَفْظَ أَلْبَتَّةَ يَقْتَضِي الثَّلَاثَ فَرَوَاهُ بِالْمَعْنَى الَّذِي فَهِمَهُ وَغَلِطَ فِي ذَلِكَ
¶ ইমাম নববী, শরহে সহীহ মুসলিম, খণ্ড-১০, পৃষ্ঠা-৭১, হাদিস-১৪৭২ এর আলোচনা।
সৈয়্যদুনা আবদুল্লাহ ইবনে উমর (رضي الله عنه) স্বীয় বিবি সাহেবানীকে ঋতুকালীন সময়ে এক সঙ্গে তিন তালাক দিয়েছিলেন। কিন্তু হুযূর (ﷺ) এ গুলোকে এক তালাকই সাব্যস্ত করেছেন এবং ওকে পুনঃ গ্রহণ করার নির্দেশ দিলেন। যদি এ তিন তালাক তিনই ধরা হতো, তাহলে পুনঃগ্রহণ সম্ভব হতে না।
এটা ভুল ধারণা। আসলে সৈয়্যদুনা ইবনে উমর নিজ বিবিকে ঋতুকালে এক তালাকই দিয়েছিলেন। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম রজায়াত অর্থাৎ পুনঃ গ্রহণ করার নির্দেশ দিলেন। কেননা তালাক পবিত্র থাকাকালীন সময়ে দেয়া উচিৎ। যেমন মুসলিম শরীফের بَابُ تَحْرِيمِ طَلَاقِ الْحَائِضِ শীর্ষক অধ্যায়ে বর্ণিত আছে
عَنْ نَافِعٍ، عَنْ عَبْدِ اللهِ، أَنَّهُ طَلَّقَ امْرَأَةً لَهُ وَهِيَ حَائِضٌ تَطْلِيقَةً وَاحِدَةً، فَأَمَرَهُ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَنْ يُرَاجِعَهَا، ثُمَّ يُمْسِكَهَا حَتَّى تَطْهُرَ
¶ সহীহ মুসলিম, খণ্ড-২, পৃষ্ঠা-১০৯৩, হাদিস-১৪৭১।
মুসলিম শরীফের ব্যাখ্যাগ্রন্থ নববী শরীফের الطلاق শীর্ষক অধ্যায়ে বর্ণিত আছে-
وأما حديث بن عُمَرَ فَالرِّوَايَاتُ الصَّحِيحَةُ الَّتِي ذَكَرَهَا مُسْلِمٌ وَغَيْرُهُ أنه طلقها واحدة
সুতরাং তাঁর ব্যাপারে তিন তালাক সম্পর্কিত রিওয়ায়েতসমূহ একেবারে জঈফ (দুর্বল)।
¶ ইমাম নববী, শরহে সহীহ মুসলিম, খণ্ড-১০, পৃষ্ঠা-৭১, হাদিস-১৪৭২ এর আলোচনা।
তফসীরে কবীরের ৬ খণ্ড ৪৪২ পৃষ্ঠায় الطلاق مرتان এর তফসীর প্রসঙ্গে উল্লেখিত আছে-
وَمَعْنَاهُ أَنَّ التَّطْلِيقَ الشَّرْعِيَّ يَجِبُ أَنْ يَكُونَ تَطْلِيقَةً بَعْدَ تَطْلِيقَةٍ عَلَى التَّفْرِيقِ دُونَ الْجَمْعِ وَالْإِرْسَالِ دُفْعَةً وَاحِدَةً، وَهَذَا التَّفْسِيرُ هُوَ قَوْلُ مَنْ قَالَ: الْجَمْعُ بَيْنَ الثَّلَاثِ حَرَامٌ
-‘‘শরয়ী তালাক এক সঙ্গে না দিয়ে পৃথক পৃথকভাবে দেয়া ওয়াজিব। এটি তাঁদেরই তফসীর, যাঁরা এক সংগে তিন তালাক দেয়াকে হারাম বলেন। এর থেকে প্রতীয়মান হয় যে এক সংগে তিন তালাক দেয়া শরীয়ত সম্মত নয়।’’
