সহীহ বুখারী শরীফে উম্মুল মুমিনীন হজরতে আয়েশা সিদ্দীকা (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, তিনি নবী করীম (সঃ) কে কখনও এরকম জোরে অট্টহাসি করতে দেখেন নি—যাতে মুখের লাহাওয়াত দৃষ্টিগোচর হয় । লাহাওয়াত শব্দটি 'লাহাওয়া' এর বহুবচন। কন্ঠনালীর শেষ প্রান্তে উপরের তালু সংলগ্ন গোশতের টুকরাকে লাহওয়াত বলা হয়। (বাংলায় যাকে বলে, আলা জিহবা)।
হুজুর আকরম (সঃ) এর ওষ্ঠাধরে সর্বদাই মৃদু হাসি লেগে থাকতো । কোনো কোনো হাদীছে এরূপ বর্ণনা পাওয়া যায়, তিনি এতো বেশী হাসতেন না যাতে নাওয়াজে দাঁত দৃষ্টিগোচর হয়। ‘নাওয়াজ্যে' চোয়ালের শেষ প্রান্তের দাঁতকে বলা হয়। পূর্ণ বয়সী হওয়ার পর যে দাঁত উঠে থাকে মানুষেরা সাধারণতঃ তাকে আক্কেল দাঁত বলে থাকে। হাসির এরূপ বর্ণনা অতিরঞ্জিত মনে হয়। প্রকৃত অবস্থা এরূপ নয়। উপরের বর্ণনা আসলে কোনো ব্যক্তির অত্যধিক হাসাহাসি করার একটা উদাহরণ মাত্র। এ অবস্থা রসূল (সঃ) এর ক্ষেত্রে বাস্তবতার পরিপন্থী। উক্ত বর্ণনা সম্পর্কে আবার কেউ এরূপ সমাধান দিয়েছেন যে, নাওয়াজ্যে বলতে আক্কেল দাঁত বুঝানো হয় নি বরং সমস্ত দাঁতকেই বোঝানো হয়েছে। রসূলে করীম (সঃ) এর হাসি—মৃদু হাসিই ছিলো। আওয়াজবিহীন বড়ো হাসিকে যেহেক বলা হয় । আর যেহেকের প্রাথমিক অবস্থা মুচকি হাসি। এতে খুশির প্রাবল্য যদি বেশী থাকে তবে কখনও কখনও দু'একটি দাঁত প্রকাশিত হওয়া স্বাভাবিক। এরূপ অবস্থায় যদি আওয়ায বিদ্যমান থাকে তবে তাকে বলা হয় কাহুকাহা বা অট্টহাসি। নিঃশব্দে দাঁত বের করে হাসলে তাকে বলে যেহেক। আর যদি একেবারেই শব্দ না থাকে এবং দাঁত বের না হয় তবে সে হাসিকে ‘তাবাস্সুম' বা মৃদু হাসি বলে। সাররাহ নামক কিতাবে আছে, ওষ্ঠদ্বয় মিলিত থাকা অবস্থায় যে হাসি হয় তাকে তাবাস্সুম বলে। তবে তাবাস্সুম বা মুচকি হাসির এ সংজ্ঞাই সর্বাধিক প্রসিদ্ধ যে নিঃশব্দ হাসিতে দাঁতের শুভ্রতা দৃষ্টিগোচর হয় ।
হজরত শায়েখ ইবন হাজার আসকালানী (রঃ) বলেন, নবীকরীম (সঃ) এর বিশেষ থেকে বিশেষতর অবস্থার অধিকাংশ হাসি তাবাস্সুম বা মুচকি হাসি ছিলো। তবে এটা হতে পারে যে কখনও কখনও তিনি যেহেক হাসি হেসেছেন। কিন্তু তাই বলে যেহেকের সীমা অতিক্রম করেন নি। আর কাকাহা বা অট্টহাসির তো প্রশ্নই আসতে পারে না। কারণ অট্টহাসি মাকরুহ। অধিক হাসাহাসি করলে বা যেহেক হাসির উপর অতিরঞ্জিত করলে মানুষের ব্যক্তিত্ব ও আত্মসম্মান ক্ষুণ্ণ হয় ।
ইমাম বায়হাকী (রঃ) হজরত আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেন, রসূলে আকরম (সঃ) যখন হাসতেন তখন পার্শ্ববর্তী দেয়াল আলোকিত হয়ে যেতো এবং তাঁর পবিত্র দাঁতের নূরে দেয়ালে সূর্যরশ্মির ন্যায় ঝিলিক মারতো। তিনি যখন ক্রন্দন করতেন তখনও এরূপ অবস্থা হতো। ক্রন্দনের সময় আওয়াজ উচ্চ হতো না। পবিত্র চোখ থেকে অশ্রু নির্গত হতো। তামার ডেগের ভিতর ফুটন্ত পানির শব্দের মতো পবিত্র বক্ষাভ্যন্তর থেকে এক ধরনের বিশেষ শব্দ শোনা যেতো। কোনো কোনো বর্ণনায় তাকে ঢাকা ঘূর্ণনের আওয়াযের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। তাঁর এরকম ক্রন্দন কখনও নিজের দুঃখ্যাতনার জন্য হতো না। তিনি কাঁদতেন আল্লাহতায়ালার জালালী সিফাতের তাজাল্লীর কারণে, উম্মতে মরহুমার প্রতি অপার স্নেহ মমতা বা কোনো মাইয়্যেতের উপর আল্লাহতায়ালার দরবারে রহমত যাঞ্চা করার জন্য। তিনি যখন তন্ময় হয়ে আল্লাহর কালাম শ্রবণ করতেন অথবা কোনো কোনো সময় রাত্রে নামাজ আদায় করতেন তখন এমন করুণ দৃশ্যের অবতারণা হতো। তিনি কখনও হাই তুলতেন না। আল্লাহতায়ালা তাঁকে এ কাজটি থেকে সুরক্ষিত রেখেছিলেন। হাই তোলা দৈহিক ও আঙ্গিক অবসন্নতার বহিঃপ্রকাশ। হুজুর পাক (সঃ) এর ব্যক্তিত্বে এরকম অবস্থা আদৌ ছিলোনা। তারিখে বুখারী ও হজরত ইবনে আবী শায়বা (রাঃ) এর তসনীফে উল্লেখ আছে, নবী করীম (সঃ) কখনও হাই তোলেন নি । আবার কোনো কোনো বর্ণনায় এরকমও আছে, কোনো নবীই কখনও হাই তোলেন নি । এক হাদীছে এরকম উল্লেখ আছে, হাই শয়তানের তরফ থেকে হয়ে থাকে । কারও যদি হাই প্রবল হয়ে যায় তাহলে বাম হাতের পিঠ মুখের উপর স্থাপন করতে হবে অথবা দাঁত দিয়ে ঠোঁট চেপে ধরতে হবে। হাই তোলার সময় হা-হা অথবা আহ্ আহ্ শব্দ মুখ থেকে বের করা নেহায়েত মন্দ কাজ। এক বর্ণনায় আছে, যে ব্যক্তি হাই তুলে আওয়ায বের করে, শয়তান তার মুখের ভিতর থেকে হাসাহাসি করতে থাকে।
পূর্ববর্তী পেইজ | পরবর্তী পেইজ |
(০০৮) পবিত্র মুখের লালা | (০১০) পবিত্র কণ্ঠস্বর |
সূচীপত্র | এরকম আরো পেইজ |