এ অধ্যায়টি ছয়টি পরিচ্ছেদে বিন্যস্ত। প্রথম পরিচ্ছেদে কুরআনের বিভিন্ন আয়াত দ্বারা অদৃশ্য জ্ঞান প্রমাণ করা হয়েছে। দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে বিভিন্ন হাদীছের দ্বারা উহার প্রমাণাদি উপস্থাপিত করা হয়েছে। তৃতীয় পরিচ্ছেদে হাদীছের ব্যাখ্যাকারকদের ব্যাখ্যা দ্বারা গায়বের সমর্থনে উলামায়ে উম্মত ও ফিকহ শাস্ত্রবিদদের উক্তিসমূহ তুলে ধরা হয়েছে। পঞ্চম পরিচ্ছেদে স্বয়ং অদৃশ্য জ্ঞানের অস্বীকারকারীদের রচিত গ্রন্থাবলী থেকে উহা প্রমাণ করা হয়েছে, ষষ্ঠ পরিচ্ছেদে যুক্তিগত প্রমাণাদি ও আওলিয়া কিরামের ইলমে গায়ব সম্পর্কে বর্ণনা করা হয়েছে।
وَعَلَّمَ آدَمَ الْأَسْمَاءَ كُلَّهَا ثُمَّ عَرَضَهُمْ عَلَى الْمَلَائِكَةِ
-‘‘এবং আল্লাহ তা‘য়ালা হযরত আদম (عليه السلام) কে সমস্ত কিছুর নাম শিখিয়ে দিলেন। অতঃপর সে সমস্ত বস্তু ফিরিশতাদের কাছে উপস্থাপন করলেন।’’
{সূরাঃ বাক্বারা, আয়াতঃ ৩১, পারাঃ ১}
‘তাফসীরে মাদারেকে’ এ আয়াতের ব্যাখ্যায় লিখা হয়েছে-
وَمَعْنَى تَعْلِمِيهِ اَسْمَاءِ الْمُسَمِّيَاتِ اَنَّهُ تَعَالَى اَرَاهُ اَلاَجْنَاسَ الَّتِىْ خَلَقَهُا وَعَلَّمَهُ اَنَّ هَذَا اِسْمُهُ فَرَسٌُ وَهَذَا اِسْمُهُ بَعِيْرٌُ وَهَذَا اِسْهُمُ كَذَا، وَعَنْ اِبْنِ عَبَّاسٍ عَلَّمَهُ اِسْمَ كُلِّ شَئْىٍ حَتًّى الْقَصْعَةَ وَالْمَغْرَفَةَ
‘‘হযরত আদম (عليه السلام) কে সমস্ত বস্তুর নাম শিক্ষা দেয়ার অর্থ হচ্ছে, আল্লাহ তাআলা তাঁকে তাঁর সৃষ্ট সব কিছুর দেখিয়েছেন এবং বলে দিয়েছেন যে এটার নাম ঘোড়া, এটার নাম উট এবং ওটার নাম অমুক। হযরত ইবনে আব্বাস থেকে বর্ণিত আছে যে, তাঁকে প্রত্যেক কিছুর নাম শিখিয়ে দিয়েছেন, এমন কি পেয়ালা ও কাঠের চামচের নাম পর্যন্ত।’’।
{ইমাম নাসাফীঃ তাফসীরে মাদারিকঃ ১/৪৫ পৃ.}
‘তাফসীরে খাযেনে’ এ আয়াতের ব্যাখ্যায় একই কথা বলা হয়েছে তবে এতটুকু বাড়িয়ে বলা হয়েছে যে-
وَقِيْلَ عَلَّمَ اَدَمَ اَسْمَاءَ الْمَلَئِكَة وَقِيْلَ اَسْمَاَءَ ذُرِّيَّتِهِ وَقِيْلَ عَلَمَّهُ اللَّغَاتَ كُلَّهَا
(কারো মতে আদম (عليه السلام) কে সমস্ত ফিরিশতাদের নাম, কারো মতে তাঁর সন্তান-সন্ততিদের নাম, আবার কারো মতে সমস্ত ভাষা শিখানো হয়েছিল)।
(তাফসীরে খাযেনঃ ১/৪২ পৃ.)
উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় তাফসীরে কবীরে লেখা হয়েছে,
قَوْلُهُ اَىْ عَلَّمَهُ صِفَاتَ الْاَشْيَاءِ وَنَعُوْتَهَا َ.... وَهُوَ الْمَشْهُورُ أَنَّ الْمُرَادَ أَسْمَاءُ كُلِّ مَا خَلَقَ اللَّهُ مِنْ أَجْنَاسِ الْمُحْدَثَاتِ مِنْ جَمِيعِ اللُّغَاتِ الْمُخْتَلِفَةِ الَّتِي يَتَكَلَّمُ بِهَا وَلَدُ آدَمَ الْيَوْمَ مِنَ الْعَرَبِيَّةِ وَالْفَارِسِيَّةِ وَالرُّومِيَّةِ وَغَيْرِهَ
-‘‘আদম (عليه السلام) কে সমস্ত বস্তুর বৈশিষ্ট্য ও অবস্থাদি শিক্ষা দিয়েছেন। একথাই প্রসিদ্ধি লাভ করেছে যে, সৃষ্টবস্তু দ্বারা বোঝানো হয়েছে অচিরন্তন প্রত্যেক বস্তুর নাম সমূহ, যেগুলো বিভিন্ন ভাষায় প্রচলিত হবে ও যে নামগুলো আজ পর্যন্ত আদম সন্তান-সন্ততিগণ আরবী, ফার্সী, রুমী ইত্যাদি ভাষায় ব্যবহার করে আসছে।’’
{ইমাম রাজীঃ তাফসীরে তাফসীরে কাবীরঃ ১/৩৯৮পৃ. দারু ইহইয়াউত্-তুরাসুল আরাবী, বয়রুত, লেবানন, প্রকাশ.১৪২০হিজরী}
তাফসীরে আবু সাউদে উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে,
وَقِيْلَ اَسْمَاءَ مَاكَانَ وَمَا يَكُوْنُ وَقِيْلَ اَسْمَاءِ خَلْقِهِ مِنَ الْمَعْقُوْلاَتِ وَالْمَحْسُوَسَاتِ وَالْمُتَخَيَّلاَتِ وَالْمُوْهُوْمَاتِ وَاَلْهَمَهُ مَعْرَفَةَ ذَوَاتِ الاْشَيْآَءِ وَاَسْمَاءِ هَاخَوَاصَهَا وَمَعَارِفَهَا اُصُوْلَ الْعِلْمِ وَقَوَانِيْنَ الصَّنْعَاتِ وَتَفَاصِيْلَ اَلاَتِهَا وَكَيْفِيَّةً اِسْتِعْمَالَاتِهَا
-‘‘কারো মতে আদম (عليه السلام) কে অতীত ও ভবিষ্যতের সমস্ত বিষয়ের নাম শিখিয়েছেন। আর কেউ এ অভিমত ব্যক্ত করেছেন যে তাঁকে সমগ্র সৃষ্টির নাম শিখিয়েছিলেন। ইন্দ্রিয়াতীত, ইন্দ্রিয় গ্রাহ্য, কাল্পনিক ও খেয়ালী সবকিছুই শিক্ষা দিয়েছিলেন, সব কিছুর সত্ত্বা, নাম, বৈশিষ্ট্য, পরিচিত জ্ঞান বা বিদ্যার নিয়মাবলী, পেশা ও কারিগরী নীতিমালা এবং সংশিষ্ট যন্ত্রপাতি ও সাজ-সরঞ্জামের বিস্তারিত বর্ণনা ও সেগুলোর ব্যবহার প্রণালী আদম (عليه السلام) কে অবহিত করেছিলেন।’’
{.ইমাম আবুস সাউদঃ তাফসীরে আবুস সাউদঃ ১/৮৪ পৃ.}
তাফসীরে রুহুল বয়ানে আলোচ্য আয়াতের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে,
وَعَلَّمَهُ اَحْوَالَهَا وَمَا يَتَعَلَّقَ بِهَا مَنَ الْمَنَافِعِ الدِّيْنِيَّةِ وَالدُّنْيَوِيَّةِ وَعَلَّمَ اَسْمَاءَ الْمَلاَ ئِكَةِ وَاَسْمَاءَ. ذُّرِّيَتِهِ وَاَسْمَاءَ الْحَيْوَانَاتِ وَالْجَمَادَاتَ وَصَنْعَةَ كُلَّ شَئِّىٍ وَاسْمَاِءَ الْمُدْنِ وَالْقُرَىَ وَاَسْمَاءَ الطَّيْرِ وَالشَّجَرِ وَمَا يَكُوْنُ وَاَسْمَاَءَ كُلِّ شَئِّى يَخْلُقَهَا اِلَى يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَاَسْمَاء الْمَطْعُوْمَاتِ وَاْلمَشْرُوْبَاتِ وَكُلِّ نَعِيْمِ فِى الجَنَّةِ وَاَسْمَاَءُ كُلِّ شَيِّئٍ وَفِى الْخَبْرِ عَلْمَهُ سَبْعَ مِاَئةِ اَلَّفِ لَغَاتٍ
