বৃদ্ধাঙ্গুলী চুম্বন সম্পর্কে যে হাদীছসমূহ বর্ণনা করা হয়েছে, সবই জয়ীফ (দুর্বল) এবং যঈফ হাদীস দ্বারা শরয়ী মাসআলা প্রমাণিত হয় না। দেখুন,
‘মাকাসিদুল হাসানা’ উল্লেখিত আছে-
ولا يصح في المرفوع من كل هذا شيء.
-‘‘ওই সমস্ত হাদীছসমূহের মধ্যে কোন মারফু-সহীহ হাদীস পাওয়া যায়নি।’’
¶ ইমাম সামসুদ্দীন সাখাভী, মাকাসিদুল হাসানা, পৃষ্ঠা-৬০৬, হাদিস-১০২০, দারুল কিতাব আরাবী, বয়রুত, লেবানন।
আল্লামা মোল্লা আলী কারী (رحمة الله) এর লিখিত ‘মাওদ্বুআতুল কাবীরে’ এ সব হাদীস প্রসঙ্গে বলেছেন-
وَكُلُّ مَا يُرْوَى فِي هَذَا فَلَا يَصِحُّ رَفْعَهُ
-‘‘এ মাসআলার বেলায় যতগুলো হাদীছ বর্ণিত হয়েছে, ওইগুলোর মধ্যে একটিও সহীহ হাদীছের পর্যায়ভুক্ত নয়।’’
¶ আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী, আসারুল মারফুআ, ৩১৬ পৃ:, হা/৪৩৫
স্বয়ং আল্লামা শামী (رحمة الله) সেই একই বহসের একই জায়গায় বলেছেন-
لم يصح من الْمَرْفُوعُ من هذا شيئ
-‘‘ওই গুলোর মধ্যে কোন মারফু সহীহ হাদীস নেই।’’
রূহুল বয়ানের রচয়িতাও ওই হাদীছগুলোকে বিশুদ্ধ বলতে অস্বীকার করেছেন। সুতরাং ওই সব হাদীছ উপস্থাপন করাটাই অর্থহীন।
এর কয়েকটি উত্তর রয়েছে।
قُلْتُ وَإِذَا ثَبَتَ رَفْعُهُ عَلَى الصَّدِّيقِ فَيَكْفِي الْعَمَلُ بِهِ لِقَوْلِهِ عَلَيْهِ الصَّلَاةُ وَالسَّلَامُ عَلَيْكُمْ بِسُنَّتِي وَسِنَّةِ الْخُلَفَاءِ الرَّاشِدِينَ
-‘‘আমার কথা হলো হাদীছটার সনদ যেহেতু হযরত সিদ্দীক আকবর (رضي الله عنه) পযর্ন্ত প্রসারিত, সেহেতু আমলের জন্য এতটুকুই যথেষ্ট। কেননা, হুযুর (ﷺ) বলেছেন-তোমাদের জন্য আমার সুন্নাত ও আমার খুলাফায়ে রাশিদীনের সুন্নাত অনুসরণীয়।’’
¶ আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী, আসারুল মারফুআ, ৩১৬ পৃ:, হা/৪৩৫
বোঝা গেল, হাদীসে মাওকুফ সহীহ ও আমলের জন্য যথেষ্ট।
وَقَدْ رَوَاهُ ابْنُ حِبَّانَ وَغَيْرُهُ عَنْهُ - عَلَيْهِ الصَّلَاةُ وَالسَّلَامُ - مِنْ طُرُقٍ
-এ হাদীছটি ইবনে হাববান প্রমুখের কয়েকটি সনদ দ্বারা বর্ণিত হয়েছে।
¶ হাসকাফী, দুররুল মুখতার, ৯৫ পৃ: ইমাম ইবনে আবেদীন শামী, ফাতওয়ায়ে শামী, ১/১২৭ পৃ:
এর প্রেক্ষাপটে শামীতে বলা হয়েছে -
أَيْ يُقَوِّي بَعْضُهَا بَعْضًا فَارْتَقَى إلَى مَرْتَبَةِ الْحَسَنِ
অর্থাৎ কতেক সনদ কতেক সনদকে শক্তি জোগায়। তাই এ হাদীছ হাসনের পর্যায়ে পৌছে গেছে।
¶ ইমাম ইবনে আবেদীন শামী, ফাতওয়ায়ে শামী, ১/১২৭ পৃ:
আমি প্রথম অধ্যায়ে উল্লেখ করেছি যে, এ হাদীছ বিভিন্ন সনদে বর্ণিত আছে। সুতরাং এটা হাসন হিসেবে গণ্য।
عَلَى أَنَّهُ فِي فَضَائِلِ الْأَعْمَالِ يَجُوزُ الْعَمَلُ بِالْحَدِيثِ الضَّعِيفِ كَمَا مَرَّ أَوَّلَ كِتَابِ الطَّهَارَةِ
