قُلْ لَا أَقُولُ لَكُمْ عِنْدِي خَزَائِنُ اللَّهِ وَلَا أَعْلَمُ الْغَيْبَ
-‘‘আপনি বলে দিন, ‘আমি তোমাদের নিকট বলছি না যে আমার কাছে আল্লাহর ধন ভান্ডার এবং এও বলছি না যে, আমি গায়ব জানি।’’
{সূরাঃ আনআম, আয়াতঃ ৫০}
তাফসীরকারকগণ এ আয়াতের চার ধরনের ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন।
‘তাফসীরে নিশাপুরী’তে এ আয়াতের পরিপ্রেক্ষিতে লিখা হয়েছে-
يَحْتَمِلْ اَنْ يَّكُوْنَ وَلاَ اَعْلَمُ الْغَيْبَ عَطْفًا عَلَى لاَاَقُوْلُ لَكُمْ اَىْ قَلَ لاَّ اَعْلَمُ الْغَيْبَ فَيَكُوْنُ فِيْهِ دَلاَلَةٌُ عَلَى اَنَّ الْغَيْبَ بِالْاِسْتِقْلاَلِ لاَيَعْلَمُهُ اِلاَّاللهُ.
-‘‘এ আয়াতের এও হতে পারে যে, لَااَعْلَمُ বাক্যটি সংযোজক অব্যয় واو এর মাধ্যমে لَااَقُوْلُ لَكُمْ বাক্যটির সহিত সম্পর্কযুক্ত। এতে অর্থ দাঁড়ায়ঃ হে মাহবুব (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আপনি বলে দিন যে আমি গায়ব জানি না। তখন গায়ব বলতে সত্ত্বাগত ইলমে গায়বই বোঝা যাবে, যা আল্লাহ ছাড়া আর কারো আয়ত্বে নেই।’’
{ইমাম নিশাপুরীঃ তাফসীরে নিশাপুরীঃ ৬/১১০ পৃ.}
‘তাফসীরে বায়যাবী’তে এ আয়াতের ব্যাখ্যা এভাবে করা হয়েছে-
لَا اَعْلَمُ الْغَيْبَ مَالَمْ يُوْحَ اِلَىَّ اَوْلَمْ يَنْتَصِبْ عَلَيْهِ دَلِيْلٌُ
-‘‘আমি গায়ব জানিনা, যতক্ষণ পর্যন্ত না আমার প্রতি ওহী নাযিল হয়, বা এ ব্যাপারে কোন দলীল প্রমাণ প্রতিষ্ঠিত হয়।’’
{কাজী নাসিরুদ্ধীন বায়যাভীঃ তাফসীরে বায়যাভীঃ ২/৪১০ পৃ.}
এও হতে পারে যে এ আয়াতে সম্পূর্ণ জ্ঞানের অস্বীকৃতির কথাই ব্যক্ত করা হয়েছে।
‘তাফসীরে কবীরে’ এ আয়াতের তাফসীরে বলা হয়েছে-
قَوْلُهُ لَااَعْلَمُ الْغَيْبَ يَدُلُّ عَلَى اِعْتِرَ افِهِ بِاَنَّهُ غَيْرُ عَالِمٍ بِكُلِّ الْمَعْلُوْ مَاتِ.
-‘‘আমি গায়ব জানি না’ কুরআনে উল্লেখিত এ ফরমান দ্বারা হুযুর আলাইহিস সালামের এ কথারই স্বীকারোক্তির প্রতি ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে যে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সম্পূর্ণ জ্ঞানের অধিকারী নন।’’
{ইমাম ফখরুদ্ধীন রাজীঃ তাফসীরে কবীরঃ ২/১১৪ পৃ.}
অথবা, এরূপ উক্তি বিনয় ও নম্রতা প্রকাশ করার জন্য করা হয়েছে।
‘তাফসীরে খাযেনে’ এ আয়াতের তাফসীরে বলা হয়েছে-
وَاِنَّمَا نَفَى عَنْ نَفْسِهِ الشَّرِيْفَةِ هَذٍهِ الْاَشْيَاءَ تَوَاضُعًا لِلَّهِ تَعَالَى وَاِعْتِرَافًا لِلْعُبُوْدِيَةِ فَلَسْتُ اَقُوْلُ شَيْئًا مِنْ ذَلِكَ وَلاَ اَدَّعِيْةِ
-‘‘হুযুর আলাইহিস সালাম নিজের পবিত্র সত্ত্বা সম্পর্কে এ সকল বিষয়ের অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেছেন। এটা এ জন্য যে, এতে আল্লাহর নিকট তাঁর অনুনয়- বিনয় ও স্বীয় বন্দেগীর স্বীকারোক্তি প্রকাশ পায়। অর্থাৎ রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেনঃ আমি ওসব ব্যাপারে কিছু বলছি না, এবং কোন কিছুর দাবীও করছি না।’’
{ইমাম খাযেনঃ লুবাবুত তা’ভীলঃ ২/১৮০ পৃ.}
তাফসীরে ‘আরাইসুল বয়ানে’ উল্লেখিত আছে-
وتواضع حين اقام نفسه مقام الانسانية بعد ان كان اشرف خلق الله من العرش الى الثرى واطهر من الكرو بين والروحانيين خضوعا لجبروته وخشو عا لملكوته
-‘‘হুযুর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) নিজের সত্ত্বাকে মানুষের নির্ধারিত স্তরে রেখে বিনয়ভাবে প্রকাশ করেছেন। অথচ রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) হচ্ছেন ‘আরশ থেকে পাতাল পর্যন্ত সমস্ত সৃষ্টির মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ। ফিরিশতা এমনকি ‘রূহানীয়ীন’ নামক ফিরিশতাগণের চাইতেও অধিক পবিত্র। আল্লাহর মহান প্রতাপ ও প্রতিপত্তির সামনে অনুনয়-বিনয় ও তাঁর মহান ইলমে গায়বের দাবী সম্পর্কেই অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করা হয়েছে। অর্থাৎ রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন- “আমি ইলমে গায়বের অধিকারী বলে দাবী করছি না।”
তাফসীরে ‘নিশাপুরীতে’ আছে-
اَىْ لَااَدَّعِىُ الْقُدْرَةَ عَلَى كُلِّ الْمَقْدُوْرَاتِ وَالْعِلْمَ بِكُلِّ الْمَعْلُوْ مَاتِ
-‘‘আমি দাবী করছি না যে, আমি সবকিছু করার সামর্থ রাখি, কিংবা সমস্ত কিছু জানি।’’
{ইমাম নিযামুদ্দীন নিশাপুরীঃ তাফসীরে নিশাপুরীঃ ৬/১১২ পৃ.}
‘তাফসীরে কবীরে’ একই আয়াতের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে-
اَىْ لاَاَدَّعِىُ كَوْنِىْ مَوْصُوْفًا بِعِلءمِ اللهِ وَبِمَجْمُوْعِ هَذَيْنِ الْكَلاَمَيْنِ حَصَلَ اَنَّهُ لاَيَدَّعِىُ الْاِلَهِيَّةَ
-‘‘আমি আল্লাহর জ্ঞানে গুণান্বিত হওয়ার দাবী করি না। আয়াতের দু’অংশকে একত্রিত করলে সারমর্ম হয়, হুযুর আলাইহিস সালাম খোদা হওয়ার দাবী করেন না।’’
{ইমাম ফখরুদ্দীন রাজীঃ তাফসীরে কবীরঃ ৪/৫৩৮ পৃ.}
‘তাসফীরে রূহুল বয়ানে’ এ একই আয়াতের তাফসীরে আছে-
عَطْفً عَلَى عِنْدِىْ خَزَائِنُ اللهِ وَلاَمُذَكِّرَةٌُ لِلنَّفِىْ اَىْ وَلاَ اَدَّعِىُ اَنِّىْ اَعْلَمُ الْغَيْبَ مِنْ اَفْعَالِهِ تَعَالَى عَلىَ اَنَّهَا عِنْدِىْ وَلَكِنْ لاَّ اَقُوْلُ لَكَمْ فَمَنْ قَالَ اِنَّ نَبِىَّ اللهِ لَايَعْلَمُ الْغَيْبَ فَقَدْ اَخْطَاءَ فِيْمَا اَصَابَ
অর্থাৎ- عِنْدِىْ خَزَ ائِنَ اللهِ বাক্যটির সাথেই وَلاَ اَعْلَمُ الْغَيْبَ বাক্যটির সম্বন্ধ রয়েছে। এবং لاَ অক্ষরটি এখানে অতিরিক্ত অস্বীকৃতির স্মারক হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। অর্থাৎ আমি আল্লাহর কার্যকালাপ সমূহের অদৃশ্য বিষয়াদি জানার এ বলে দাবী করি না যে, আল্লাহর ধনভান্ডার সমূহ তো আমার কাছে আছে, কিন্তু আমি তা’ বলি না।’ সুতরাং, যে ব্যক্তি বলে যে, নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) গায়ব জানতেন না, সে এ আয়াতের গুঢ় মর্মার্থ অনুধাবনে ভুল করেছে, যদিও সে বাহ্যিক দিক থেকে আয়াতের শাব্দিক অর্থ ঠিকই করেছে।’’
{আল্লামা ইসমাঈল হাক্কীঃ রুহুল বায়ানঃ ৩/৪৫ পৃ.}
‘তাফসীরে মাদারিকে’ এ আয়াতের শব্দ বিন্যাস প্রসংগে বলা হয়েছে-
وَمَحلُّ لاَ اَعْلَمُ الْغَيْبَ النَّصْبُ عَطْفًا عَلَى مَحَلِّ عِنْدِىْ خَزَ ائِنُ اللهِ لاَنَّهُ مِنْ جُمْلَةِ الْمُقُوْلِ كَاَنَّهُ قَالَ لاَاَقُوْلُ لَكُمْ هَذَا الْقَوْلَ وَلاَهَذَا الْقَوْلَ وَلاَ اَعْلَمُ الْغَيْبَ
অর্থাৎ- عِنْدِىْ خَزَ ائِنُ اللهِ বাক্যটির শব্দ বিন্যাসগত অবস্থানের সহিত সংযোজক অব্যয়ের মাধ্যমে সম্পর্কযুক্ত হওয়ায় وَلاَ اَعْلَمُ الْغَيْبَ বাক্যটি ‘খবর’ বিশেষ। কেননা, لاَاَقُوْلُ এরপরে যে কথাটি বলা হয়েছে, সে কথাটিরই অন্তভুর্ক্ত হচ্ছে وَلاَ اَعْلَمُ الْغَيْبَ বাক্যটিও। অর্থাৎ রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) যেন একথাই বলেছেন, আমি তোমাদের কাছে না এটা বলছি, না, ওটা কোনটাই বলছি না।’’
{ইমাম নাসাফীঃ তাফসীরে মাদারিকঃ ১/৩৬৫ পৃ.}
‘তাফসীরে নিশাপুরী’তে আছে-
اَىْ قَلْ لاَاَعْلَمُ الْغََيْبَ فَيَكُوْنُ فِيْهِ دَلاَلَةٌُ عَلَى اَنَّ الْغَيْبَ بِاِسْتِقْلاَلٍ لاَ يَعْلَمُ اِلاَّ اللهُ
-‘‘বলুন, ‘আমি গায়ব জানি না’ এখানে ‘গায়ব’ বলতে সত্ত্বাগত ও স্বয়ং সম্পূর্ণরূপে ‘গায়ব’ জানার কথাই বোঝানো হয়েছে, যেভাবে আল্লাহ ছাড়া আর কেউ জানে না।’’
{ইমাম নিশাপুরীঃ তাফসীরে নিশাপুরীঃ ৬/১১০ পৃ.}
এ আয়াতের দু’জায়গায় لاَاَقَوْلُ ব্যবহৃত হয়েছে। প্রথম لاَاَقَوْلُ পর দু’টি বিষয়ের কথা উল্লেখিত আছে। (১) ‘আমি বলছি না, যে আমার কাছে আল্লাহর ধনভান্ডার আছে।’ এবং (২) ‘এও বলছি না যে আমি গায়ব জানি’ দ্বিতীয় لاَاَقَوْلُ পর মাত্র একটি বিষয়ের উল্লেখ আছে। তা হলো ঃ ‘আমি বলছি না যে, আমি ফিরিশতা।’ এর তাৎপর্য হলো প্রথমোক্ত দু’টি বিষয়ে শুধু দাবীর অস্বীকৃতিই জ্ঞাপন করা হয়েছে, কিন্তু কথিত বিষয়টির স্বীকৃতি পাওয়া যাচ্ছে। অন্যদিকে ২য় لاَاَقَوْلُ দ্বারা দাবী ও দাবী করার বিষয় উভয়টি সম্পর্কে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করা হয়েছে। অর্থাৎ আমার কাছে আল্লাহর ধনভান্ডারও আছে, এবং আমি গায়বও জানি, কিন্তু এগুলো ধারক বলে দাবী করি না।
‘মিশকাত শরীফে’ فَضَائِلِ سَيِّدُ اْلمُرْسَلِيْن শীর্ষক অধ্যায়ে হযরত উকবা বিন আমের (রা.) হতে বর্ণিত আছে-
أُعْطِيتُ مَفَاتِيحَ خَزَائِنِ الْأَرْضِ
-‘‘আমাকে পৃথিবীর যাবতীয় ধনভান্ডারের চাবি সমূহের অর্পণ করা হয়েছে।’’
ইলমে গায়ব সম্পর্কিত হাদীছ সমূহ ইতিপূর্বে উল্লে করেছি। এ আয়াত থেকে বোঝা যায় যে, রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন “আমি আসলে ফিরিশতাও নই এবং ওটার দাবীও করছি না।” এ অন্তনির্হিত তাৎপর্য না হলে لاَاَقُوْلُ বাক্যটি একবার ব্যবহার করাই যথেষ্ট ছিল, দু’জায়গায় কেন বলা হলো? যদি আমার বর্ণিত ব্যাখ্যা সমূহের আলোকে উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যা করা না হয়, তাহলে এ আয়াতটি ভিন্নমতাবলম্বীদেরও মতের বিপরীত হবে। কেননা, ইলমে গায়বের কিয়দংশ তারাও স্বীকার করেন। অথচ এ আয়াতে সম্পূর্ণরূপে বিষয়টির অস্বীকার করা হচ্ছে। অধিকন্তু, এখানে لَكُمْ দ্বারা কাফিরদের প্রতি নির্দেশ করা হয়েছে। অর্থাৎ বলা হয়েছে হে কাফিরগণ, আমি তোমাদের কাছে বলছি না যে, আমার কাছে ধনভান্ডারসমূহ আছে। তোমরা চোর। চোরের কাছে ধনভান্ডারের কথা বলা যায় না। যাতে তোমরা শয়তানের মত গোপন রহস্যাবলী চুরি করতে না পার। আল্লাহ তা’আলা আসমানের উপর শয়তানের যাওয়ার পথে এ জন্যই প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করেন যে, সে চোর। তবে হ্যাঁ, একথা হযরত সিদ্দীক আকবর (রাদিআল্লাহু আনহু) এর কাছে বলা যাবে যে, ‘আমাকে আল্লাহর ধনভান্ডারের চাবিসমূহ অর্পণ করা হয়েছে’ আবার এখানে عِنْدِىْ শব্দের উল্লেখ করে এ কথাই বোঝানো হয়েছে, যে ধনভান্ডার আমার হাতে নেই আমার কর্তৃত্বাদীনে আছে। কেননা, ধনভান্ডার ভান্ডার রক্ষকের কাছে ও মালিকের মালিকানাধীনেই সুরক্ষিত থাকে। আমিতো ভান্ডার রক্ষক নই (আমি বরং মালিক)। দেখেন নি, রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ইঙ্গিতে মেঘ বৃষ্টি বর্ষণ করেছে, তাঁরই মুবারক অঙ্গুলিগুলো হতে ঝর্ণাধারা প্রবাহিত হয়েছে?