-‘‘হযরত আদম (عليه السلام) সমস্ত জিনিসের অবস্থাদি শিখিয়েছেন এবং এগুলোর অন্তর্নিহিত, ধর্মীয়, পার্থিব উপকারিতার কথা বলে দিয়েছেন। তাঁকে ফিরিশতাদের নাম, তাঁর বংশধর, জীব জন্তু ও প্রাণীবাচক বস্তু সমূহের নাম শিক্ষা দিয়েছেন, প্রত্যেক জিনিস তৈরী করার পদ্ধতি, সমস্ত শহর ও গ্রামের নাম, সমস্ত পাখী বৃক্ষরাজির নাম যা হয়েছে এবং যা হবে সবকিছুর নাম কিয়ামত পর্যন্ত যা কিছু সৃষ্টি হবে, সবকিছুর নাম, যাবতীয় আহার্য দ্রব্য সামগ্রীর নাম, বেহেশতের প্রত্যেক নিয়ামতের নাম-মোট কথা প্রত্যেক কিছুর নাম শিখিয়ে দিয়েছিলেন। হাদীছ শরীফে আছে যে আদম (عليه السلام) কে সাত লাখ ভাষা শিখিয়েছেন।’’
{আল্লামা ইসমাঈল হাক্কীঃ তাফসীরে রুহুল বায়ানঃ ১/১৩৬ পৃ.}
উপরোক্ত তাফসীর সমূহ থেকে এতটুকু বোঝা গেল যে, যা কিছু হয়েছে ও যা কিছু হবে, সমস্ত কিছুর সম্পূর্ণ জ্ঞান হযরত (আদম (عليه السلام) কে দান করা হয়েছে। তাঁকে বিভিন্ন ভাষাজ্ঞান দান করেছেন, বিভিন্ন জিনিসের উপকারিতা ও অপকারিতা, তৈরী করার পদ্ধতি, যন্ত্রপাতির ব্যবহার সবকিছু দেখিয়ে দিয়েছেন। এখন আমাদের অঁাকা মওলা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জ্ঞান ভান্ডার দেখুন। সত্যি কথা এই যে হযরত আদম (عليه السلام) এর এ ব্যাপক জ্ঞান নবী করিম عليه السلام'র জ্ঞান সমুদ্রের এক ফোটা তুল্য বা ময়দানের এক কণা সদৃশ।
শাইখ ইবনে আরবী তদ্বীয় “ফুতুহাতে মক্কীয়া” গ্রন্থে দশম অধ্যায়ে বলেছেন,
اَوَّلَ نَائِبٍ كَانَ لَهُ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَخَلِيْفَتُهُ اَدَمَ عَلَيْهِ السَّلاَمُ
-‘‘হযরত (ﷺ)এর প্রথম খলীফা ও প্রতিনিধি হলেন হযরত আদম (عليه السلام)। এতে বোঝা গেল যে, হযরত আদম (عليه السلام) হলেন হুজুর (ﷺ) এর খলীফা।’’
‘খলীফা’ হচ্ছেন তিনিই, যিনি আসল বা প্রকৃত মালিকের অনুপস্থিতিতে তাঁর স্থলাভিষিক্ত হয়ে কাজ করেন। হুজুর (ﷺ) এর জন্মের আগেকার সমস্ত নবী (عليه السلام) তাঁরই প্রতিনিধি ছিলেন। একথাটি মৌলভী কাসেম নানুতবী ছাহেবও তদীয় ‘তাহজীরুন নাস’ গ্রন্থে লিখেছেন, যার বর্ণনা পরে করা হবে। এহলো প্রতিনিধির ব্যাপক জ্ঞানের অবস্থা।
ইমাম কাযী আয়াযের (রহমতুল্লাহে আলাইহে) এর ‘শিফা শরীফ’ এর ব্যাখ্যা গ্রন্থ ‘নাসিমুর রিয়াদ্ব’ এ উল্লেখিত আছে,
اِنَّهَ عَلَيْهِ السَّلَامُ عُرِضَتُ عَلَيْهِ الْخَلَائِقِ مِن لَّدْنِ اَدَمَ اِلَى قِيَامِ السَّاعَةِ فَعَرَ فَهُمْ كُلَّهُمْ كَمَا عَلَّمَ اَدَمَ الْاَسْمَاءَ كُلَّهَا
-‘‘হযরত আদম (عليه السلام) থেকে আরম্ভ করে রোজ কিয়ামত পর্যন্ত তার বংশজাত আওলাদকে হুজুর (ﷺ) এর সম্মুখে উপস্থাপিত করা হয়েছিল। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) তাঁদের সবাইকে চিনেছিলেন, যেমনিভাবে হযরত আদম (عليه السلام) কে সবকিছুর নাম শিখানো হয়েছিল।’’
{ইমাম শিহাবুদ্দীন খিফ্ফাজীঃ নাসিমুর রিয়াদ্ধঃ ২/২০৮ পৃ.}
এ ভাষ্য থেকে বোঝা গেল যে, হুজুর (ﷺ) সবাইকে জানেন, সকলকে চিনেন।
وَيَكُوْنَ الرَّسُوْلَ عَلَيْكُمْ شَهِيْدًا
-‘‘এ রসূল তোমাদের রক্ষণাবেক্ষণকারী ও সাক্ষী হবেন।’’
{সূরাঃ বাকারাঃ আয়াতঃ ১৪৩, পারাঃ ২}
এ আয়াতের ব্যাখ্যায় ‘তাফসীরে আযীযীতে’ লিখা হয়েছে,
رسول عليه السلام مطلع است بنور نبوت بردين هر متدين بدين خود كه در كدام درجه از دين من رسيده وحقيقت ايمان اوچيست وحجابے كه بداں ازترقى محجوب مانده است كدام است چس ادمى شناسد گناهان شمارا ودرجات ايمان شمارا واعمال بدونيك شمارا واخلاق ونفاق شمارا لهذا شهادت اودردنيا بحكم شرع درحق امت مقبول واجب العمل است