-‘‘ফাযায়েলে আমালের ক্ষেত্রে যঈফ হাদীস অনুযায়ী আমল করা জায়েয। যেমনটি আমি কিতাবুত তাহারাতে আলোকপাত করে এসেছি।’’
¶ ইমাম ইবনে আবেদীন শামী, ফাতওয়ায়ে শামী, ১/৩৮৫ পৃ:
এখানেও ওয়াজিব-হারামের মাসআলা নয়, কেবল আঙ্গুলী চুম্বনের ফযীলতের কথাই বলা হয়েছে। সুতরাং এ ক্ষেত্রেও যঈফ হাদীছ অনুযায়ী আমল করা যায়। অধিকন্তু মুসলমানদের আমল যঈফ হাদীসকে মজবুত করে দেয়। যেমনঃ
ইমাম নববী (رحمة الله) এর কিতাবুল আযকারে তালকীনে মায়্যিত শীর্ষক আলোচনায় বর্ণিত আছে-
وقد روينا فيه حديثاً من حديث أبي أمامة ليس بالقائم إسناده ، قال الحافظ بعد تخريجه: هذا حديث غريب، وسند الحديث من الطريقين ضعيف جداً ولكن اعتضد بشواهد، وبعمل أهل الشام
-‘‘তলকীনে মায়্যিতের হযরত আবু উমামা (رضي الله عنه)-এর হাদীস সনদের দিক দিয়ে জোরালো নয়; ......কিন্তু শাম বাসীর আমল এবং অন্যান্য সাক্ষ্য থেকে জোরালো হয়ে গেছে।’’
¶ ইমাম নববী, কিতাবুল আযকার, ১৬৩ পৃ:, ক্রমিক/৪৭১ (শায়খ শুয়াইব আরনাউতের তাহকীককৃত)।
বৃদ্ধাঙ্গুলী চুম্বনও মইয়তের আমলের মত। তাই এ হাদীসটা জোরালো হয়ে গেছে। এর থেকে আরও ব্যাপক বিশ্লেষণের জন্য নুরুল আনোয়ার, তওজীহ ইত্যাদি গ্রন্থ দ্রষ্টব্য।
مَا رَآهُ الْمُسْلِمُونَ حَسَنًا فَهُوَ عِنْدَ اللَّهِ حَسَنٌ
-‘‘যে কাজটা মুসলমানগণ ভাল মনে করে, তা আল্লাহর কাছেও ভাল বলে বিবেচ্য।’’
¶ ইমাম হাকেম, আল-মুস্তাদরাক, ৩/৮৩ পৃ: হা/৪৪৬৫, এ হাদিসটির বিষয়ে বিস্তারিত জানতে আমার লিখিত “প্রমাণিত হাদিসকে জাল বানানোর স্বরূপ উন্মোচন” ১ম খণ্ডের ৩৮৭ পৃৃষ্ঠায় (প্রথম প্রকাশ) দেখুন।
اجتهاد ادر اختراع اعمال تصريفيه راه كشاده است مانند استخراج اطباء نستجا قرابا دين را
অর্থাৎঃ (সুফিয়ানে কিরামের আমলের বেলায় ইজতিহাদের পথ খোলা। যেমন ডাক্তারগণ চিকিৎসার ফর্মূলা আবিষ্কার করে থাকেন।)
শাহ সাহেব স্বয়ং স্বীয় কিতাব القول الجميل এ জ্বীনকে দমন, এবং জ্বীন থেকে হিফাজত থাকার অনেক আমল-তদবীরের কথা বর্ণনা করেছেন। উক্ত কিতাবে গর্ভবতী মহিলা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে যে অমুক দুআ হরিণের চামড়ায় লিখে গলায় দিলে গর্ভপাত হবে না। পশমের রঙিন ডোরা (সুতা) দিয়ে মহিলার মাপ নিয়ে উক্ত সুতায় সাতটি গিরা দিয়ে মহিলার বাম উরুতে বাঁধলে প্রসব বেদনা লাঘব হবে, ইত্যাদি ইত্যাদি। বলুন, এসব আমলের ব্যাপারে কোন হাদীছটি উপস্থাপন করা যাবে? আল্লামা শামী (رحمة الله) ও যাদু থেকে রক্ষা ও হারানো জিনিসের সন্ধানের জন্য ফাতওয়ায়ে শামীতে অনেক তরীকা বর্ণনা করেছেন। বলুন এসব কোন হাদীছ মতে?
যেহেতু আমি প্রথম অধ্যায়ে প্রমাণ করেছি যে এ আমলটা চক্ষু পীড়ার জন্য পরীক্ষিত, তাই একে কেন নিষেধ করা হবে?