وَلَوْ كُنْتُ أَعْلَمُ الْغَيْبَ لَاسْتَكْثَرْتُ مِنَ الْخَيْرِ
-‘‘যদি আমি গায়ব জানতাম তাহলে প্রভূত কল্যাণ পুঞ্জীভূত করতাম।’’
{সূরাঃ আ’রাফ, আয়াতঃ ১৮৮, পারাঃ ৯}
তাফসীরকারগণ এ আয়াতেরও তিনটি ভাবার্থ ব্যক্ত করেছেন- (এক) হুযুর আলাইহিস সালামের এ উক্তিটা হচ্ছে বিনয় জ্ঞাপক। (দুই) এখানে আল্লাহর জানা যাবতীয় বিষয়ের জ্ঞানের অস্বীকৃতি জ্ঞাপনই মূল উদ্দেশ্য; (তিন) সত্ত্বাগত ও স্বয়ং সম্পূর্ণ জ্ঞানের অস্বীকারই এখানে ব্যক্ত হয়েছে।
আল্লামা শিহাবুদ্দীন খিফ্ফাজী (রহ.) তার ‘নাসীমুর রিয়াদ্ব’ নামক গ্রন্থের এ আয়াতের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বলেন-
قَوْ لُهٌ وَلَوْ كُنْتُ اَعْلَمْ اَلغيْبَ فَاِنَّ الْمُنْفِىَّ عِلْمُهُ مِنْ غَيْرِ وَ اسِطَة وَاَمَّا اِطِّلاَعُهُ عَلَيْهِ الْسَلاَمُ بِاِعْلاَمِ اللهِ تَعَالَى فَاَمْرٌُ مُتَحَقُّقُ بِقَّوْلِهِ تَعَالَى فَلاَ يُظُهِرُ عَلَى غَيْبِهِ اَحَدًا اِلاَّمَنِ ارْتَضَى مِنْ رَّسُوْلِ
-‘‘অদৃশ্য বিষয়াদির সমর্থন এ আয়াতের وَلَوْ كُنْتَ اَعْلَمَ الْغَيْبَ পরিপন্থী নয়। কেননা, এখানে মাধ্যম বিহীন অর্জিত অদৃশ্য জ্ঞানকেই অস্বীকার করা হয়েছে। কিন্তু আল্লাহ কর্তৃক জানানোর ফলশ্রুতিতে হুযুর আলাইহিস সালামের গায়ব জানার বিষয়টি যথার্থরূপে প্রতিষ্ঠিত সত্য। কারণ, আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন- فَلاَ يَظْهَرُ عَلَى غَيْبِهِ (আল্লাহর নিজের অদৃশ্য বিষয়াদি কারো নিকট প্রকাশ করেন না।) এখানে আল্লাহর জানা যাবতীয় বিষয় সম্পর্কিত জ্ঞানের অস্বীকৃতিই জ্ঞাপন করা হয়েছে।’’
{ইমাম শিহাবুদ্দীন খিফ্ফাজীঃ নাসীমুর রিয়াদ্ধঃ ৩/১৫০ পৃ.}
‘শরহে মওয়া কিফে’ আল্লামা মীর সৈয়দ শরীফ (রহমতুল্লাহে আলাইহে) বলেছেন-
اَلْاِطِّلاَعُ عَلَى جَمِيْعِ الْمُغَيِّبَاتِ لاَيُجِبَ لِلنَّبِىِّ وَلِذَا قَالَ عَلَيْهِ السَّلاَمُ لَوَكُنْتُ اَعْلَمُ الْغَيْبَ (الاية) وَجَمِيْعَ مُغَيِّبَاتٍ غَيْرُ مُتَنَا هِيَةٍ
অর্থাৎ- নবীর জন্য সমস্ত গায়ব সম্পর্কে অবহিত হওয়ার প্রয়োজন নেই। এ জন্যেই নবী করীম আলাইহিস সালাম ইরশাদ করেছেন- وَلَوْ كُنْتُ اَعْلَمُ الْغَيْبَ الاية আর, সমস্ত অদৃশ্য বিষয় হলো অসীম, সীমাবদ্ধতার গন্ডী বহির্ভুত। অথবা, এরূপ উক্তি অনুনয় বিনয় প্রকাশের নিমিত্তে করা হয়েছে।
‘সাবী’ হাশিয়ায়ে জালালাইনে এ আয়াত প্রসঙ্গে লিখা হয়েছে-
اِنْ قُلْتَ اَنَّ هَذَا يَشْكِلُ مَعَ مَاتَقَدَّمَ مِنْ اَنَّهُ اُطُّلِعَ عَلَى جَمِيْعِ مُغَيِّبَاتِ الدُّنْيَا وَالْاَخِرَةِ فَالْجَوَابُ اَنَّهُ قَالَ ذَالِكَ تَوَاضُعًا
-‘‘যদি আপনারা বলেন, এ আয়াতটি পূর্বোলেখিত বক্তব্যের (হুযুর আলাইহিস সালামকে) সমস্ত দ্বীনী ও পার্থিব অদৃশ্য বিষয় সমূহ অবহিত করা হয়েছে। বিপরীত তাহলে এর উত্তর হবেঃ এ উক্তিটা করা হয়েছে বিনয় ও নম্রতা প্রকাশের নিমিত্তে।’’
{ইমাম সাভীঃ তাফসীরে সাভীঃ ২/১৮৫পৃ.}
‘তাফসীরে খাযেনে’ এ আয়াতের পরিপ্রেক্ষিতেই ‘জুমাল-হাশিয়ায়ে জালালাইন’ থেকে উদ্ধৃতি করা হয়েছে-
فَاِنْ قُلْتَ قَدْ اَخْبَرَ النَّبِىُّ عَلَيْهِ السَّلاَمُ عَنِ الْمُغَيِّبَاتِ قَدْ جَاءَتْ اَحَادِيْثُ فِى الصَّحِيْحِ بِذَالِكَ وَهُوَ مِنْ اَعْظَمِ مُعْجِزَاتِهِ فَكَيْفَ الْجَمْعُ بَيْنَهُ وَبَيْنَ قَوْلِهِ لَوْ كُنْتَ اَعْلَمَ الْغَيْبَ قُلْتَ يَحْتَمِلَ اَنْ يَّكُوْنَ قَالَهُ تَوَاضُعًا وَّاَدبَا وَالْمَعْنَى لاَاَعْلَمُ الْغَيْبَ اِلاَّاَنْ يُطْلِعَنِى اللهُ عَلَيْهِ وَيُقَدِّرَهُ لِىْ وَيَحْتَمِلُ اَنْ يَّكُوْنَ قَالَ ذَلِكَ قَبْلَ اَنْ يُّطْلِعَهُ اللهُ عَلَى الْغَيْبِ فَلَمَّا اَطْلَعَهُ اللهُ اَخْبَرَ بِهِ
-‘‘আপনারা হয়তো প্রশ্ন করবেন, হুযুর আলাইহিস সালাম অনেক অদৃশ্য বিষয়ের খবর দিয়েছেন। এ সম্পর্কে অনেক সহীহ হাদীছও বর্ণিত আছে এবং ইলমে গায়ব হলো হুযুর আলাইহিস সালামের এক বড় মুজিযা। তাহলে এ সমস্ত কথা এবং উক্ত আয়াত لَوْكُنْتَ اَعْلَمُ الْغَيْبَ এর মধ্যে কিভাবে সামঞ্জস্য বিধান করা হবে? এর উত্তরে আমি বলবোঃ হতে পারে যে, এখানে বিনয় ও নমত্রার খাতিরে তিনি এরূপ বলেছেন এবং এর অর্থ হচ্ছে খোদার পক্ষ থেকে অবহিত হওয়া ছাড়া আমি গায়ব জানি না। এও হতে পারে যে, এ উক্তিটা ইলমে গায়বের অধিকারী হওয়ার আগেই করা হয়েছিল। যখন আল্লাহ তা’আলা হুযুর আলাইহিস সালামকে ইলমে গায়ব দান করেন, তখনই রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) গায়বের খবর দিয়েছেন।’’
‘আল্লামা সুলাইমান জুমাল (রহমতুল্লাহে আলাইহে) ‘ফুতুহাতে ইলাহিয়া’ নামক হাশিয়ায়ে জালালাইনের’ ২য় খন্ডের ২৫৮ পৃষ্ঠায় অনুরূপ কথাই বলেছেনঃ
اَىْ قُلْ لاَّاَعْلَمُ الْغَيْبَ فَيَكُوْنُ فِيْهِ دَلاَلَةٌُ عَلَى اَنَّ الْغَيْبَ بِالْاِسْتِقْلاَلِ لاَيَعْلَمُ اِلاَّاللهُ
অর্থাৎ বলে দিন, আমি গায়ব জানি না। অতএব, আয়াত থেকে ইহাই বোঝা যায় যে, সত্ত্বাগতভাবে গায়বী বিষয়াদি নাজানার কথাই ব্যক্ত হয়েছে। অর্থাৎ সত্ত্বাগতভাবে খোদা ব্যতীত আর কেউ গায়বী বিষয়াদি জানে না।
{আল্লামা সুলাআমিান জুমালঃ ফতহাতে ইলাহিয়্যাহঃ ২/২১৭ পৃ.}
তাফসীরে সা’বীতে এ আয়াতের তাফসীরে আছে-
اَوْ اَنَّ عِلْمَهُ بِالْمُغَيَّبِ كَلاَّ عِلْمٍ مِنْ حَيْثَ اَنَّهُ لاَقُدْرَةَ لَهُ عَلَى تَغَيْرِ مَاقَدَّرَ اللهُ فَيْكُوْنُ الْمَعْنَى حِيْنَئِذٍ لَوْكَانُ لِىْ عِلْمٌُ حَقِيْقِىٌُّ بِاَنْ اَقْدِرَ عَلَى مَااُرِيْدُ وُقُوْعَهً لَاَسْتَكْثَرْتُ مِنَ الْخَيْرِ
-‘‘হুযুর আলাইহিস সালামের গায়ব জানাটা না জানার মতই। কেননা, আল্লাহ তা’আলা যা’ কিছু নির্ধারণ করেছেন, তা পরিবর্তন করার ক্ষমতা তাঁর নেই। তখন এ আয়াতের অর্থ হবে যদি আমি ইলমে হাকীকীর অধিকারী হতাম, যাতে আমার উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করতে পারি, তাহলে প্রভূত কল্যাণ পুঞ্জীভূত করতে পারতাম।’’
{ইমাম সাভীঃ তাফসীরে সাভীঃ ২/৩০৭ পৃ.}
এ তাৎপর্যটা খুবই যুক্তিযুক্ত। কেননা, এ আয়াতের অর্থ হলো যদি আমি গায়ব জানতাম, তাহলে প্রভূত কল্যাণ লাভ কারতাম, এবং আমাকে কোন কষ্ট পেতে হতো না। শুধু কোন বিষয় সম্পর্কে জানাটা কল্যাণ লাভের ও বিপদ থেকে বাঁচার বিশেষ ক্ষমতা না থাকে। আমার জানা আছে যে, বার্ধক্য আসবে, তখন আমাকে অনেক বার্ধক্যজনিত কষ্ট সহ্য করতে হবে। কিন্তু বার্ধক্য প্রতিরোধ করার কোন শক্তি আমার নেই। আমি আজ জানতে পারলাম যে, কয়েক দিন পর খাদ্য শস্যের দাম বৃদ্ধি পাবে। কিন্তু আমার কাছে আজ এত টাকা নেই যে, এক সঙ্গে বেশী পরিমাণ খাদ্যশস্য খরিদ করে রাখতে পারি। বোঝা গেল যে, কল্যাণ লাভ ও বিপদ থেকে বাঁচার ব্যাপারটি জ্ঞান ও ক্ষমতা উভয়টির উপর নির্ভরশীল। এ আয়াতে কুদরতের উল্লেখ নেই। তাই ‘ইলমে গায়ব’ বলতে ঐ ‘ইলমকেই বোঝানো হয়েছে, যা কুদরত বা শক্তি সামর্থ্যের সহিত সম্পৃক্ত। অর্থাৎ সত্ত্বাগত জ্ঞান, যা খোদা হওয়ার জন্য অত্যাবশ্যকীয়, যার সাথে কুদরতের সহাবস্থান অপরিহার্য। আয়াতের এ অর্থ গ্রহণ না করলে এর অন্য কোন অর্থই বিশুদ্ধ হয় না। কেননা উক্ত সাপেক্ষ বাক্যটিতে (আয়াতে) পূর্বগ ও অনুগের মধ্যে কোন সামঞ্জস্য থাকছে না, যা না হলে ‘কিয়াস’ সঠিক হয় না।