এটা অস্বীকার করছে কারা? আমরাওতো বলি- তালাক পৃথক পৃথক ভাবে দেয়া উচিৎ। কিন্তু কথা হচ্ছে- এক সংগে তিন তালাক দিলে, তিন তালাক কার্যকরী হবে কিনা? তাফসীরে কবীরে উপরোক্ত ইবারতে তিন তালাক পতিত হবে না বলে কোথায় আছে? সেখানেতো কেবল উল্লেখিত আছে যে এ রকম কাজ নাজায়েয। কোন জিনিস হারাম হওয়া এক কথা আর এর উপর শরয়ী হুকুম বর্তানো আর এক কথা। রমযান শরীফে দিনের বেলায় খানাপিনা হারাম। কিন্তু কেউ খেয়ে ফেল্লে রোযা ভেংগে যাবে। যেনা হারাম তবে যদি কেউ করে, তার উপর গোসল ওয়াজিব হয়ে যাবে। হারামের প্রভাব কার্যকরণের উপর পতিত হয় না।
তফসীর কবীর (মিসরী) ৬ খণ্ডের ৪৪২ পৃষ্ঠায় বর্ণিত আছে।
وَهُوَ اخْتِيَارُ كَثِيرٍ مِنْ عُلَمَاءِ الدِّينِ، أَنَّهُ لَوْ طَلَّقَهَا اثْنَيْنِ أَوْ ثَلَاثًا لَا يَقَعُ إِلَّا الْوَاحِدَةُ
অর্থাৎ অনেক উলামায়ে দ্বীন এটাই গ্রহণ করেছেন যে যদি কেউ এক সংগে দুই বা তিন তালাক দিয়ে দেয়, তাহলে এক তালাকই পতিত হবে।
অতএব বোঝা গেল যে সাধারণ উলামায়ে ইসলামের মতে এক সংগে তিন তালাক দিলে এক তালাকই পতিত হয়।
আপত্তিকারী বলেনি যে, ওসব উলামা কারা এবং তাদের মযহাব কি? আমি মনে করি এরা হলেন ইবনে তায়মিয়া ও ওহাবী অনুসারী আলিমগণ। তাঁদের মযহাব সম্পর্কে আমি আলোচ্য বিষয়ের প্রথম অধ্যায়ে তাফসীরে সাবীর উদ্ধৃতি দিয়ে বর্ণনা করেছি যে ইবনে তায়মিয়া ও তাঁর অনুসারীগণকে হক্কানী উলামায়ে কিরাম গুমরাহ ও গুমরাহকারী বলেছেন। আর আপত্তিকারী তাফসীর কবীরের পূর্ণ ইবারত উদ্ধৃত করেননি।
উল্লেখিত ইবরাতের আগে বর্ণিত আছে-
وَالْقَوْلُ الثَّانِي: وَهُوَ قَوْلُ أَبِي حَنِيفَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ: أَنَّهُ وَإِنْ كَانَ مُحَرَّمًا إِلَّا أَنَّهُ يَقَعُ
অর্থাৎ দ্বিতীয় উক্তিটা হচ্ছে ইমাম আবু হানিফার- এক সংগে তিন তালাক দেয়া যদিওবা নিষেধ, তথাপি তালাক পতিত হবে।
একটু পরে তাফসীরে কবীরে আরও উল্লেখিত আছে যে ইমামগণের অভিমত হচ্ছে যাকে তিন তালাক দেয়া হবে, সে স্বামীর জন্য হালাল হবে না। (তফসীরে কবীর (মিসরী) ৬ খণ্ডের ৪২২ পৃষ্ঠা দেখুন)
যুক্তিও বলে যে এক সংগে তিন তালাক দিলে এক তালাকই ধরা উচিৎ; কেননা যে কাজসমূহের পৃথক পৃথকভাবে করার নির্দেশ আছে, সেগুলোকে একবারে করে ফেল্লে একের হুকুমই বর্তাবে। যেমন লায়ানে পৃথক পৃথক চারটি শপথ করা ওয়াজিব এবং হজ্বে শয়তানকে পৃথক পৃথকভাবে সাত কংকর নিক্ষেপ করা ওয়াজিব। যদি কেউ সাত কংকর এক সংগে নিক্ষেপ করে, তাহলে এক বারই ধরা হবে। এবং আরও ছয় কংকর পৃথক পৃথকভাবে নিক্ষেপ করতে হবে। আর চারটি শপথ যদি কেউ একটি শব্দ দ্বারা করে, তাহলে একটি শপথই ধরা হবে। অনুরূপ যদি কেউ শপথ করলো আমি এক হাজার বার দরূদ শরীফ পাঠ করবো, কিন্তু সে যদি এভাবে একবার পাঠ করে-
اللهم صَلَّى عَلٰى عَلَيْهِ سَيِّدِنَا اَلْف مَرَّة