-‘‘হুজুর (ﷺ) স্বীয় নবুয়তের আলোতে প্রত্যেক ধর্ম পরায়ন ব্যক্তির ধর্মের অবস্থা সম্পর্কে অবগত আছেন। কোন ব্যক্তি ধর্মের কোন স্তরে পৌঁছেছেন, তার ঈমানের হাকীকত কি এবং তাঁর পরলৌকিক উন্নতির পথে
অন্তরায় কি, এসব কিছুই তিনি জানেন। সুতরাং, হুজুর (ﷺ) তোমাদের পাপরাশি, তোমাদের ঈমানের স্তরসমূহ, তোমাদের ভালমন্দ কার্যাবলী এবং তোমাদের বিশুদ্ধ চিত্ততা ও কপটতা সম্পর্কে ওয়াকিফহাল। এ জন্যই তো পৃথিবীতে উম্মতের পক্ষে বা বিপক্ষে তার সাক্ষ্য শরীয়তের বিধানমতে গ্রহণীয় এবং অব্যশ্য পালনীয়।’’
{শায়খ আব্দুল আজিজ মুহাদ্দিস দেহলভীঃ তাফসীরে আযিযীঃ ১/৫১৮ পৃ.}
‘তাফসীরে রূহুল বয়ানে’ এ আয়াতের ব্যাখ্যায় লিখা হয়েছে,
هَذَا مَبْنِىَّ عَلَى تَضْمِيْنِ الشَّهِيَدِ مَعْنَىِ الرَّقِيْبِ وَالْمَطَلِّعِ وَالْوَجْهُ فِىْ اِعْتِبَارِ تَضْمِيْنِ الشَّهِيْدِ الْاِشَارَةُ اِلَى اَنَّ التَّعْدِيْلَ وَالتَّزْكِيَةَ اِنَّمَا يَكُوْنَ عَنْ خُبْرَةٍ وَمَرَ اقَبَةٍ بِحّالِ الشَّاهِدِ وَمَعْنَى شَهَادَةِ الرَّسُوْلِ عَلَيْهِمْ اِطَّلاَعُهَ رُتُبَةَ كُلِّ مُتَدَيْنٍ بَدِيْنِهِ فَهُوَ يَعْرِفُ دَنَوْبَهُمْ وَحَقِيْقَةَ اِيْمَانِهِمْ وَاَعْمَالِهُمْ وَحَسَنَاتِهِمْ وَسَيِّئاَتِهِمْ وَاِخْلَاصِهُمْ وِنِفَاقِهُمْ وَغَيْرِ ذَالِكَ بِنُوْرِ الْحَقِّ وَاُمَّتَهُ يَعْرِ فُوْنَ ذَالِكَ مِنْ سَائِرِ الْاُمَمِ بِنُوْرِهِ عَلَيْهِ السَّلَامُ
-‘‘এটা এ কারণেই যে, আয়াতে উল্লেখিত (شهيد) শব্দটি রক্ষণাবেক্ষণকারী ও ওয়াকিফহাল কথাটাও অন্তভুর্ক্ত করে এবং এ অর্থ দ্বারা একথারই ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে কোন ব্যক্তির যথার্থতা ও দূষণীয়তার সাক্ষ্য প্রদান তখনই সম্ভবপর হবে, যখনই সাক্ষী উক্ত ব্যক্তির যাবতীয় অবস্থা সম্পর্কে সম্যকরূপে ওয়াকিফহাল হয়। হুজুর (ﷺ) এর পক্ষে সাক্ষ্য দেওয়ার অর্থ হচ্ছে তিনি প্রত্যেক ধর্মপরায়ণ ব্যক্তির ধর্মীয় অবস্থা সম্পর্কে অবগত। সুতরাং, বোঝা যায় যে, হুজুর (ﷺ) মুসলমানদের গুণাহ সমূহ, তাদের ইসলামের হাকীকত, তাদের ভালমন্দ কার্যাবলী, তাদের আন্তরিকতা ও কপটতা ইত্যাদিকে সত্যের আলোর বদৌলতে অবলোকন করেন। হুজুর (ﷺ) এর উম্মতের নিকটও তাঁর নুরের ওসীলায় অন্যান্য সমস্ত উম্মতগণের অবস্থাও কিয়ামতের ময়দানে সম্পূর্ণরূপে উদ্ভাসিত।’’
{আল্লামা ইসমাঈল হাক্কীঃ তাফসীরে রুহুল বায়ানঃ ১/১৩৬ পৃ.}
‘তাফসীরে খাযেনে’ এ আয়াতের ব্যাখ্যায় লিখা হয়েছে,
ثُمَّ يُؤْتَى بِمَحَمَّدٍ عَلَيْهِ السَّلاَمُ فَيُسْئَلُهُ عَنْ حَالِ اُمَّتِهِ فَيُزْكِّيْهِمْ وَيَشْهَدُ بِصِدْقِهِمْ
-‘‘অতঃপর কিয়ামতের দিন হুজুর (ﷺ)কে আহ্বান করা হবে। এরপর আল্লাহ তা’য়ালা তাঁকে তাঁর উম্মতের অবস্থা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করবেন। তখন তিনি তাঁদের পবিত্রতা ও সত্যতার সাক্ষ্য দিবেন।’’
{ইমাম খাযেনঃ তাফসীরে খাযেনঃ ১/৮৭ পৃ}
‘তাফসীরে মাদারেকে’ ২য় পারার সূরায়ে বাকারার’ এ আয়াতের তাফসীরে লিখা হইয়াছে,