দেওবন্দীরা এ আয়াতের অর্থ করেন এরূপঃ যদি আমি গায়ব জানতাম, তাহলে প্রভূত, কল্যাণ সঞ্চয় করতাম এবং আমার উপর কোন বালামুসীবত আসতো না। কিন্তু যেহেতু আমার কাছে কল্যাণও নেই এবং মুসীবত থেকে বাঁচাও নেই, সেহেতু আমি গায়ব জানি না।
আমরাও আয়াতের এ ধরণের অর্থ করতে পারি, ভেবে দেখতে পারেন। “যদি আমার কাছে মঙ্গলজনক কিছু থাকে এবং আমি মুসীবত থেকে রক্ষা পাই, তাহলে জেনে নাও যে, আমার ইলমে গায়বও আছে।” আমার কাছে মঙ্গলজনক অনেক কিছুতো আছেই। যেমন- কুরআনই প্রমাণ করে-
وَمَنْ يُؤْتَ الْحِكْمَةَ فَقَدْ أُوتِيَ خَيْرًا كَثِيرًا
-‘‘যাকে জ্ঞান বিজ্ঞান ও দর্শন দান করা হয়েছে, তাকে প্রভূত কল্যাণ দান করা হয়েছে।
{সূরাঃ বাক্বারা, আয়াতঃ ২৬৯, পারাঃ ৩}
অন্যত্র বলা হয়েছে
اِنَّااَعْطَيْنَكَ الْكَوْثَرَ
অর্থাৎ- আমি আপনাকে অনেক কিছু দিয়েছি।
{সূরাঃ কাউসার, আয়াতঃ ১}
আর এক জায়গায় আছে
يُعَلِّمُهُمُ الْكِتَبَ وَالْحِكْمَةَ
অর্থাৎ- তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) তাদেরকে কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দেন।
{সূরাঃ মায়েদা, আয়াতঃ ৬৭, পারাঃ ৬}
এ ছাড়া আমি বিপদাপদ থেকে তো নিরাপদ। কেননা, আল্লাহ তা’আলা ফরমাচ্ছেনঃ وَاللهُ يَعْصِمُكَ مِنَ النَّاسِ অর্থাৎ- আল্লাহ আপনাকে লোকদের হাত থেকে রক্ষা করবেন। সুতরাং, আমার ইলমে গায়বও আছে। এ আয়াত তো ইলমে গায়েবের প্রমাণবহ, এখানে ইলমে গায়েবের অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করা হচ্ছে না।
তাফসীরে রুহুল বয়ানে এ আয়াতের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে লেখা হয়েছেঃ-
وَقَدء ذَهَبَ بَعْضُ الْمَشَائِخُ اِلَى اَنَّ النَّبِىَّ عَلَيْهِ السَّلاَمُ كَانَ يَعْرِفُ وَقْتَ السَّاعَةِ بِاِعْلاَمِ اللهِ وَهُوَ لاَيُنَافِى الْحَصْرَ فِى الْاَيَةِ كَمَا لاَيَخْفَى
অর্থাৎ- কোন কোন মাশায়িখ এ কথাও বলেছেন যে, নবী আলাইহিস সালামের আল্লাহ প্রদত্ত জ্ঞানের বদৌলতে কিয়ামতের সুনির্দিষ্ট সময় জানাছিল। তাঁদের এ উক্তি এ আয়াতের حصر বা সীমাবদ্ধতার (ইলমে গায়ব একমাত্র আল্লাহরই সহিত সীমাবদ্ধ।) পরিপন্থী নয়, ইহা সুস্পষ্ট।
{আল্লামা ইসমাঈল হাক্কীঃ তাফসীরে রুহুল বায়ানঃ ১০/৩৮৭ পৃ.}
وَعِنْدَهُ مَفَاتِحُ الْغَيْبِ لَا يَعْلَمُهَا إِلَّا هُوَ
-‘‘তাঁরই কাছে রয়েছে গায়বের চাবিসমূহ। একমাত্র তিনিই ঐগুলো সম্পর্কে জ্ঞাত।’’
{সূরাঃ আনআম, আয়াতঃ ৫৯, পারাঃ ৭}
তাফসীরকারকগণ বলেছেন ‘মাফাতিহুল গায়ব’ مَفَاتِحُ الْغَيْبِ দ্বারা হয়তো ‘গায়বের ভান্ডার’ বোঝানো হয়েছে। অর্থাৎ খোদার জানা সবকিছুর জ্ঞান। কিংবা আয়াতে অদৃশ্যকে দৃশ্যমান বা সম্মুখে হাজির করার তথ্য বস্তু সমূহের সৃষ্টির সামর্থ থাকার প্রতি সুস্পষ্ট ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে। কেননা, চাবির কাজ হলো তালা খুলে বাহিরের জিনিস ভিতরে ও ভিতরের জিনিস বাহিরে আনা-নেওয়া। অনুরূপ অদৃশ্যকে দৃশ্যমান ও দৃশ্যমানকে অদৃশ্য করার অর্থাৎ সৃষ্টি ও মৃত্যু প্রদানের ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহর কাছেই আছে।
তাফসীরে কবীরে এ আয়াতের পরিপ্রেক্ষিতে লিখা হয়েছেঃ
فكذلك هاهنا الْحَقُّ سُبْحَانَهُ لَمَّا كَانَ عَالِمًا بِجَمِيعِ الْمَعْلُومَاتِ عَبَّرَ عَنْ هَذَا الْمَعْنَى بِالْعِبَارَةِ الْمَذْكُورَةِ....وَعَلَى التَّقْدِيرِ الثَّانِي الْمُرَادُ مِنْهُ الْقُدْرَةُ عَلَى كُلِّ الْمُمَكِنَاتِ
-‘‘যেহেতু আল্লাহ তা’য়ালাই তাঁর জ্ঞাত যাবতীয় বিষয়ের জ্ঞান রাখেন, তাই সে কথাটিই তিনি উক্ত ভাষায় ব্যক্ত করেছেন। আয়াতের দ্বিতীয় লক্ষ্যার্থ হলো সম্ভবপর সবকিছু করার সামর্থ থাকা। এই কথাটুকু ব্যক্ত করার জন্য বলা হয়েছে- তাঁর কাছেই আছে অদৃশ্য বিষয়াদির চাবিসমূহ।”
{ইমাম ফখরুদ্দীন রাজীঃ তাফসীরে কবীরঃ ১৩/১০পৃ.}
‘তাফসীরে রূহুল বয়ানে’ এ আয়াতের তাৎপর্য বিশেষণে লিখা হয়েছেঃ
وَقَلَمُ تَصْوِيْرِهاَ الَّذِىْ هُوَ مِفْتَاحٌُ يُفْتَحُ بِهِ بَابُ عِلْمِ تَكْوِيْنِهَا عَلَى صُوْرَتِهَا وَكُوْنَهَا هُوَ الْمَلَكُوْتُ فَبِقَلَمِ مَلَكُوْتٍ كُلِّ شَيْئٍ يَكُوْنُ كُلُّ شَيْئٍ وَقُلَمُ الْمَلَكُوْتِ بِيَدِاللهِ لِاَنَّ الْغَيْبَ هُوَ عِلْمُ التَّكْوِيْنِ
-‘‘ঐ সমস্ত বস্তুর নক্শা তৈরী করার কলম, যেটি এমন একটি চাবি, যদ্বারা সেই সমস্ত বস্তুর সৃষ্টির দ্বার উন্মুক্ত করা হয় (ঐ সমস্ত বস্তুর যথোপযুক্ত আকৃতিতে)। উহাই হচ্ছে ‘মালাকুত’। সুতরাং, প্রত্যেক বস্তুই তার মালাকুতের কলম দ্বারাই অস্তিত্ব লাভ করে। আর মালাকুতের কলম হচ্ছে আল্লাহর হাতে। এ পরিপ্রেক্ষিতেই এখানে ‘গায়ব’ বলতে কোন কিছু সৃষ্টি করার জ্ঞানকে বোঝানো হয়েছে।’’
{.আল্লামা ইসমাঈল হাক্কীঃ তাফসীরে রুহুল বায়ানঃ ৩/৫৭ পৃ.}
‘তাফসীরে খাযেনে এ আয়াতের ব্যাখ্যা বলা হয়েছেঃ
لِاَنَّ اللهَ تَعَالَى لَمَّا كَانَ عَا لِمَّا بِجَمِيْعِ الْمَعْلُوْمَاتِ غَبَّرَ هَذَ الْمَعْنَى بِهَذَا الْعِبَارَةِ وَعَلَى التَّفْسِيْرِ الثَّانِىْ يَكُوْنُ الْمَعْنَى وَعِنْدَهُ خَزَائِنُ الْغَيْبِ وَالْمُرَادُ مِنْهُ الْقَدْرَةُ الْكَامِلَةُ عَلَى كُلِّ الْمُمْكِنَاتِ
-‘‘আল্লাহ তা’আলা যে সর্ববিষয়ে জ্ঞানী, এ আয়াতের দ্বারা সেই কথাটাই তিনি বর্ণনা করেছেন। ২য় তাফসীর মতে এর অর্থ হবে আল্লাহর কাছে গায়বের ভান্ডার রয়েছে। এর মর্মার্থ হলো সম্ভবপর প্রত্যেক কিছুর উপর তার পরিপূর্ণ ক্ষমতা রয়েছে।’’
{ইমাম খাযেনঃ তাফসীরে খাযেন, ২/২১৮পৃ.}
অথবা, এ অর্থও হতে পারে যে, আল্লাহ তা’আলার প্রদত্ত জ্ঞান ছাড়া কেউ গায়বের চাবিসমূহ সম্পর্কে জানতে পারবে না।
তাফসীরে ‘আরায়েসুল বয়ানে’ আছেঃ
قَالَ الْحَرِيْرِىُّ لاَيَعْلَمُهَا اِلاَّهُوَ وَمَنْ يُّطْلِعُهُ عَلَيْهَا مِنْ خَلِيْلٍ وَحَبِيْبٍ اَىْ لاَيَعْلَمُهَا الْاَوَّلُوْنَ وَالْاَخِرُوْنَ قَبْلَ اِظْهَارهِ تَعَالَى ذَلِكَ لَهُمْ
-‘‘আল্লামা হারীরী (রহমতুল্লাহে আলাইহে) বলেন, ঐ সমস্ত চাবি সম্পর্কে আল্লাহ তা’আলা এবং তার প্রিয় বান্দাগণ (যাঁদেরকে তিনি অবহিত করেছেন) ছাড়া আর কেউ জানে না। অর্থাৎ পূর্বব র্তী ও পরব র্তী প্রিয় বান্দাগণ আল্লাহ কর্তৃক জ্ঞাত করার আগে সেগুলো সম্পর্কে জানতেন না।’’
‘তাফসীরে ‘ইনায়াতুল কাযী’তে এ আয়াত সম্পর্কে উল্লেখিত আছেঃ
وَجْهُ اخْتِصَا صِهَابِهِ تَعَالَى اَنَّهُ لاَيَعْلَمُهَا كَمَاهِىَ اِبْتِدَاءً اِلاَّهُوَ