তাহলে দরূদকে এক হাজার বার মনে করা হবে না বরং একবার ধরা হবে। তাই যদি কেউ এক সংগে তিন তালাক দিয়ে দেয়, তাহলে তিন নয়, এক তালাক কার্যকরী হওয়া যুক্তিসংগত।
আলহামদু লিল্লাহ, আপনারা কিয়াসের সমর্থক হলেন এবং কিয়াসের জন্য বেশ কষ্টও স্বীকার করলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য আপনারা যেমন, আপনাদের কিয়াসও তেমন। জনাব, লায়ান ও রমিতে কাজই উদ্দেশ্য, এর কার্যফল নয় কিন্তু তালাকের ক্ষেত্রে কেবল কার্য নয়, কার্যফলই উদ্দেশ্য। সুতরাং এ কিয়াসটা সঠিক হলোনা। লায়ানে একটি শপথ একটি সাক্ষ্যের সমতুল্য। যেহেতু যেনায় চার জন সাক্ষীর প্রয়োজন, সেহেতু লায়ানে, যা এর বিকল্প হিসেবে বিবেচ্য, শপথ কার্যটাও চার বার হওয়া বাঞ্ছনীয়। এক শব্দে চারটি শপথ করলে, একটি কার্য বোঝা গেল। আর শয়তানকে কংকর নিক্ষেপের ক্ষেত্রে সাত কংকর নিক্ষেপ হয়েছে সত্য, তবে নিক্ষেপ কাজ হয়েছে মাত্র একবার। যেহেতু আমাদের নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিক্ষেপ কাজটি সাতবার করেছেন, সেহেতু এর অনুসরণ করা কর্তব্য। দরূদ শরীফ পাঠে পরিশ্রম অনুযায়ী ছওয়াব পাওয়া যায়। এক হাজার দরূদ শরীফের অঙ্গীকার মানে এক হাজার বার দরূদ শরীফ পাঠের অঙ্গীকার। তাই যদি একবারে ‘আল্লাহুম্মা সালে আলা সায়্যিদেনা মুহাম্মদ এক হাজার বার’ এ রকম বললে এক হাজার বার দরূদ শরীফ পাঠের সেই কষ্টটা পাওয়া গেল না। কিন্তু তালাকটা কোন্ ছওয়াবের কাজ হলো যে বেশী কষ্ট করলে বেশী ছওয়াব পাওয়া যাবে? মোট কথা হলো তাদের সমস্ত আপত্তি মাকড়সার জালের মত দুর্বল। তাদের আরাম প্রিয়তা ও নফসের অনুসরণই হচ্ছে এ সব বক্তব্যের মূল ভিত্তি। আল্লাহ তা’আলা তাদেরকে কুরআন হাদীছ বোঝার তাওফীক দিন।
যদি তিন তালাকের দ্বারা এক তালাক পতিত হয়, এবং স্বামী-স্ত্রী পৃথক হয়ে যায়, এতে কোন ক্ষতি নেই। কিন্তু যদি তিন তালাক পতিত হয় এবং ২য় স্বামী গ্রহণ ব্যতিরেকে পুনরায় ঘরসংসার করে, তাহলে সারা জীবন হারামকারী হিসেবে গণ্য হবে। সুতরাং সতর্কতামূলক এক সংগে তিন তালাক বললে তিন তালাকই ধরা উচিৎ। এ জন্য উসূল ফিক্হে পারদর্শী উলামায়ে কিরাম বলেন যে, যখন মুবাহ ও হারামের মধ্যে দ্ব›দ্ব হয়, তখন হারামকে অগ্রাধিকার দিতে হয়।
وصلى الله تعالى على خير خلفه ونور عرشه سيدنا و مولنا محمد واله واصحابه اجمعين برحمته وهو ارحم الراحمين
দ্বিতীয় ভাগ সমাপ্ত
পূর্ববর্তী পেইজ | পরবর্তী পেইজ |
(০৫৮) তিন তালাক কার্যকরী হওয়ার প্রমাণাদি | |
সূচীপত্র | এরকম আরো পেইজ |