ইনশাআল্লাহ মকরূহ প্রমাণের জন্য সহীহ হাদীছতো দূরের কথা জয়ীফ হাদীছটাও পাওয়া যাবে না। তাদের যাবতীয় গবেষণা ও প্রচেষ্টা রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লামের প্রতি শত্রুতা ছাড়া আর কিছু নয়। যাক আপত্তির নিষ্পত্তি হলো এবং হক প্রতিফলিত হলো।
হযরত আদম (عليه السلام) যদিও বা বৃদ্ধাঙ্গুলীর নখে নুরে মোস্তাফা (ﷺ) দেখে চুমু দিয়ে ছিলেন, তাহলে আপনারা কোন নুর দেখে চুমু দিচ্ছেন? তখন চুম্বনের কারণ ছিল; এখনতো তা নেই।
হযরত হাজেরা (رضي الله عنه) যখন স্বীয় সন্তান হযরত ইসমাঈল (عليه السلام) কে নিয়ে মক্কা শরীফের জঙ্গলে বনবাসে আসলেন, তখন পানির সন্ধানে সাফা ও মারওয়া পাহাড়ের মধ্যে দৌড়াদৌড়ি করেছিলেন। কিন্তু বর্তমানে আপনার হজ্বের সময় ওখানে কেন দৌড়াদৌড়ি করেন? আর পানিরও বা কি প্রয়োজন? হযরত ইসমাইল (عليه السلام) কুরবানীর উদ্দেশ্যে যাবার সময় পথে তিন জায়গায় শয়তানকে পাথর ছুঁড়ে মেরেছিলেন। কিন্তু আজকাল আপনারা হজ্বের সময় তথায় পাথর ছুঁড়ে মারেন কেন? কোন শয়তান এখন আপনাদেরকে ধোঁকা দিচ্ছে? হুযুর (ﷺ) এক বিশেষ প্রয়োজনে মক্কার কাফিরদেরকে দেখানোর জন্য তওয়াফের সময় রমল (বুক ফুলিয়ে হেলে দুলে চলা) করে স্বীয় শক্তি দেখিয়ে ছিলেন। কিন্তু এখন তওয়াফে কুদুমের সময় রমল কেন করেন? এখন কি কাফিরেরা তা দেখে? সাহেব, আম্বিয়ায়ে কিরামের কতেক আমল এমনভাবে কবুল হয়েছে যে এ সবের স্মৃতি অক্ষুন্ন রাখা হয়েছে, যদিও বা এর প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে। এটাও তদ্রুপ।
হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লামের নাম নেয়ার সময় বৃদ্ধাঙ্গুলীর নখ চুম্বনের কি কারণ থাকতে পারে? নখের মধ্যে কি বৈশিষ্ট্য রয়েছে, অন্য কিছু কেন চুম্বন করা হয় না? হাত, পা, কাপড় ইত্যাদিকে ওতো চুমু দেয়া যায়।
যেহেতু রেওয়াতের মধ্যে নখের কথা রয়েছে, সেহেতু তা চুমু দেখা দেয়। সুস্পষ্ট দলীলের ক্ষেত্রে কারণ অনুসন্ধান করার প্রয়োজন নেই। তবে এর রহস্য হচ্ছে তাফসীরে খাযেন, রূহুল বয়ান ইত্যাদিতে অষ্টম পারার সূরা আরাফের আয়াত - بَدَتْ لَهُمَا سَوْآتُهُمَا (সূরা আ’রাফ, আয়াত নং-২২) এর ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে উল্লেখিত আছে যে বেহেশতে হযরত আদম (عليه السلام) এর পোশাক ছিল নখ অর্থাৎ সমস্ত শরীরে নখ ছিল, যা খুবই সুন্দর ও মোলায়েম ছিল। খোদা যখন তাঁর প্রতি অসন্তুষ্ট হলেন, তখন সেই পোশাক খুলে নেয়া হয়। কিন্তু আঙ্গুলের মাথায় স্মৃতি চিহ্ন স্বরূপ রাখা হয়েছে। এতে বোঝা যায়, আমাদের নখ হচ্ছে জান্নাতী পোশাক। তাই বেহেশতে যেহেতু হুযুর (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লামের ওসীলায় মিলবে, সেহেতু তাঁর পবিত্র নাম নেয়ার সময় বেহেশতী পোশাকেই (নখে) চুমু দেয়া হয়। যেমন কাবা শরীফের হাজর আসওয়াদ হচ্ছে জান্নাতী পাথর। একে চুমু দেয়া হয়। কাবা শরীফের অন্যান্য অংশকে চুমু দেয়া হয় না। কেননা তা হচ্ছে সেই জান্নাতী পাথরের স্মরণ, যা হযরত আদম (عليه السلام) এর জন্য পৃথিবীতে অবতরণ করা হয়েছিল এবং হযরত নুহ (عليه السلام) এর তুফানের সময় উঠিয়ে নেয়া হয়েছিল। এ পাথর তারই স্মৃতিচিহ্ন। অনুরূপ নখও বেহেশতী পোশাকের স্মৃতিচিহ্ন।
পূর্ববর্তী পেইজ | পরবর্তী পেইজ |
(০৪৩) আযানের সময় বৃদ্ধাঙ্গুলী চুম্বনের বর্ণনা | (০৪৫) জানাযার আগে উচ্চস্বরে কলেমা বা না’ত পাঠ করার বিবরণ |
সূচীপত্র | এরকম আরো পেইজ |