-‘‘গায়বের চাবিসমূহ খোদার সাথে বিশেষভাবে সম্পর্কিত হওয়ার কারণ হলো এগুলো আদিতে যেরূপে ছিল সে সম্পর্কে আল্লাহ তা’আলা ব্যতীত আর কেউ জানে না।’’
{ইমাম বায়যাভীঃ ইনীয়াতুল কাযী আলা তাফসীরে বায়যাভীঃ ৪/৭৩ পৃ.}
এ আয়াতের ভাবার্থ আমি যা’ বর্ণনা করেছি তা’ যদি গ্রহণ করা না হয়, তা’হলে এ আয়াতটি বিরুদ্ধমতাবলম্বীদেরও মতের বিপরীত হবে। কেননা, তারাও আংশিকরূপে গায়ব এর জ্ঞান স্বীকার করেন, অথচ এ আয়াত ইলমে গায়বকে পরিপূর্ণভাবে অস্বীকার করা হয়েছে।
জনৈক ভদ্রলোক আমাকে বলেছেন যে, আ’লা হযরত (কুঃ সিঃ) এখানে একটা রহস্য উদ্ঘাটন করেছেন। সেটা হলো এ আয়াতে আছে عِنْدَهَ مَفَاتِحَ الْغَيْبِ অন্যত্র আছে لَهُ مَقَاليْدُ السَّمَوَاتِ وَالْاَرْضِ মাফাতিহ ও মাকালীদ’ (مقاليد ও مفاتح) শব্দদ্বয়ের অর্থ হচ্ছে চাবিসমূহ। যদি مفاتح শব্দটির প্রথম ও শেষ অক্ষর। (م ও ح) এবং مقاليد শব্দটির প্রথম ও শেষ অক্ষর م ও د একত্রিত করা হয় তখন (محمد) শব্দ গঠিত হয়। এ থেকে বোঝা যাচ্ছে যে, রাসূলুল্লাহ আলাইহিস সালামের সত্ত্বা হলো নিখিল বিশ্ব বিকাশের চাবিকাঠি। لاَيَعْلَمُهَا اِلاَّهُوَ (ঐগুলো সম্পর্কে তিনিই জানেন) আয়াতের এ অংশটুকুর দ্বারা একথার প্রতিই ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, হুযুর আলাইহিস সালাম প্রকৃত পক্ষে যেরূপ বিরাজমান, সেরূপে কেউ তাঁকে জানে না। ‘হাকীকাতে মুহাম্মদীয়া, কে একমাত্র আল্লাহ তা’আলাই জানেন। مفاتح শব্দটি বহুবচন আকারে এজন্য ব্যবহৃত হয়েছে যে, তাঁর প্রত্যেকটি প্রেমময় আচরণ রহমতে ইলাহীর চাবি বিশেষ, তাঁর নূর হচ্ছে নিখিল জগতের চাবিস্বরূপ।
হাদীছে উক্ত হয়েছে:
كُلُّ الْخَلْقِ مِنْ نُوْرِىْ
-সমস্ত মাখলুক আমার নূর থেকে সৃষ্ট।
এ হাদিস এবং বিষয় সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে আমার লিখিত ‘‘প্রমাণিত হাদিসকে জাল বানানোর স্বরূপ উন্মাচন’ এর ১ম খন্ডের ৩৭৬-৩৮১পৃষ্ঠায় দেখুন-বাহাদুর।
কিয়ামতের দিন তাঁর সিজদা শাফায়াতের চাবি, বেহেশতের মাঝে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) পবিত্র নাম প্রত্যেক নেয়ামতের চাবি এবং বেহেশতে তাঁর পদার্পণ সকলের জন্য বেহেশত উন্মুক্ত হওয়ার চাবি।
(এ প্রসঙ্গে বিস্তারিতভাবে জানার জন্য আমার রচিত গ্রন্থ ‘শানে হাবিবুর রহমান’ দেখুন।)
আরও একটি সুক্ষন্ড তাৎপর্যঃ এ আয়াত থেকে বোঝা গেল যে, গায়বের চাবিসমূহের রয়েছে আল্লাহ তা’আলার কাছে। এখন প্রশ্ন হলো, এ চাবি দিয়ে কারো জন্য গায়বের দরজা খোলা হয়েছে কিনা? বা কাউকে কোন চাবি দেয়া হয়েছে কিনা? এর জওয়াব কুরআন হাদীছের মধ্যেই রয়েছে, পর্যালোচনা করুন। কুরআন ইরশাদ করেছে
اِنَّا فَتَحْنَللَكَ فَتْحَا مُبِيْنًا
অর্থাৎ- আমি (আল্লাহ) আপনার জন্য সুস্পষ্টভাবে খুলে দিয়েছি। কি খুলে দিয়েছেন?
{সূরাঃ ফাতাহ, আয়াতঃ ১, পারাঃ ২৬}
(এ সম্পর্কে হৃদয়গ্রাহী তাৎপর্যপূর্ণ বিবরণ আমার রচিত কিতাব “শানে হাবিবুর রহমান বি আয়াতিল কুরআন” পর্যালোচনা করে দেখুন।)
তালা-চাবিতে বস্তুই সযত্নে রাখা হয়, যা’ খুলে বের করতে হয়; আর যা’ খুলে বের করতে হয় না, তা’ যমীনে পুঁতে ফেলা হয়। এতে বোঝা গেল যে, গায়ব’ তাঁকে দেয়ার ছিল, তাই চাবিতে রাখা হয়েছিল।
এ প্রসঙ্গে হাদীছ শরীফে আছে-
أُعْطِيتُ مَفَاتِيحَ خَزَائِنِ الْأَرْضِ
-‘‘আমাকে পৃথিবীর যাবতীয় ধনভান্ডারের চাবি সমূহের অর্পণ করা হয়েছে।’’
এ থেকে বোঝা গেল যে, হুযুর আলাইহিস সালামকে চাবিও দেয়া হয়েছে, আর তাঁর জন্য দরজাও উন্মুক্ত করা হয়েছে।
قُلْ لَا يَعْلَمُ مَنْ فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ الْغَيْبَ إِلَّا اللَّهُ
-‘‘আপনি বলুন, আল্লাহ ছাড়া আসমান সমূহ ও যমীনে যারা আছেন, তারা গায়ব জানেন না।’’
{সূরাঃ নামল, আয়াতঃ ৬৫, পারাঃ ২০}
তাফসীরকারগণ এ আয়াতের দুটি তাৎপর্য দুটি ভাবার্থ লিখেছেন- সত্ত্বাগতভাবে ‘গায়ব কেউ জানে না বা সমস্ত গায়বও কেউ জানে না।
তাফসীরে ‘আলমুয়াজে জলীলে’ এ আয়াতের ব্যাখ্যায় লিখা হয়েছে-
مَعْنَاهَ لاَيَعْلَمُ الْغَيْبَ بِلاَدَلِيْلٍ اِلاَّاللهُ اَوْ بِلاَ تَعْلِيْمِ اَوْ جَمِيْعَ الْغَيْبِ
-‘‘এ আয়াতের অর্থ হচ্ছে বিনা দরীলে বা জ্ঞাত করানো ছাড়া, সম্পূর্ণ গায়ব খোদা ভিন্ন অন্য কেউ জানে না।’’
{ইমাম আহমদ রেযা খাঁনঃ খালিসুল ই’তিকাদঃ ১৫ পৃ.}
‘তাফসীরে মাদারিকে’ এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছেঃ
وَالَغَيَبُ مَالَمْ يَقُمْ عَلَيْهِ دَلِيْلً وَلاَ اُطَلِىَ عَلَيْهِ مَخْلُوْقً
-‘‘গায়ব হলো উভয়ই, যা’র কোন প্রমাণ উপস্থাপিত নেই এবং সৃষ্টিকূলের কাউকে যা’ জ্ঞাত করা হয়নি।’’
{ইমাম নাসাফীঃ তাফসীরে মাদারিকঃ ২/২৪৬ পৃ.}
‘তাফসীরে মাদারিকের’ এ ব্যাখ্যা থেকে বোঝা গেল যে, উক্ত মুফাসসিরের পরিভাষায় প্রদত্ত জ্ঞানকে ‘ইলমে গায়ব’ বলা হয় না; কেবল সত্ত্বাগত জ্ঞানকে ইলমে গায়ব বলা হয়। এখন আর কোন সমস্যাই রইলো না। কেননা, যে সব আয়াতে ইলম গায়ব এর অস্বীকৃতি প্রকাশ পেয়েছে, সেগুলো সত্ত্বাগতভাবে জানা গায়ব সম্পর্কে প্রযোজ্য। এ আয়াতের কিছু আগে আছেঃ
مَامِنْ غَائِبٍ فِى الْاَرْضِ وَلاَفِى السَّمَاءِ اِلاَّفِىْ كِتَابٍ مُّبِيْنٍ
-‘‘ভূ-মন্ডল ও নভঃমন্ডলে যা’ কিছু অদৃশ্য আছে, তা সুস্পষ্ট বিবরণ সম্বলিত কিতাবে লিপিবদ্ধ আছে।’’
এ আয়াত থেকে বোঝা গেল প্রত্যেকটি ‘গায়ব’ লওহে মাহফুজ ও কুরআনের মধ্যে মওজুদ আছে।
‘ফতওয়ায়ে ইমাম নববীতে’ উল্লেখিত আছেঃ
مَامَعْنَى قَوْلِ اللهِ لاَيَعءلَمُ مَنْ فِى السَّمَوَتِ وَاَشْبَاهِ ذَلِكَ مَعَ اَنَّهُ قَدْ عَلِمَ مَافِىْ غَدٍ وَالْجَوَابُ مَعءنَاهُ لاَيَعْلَمُ ذَلِكَ اِسْتَقْلاَلاً وَاَمَّا الْمُعْجِزَاتُ وَالْكَرَا مَاتُ فَحَصَلَتْ بِاِعْلاَمِ اللهِ لاَاِسْتَقْلاَلاًَ
-‘‘কুরআনের আয়াত لاَيَعْلَمُ مَنْ فِى السَّمَوَتِ الخ ও এ ধরনের অন্যান্য আয়াতের কি অর্থ হতে পারে? হুযুর আলাইহিস সালামতো ভবিষ্যতের খবর জানেন। এর উত্তর হলো গায়বকে স্বয়ং সম্পূর্ণভাবে (সত্ত্বাগতভাবে) কেউ জানে না। তাহলে মু’জিযা ও কারামতের কি তাৎপর্য হবে? এর উত্তর হবে, এতে আল্লাহ তা’আলা কর্তৃক অবহিত করার ফলেই এ জ্ঞান অর্জিত, সত্ত্বাগত বা স্বয়ং সম্পূর্ণরূপে নয়।’’
{ইমাম নববীঃ ফাতওয়ায়ে ইমাম নববীঃ ১৭৩ পৃ.}
ইমাম ইবনে হাজর মক্কী (রহঃ) ‘ফাতওয়ায়ে হাদীছিয়া’ বলেনঃ
مَاذَكَرْنَاهُ فِى الْاَيَاتِ صَرَّحَ بِهِ النَّوْوِىُّ فِىْ فَتَاوَاهُ فَقَالَ لاَيَعْلَمُ ذَلِكَ اِسْتِقْلاَلاً وَعِلْمَ اِحَاطَةٍ بِكُلِّ الْمَعْلُوَمَاتِ
-‘‘আমি এ আয়াত সম্পর্কে যা কিছু বলেছি, ইমাম নববী (রহমতুল্লাহে আলাইহে) তাঁর ফাত্ওয়ায়ে এটা সুস্পষ্ট ভাষায় বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, গায়ব সম্পর্কে স্বয়ং সম্পূর্ণরূপে ও আল্লাহর জ্ঞাত সমস্ত বিষয় সম্পর্কে কেউ জ্ঞাত নয়।’’
