রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর তিন পুত্র ও চার কন্যা ছিল। কাসিম, আবদুল্লাহ্ ও ইবরাহীম তিন পুত্র এবং যয়নব, রুকাইয়া, উম্ম কুলসুম ও ফাতিমা চার কন্যা। এদের মধ্যে ইবরাহীম ছাড়া সকলেই হযরত খাদীজার গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন এবং মক্কায় জন্মগ্রহণ করেন। শুধু ইবরাহীম মদীনায় হযরত মারিয়া কিবতিয়ার গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন।
নবুওয়াতের পূর্বে হযরত খাদীজার গর্ভে কাসিমের জন্ম । প্রথম সন্তানের কারণে রাসূলুল্লাহ্ আবুল কাসিম নামে খ্যাত। শিশুকালেই তাঁর মৃত্যু হয়। সতের মাস কিংবা দুই বছর তিনি বেঁচে ছিলেন। নবুওয়াত লাভের পূর্বেই তাঁর ইন্তিকাল হয় ৷
নবুওয়াত লাভের পর তার জন্ম। তাই তাঁকে তাহির ও তাইয়্যিবও বলা হতো। তিনিও শিশুকালে ইন্তিকাল করেন। তাঁর ইন্তিকালে কাফিররা উৎফুল্ল হয়ে বলেছিলঃ সে তো নির্বংশ। তাদের ধারণা ছিল যে, তাঁরপর তাঁর প্রচারিত দীনও তাঁর বংশের মত শেষ হয়ে যায়। তখন আল-কুরআনের ১০৮ নং সূরা আল-কাওসার নাযিল হয়। কারো কারো মতে এ ঘটনা ইবরাহীম অথবা কাসিমের ইন্তিকালের পর ঘটেছিল ।
মদীনায় ৮ম হিজরীতে মারিয়া কিবতিয়া (রা)-এর গর্ভে তাঁর জন্ম। তিনিই রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সর্বশেষ সন্তান। জন্মের ৭দিন পর দুটি ভেড়া যবেহ করে তাঁর আকীকা করেন। মাথার চুল দাফন করিয়েছেন ও চুলের ওযন পরিমাণ রৌপ্য সাদকা করেন। হযরত আবূ হিন্দ বায়াযি (রা) তাঁর মাথা মুণ্ডন করেন। ১০ম হিজরী ১০ রবিউল আউয়ালে ১৬ মাস বয়সে, মতান্তরে ১৮ মাস বয়সে, তিনি ইন্তিকাল করেন ।
রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর শাদী মোবারকের ৫ বছর পর ৩০ বছর বয়সে হযরত খাদীজা (রা)-এর গর্ভে তাঁর জন্ম। তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন এবং আপন খালাত ভাই আবুল আস ইবন রাবী'র সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। ৮ম হিজরীতে ইন্তিকাল করেন। আলী ও উসামাহ নামে তাঁর এক পুত্র ও এক কন্যা জন্মগ্রহণ করে । মক্কা বিজয়ের দিন আলী (রা) রাসূলুল্লা (সা)-এর সঙ্গে উটের ওপর সওয়ার ছিলেন। তিনি তাঁর মাতার ইন্তিকালের পর রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর জীবদ্দশায়ই ইন্তিকাল করেন। উসামাহ (রা) ৫০ হিজরীতে ইন্তিকাল করেন। ফাতিমা (রা)-এর ইন্তিকালের পর হযরত আলী (রা) তাঁকে বিয়ে করেন। হযরত আলী (রা)-এর ঘরে তাঁর কোন সন্তান জন্মগ্রহণ করেনি। হযরত আলী (রা)-এর ইন্তিকালের পর মুগীরা ইবন নওফেলের (রা) সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। তাঁর কোন সন্তান ছিল না ৷
রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর ৩৩ বছর বয়সে খাদীজা (রা)-এর গর্ভে তাঁর জন্ম। রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর চাচা আবূ লাহাবের পুত্র ওতবার সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। আল-কুরআনের ১১১নং সূরা লাহাব নাযিল হলে আবূ লাহাব তাকে ও তার ভাই ওতাইবাকে, যার সঙ্গে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর তৃতীয়া কন্যা