فَيُؤْ تَى بِمُحَمَّدٍ فَيُسْئَلُ عَنْ حَالِ أمَّتِهِ فَيُزَ كِّيْهِمْ وَيَشْهَدُ بِعَدَ الَتِهِمْ. وَيُزُ كِّيْهِمْ وَيَعْلَمُ بِعَدَا لَتِكُمْ
-‘‘অতঃপর হুযুর (সাল্লাল্লাহু عليه السلامকে) আহ্বান করা হবে, তাঁর উম্মতের অবস্থা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে। তখন তিনি স্বীয় উম্মতের সাফাই বর্ণনা করবেন এবং তাদের ন্যায়পরায়ণ ও যথার্থ হওয়া সম্পর্কে সাক্ষ্য দিবেন। সুতরাং হুজুর (ﷺ) আপনাদের যথার্থতা সম্পর্কে অবগত আছেন।’’
{ইমাম নাসাফীঃ তাফসীরে মাদারিকঃ ১.৮৮ পৃ.}
এ আয়াত ও তাফসীর সমূহে এটাই বলা হয়েছে যে, কিয়ামতের দিন অন্যান্য আম্বিয়ায়ে কেরামের (عليه السلام) উম্মতগণ আল্লাহর দরবারে আরয করবে, হে আল্লাহ! আমাদের কাছে তোমার কোন নবী আগমন করেন নি।’ পক্ষান্তরে, ঐ সমস্ত উম্মতের নবীগণ আরয করবেন, ‘হে খোদা! আমরা তাদের কাছে গিয়েছি, তোমার নির্দেশাবলী তাদের কাছে পৌঁছিয়েছি, কিন্তু তারা গ্রহণ করেনি।’
আল্লাহ তা’আলার পক্ষ থেকে নবীগণকে বলা হবে, ‘যেহেতু তোমরা বাদী, সেহেতু তোমাদের দাবীর সমর্থনে কোন সাক্ষী উপস্থাপন কর। তাঁরা তখন তাঁদের পক্ষে সাক্ষ্য দেয়ার জন্যে হুজুর (ﷺ) এর উম্মতকে পেশ করবেন। তাঁরা সাক্ষ্য দেবেন ‘হে আল্লাহ! তোমার নবীগণ সত্যবাদী, তাঁরা তোমার নির্দেশাবলী স্ব স্ব উম্মতের কাছে পৌঁছিয়েছিলেন।
এখানে দুটি বিষয়ের তাৎপর্য বিশেষণ করা দরকার।
তিনি (ﷺ) দুটি বিষয়ের সাক্ষ্য দিবেন। একটি হলো এ সমস্ত লোকগণ এমন পাপিষ্ট বা কাফির নয় যে তাঁদের সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য হবে না। বরং তাঁরা পরহেযগার মুসলমান। অন্যটি হলো তিনি (ﷺ) বলবেন, হ্যাঁ, আমিই তাদেরকে বলেছিলাম যে, আগেকার নবীগণ নিজ নিজ উম্মতের কাছে খোদার ফরমান পৌঁছিয়েছিলেন। অতঃপর ঐ সব নবীগণের পক্ষে রায় দেয়া হবে।
এ বর্ণনা থেকে নিম্নোলেখিত কয়েকটি বিষয় জানা গেলঃ
(এ ব্যাপারে আরও বিস্তারিত জানতে হলে আমার রচিত কিতাব শানে হাবীবুর রহমান, দেখুন) এ সাক্ষ্যের উল্লেখ পরবর্তী আয়াতের মধ্যেও রয়েছে
وَجِئْنَا بِكَ عَلَى هَؤُلَاءِ شَهِيدًا
-‘‘হে মাহবুব (ﷺ) আমি আপনাকে এদের রক্ষণাবেক্ষণকারী হিসেবে আনব।’’
{সূরা নিসাঃ আয়াতঃ ৪১, পারাঃ ৫}
‘তাফসীরে নিশাপুরীতে’ এ আয়াতের তাফসীরে উল্লেখিত আছে,
لِاَنًَّ رُوْحَهُ عَلَيْهِ السَّلاَمُ شَاهِدٌُ عَلَى جَمِيْعِ الْاَرْوَاحِ وُالْقُلُوْبِ وَالنَّفُوْسِ بِقَوْلِهِ عَلَيْهِ السَّلاَمُ اَوَّلُ مَاخَلَقَ اللهُ نُوْرِىْ
-‘‘এটা এ কারণে যে, হুজুর (ﷺ) এর রূহ মুবারক সমস্ত রূহ, দিল ও সত্ত্বা সমূহকে দেখতে পান। কেননা তিনিই বলেছেন, ‘আল্লাহ তা’আলা সর্ব প্রথম যা সৃষ্টি করেছেন, তা হলো আমার নূর।’’
{ইমাম নিশাপুরীঃ তাফসীরে নিশাপুরীরঃ ৮/৬৬ পৃ.}
এ আয়াতের ব্যাখ্যায় তাফসীরে রূহুল বয়ানে আছে,
وَاعْلَمْ اَنَّهُ يُعْرَضُ عَلَى النَّبِىْ عَلَيْهِ السَّلاَمُ اَعْمَالُ اُمَّتِهِ غَدَوْةً وَعَشِيَّةً فَيَعْرِ فُهُمْ بِسِيْمَاهُمْ اَعْمَالَهُمْ فَلِذَالِكَ يَشْهَدُ عَلَيْهِمْ
-‘‘হুজুর (ﷺ) এর কাছে তাঁর উম্মতের আমলসমূহ সকাল বিকাল পেশ হয়। তাই তিনি উম্মতকে তাদের চিহ্ন দৃষ্টে চিনেন ও তাদের কার্যাবলী সম্পর্কেও অবগত হন। এ জন্য তিনি (ﷺ) তাদের ব্যাপারে সাক্ষ্য দিবেন।’’