{আল্লামা ইবনে হাজার মক্কীঃ ফতোয়ায়ে হাদীসিয়্যাহঃ ১/২২৩ পৃ.}
ইমাম খিফ্ফাজী (রহ.) তার ‘নাসিমুর রিয়াদ্বে’ লিখেন-
هَذَا لاَيُنَا فِى الْاَيَاتِ الدَّالَّةِ عَلَى اَنَّهُ لاَيَعْلَمُ الْغَيْبَ اِلاَّ اللهُ فَاِنًَّ الْنَفِىَ عِلْمًا مِنْ غَيْرِ وَاسِطَةٍ اَمَّا اِطِّلاَعُهُ عَلَيْهِ بِاِعْلاَمِ اللهِ فَاَمْرٌُ مُتَحَقَّقٌُ
-‘‘এ বক্তব্যটি ওই সমস্ত আয়াতের পরিপন্থী নয়, যেগুলো থেকে বোঝা যায় যে, খোদা ছাড়া আর কেউ গায়ব জানেনা। কেননা, সেই আয়াত সমূহে মাধ্যমবিহীন জ্ঞানের অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করা হয়েছে, কিন্তু খোদা প্রদত্ত জ্ঞানের ফলশ্রুতিস্বরূপ জানার বিষয়টি সুপ্রতিষ্ঠিত।’’
{আল্লামা শিহাবুদ্দীন খিফ্ফাজীঃ নাসিমুর রিয়াদঃ ৩/১৫০ পৃ.}
যদি উক্ত আয়াতের এ ভাবার্থ গ্রহণ করা না হয়, তাহলে এ আয়াতটি বিরুদ্ধমতাবলম্বীদের মতের বিপরীত হবে। কেননা, তারাও হুযুরের আংশিক ইলমে গায়ব স্বীকার করেন, অথচ এ আয়াতে সম্পূর্ণরূপে তার অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করা হয়েছে। অধিকন্তু তারা শয়তান ও মৃত্যুর ফিরিশতাকেও ইলমে গায়বের অধিকারী বলে স্বীকার করেন (‘বারাহীনে কাতিয়া’ গ্রন্থে ৫০ পৃষ্ঠা দেখুন।) । তারা এ আয়াতের কি মর্মার্থ গ্রহণ করবেন?
কুরআন শরীফে আছে
اِنِ الْحُكْمُ اِلاَّ لِلَّهِ.
-‘‘আল্লাহ ব্যতীত কারো হুকুম করার অধিকার নেই।’’
{সুরা ইউসুফ, আয়াত.৪০}
অন্যত্র আছে
لَهُ مَافِى السَّمَوَاتِ وَمَافِى الْاَرْضِ
অর্থাৎ- আসমান যমীনে যা’ কিছু আছে সব কিছু আল্লাহরই।
{সূরাঃ নিসা, আয়াতঃ ১৭১, পারাঃ ৬}
আর এক জায়গায় ইরশাদ করা হয়েছে
وَكَفَى بِاللهِ شَهِيْدًا
-‘‘আল্লাহ তা’আলাই সাক্ষীরূপে যথেষ্ট।’’
{সূরাঃ নিসা, আয়াতঃ ৭৯, পারাঃ ৫}
অন্য এক জায়গায় ইরশাদ করা হয়েছে
وَكَفَى بِاللهِ وَكِيْلاّ
-‘‘আল্লাহ তা’আলাই ওকীল হিসেবে যথেষ্ট।’’
{সূরাঃ নিসা, আয়াতঃ ৮১, পারাঃ ৫}
আরো এক জায়গায় আছে
وَكَفَى بِاللهِ حَسِيْبًا
-‘‘আল্লাহ তা’আলাই হিসাব গ্রহণকারী রূপে যথেষ্ট।’’
{সূরাঃ নিসা, আয়াতঃ ৬, পারাঃ ৪}
উলিখিত আয়াত সমূহ থেকে বোঝা গেল যে, রাজত্ব, মালিকানা, সাক্ষ্য, কার্যনির্বাহের ক্ষমতা, হিসাব গ্রহণ ইত্যাদি আল্লাহরই জন্য ‘খাস’ (বৈশিষ্ট্য সূচক গুণাবলী।) কিন্তু এখন ইসলামী রাজ্যের বাদশাহকে শাসক প্রত্যেক ব্যক্তিকে নিজ নিজ দ্রব্যসামগ্রীর মালিক, বিধর্মীদেরকে ওকীল ও হিসাব
নিকাশকারী এবং সাধারণ লোকদেরকে মামলা মুকাদ্দমায় সাক্ষীরূপে সবাই স্বীকার করেন। এটা কেমনে হয়? এটা শুধু এজন্য যে, উলিখিত আয়াত সমূহে রাজত্ব, মালিকানা ইত্যাদি দ্বারা যথার্থ ও সত্ত্বাগত গুণের কথাই ব্যক্ত করা হয়েছে। আর, এসব গুণাবলী অন্যান্যদের বেলায় খোদা প্রদত্ত হিসেবে স্বীকৃতি হয়েছে। অনুরূপভাবে গায়ব সম্পর্কিত আয়াতের ক্ষেত্রে অনুরূপ ব্যাখ্যা গ্রহণ অপরিহার্য। অর্থাৎ আয়াতে যথার্থ ও সত্ত্বাগত জ্ঞানের অস্বীকৃতি এবং খোদা প্রদত্ত জ্ঞানের স্বীকৃতি জ্ঞাপন করা হয়েছে।
وَمَا عَلَّمْنَاهُ الشِّعْرَ وَمَا يَنْبَغِي لَهُ إِنْ هُوَ إِلَّا ذِكْرٌ وَقُرْآنٌ مُبِينٌ
-‘‘আমি তাঁকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) কবিতা আবৃত্তি শিক্ষা দিইনি, এবং তা’ তাঁর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সম্মান-প্রতিপত্তির দৃষ্টিকোণ থেকে অশোভনীয়ও বটে। এটা উপদেশ ও সুস্পষ্ট কুরআন বৈ আর কিছু নয়।’’
{সূরাঃ ইয়াসীনঃ আয়াতঃ ৬৯, পারাঃ ২৩}
তাফসীরকারকগণ এ আয়াতের তিনটি মর্মার্থ ব্যক্ত করেছেন।
علم ‘ইলম’ শব্দের কয়েকটি অর্থ আছে; যেমন- জানা, প্রতিভা চর্চা, অভিজ্ঞতা ইত্যাদি। এখানে এ শব্দটি দ্বিতীয় অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। অর্থাৎ, আমি নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) কে কবিতা আবৃত্তির প্রতিভা দিইনি। একথা নয় যে, তাঁকে ভাল-মন্দ, শুদ্ধ-অশুদ্ধ কবিতাবলী যাচাই করার প্রতিভা দিইনি।
কবিতার দু’ধরনের অর্থ আছে। একঃ ছন্দোবদ্ধ শব্দের মিল সম্বলিত কথা (গযল)। দুইঃ মিথ্যা মনগড়া ও কাল্পনিক কথাবার্তা। এ আয়াতের এ ‘শের’ শব্দটি দ্বিতীয় প্রকারের অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। অর্থাৎ আমি তাঁকে মিথ্যা, মনগড়া ও কাল্পনিক কথাবার্তা শিক্ষা দিইনি। তিনি যা কিছু বলেন, তা সত্য।
‘কবিতা’ বলতে এখানে সংক্ষিপ্ত ও রহস্যাবৃত কথাবার্তাকে বোঝানো হয়েছে। অর্থাৎ আমি তাঁকে প্রত্যেক কিছুর বিস্তারিত জ্ঞান দান করেছি, ধাঁধাঁপূর্ণ, সংক্ষিপ্ত ও দুর্বোধ্য কথাবার্তা শিখাইনি।
কুরআনই ইরশাদ করেন- وَتَفْصِيْلاً لِّكُلِّ شَيْئٍ অর্থাৎ- এ কুরআন বিস্তারিত বিবরণ সম্বলিত। علم শব্দটি এখানে প্রতিভা অর্থে ব্যবহৃত। কুরআন করীম ইরশাদ করছে
وَعَلَّمْنَهُ صَنْعَةَ لَبُوْسٍ لٌُكَمْ،
-‘‘আমি তাঁকে তোমাদের জন্য পরিধেয় সরঞ্জাম প্রস্তুতের পদ্ধতি শিক্ষা দিয়েছি।’’
{সূরাঃ আম্বিয়া, আয়াতঃ ৮০, পারাঃ ১৭}
প্রখ্যাত মুহাদ্দিছ দায়লামী (রহমতুল্লাহে আলাইহে) তার ফিরদাউস কিতাবে হযরত জাবির (রাদিআল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণনা করেছেন-
عَلِّمُوْا بَيْنَكُمْ الرَّمْىَ.
-‘‘তোমরা নিজ সন্তান-সন্ততিদেরকে তীরান্দাযী শিক্ষা দাও।’’
{ইমাম দায়লামীঃ ফিরাউস বিমাহিরুল খিতাবঃ ৩/১১ হাদিসঃ ৪০০৮}
‘তাফসীরে রূহুল বায়ানে’ এ আয়াতের ব্যাখ্যা লিখা হয়েছেঃ
والْاَصَّحُّ اَنَّهُ كَانَ لاَيُحْسِنَهُ وَلَكِنْ كَانَ يُمَيِّزُ جَيِّدَ الشِّعْرِ وَرَدِيَّهُ
-‘‘সর্বাধিক সঠিক কথা হলো, রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) সুন্দরভাবে কবিতা আবৃত্তি করতেন না, কিন্তু ভাল-মন্দ কবিতার পার্থক্য নির্ণয় করে ফেলতেন।’’
{আল্লামা ইসমাঈল হাক্কীঃ তাফসীরে রুহুল বায়ানঃ ৭/৩০৬ পৃ.}
তাফসীরে রূহুল বয়ানে সে একই প্রসঙ্গে আরও উল্লেখিত আছেঃ
اِنَ الْمُحَرَّمَ عَلَيْهِ اِنَّمَا هُوَ اِنْشَاءُ الشِّعْرِ
‘‘রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) জন্য কবিতা রচনা নিষিদ্ধ ছিল।’’
এখানে شعر শে’র শব্দের অর্থ হলো মিথ্যা বর্ণনা। মক্কার কাফিরগণ বলতো যে, কুরআন শরীফ হলো কবিতা, আর হুযুর আলাইহিস সালাম হলেন কবি بَلْ هُوَ شَاعِرٌُ (তিনি বরঞ্চ একজন কবি) এ‘শে’র শব্দ বলতে তারা মিথ্যা বর্ণনাকে বোঝাতো। তাই এদের এ অবান্তর উক্তি খন্ডন করার জন্য এ আয়াত নাযিল করা হয়েছে। বলা হয়েছেঃ
ان هُوَ الاَّذِكْرٌُ وَقُرْآنَّ مٌُبِيْن
অর্থাৎ- এটা উপদেশ ও উজ্জ্বল কুরআন বৈ অন্য কিছু নয়।
{সূরাঃ ইয়াসীন, আয়াতঃ ৬৯, পারাঃ ২৩}
উক্ত আয়াতে যদি شعر বলতে ছন্দোবদ্ধ পদ্যাকারে রচিত কথাই বোঝানো হয়ে থাকে, তাহলে এ আয়াতের শেষোক্ত অংশের সাথে ওই একই আয়াতের প্রথমোক্ত অংশের কি সম্পর্ক থাকতে পারে?