উম্মু কুলসুমের শাদী হয়েছিল, বলেছিল : তোমাদের সাথে আমার দেখা-সাক্ষাৎ হারাম যতক্ষণ না তোমরা মুহাম্মদের কন্যাদ্বয়কে তালাক দাও। এতে তারা উভয়ই তালাক দিয়ে দেয়। তাদের এ বিয়ে বাল্যকালে হয়েছিল, এমন কি তাদের বাসর ঘরেরও সুযোগ হয়নি। যদিও মক্কা বিজয়ের পর ওতবা ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন, তবুও যেহেতু আগেই হযরত উসমান (রা)-এর সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়ে গিয়েছিল, তাই তার আর কোন দাবি ছিল না। হযরত রুকাইয়্যা (রা) প্রথমে হাবশায় ও পরে মদীনায় হিজরত করেন। বদর যুদ্ধের সময় তিনি অসুস্থ থাকায় হুযুর (সা) হযরত উসমান (রা)-কে তাঁর শুশ্রূষার জন্য রেখে যান। যখন বদর যুদ্ধের বিজয় খবর মদীনায় পৌঁছে তখন হযরত রুকাইয়্যার দাফন সম্পন্ন হয়। হাবশায় হিজরতকালীন অবস্থায় তাঁর আবদুল্লাহ্ নামে একপুত্রের জন্ম হয়, যিনি ৪র্থ হিজরীতে ইন্তিকাল করেন।
হুযুর (সা)-এর তৃতীয়া কন্যা মক্কায় জন্ম গ্রহণ করেন। আবূ লাহাবের পুত্র ওতবার সঙ্গে বাল্যকালে বিয়ে হয়। রুখছতি ও বাসর ঘর সম্পন্ন হওয়ার আগেই পিতার নির্দেশে ওতাইবা তালাক দিয়ে দেয়। তৃতীয় হিজরীতে উসমান (রা)-এর সঙ্গে তাঁর পুনরায় বিয়ে হয়। রুকাইয়্যা (রা)-এর মৃত্যুর পর হযরত উমর তাঁর কন্যা হাফসাকে উসমান (রা)-এর সঙ্গে বিয়ের প্রস্তাব দিলে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। এতে হযরত উমর (রা) দারুণ ব্যথা পান। একথা রাসূলুল্লাহ্ (সা) জানতে পেরে উমর (রা)-কে বললেন : আমি কি তোমাকে উসমানের চাইতে উত্তম এবং উসমানকে তোমার চাইতে উত্তমের সন্ধান দিব ? হযরত উমর (রা) বললেনঃ অবশ্যই, হে আল্লাহর রাসূল! তখন তিনি বললেন : তোমার কন্যাকে আমার সঙ্গে বিয়ে দাও এবং আমার কন্যাকে উসমানের সঙ্গে বিয়ে দেই।
হযরত উসমান (রা)-এর ঘরে তাঁর কোন সন্তান জন্ম গ্রহণ করেনি । ৯ম হিজরীতে তিনি ইন্তিকাল করেন। তাঁর ইন্তিকালের পর হুযূর (সা) বলেন : যদি আমার একশত কন্যা থাকত এবং একের পর এক মারা যেতো, তা এভাবেই আমি একের পর এক উসমানের সঙ্গে বিয়ে দিতাম ।
আজযাহরা, আলবতুল, সাইয়্যেদাতু আহলিল জান্নাত ও সাইয়্যেদাতু নিসায়িল মু'মিনীন তাঁর খিতাব। তিনি রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর চতুর্থ কন্যা। এবং সমস্ত কন্যাদের মধ্যে তিনি বয়সের দিক দিয়ে সর্বকনিষ্ঠ ছিলেন। নবুওয়াতের ১ বছর পর, ভিন্ন মতে ৫ বছর পূর্বে মক্কায় জন্মগ্রহণ করেন। হিজরতের দু'বছর পর হযরত আলী (রা)-এর সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয়। বিয়ের ৭ মাস ১৫দিন পর রুখছতী হয়। তখন তাঁর বয়স ছিল ১৫ বছর ৫ মাস। এবং আলী (রা)-এর বয়স ছিল ২১ বছর পাঁচ মাস ভিন্ন মতে ২৪ বছর দেড় মাস। হযরত ফাতিমা (রা)-এর জীবদ্দশায় হযরত আলী (রা) অন্য কোন বিয়ে করেননি। একবার তিনি আবূ জাহলের কন্যাকে দ্বিতীয় বিয়ে করার ইচ্ছা প্রকাশ করলে হযরত ফাতিমা (রা) হুযূর (সা)-এর কাছে অভিযোগ করেন। হুযূর (সা) বললেন : ফাতিমা আমার কলিজার টুকরা, যে তাঁর মনে কষ্ট দিল সে যেন আমার মনে কষ্ট দিল। একথা শুনে হযরত আলী (রা) তাঁর জীবিত থাকাকালীন সময়ে দ্বিতীয় বিয়ে করেননি । হুযূর (সা)-এর ইন্তিকালের ৬ মাস পর হযরত ফাতিমা (রা) ইন্তিকাল করেন ।