{আল্লামা ইসমাঈল হাক্কীঃ তাফসীরে রুহুল বায়ানঃ ২/২৫৭ পৃ.}
‘তাফসীরে মাদারেকে’ এ আয়াতের ব্যাখ্যায় উল্লেখ করা হয়েছেঃ
اَىْ شَاهِدًا عَلَى مَنْ اَمَنَ بِالْايِمَانِ وَعَلَى مَنْ كَفَرَ بِا لْكُفْرِ وَعَلَى مَنْ نَافَقَ بِالنِّفَاقِ
-‘‘হুজুর (ﷺ) মুমিনদের জন্য তাদের ঈমানের, কাফিরদের জন্য তাদের কুফরীর ও মুনাফিকদের জন্য তাদের মুনাফেকীর সাক্ষী।’’
{ইমাম নাসাফীঃ তাফসীরে মাদারিকঃ ১/২৫৩ পৃ.}
এ আয়াত ও তাফসীর সমূহ দ্বারা বোঝা গেল যে, হুজুর (ﷺ) সৃষ্টির আদিকাল থেকে কিয়ামত পর্যন্ত সমস্ত লোকের কুফর, ঈমান, কপটতা আমল ইত্যাদি সব কিছুই জানেন। এ জন্যই তো তিনি সকলের জন্য সাক্ষী একেইতো বলে ‘ইলমে গায়ব’ বা অদৃশ্য জ্ঞান।
مَنْ ذَا الَّذِي يَشْفَعُ عِنْدَهُ إِلَّا بِإِذْنِهِ يَعْلَمُ مَا بَيْنَ أَيْدِيهِمْ وَمَا خَلْفَهُمْ
-‘‘কে সে, যে তার কাছে তার অনুমতি ব্যতীত সুপারিশ করবে? তিনি তাদের পূর্বাপর সবকিছুই জানেন।’’
{সূরাঃ বাকারা, আয়াতঃ ২৫৫}
‘তাফসীরে নিশাপুরীতে’ এ আয়াতের ব্যাখ্যায় লিখা হয়েছে,
يَعْلَمُ مُحَمَّدٌُ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَابَيْنَ اَيْدِيْهِمْ مِنْ اَوَّلِيَّاتِ اَلاَمْرِ قَبْلَ الْخَلاَئِقِ وَمَا خَلْفَهُمْ مِنْ اَحْوَالِ الْقِيَامَةِ
-‘‘হুজুর (ﷺ) সৃষ্টির আগেকার অবস্থাাদি জানেন এবং সৃষ্টির পরে কিয়ামতের যে ভয়াবহ অবস্থাদি সংঘটিত হবে, তা’ও তিনি জানেন।’’
{ইমাম নিশাপুরীঃ তাফসীরে নিশাপুরীঃ প্রথম পারাঃ ২৫৫ নং আয়াত এর ব্যাখ্যা।}
এ আয়াতের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে তাফসীরে রূহুল বয়ানে আছে,
يَعْلَمُ مُحَمَّدٌُ عَلَيْهِ السَّلاَمُ مَابَيْنَ اَيْدِيْهِمْ مِنَ الْاُمُوْرِ الْاَوَّلِيَّاتِ قَبْلَ الْخَلاَئِقِ وَمَا خَلفَهُمِ مِنْ اَحْوَالِ الْقِيَامَةِ وَفَزَعِ الْخَلَقِ وَغَضَبِ الرَّبِّ
-‘‘হুজুর (ﷺ) সৃষ্টির আগের অবস্থা জানেন। সৃষ্টির পূর্বাপর যাবতীয় অবস্থা সম্পর্কে অবগত। কিয়ামতের অবস্থা, সৃষ্টিকূলের ভয়ভীতি, আল্লাহর গজব ইত্যাদির প্রকৃতি সম্পর্কেও সম্যকরূপে অবগত।’’
{আল্লামা ইসমাঈল হাক্বীঃ তাফসীরে রুহুল বায়ানঃ ১/৪৩ পৃ.}
এ আয়াত ও তাফসীর সমূহ দ্বারা বোঝা গেল যে, ‘আয়াতুল কুরসী’র মধ্যে مَنْ ذَالَّذِىْ থেকে اِلاَّ بِمَا شَآءَ পর্যন্ত হুজুর (ﷺ) এর তিনটি গুণের কথাই বিধৃত হয়েছে। বাকী অবশিষ্ট গুণাবলী আল্লাহর সহিত সম্পৃক্ত। এ আয়াতে বলা হয়েছে যে, আল্লাহর নিকট বিনা অনুমতিতে কেউ সুপারিশ করতে পারে না। যিনি সুপারিশ করার অনুমতি প্রাপ্ত, তিনি হলেন প্রিয় নবী হুজুর (ﷺ)। সুপারিশকারীকে পাপীগণের পরিণাম ও অবস্থা সম্পর্কে অবশ্যই অবগত হতে হয়, যাতে অনুপযুক্তদের জন্য সুপারিশ করা না হয়, আর সুপারিশের উপযুক্ত ব্যক্তিগণ যেন সুপারিশ থেকে বঞ্চিত না হয়। যেমন কোন ডাক্তারের আরোগ্য ও দুরারোগ্য ব্যাধি সম্পর্কে পূর্ণ জ্ঞান থাকা একান্ত দরকার।
এ জন্য বলা হয়েছে,
يَعْلَمُ مَا بَيْنَ اَيْدِيْهِمْ
যাকে আমি (আল্লাহ) সুপারিশকারী মোতায়েন করেছি, তাকে সব কিছুর জ্ঞানও দান করেছি, কেননা ‘শাফায়াতে ‘কুবরা’ বা সুমহান সুপারিশের জন্য অদৃশ্য জ্ঞানের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য।