‘তাফসীরে মাদারিকে’ এ আয়াতের ব্যাখ্যায় লিখা হয়েছেঃ
اَىْ مَاعَلٌُمْنَا النَّبِىَّ عَلَيهِ السَّلاَمُ قَوْلَ الشِّعْرِ وَمَا عَلَّمْنَاهُ بِتَعْلِيْمِ الْقُرْاَنِ الشِّعْرَ عَلىَ مَعْنَى اَنَّ الْعُرْاَنَ لَيْسَ بِشِعْرٍ
-‘‘আমি নবী আলাইহিস সালামকে কবিতা আবৃত্তি শিক্ষা দিইনি, বা তাঁকে কুরআন শিক্ষা দিতে গিয়ে কবিতা শিখায়নি। আসল কথা হলো ‘কুরআন কল্পনা প্রসূত কবিতা নয়।’’
{ইমাম নাসাফীঃ তাফসীরে মাদারিক কঃ ২/৪০৪ পৃ.}
‘তাফসীরে খাযেনে এ আয়াতের তাফসীরে বলা হয়েছেঃ
وَلمَّا نَفَى اَنْ يُّكُوْنَ الْقُرْاَنُ مِنْ جِنْسِ الشِّعَرِ قَالَ اللهُ تَعَالَى اِنْ هُوَاِلاَّ ذِكْرٌُ وَّقُرْ اَنٌُ مُّبِيْنٌُ
-‘‘যখন আল্লাহ তা’আলা তাদের একথা ‘কুরআন কাব্য জাতীয় উদ্ভট চিন্তাধারা’ খন্ডন করে দিল, তখন ইরশাদ করলেন- এটা উপদেশ ও উজ্জ্বল কুরআন বৈ অন্য কিছু নয়।’’
{ইমাম খাযেনঃ তাফসীরে খাযেনঃ ৪/১৩ পৃ.}
তাফসীরে খাযেনে আরও উল্লেখিত আছেঃ
قِيْلَ اِنَّ كُفَّارَ قُرَيْشٍ قَالُوْا اِنَّ مُحَمَدًا شَاعِرٌُ وَمَايَقُوْلُهُ شِعْرٌُ فَاَنْزَلَ اللهُ تُكْذِيْبًا لَّهُمْ وَمَاعَلَّمْنُهُ الشِّعْرَ
-‘‘বর্ণিত আছে যে, কুরাইশ বংশের কাফিরগণ বলে ছিল যে, হুযুর আলাইহিস সালাম হলেন একজন কবি এবং তিনি যা কিছু বলেন (কুরআন) তা’ হলো কবিতা। তাদের এ কথাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করার জন্য অবতীর্ণ হয়েছে- وَمَاعَلَّمْنُهُ الشِّعْرَ الخ (আমি তাঁকে ‘শে’র’ শিখাইনি)।’’
{ইমাম খাযেনঃ তাফসীরে খাযেনঃ ৪/১২ পৃ.}
বিঃ দ্রঃ উল্লেখ্য যে এখানে বিরুদ্ধমতাবলম্বীনগণ প্রশ্ন করে থাকেন যে, বর্ণিত আছে যে, নবী আলাইহিস সালামের পবিত্র যবান কবিতা পাঠের উপযোগী ছিল না। অর্থাৎ- তিনি কোন কবিতা পাঠ করতেই শব্দ বিন্যাস, ছন্দ ইত্যাদির বিকৃতি ঘটতো।
যেমন, তাফসীরে খাযেনেই বর্ণিত আছেঃ
اَىْ مَايَسْهَلُ لَهُ ذَلِكَ وَمَا يُصْلِحُ مِنْهُ بِحَيْثُ لَوْ اَرادَ نَظْمَ شِعْرٍ لَمْ يَتَاتَّ لِذَلِكَ
-‘‘রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) জন্য কবিতা আবৃত্তি তত সহজ ছিল না, এবং যথাযথভাবে আবৃত্তি করতে পারতেন না। যদি কখনও পদ্যাকারে কবিতা আবৃত্তি করার ইচ্ছা করতেন, এটা তাঁর জন্য সম্ভবপর হতো না।’’
{ইমাম খাযেনঃ তাফসীরে খাযেনঃ ৪/১২ পৃ.}
তাফসীরে মাদারিকে আছেঃ
اَىْ جَعَلْنَاهُ بِحَيْثُ لَوْ اَرَادَ قِرْءَةَ شِعْرٍ لَّمْ يَتَسَهَّلْ
-‘‘আমি তাকে এমনভাবে গড়ে তুলেছি যে তিনি কবিতা পাঠের ইচ্ছা করলেও যেন তাঁর জন্য তা সহজ না হয়।’’
{ইমাম নাসাফীঃ তাফসীরে মাদারিককঃ ১/৪০৫ পৃ.}
‘তাফসীরে কবীরে’ আছেঃ
مَا يَتَسَهَّلُ لَهُ حَتَّى أَنَّهُ إِنْ تَمَثَّلَ بَيْتَ شِعْرٍ سُمِعَ مِنْهُ مُزَاحَفًا
-‘‘রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) জন্য কবিতা সহজ ছিল না এমনকি তিনি কোন কবিতার চরণ আবৃত্তি করতে চাইলে, তা’ ভাঙ্গা ভাঙ্গা ও বেসুরে শোনা যেত।’’
{ইমাম ফখরুদ্দীন রাজীঃ তাফসীরে কবীরঃ ৯/৩০৪-৩০৫ পৃ.}
উল্লেখিত প্রশ্নের উত্তর হলো এ যে, কাব্য জ্ঞান ও কাব্য আবৃত্তির জ্ঞান এক নয়। অনেক বড় বড় কবিও সূর দিয়ে কবিতা আবৃত্তি করতে পারতেন না, আবার অনেক প্রশংসাসূচক কবিতা পাঠক ও কাওয়ালও কাব্য জ্ঞান সম্পর্কে অজ্ঞ থেকেও কাব্য আবৃত্তির পূর্ণ সামর্থ রাখেন। আপনি রুটি তৈরী করতে জানেন না, কিন্তু রুটি ভাল কি মন্দ, পুরু কি পাতলা ইত্যাদি বিষয় ভাল করেই বুঝতে পারেন।
আপনাদের উক্ত ভাষ্য থেকে একটুকুই বোঝা গেল যে, হুযুর আলাইহিস সালামের কবিতা পাঠের প্রতিভা বা কোন রূপ অভিজ্ঞতা ছিল না। কিন্তু একথা নয় যে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) কবিতার গুণাগুণ বিচারের জ্ঞান ছিল না। আমরাও তো তাই বলছি- কতেক কবিতা তাঁর পছন্দ এবং কতেক অপছন্দ ছিল।
‘তাফসীরে রূহুল বয়ানে’ সেই একই আয়াতের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বলা হয়েছেঃ
كَانَ اَحَبَّ الْحَدِيْثِ اِلَيْهِ عَلَيْهِ السَّلاَمُ الشِّعْرُ وَاَيْضًا كَانَ اَبْغَضَ الْحَدِيْثِ اِلَيْهِ عَلَيْهِ السَّلاَمُ الشِّعْرُ
-‘‘হুযুর (আলাইহিস সালামের) কাছে কবিতা খুবই পছন্দনীয় ছিল তবে কোন কোনটি আবার অতীব না পছন্দও ছিল।’’
{আল্লামা ইসমাঈল হাক্কীঃ তাফসীরে রুহুল বায়ানঃ ৭/৫০৬ পৃ.}
আবার অনেক হাদীছ থেকে প্রমাণিত হয় যে, রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) কোন কোন কবির কবিতামালা পাঠ করতেন এবং এগুলোর ভুয়সী প্রশংসা করেছেন। সেরূপ কবিতার একটি পংক্তি হলো اَلاَكُلُّ شَيْئٍ مَاخَلاَ اللهُ بَاطِلٌُ. অর্থাৎ- সাবধান! আল্লাহ ছাড়া যা’ কিছু আছে, সবই বাতিল। যদি তাঁর কবিতা সম্পর্কে ভালমন্দ জ্ঞান না থাকতো, তাহলে তার প্রশংসাই বা করতেন কিরূপে? কুরআনে উল্লেখিত কবিতা বলতে সংক্ষিপ্ত ও অস্পষ্ট অর্থপূর্ণ উক্তির বিষয়ের প্রতি নির্দেশ করা হয়েছে।
তাফসীরে রূহুল বয়ানে এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছেঃ
قاَل َالشَّيْخُ الْاَكْبَرُ اِعْلَمْ اَنَّ الشِّعْرَ مَحَلٌُ لِلْاِجْمَالِ وَاللَّغْزِ وَالتَّوْرِيَّةِ اَىْ مَارَمَزْنَا مُحَمَّدًا عَلَيْهِ السَّلاَمُ شَيْئًا وَلاَ اَلْغَزْنَا وَلاَ خَطَبْنَاَهُ بِشَيْئٍ وَنَحْنُ نُرِيْدُ شَيْئًا وُلاَجعَلَنْاَ لَهُ الْخِطَابَ حَيْثُ لَمْ يَفْهَمْ
-‘‘শায়খ আকবর (রহমতুল্লাহে আলাইহে) বলেছেন, একথা জানতে হবে যে, কবিতা হচ্ছে সংক্ষিপ্ত, অস্পষ্ট, ধাঁধাঁ, সূক্ষ্ম ইঙ্গিত পূর্ণ উক্তির সহিত ওতোপ্রোতভাবে জড়িত। অতএব উক্ত আয়াতের অর্থ হবে, আমি প্রিয় নবীর কাছে কোন কিছু ইশারা ইঙ্গিতে প্রকাশ করিনি এবং এ রকমও করিনি যে একটি কথার ইচ্ছা করে অপর একটি বিষয় প্রকাশ করেছি। তাঁর সাথে এমন কোন সংক্ষিপ্ত ও অস্পষ্ট কথাও বলিনি, যা’ তাঁর বোধগম্য হয় না।’’
{আল্লামা ইসমাঈল হাক্কীঃ তাফসীরে রুহুল বায়ানঃ ৭/৫০৪ পৃ.}
مِنْهُمْ مَنْ قَصَصْنَا عَلَيْكَ وَمِنْهُمْ مَنْ لَمْ نَقْصُصْ عَلَيْكَ
-‘‘ওই সকল নবীগণের কারো কারো অবস্থা আপনাদের নিকট ব্যক্ত করেছি এবং অনেকের অবস্থা ব্যক্ত করেনি।’’
{সূরাঃ গাফির, আয়াতঃ ৭৮, পারাঃ ২৪}
তাফসীরকারকগণ এ আয়াতের কয়েকটি প্রায়োগিক ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন। প্রথমতঃ এখানে সকল নবীগণের অবস্থা সম্পর্কে জ্ঞান দান করার অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করা হয়নি বরং কুরআন করীমে সুস্পষ্টভাবে বর্ণনার বিষয়টির অস্বীকৃতিই নির্দেশ করা হয়েছে। অর্থাৎ কোন কোন নবীর ঘটনাবলী সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করা হয়নি। দ্বিতীয়তঃ আয়াতে সুবিস্তৃতি বর্ণনার অস্বীকৃতি বোঝানো হয়েছে, তবে সবার সামগ্রিক, সংক্ষিপ্ত বিবরণ প্রদান করা হয়েছে। তৃতীয়তঃ প্রকাশ্য ওহীতে সবার কথা উল্লেখ করা হয়নি, অপ্রকাশ্য ওহীতে সবার কথা বলা হয়েছে।
‘তাফসীরে সাবী’তে এ আয়াতের ব্যাখ্যা উল্লেখ করা হয়েছেঃ