তাঁর তিন পুত্র ও তিন কন্যা ছিল। বিয়ের দ্বিতীয় বছর হযরত হাসান (রা), তৃতীয় বছর হযরত হুসাইন (রা) ও চতুর্থ বছর হযরত মুহসিন (রা) জন্মগ্রহণ করেন । মুহসিন (রা) শৈশবেই ইন্তিকাল করেন । কন্যাদের মধ্যে হযরত রুকাইয়্যা বাল্যকালেই ইন্তিকাল করেন। দ্বিতীয় কন্যা হযরত উম্মু কুলসুম (রা)-এর প্রথম বিয়ে দ্বিতীয় খলীফা হযরত উমর (রা)-এর সঙ্গে হয়। এ বিয়েতে একপুত্র যায়েদ (রা) ও এক কন্যা রুকাইয়্যা জন্মগ্রহণ করেন । হযরত উমর (রা)-এর ইন্তিকালের পর তাঁর বিয়ে হযরত আউন বিন জা'ফর (রা)-এর সঙ্গে হয়। এ বিয়েতে কোন সন্তান জন্মেনি। তাঁর ইন্তিকালের পর তাঁর বিয়ে হযরত আউনের ভাই মুহাম্মদ (রা)-এর সঙ্গে হয় । এ বিয়েতে এক কন্যা জন্মে, যার মৃত্যু শৈশবেই হয়। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর ভাই আবদুল্লাহ্ বিন জা’ফরের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। এ বিয়েতেও কোন সন্তান জন্মেনি। এ বিবাহিত জীবনেই তাঁর ইন্তিকাল হয় এবং একই দিন তাঁর পুত্র যায়েদ (রা) ও ইন্তিকাল করেন। এদের উভয়ের জানাযা একত্রে হয়। তাঁর থেকে কোন বংশানুক্রম চালু থাকল না। হযরত উমর (রা)-এর ইন্তিকালের পর হযরত উম্মু কুলসুমের যে তিন ভাইয়ের সঙ্গে বিয়ে হয়, তাঁরা ছিলেন হযরত আলী (রা)-এর ভাই হযরত জা'ফর তাইয়ার (রা)-এর পুত্র ।
হযরত যয়নব (রা) তৃতীয় কন্যা। হযরত জাফর তাইয়ারের পুত্র হযরত আবদুল্লাহ্ (রা)-এর সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। এ বিয়েতে দু'পুত্র আবদুল্লাহ্ ও আউন জন্মগ্রহণ করেন। এ বিয়েতেই তিনি ইন্তিকাল করেন। তাঁর ইন্তিকালের পর তাঁর সহোদরা হযরত উম্মু কুলছুমের সঙ্গে হযরত আবদুল্লাহ্ বিন জাফরের বিয়ে হয় ।
হযরত ফাতিমা (রা) থেকেই হুযূর (সা)-এর বংশানুক্রম চালু আছে। হুযূর (সা) হযরত ফাতিমা (রা)-কে সর্বাধিক ভালবাসতেন। সফরে গমনের সময় সর্বশেষে তাঁর কাছ থেকে বিদায় নিতেন এবং সফর থেকে ফিরে এসে সর্বপ্রথম তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেন। ওহীর মাধ্যমে তাঁর নাম রাখা হয়েছিল। তাঁকেও যারা তাঁকে ভালবাসে তাদের জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করা হবে, তাই তাঁর নাম ফাতিমা। ‘ফাতম’ শব্দের অর্থ রক্ষা করা। আর দীনের দিক দিয়ে ও মর্যাদার নিরিখে তিনি সমকালীন সমস্ত নারীকুলের মধ্যে অনন্য ছিলেন বিধায় তাঁকে 'বতুল' বলা হয়। ‘বতুল' অর্থ স্বতন্ত্র, বিচ্ছিন্ন।
ইমাম আ'যম (রা) রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর স্ত্রীদের কথা উল্লেখ করেননি। এখানে সংক্ষেপে তাঁদের উল্লেখ করা গেল : সর্বসম্মত মতে হুযূর (সা)-এর এগারজন বিবি ছিল। এদের মধ্যে হযরত খাদীজা (রা) ও হযরত যয়নব বিনত খুযাইমা (রা) ছাড়া বাকী নয়জন হুযূর (সা)-এর ওফাতের সময় বর্তমান ছিলেন। হুযূর (সা)-এর বিবিদের নাম-খাদীজা (রা), সওদা (রা), আয়েশা (রা), হাফসা (রা), যয়নব বিনত খুযাইমা (রা), উম্মু সালমা (রা), যয়নব বিনত জাহাশ (রা), জুয়াইরিয়া (রা), উম্মু হাবীবা (রা), সফিয়া (রা) ও মায়মূনা (রা)।