এ থেকে বোঝা গেল যে, যারা বলে যে হুজুর (ﷺ) কিয়ামতের মাঠে মুনাফিকদেরকে চিনবেন না, বা হুজুর (ﷺ) নিজেই জানেন না তাঁর কি পরিণতি হবে; ইহা তাদের নিছক ভুল ধারণা ও ধর্মহীনতা মাত্র। এ সম্পর্কে সামনে বিস্তারিত আলোচনা হবে।
وَلَا يُحِيطُونَ بِشَيْءٍ مِنْ عِلْمِهِ إِلَّا بِمَا شَاءَ
-‘‘তারা তাঁর জ্ঞান ভান্ডার থেকে কিছুই পায় না, তবে তিনি যতটুকু ইচ্ছে করেন।’’
{সূরাঃ বাক্বারা, আয়াতঃ ২৫৫}
‘তাফসীরে রূহুল বয়ানে’ এ আয়াতের প্রেক্ষাপটে উল্লেখ আছে,
يَحْتَمِلُ اَنْ تَكُوْنَ الْهَاءُ كِنَايَةً عَنهُ عَلَيْهِ السَّلاَمُ يَعْنِىْ هُوَ شَاهِدٌُ عَلَى اَحْوَالِ هِمْ يَعْلَمُ مَابَيْنَ اَيْدِيْهِمْ مِنْ سِيَرِهِمْ وَمَعَا مَلاَ تِهِمْ وَقَصَصِهَمْ وَمَا خَلْفَهُمْ مِنْ اُمُوْرِ الْاَخِرَةِ وَاَحْوَالِ اَهْلِ الْجَنَّةِ وَالنَّارِ وَهُمْ لَا يَعْلَمُوْنَ شَيْئًا مِّنْ مَعْلُوْمَاتِهِ اِلَّا بِمَاشَآءَ مِنْ مَعْلُوْ مَاتِهِ عِلْمُ الْاَوْلِيَاءِ مِنْ عِلْمِ ألْاَنْبِيَآَء بِمَنْزِ لَةِ قَطْرَةٍ مِنْ سَبْعَةِ اَبْحُرٍ وَعِلْمُ الْاَنْبِيَآءِ مِنْ عِلمِ نَبِيِّنَا عَلَيْهِ السَّلاَمُ بِهَذِهِ الْمَنْزِ لَةِ وَعِلْمُ نَبِيِّنَا مِنْ عِلْمِ الْحَقِّ سُبْحَانَهُ بِهَذَ الْمَنْزَِلَةِ فَكُلُّ رَسُوْلٍ وَنَبِىٍّ وَوَلِىِّ اَخِذُوْنَ بِقَدْرِ الْقَابِلِيًَّةِ وَالْاِسْتِعْدَادِ مِمَّا لِدَيْهِ وَلَيْسَ لِاَحَدٍانْ يَعْدُفْهُ اَوْيَتَقَدَّمَ عَلَيْهِ
-‘‘এও হতে পারে যে উক্ত আয়াতের عَلَيْهِ শব্দের هِ (‘হি’) সর্বনাম দ্বারা হুজুর (ﷺ) এর প্রতি নির্দেশ করা হয়েছে। অর্থাৎ হুজুর (ﷺ) মানুষের অবস্থা অবলোকন করেন, তাদের ভবিষ্যৎ, তাদের চরিত্র, তাদের আচরণ তাদের ঘটনা প্রবাহ ও তাদের বিগত অবস্থাও তিনি জানেন। পরকালের হাল-হাকিকত ও বেহেশতী জাহান্নামী লোকদের অবস্থা সম্পর্কেও তিনি ওয়াকিফহাল। ওই সমস্ত লোক হুজুর (ﷺ) এর জ্ঞান ভান্ডারের কিছুই জানতে পারেন না, তবে ততটুকু জানতে পারেন, যতটুকু তিনি (ﷺ) চান। আম্বিয়া কিরামের (عليه السلام) জ্ঞানের সামনে আল্লাহর ওলীগণের জ্ঞান হলো সাত সমুদ্রের এক ফোটার সমতুল্য, আর হুযুর আলাইহি সালামের জ্ঞানের সামনে অন্যান্য আম্বিয়া কিরামের (عليه السلام) জ্ঞানও তদ্রুপ। অতএব প্রত্যেক নবী, রসূল ও ওলী নিজ নিজ ধারণ ক্ষমতা ও যোগ্যতা অনুসারে হুজুর (ﷺ) এর নিকট থেকে আহরণ করেন। হুজুর (ﷺ) কে ডিঙিয়ে যাওয়া কারো পক্ষে সম্ভব নয়।’’
{আল্লামা ইসমাঈল হাক্কীঃ তাফসীরে রুহুল বায়ানঃ ২/২৫৭ পৃ.}
‘তাফসীরে খাযেনে’ এ আয়াতের ব্যাখ্যায় উল্লেখিত আছে,
يَعْنِىْ اَنْ يَطَّلِعَهُمْ عَلَيْهِ وَهُمُ الْاَنْبِيَاءُ وَالرُّسُلُ وَلِيَكُوْنَ مَا يُطْلِعَهُمْ عَلْيِه مِنْ عِلْمِ غَيْبِهِ دَلِيْلاً عَلَى نَبُوَّتِهِمْ كَمَا قَالَ اللهُ تَعَالَى فَلاَ يُظْهِرْ عَلَى غَيْبِهِ اَحَدًا اِلَّامَنِ ارْتَضَى مَنَ رَّسُوْلٍ