اِنَّ النَّبِىُّ عَلَيْهِ السَّلاَمُ لَمْ يَخْرُجُ مِنَ الدُّنْيَا حَتَّى عَلِمَ جَمِيْعِ الْاَنْبِيَاءِ تَفْصِيْلًا كَيْفَ لاَوَهُمْ مُخْلَقُوْنَ مِنْهُ وَخَلَّفَهُمْ لَيْلَةَ الْاِسْرَاءِ فِىْ بَيْتِ الْمُقَدَّسِ وَلَكِنَّهُ الْعِلْمُ الْمَكْنُوْنُ وَاِنَّمَا تَرَكَ بَيَانَ قَصَصِهِمْ لِاَمَّتِهِ رَحْمَةً بِهِمْ فَلَمْ يُكَلِّفُهُمْ اِلاَّ بِمَا كَانُوْا يُطِيْقُوْنَ
অর্থাৎ- হুযুর আলাইহিস সালাম সকল নবীগণের বিস্তারিত তথ্য না জেনে পৃথিবী থেকে তাশরীফ নিয়ে যান নি। কেননা, নবীগণ সবাই রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) নূর থেকেই সৃষ্ট হয়েছেন এবং মিরাজের পবিত্র রাতে ‘বায়তুল মুকাদ্দিসে’ সবাই তাঁর মুক্তাদী হয়েছিলেন। কিন্তু এটা হলো গোপনীয় বিষয় সম্পর্কিত জ্ঞান। আর ঐ সকল নবীগণের বিস্তারিত বিবরণ উম্মতের প্রতি মেহেরবাণী স্বরূপ বাদ দিয়েছেন। তাদেরকে সাধ্যাতীত কষ্ট দেননি।
{ইমাম সাভীঃ তাফসীরে সাভীঃ ৫/১৯৭ পৃ.}
মিশকাত শরীফের ব্যাখ্যামূলক গ্রন্থ ‘মিরকাতের’ প্রথম খন্ডের ৫০ পৃষ্ঠায় উল্লেখিত আছেঃ
هَذَا لاَيُنَا فَىْ قُوْلَهُ تَعَالَي مِنْهُمْ مَنْ لَّمْ نَقْصُصْ عَلَيْكَ لِاَنَّ الْمَنْفِىَّ هُوَ التَّفْصِيْلُ وَالثًابِتْ هُوَالْاِجْمَالُ اَوِالنَّفِىُّ مُقَيِّدٌُ بِالْوَحِى الْجَلِىِّ وَالثَّبُوْتُ مُتَحَقَّقٌُ بِالْوَحْىِ الْخَفِىِّ
অর্থাৎ- এ বক্তব্য আয়াত مِنْ هُمْ مَنْ لَّمْ نَقْصُصْ عَلَيْكَ এর সহিত অসঙ্গতিপূর্ণ নয়। কেননা, আয়াতে অস্বীকৃতি বিষয়টি হলো সংক্ষিপ্ত ভাষায় ব্যক্ত তথ্যসমূহ অথবা অস্বীকৃতি হলো প্রকাশ্য ওহী (কুরআন) মারফত বর্ণনা করার বিষয়টির, আর স্বীকৃতি হলো অপ্রকাশ্য ওহীর (হাদীছ) মাধ্যমে বর্ণনা করার ব্যাপারটির।
এ প্রসঙ্গে কুরআন ইরশাদ করেছেঃ
وكُلاَّ نَقْصُىْ عَلَيْكَ مِنْ اَنْبَاءِ الرُّسُلِ مَانُثَبُتَ بِهِ فُؤادَكَ
অর্থাৎ- আমি আপনাকে সমস্ত রাসূলের কাহিনী শুনাই, যাতে আপনার হৃদয়ে স্থিতি আসে।
{সূরাঃ হুদ, আয়াতঃ ১২০, পারাঃ ১২}
يَوْمَ يَجْمَعُ اللهُ الرُّسُلَ فَيَقُوْلُ مَاذَا اُجِبْتُمْ قَالُوْا لاَعِلْمَ لَنَا اِنَّكَ اَنْتَ عَلاَّم الْغُيُوْبِ
অর্থাৎ- যেদিন আল্লাহ তা’আলা রাসূলগণকে একত্রিত করে বলবেন, আপনারা (স্ব-স্ব উম্মতের পক্ষ হতে) কি উত্তর পেয়েছেন? আরয করবেন, আমাদের কোন জ্ঞান নেই। নিশ্চয় আপনিই যাবতীয় অদৃশ্য বিষয়াদি সম্পর্কে সম্যকরূপে অবগত।
{সূরাঃ মায়েদা, আয়াতঃ ১০৯, পারাঃ ৭}
তাফসীরকারগণ এ আয়াতের তিন ধরনের ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন। প্রথমটা হলো, আপনার জ্ঞানের মুকাবিলায় আমাদের কোন জ্ঞান নেই। দ্বিতীয়টা হলো আদব ও সম্মান প্রদর্শন পূর্বক এ ধরনের বিনীত নিবেদন করা হবে। তৃতীয়টা হলো কিয়ামতের মাঠে যখন দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে সকলের মুখ থেকে ‘নফসী’ ‘নফসী’ রব উঠবে, তখনই নবীগণ এরূপ বলবেন। পরে অবশ্য আরয করবেন; আমরা নিজ নিজ উম্মতের কাছে আপনার নির্দেশাবলী প্রচার করেছি, কিন্তু তারা মানেনি। কাফিরগণ বলবে, আমাদের কাছে আপনার নির্দেশাবলী পৌঁছেনি। এ ব্যাপারে উম্মতে মুস্তাফা আলাইহিস সালাম নবীগণের পক্ষে সাক্ষ্য দিবেন।
তাফসীরে খাযেনে এ আয়াতের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বলা হয়েছেঃ
فَعَلى هَذَا الْقَوْلِ اِنَّمَا نَفُوا الْعِلْمَ عَنْ اَنْفُسِهِمْ وَاِنْ كَانُوْا عُلَمَاءَ لِاَنَّ عِلْمَهُمْ صَارَ كَلاَ عِلْمٍ عِنْدَ اللهِ
অর্থাৎ- এ উক্তির দ্বারা নবীগণ নিজেদের সম্পর্কে জ্ঞানের অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করবেন, যদিও বা তাঁরা সম্যকরূপে সবকিছুই জানবেন। এরূপ উক্তি করার কারণ হবে আল্লাহর জ্ঞানের সামনে তাদের জ্ঞান অজ্ঞানতার মতই প্রতিভাত হবে।
{ইমাম খাযেনঃ তাফসীরে খাযেন, ২/৮৯ পৃ.}
‘তাফসীরে মাদারিকে’ আছেঃ
قَالُوْا ذَلِكَ تَاَدُّبًا اَىْ عِلْمُنَا مَعَ عِلْمِكَ فَكَاَنَّهُ لاَعلِمْ َلَنَا
অর্থাৎ- ওই সকল নবীগণ এরূপ উক্তি করবেন মহান আল্লাহর প্রতি আদব ও সম্মান প্রদর্শনের খাতিরে। অর্থাৎ তাঁর বলবেন, প্রভু হে! আমাদের জ্ঞান তোমার অসীম জ্ঞানের সামনে অজ্ঞানতায় পর্যবসিত হয়েছে। সুতরাং, আমাদের যেন কোন জ্ঞানই নেই।
{ইমাম নাসাফী, তাফসীরে মাদারিক, ১/১৫০ পৃ.}
‘তাফসীরে কবীরে’ এ আয়াত প্রসঙ্গে উল্লেখ করা হয়েছেঃ
اِنًَّ الرُّسُلَ عَلَيْهِمُ السَّلاَمُ كَمَا عَلِمُوْا اَنَّ اللهَ عَالِمٌُ لاَيَجْهَلْ حَلِيْمُ لاَيَسْفَهُ عَادِلٌُ لاَيَظْلِمُ عَلِمُوْا اَنَّ قَوْلَهُمْ لاَيُفِيْدُ خَيْرًا وَّلاَيَدْفَعُ شَرًّا فَالْاَدَبُ فِى السُّكُوْتِ وَتَفْوِيْضِ الْاَمْرِ اِلَى اللهِ وَعَدَلِهِ فَقَالُوْا لاَعِلْمَ لَنَا
অর্থাৎ- নবীগণ যখন জানেন যে, আল্লাহ তা’আলা জ্ঞানী, অজ্ঞ নন, প্রজ্ঞাময় ও ধৈর্যশীল, নির্বোধ নন, ন্যায়পরায়ণ, অত্যাচারী নন, তখন তাঁরা বুঝে নিবেন যে, তাঁদের কোন কথা দ্বারা কোন মঙ্গল হবে না, কিংবা কোনরূপ বিপদ মুক্তিও হবে না। এমতাবস্থায় আদব রক্ষা ও সম্মান প্রর্দশনের একমাত্র উপায় নীরব থাকা ও বিষয়টি আল্লাহর ন্যায়নীতির উপর ছেড়ে দেয়া। তাই তাঁরা আরয করবেন আমাদের কোন জ্ঞানই নেই।
{ইমাম ফখরুদ্দীন রাজী, তাফসীরে কবীর, ৩/৪৬৭ পৃ.}
‘তাফসীরে বায়যাবীতে’ এ আয়াতের ব্যাখ্যায় লিপিবদ্ধ করা হয়েছেঃ
وَقِيْلَ الْمَعْنَى لاَعِلْمَ لَنَا اِلَى جَنْبِ عِلْمِكَ
অর্থাৎ- বলা হয়েছে যে, এ আয়াতের অর্থ হচ্ছে- প্রভু হে! আপনার জ্ঞানের মুকাবিলায় আমাদের কোন জ্ঞান নেই।
{ইমাম বায়যাভীঃ তাফসীরে বায়যাভী}
‘তাফসীরে রূহুল বয়ানে’ এ আয়াতের তাফসীরে বলা হয়েছেঃ
اِنَّ هَذَا الْجَوَابَ يَكُوْنُ فِىْ بَعْضِ مَوَاطِنِ الْقِيَمَةِ وَتَرْجِعُ عُقُوْلَهُمْ اِلَيْهِمْ فَيَشْهََدُوْنَ عَلَى قَوْمِهِمْ اَنَّهُمْ بَلَّغَوْا الرِّسَالَةَ وَاَنَّ قَوْمَهُمْ كَيْفَ رَدُّوْا عَلَيْهِمْ
অর্থাৎ- এ ধরনের উত্তর কিয়ামতের মাঠে কোন এক স্থানে দেয়া হবে। অতঃপর ধীর স্থির হয়ে নবীগণ (আলাইহিস সালাম) নিজ নিজ উম্মত সম্পর্কে সাক্ষ্য দিবেন আমরা রিসালাতের দায়িত্ব পালন করেছিলাম আর আমাদের উম্মতগণ আমাদের আহ্বান প্রত্যাখ্যান করেছিল (সংক্ষিপ্ত)।
{আল্লামা ইসমাঈল হাক্কীঃ তাফসীরে রুহুল বায়ানঃ ২/৫৪৯ পৃ.}
وَمَا اَدْرِىْ مَا يُفْعَلُ بِىْ وَلاَبِكُمْ
অর্থাৎ- আমি জানিনা যে আমার সাথে কিরূপ আচরণ করা হবে আর তোমাদের সাথেই বা কিরূপ আচরণ করা হবে।
{সূরাঃ আহক্বাফ, আয়াতঃ ৯, পারাঃ ২৬}
বিরুদ্ধমতাবলম্বীগণ এ আয়াতকে প্রামাণ্য দলীলরূপে গ্রহণ করে নিজেদের মতবাদের সমর্থন পেশ করে থাকেন। তারা বলেন, হুযুর আলাইহিস সালামের নিজের খবর নেই, অন্য কারো খবর রাখার তো প্রশ্নই উঠে না। কেননা, তিনি এ বিষয়ে জ্ঞাত নন যে, কিয়ামতের ময়দানে আমাদের সাথে কি ধরনের আচরণ করা হবে। কিন্তু তাফসীরকারকগণ এ আয়াতের ব্যাখ্যায় দু’টি মত প্রকাশ করেছেন-
এ আয়াত مَااَدْرِىْ দ্বারা ‘দিরায়তের’ই অস্বীকৃতি বোঝানো হয়েছে; ইলমের নয়। অনুমান ও আন্দাজের উপর ভিত্তি করে কোন কিছুর জ্ঞানকে ‘দিরায়ত’ বলা হয়। (এই ‘দিরায়ত’ থেকে ‘আদরি’ শব্দটি গঠিত হয়েছে।) অর্থাৎ এ কথা মনে করো না যে, আমি ওহী ব্যতীত অনুমানের ভিত্তিতেই এ সমস্ত বিষয় সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করেছি, বরং ওহীর মাধ্যমেই সবকিছু জেনেছি।
এ আয়াতটি হুযুর আলাইহিস সালামকে কিয়ামতের সাথে সংশিষ্ট বিষয়ে অবহিত করার আগেই নাযিলকৃত। সুতরাং, এটা রহিত (মানসুখ) বলে গণ্য।
‘তাফসীরে সাবী’তে এর আয়াতের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছেঃ
مَاخَرَجَ عَلَيْهِ السَّلاَمُ مِنَ الدُّنْيَا حَتَّى عَلَّمَهُ اللهُ فِى الْقُرْاَنِ مَايَعْمَلُ بِهِ وَبِالْمُؤْ مِنِيْنَ فِى الدُّنْيَا وَالْاَخِرَةِ اِجْمَالاًوَّتَفْصِيْلاً
অর্থাৎ- হুযুর আলাইহিস সালাম এ ধরাধাম থেকে বিদায় গ্রহণ করেন নি, যতক্ষণ পর্যন্ত না আল্লাহ তা’আলা কুরআনের মাধ্যমে তাঁর সাথে ও মুমিনগণের সাথে দুনিয়া ও আখিরাতে কি ধরনের ব্যবহার করা হবে, সে সম্পর্কে সংক্ষিপ্তভাবে ও বিস্তারিতভাবে অবহিত করেছেন।
{ইমাম সাভীঃ তাফসীরে সাভীঃ ৫/২৭৮ পৃ.}
আল্লামা মোল্লা আবদুর রহমান ইবন মোহাম্মদ দামেশকী (رحمة الله) ‘রিসালায়ে নাসিখ ও মানসুখ (رساله ناسخ ومنسوخ) নামক পুস্তিকায় উল্লেখ করেছেন-
وَمَا اَدْرِىْ مَا يُفْعَلُ بِىْ وَلاَبِكُمْ نُسِخَ بِقَوْلِهِ اِنَّا فَتَحْنَا لَكَ
অর্থাৎ- অর্থাৎ مَااَدْرِىْ الخ. আয়াতটি اِنَّا فَتَحْنَا لَكَ আয়াত দ্বারা রহিত করা হয়েছে।
‘তাফসীরে খাযেনে’ এ আয়াত প্রসঙ্গে বলা হয়েছেঃ
لَمَّا َنَزلَتْ هَذِهِ الْايَةُ فَرِحَ الْمُشْرِ كُوْنَ فَقَالُوْا وَاللاَّتُ وَالْعُزَّى مَا اَمَرَنَا وَاَمْرُ مُحَمَّدٍ اِلاَّوَاحِدً اوَمَالَهُ عَلَيْنَا مِنْ مَّزِيَّةٍ وَفَضْلٍ لَوْلاَ اَنَّهُ مَابْتَدَعَ مَا يَقُوْلُهُ لاَخْبَرَهُ الَّذِىْ بَعَثَهُ بِمَا يُفْعَلُ بِهِ فَاَنْزَلَ اللهُ عَزَّوَجَلَّ لِيَغْفِرَ لَكَ اللهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِكَ (الاية) فَقَالَتِ الصَّحَبَةُ هَنِيْئًالَكَ يَانَبِىَّ اللهِ قَدْ عَلِمْتَ مَا يَفْعَلُ بِكَ فَمَا ذَا يَفْعَلُ بِنَا فَانْزَلَ اللهُ لِيُدْخِلَ الْمُؤْ مِنِيْنَ والْمُؤْمِنِاتِ جَنَّتِ (الاية) وَاَنْزَلَ وَبَشِّرِ الْمُؤْ مِنِيْنَ بِاَنَّ لَهُمْ مِنَ اللهِ فَضْلاً كَبِيْرًا وَهَذَا قَوْلُ اَنْسٍ وَقَتَادَةَ وَعِكِرَمَةَ قَالْوا اِنَّمَا هَذَا قَبْلَ اَنْ يُّخْبَرَ بِغَفْرَانِ ذَنْبِهِ وَاِنَّمَا اُخْبِرَ بِغَفْرَانِ ذَنْبِهِ عَامَ الْحُدَيْبِيَّةِ فَنُسِخَ ذَلِكَ
অর্থাৎ- যখন আয়াতটি নাযিল হয়, তখন মুশরিকগণ খুশী হয়ে বলতে লাগলো লাত ও উয্যা মূর্তিদ্বয়ের শপথ! আমাদের ও মুহাম্মদ (ﷺ) এর একই অবস্থা; আমাদের উপর তাঁর কোন প্রাধান্য বা অন্য কোন মর্যাদা নেই। যদি রাসূল (ﷺ) কুরআনের কালামসমূহে নিজেই রচনা করে না বলতেন, তাহলে তার প্রেরক খোদা তা’আলা অবশ্যই বলে দিতেন যে, তাঁর সঙ্গে কিরূপ আচরণ করবেন। তখন আল্লাহ তা’আলা لِيَغْفِرَ لَكَ اللهُ مَا تَقَدَّمَ الخ. আয়াতটি নাযিল করলেন। তখন সাহাবায়ে কিরাম (রাঃ) আরয করলেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ (ﷺ)! আপনাকে মুবারকবাদ জানাই, আপনি তো জেনে ফেললেন, আপনার সঙ্গে কিরূপ ব্যবহার করা হবে। কিন্তু আমাদের কি গতি হবে? তখন আল্লাহ তা’আলা
لِيُدْخِلَ الْمُؤْ مِنِيْنَ َوالْمُؤْمِنِاتِ جَنَّتِ
(আল্লাহ মুসলমান পুরুষ ও স্ত্রীদেরকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন) আয়াতটি নাযিল করলেন। এবং
وَبَشِّرِ الْمُؤْ مِنِيْنَ بِاَنَّ لَهُمْ مِنَ اللهِ فَضْلاً كَبِيْرًا
(মুমিনদেরকে এ শুভ সংবাদ দিন যে, তাঁদের প্রতি আল্লাহর বিশেষ মেহেরবাণী আছে) আয়াতটিও নাযিল করলেন।
হযরত আনাস, কাতদা ও ইকরামা (رضي الله عنه) এ মত পোষণ করেন। তাঁদের অভিমত হলো এ আয়াতটি নাযিল হয়েছিল ওই আয়াতের আগে, যে আয়াতে রাসূল (ﷺ)-এর মাগফিরাতের খবর দেয়া হয়েছে। রাসূল (ﷺ) হুদায়বিয়ার সন্ধির বছরই তাঁকে এ খবর দেয়া হয়েছিল। সুতরাং, এ আয়াতটি রহিত হয়ে গেছে।
(ইমাম খাযেন, তাফসীরে খাযেনঃ ২)
কেউ প্রশ্ন করতে পারেন لاَاَدْرِىْ আয়াতটি একটি ‘বিবরণাত্মক বাক্য’ এবং খবর বা বিবরণ রহিত হতে পারে না। এর কয়েকটি উত্তর আছে প্রথমতঃ উলামায়ে কিরামের অনেকেই খবর রহিত হওয়ার বৈধতার সপক্ষে মত প্রকাশ করেছেন,
যেমন وَاِنْ تُبْدُوْا الخ আয়াতটি لاَ يُكَلِّفُ اللهُ نَفْسًا الخ আয়াত দ্বারা রহিত হয়েছে।
{সূরাঃ বাক্বারা, আয়াতঃ ২৮৬, পারাঃ ৩}
অনুরূপ لاَاَدْرِىْ الخِ আয়াতটিকে হযরত আব্বাস, আনাস ও ইবন মালিক اِنَّا فَتَحْنَا لَكَ الخ আয়াত দ্বারা রহিত বলে অভিমত প্রকাশ করেছেন।
(তাফসীরে কবীর, দুররে মনসুর ও আবুস সাউদ দ্রষ্টব্য)
দ্বিতীয়ত এ আয়াতে قُلْ لاَاَدْرِىْ শব্দ দ্বারা যেহেতু নির্দেশ বুঝায় সেহেতু এর সাথেই রহিত হওয়ার ব্যাপারটি সম্পর্কিত।
(সূরাঃ বাক্বারা, আয়াতঃ ১৮৩, পারাঃ ২)
কোন কোন আয়াত আকারের দিক দিয়ে বিবৃতিমূলক বাক্যের মত দেখা যায়, কিন্তু অন্তনির্হিত তাৎপর্যের দিক দিয়ে বিবৃতিমূলক বাক্যের মত দেখা যায়, কিন্তু অন্তনির্হিত তাৎপর্যের দিক থেকে ‘আদেশসূচক বাক্য’ রূপে গণ্য হয়।
যেমন كُتِبَ عَلَيْكُمُ الصِّيَامُ – لِلَّهِ عُلىَ النَّاسِ حِجُّ الْبَيْتِ.{সূরাঃ আলে ইমরান, আয়াতঃ ৯৭, পারাঃ ৪} ইত্যাদি।
এ ধরনের আয়াত সমূহ রহিত হওয়া জায়েয।
এ আপত্তিটা আমাদের উপর প্রযোজ্য নয়, বরং সে সব তাফসীর ও হাদীছ সম্পর্কে প্রযোজ্য, যা দ্বারা ‘খবর’ রহিত হওয়ার বিষয় প্রমাণিত হয়েছে।
যদি এ আয়াতের উপরোক্ত মর্মার্থ গ্রহণ করা না হয়, তাহলে আয়াতের বাহ্যিক শাব্দিক অর্থ অনেক হাদীছের বিপরীত হবে।
হুযুর আলাইসি সালাম বলেছেন, ‘কিয়ামতের দিন প্রশংসার ঝান্ডা لِوَ اءُ الْحَمْدِ আমার হাতেই থাকবে।’
হযরত আদম আলাইহিস সালাম) ও সকল আদম সন্তান-সন্ততি আমার পতাকাতলে অবস্থান গ্রহণ করবেন। শাফাআতে কুবরা অর্থাৎ গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে আমিই সুপারিশ করবো। আমার হাউয এ রকম হবে, এর পানপাত্র এ রকম হবে ইত্যাদি ইত্যাদি।
হযরত আবু বকর (رضي الله عنه) বেহেশতী ও হযরত হাসান ও হুসাইন (رضي الله عنه) বেহেশতে নওজোয়ানদের নেতা, হযরত ফাতিমা যুহরা (رضي الله عنه) জান্নাতে মেয়েদের নেত্রী। কাউকে লক্ষ্য করে বলেছেন, ‘তুমি জাহান্নামী।’ জনৈক ব্যক্তি খুবই উত্তমরূপে জিহাদ করছিল, সাহাবায়ে কিরাম (রাঃ) তাঁর ভূয়সী প্রশংসা করলেন। কিন্তু রাসূল (ﷺ) ফরমালেন ‘সে জাহান্নামী। শেষ পর্যন্ত দেখা গেছে যে, সে আত্মহত্যা করেছিল।
যদি নাউযুবিল্লাহ! রাসূল (ﷺ)-এর নিজের খবর না থাকে, তাহলে নিজের ও অন্যান্যদের এসব খবর কিভাবে শোনাচ্ছেন? রাসূল (ﷺ) যার ঈমান রেজিষ্ট্রি করবেন, তিনি কামিল ঈমানদার। এখানে আরও অনেক উদাহরণ দেয়া যায়। কিন্তু বক্তব্য সংক্ষেপণ করার উদ্দেশ্যে এখানে ক্ষান্ত হলাম। খোদা সবাইকে বিষয়টি উপলব্ধি করার শীক্ত দান করুন। আমীন।
পূর্ববর্তী পেইজ | পরবর্তী পেইজ |
(২৫) অদৃশ্য জ্ঞান সম্পর্কে আপত্তি ও জবাব | (২৬/২) প্রাসঙ্গিক কুরআনের আয়াতের বিবরণ |
সূচীপত্র | এরকম আরো পেইজ |