-‘‘আল্লাহ তা’আলা যাদেরকে তার জ্ঞান সম্পর্কে অবহিত করেন, তাঁরা হচ্ছেন নবী ও রাসূল, যা’তে তাঁদের অদৃশ্য জ্ঞান নবুয়তের দলীলরূপে পরিগণিত হয়। যেমন আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেছেন, তাঁর বিশেষ অদৃশ্য বিষয় কারও নিকট প্রকাশ করেন না, একমাত্র তাঁর সে রাসূলের নিকট প্রকাশ করেন, যাঁর উপর তিনি (আল্লাহ) সন্তুষ্ট।”
{ইমাম খাযেনঃ তাফসীরে খাযেনঃ ১/১৯০ পৃ.}
‘তাফসীরে মা’আলিমুত তানযীলে’ উক্ত আয়াতের প্রেক্ষাপটে উল্লেখিত আছে,
يَعْنِىْ لاَ يُحِيْطُوْنَ بِشَئٍ مِنْ عِلْمِ الْغَيْبِ اِلاَّبِمَاشَآءَمِمَّا اَخْبَرَبِهِ اِلرُّسُلُ
-‘‘এ সকল লোক অদৃশ্য জ্ঞানকে বেষ্টন বা আয়ত্ত্ব করতে পারে না। শুধু ততটুকুই তারা লাভ করে, যতটুকু রাসূলগণ তাদের নিকট পরিবেশন করেছেন।’’
{ইমাম বগভীঃ মা’আলিমুত তানযীলঃ ১/২৩৯ পৃ.}
এ আয়াত ও ব্যাখ্যাসমূহ থেকে এতটুকু বোঝা গেল যে, উল্লেখিত আয়াতে হয়তো আল্লাহর জ্ঞানের কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ আল্লাহর জ্ঞান কারো কাছে নেই, তবে তিনি যাকে জ্ঞানদানের ইচ্ছা করেন, তিনিই অদৃশ্য জ্ঞান অর্জন করে থাকেন। আল্লাহ তা’আলা নবীগণ (عليه السلام) কে ইলমে গায়ব দান করেছেন এবং তাঁদের ওসীলায় কোন কোন মুমিন বান্দাকেও দিয়েছেন। অতএব মুমিন বান্দাগণও খোদা প্রদত্ত ইলমে গায়ব লাভ করেছেন। কি পরিমাণ (ইলমে গায়ব) দেয়া হয়েছে, এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা সামনে করা হবে।
অথবা, উল্লেখিত আয়াতে হুজুর (ﷺ) এর জ্ঞানের কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ হুজুর (ﷺ) এর জ্ঞান কেউ লাভ করতে পারে না, অবশ্য তিনি যাকে দিতে চান, দান করেন। অতএব আদম (عليه السلام) থেকে কিয়ামত পর্যন্ত যার যতটুকু জ্ঞান অর্জিত হয়েছে বা হবে, উহা হুজুর (ﷺ) এর জ্ঞান সমূহের এক ফোটার সমতুল্য। যার মধ্যে হযরত আদম (عليه السلام), ফিরিশতা ও অন্যান্য সৃষ্ট জীবের জ্ঞানও অন্তভুর্ক্ত। হযরত আদম (عليه السلام) এর জ্ঞানের পরিধি সম্পর্কে عَلَّمَ اَدَمَ الْاَشْمَاءَ আয়াতে বিশদভাবে আলোচনা করেছি।
وَمَا كَانَ اللَّهُ لِيُطْلِعَكُمْ عَلَى الْغَيْبِ وَلَكِنَّ اللَّهَ يَجْتَبِي مِنْ رُسُلِهِ مَنْ يَشَاءُ
-‘‘হে সাধারণ লোকগণ, এটা আল্লাহর শান নয় যে তোমাদের ইলমে গায়ব দান করবেন। তবে হ্যাঁ, রাসূলগণের মধ্যে যাকে তিনি ইচ্ছা করেন, তাকে এ অদৃশ্য জ্ঞানদানের জন্য মনোনীত করেন।’’
{সূরাঃ আলে ইমরান, আয়াতঃ ১৭৯, পারাঃ ৪}
‘তাফসীরে বায়যাবী’তে এ আয়াতের ব্যাখ্যায় উল্লেখ করা হয়েছে,
وَمَاكَانَ اللهُ لِيُوْتِىَ اُحَدَكُمْ عِلْمَ الْغَيْبِ فَيَطَّلِعُ عَلَى مَافِىْ الْقُلُوْبِ مِنْ كُفْرٍ وَّاِيْمَانٍ وَلَكِنْ اللهَ يَجْتَبِىْ لِرَسَالَتِهِ مِنْ يَّشَاءُ فَيُوْحِىَ اللهُ وَيَخْبِرَهُ بِبَعْضِ الْمُغَيِّبَاتِ اَوْيُنْصِبُ لَهُ مَايَدُلُّ عَلَيْهِ
-‘‘আল্লাহ তা’আলা তোমাদের মধ্যে কাউকে এমন ইলমে গায়ব প্রদান করেন না, যাতে তোমরা ঈমান ও কুফর, যা মনে মনে পোষণ করা হয়ে থাকে, সে সম্পর্কে অবগত হতে পারে। কিন্তু তিনি তাঁর রাসূলগণের মধ্যে যাঁদেরকে ইচ্ছে করেন, তাঁদেরকে মনোনীত করেন, তাঁদের উপর প্রত্যাদেশ করেন, তাঁদেরকেই আংশিক গায়ব সম্পর্কে অবহিত করেন, অথবা তাঁদের জন্য এমন কিছু প্রমাণাদি উপস্থাপন করেন, যা’ গায়বের পথ নির্দেশ করে থাকে।’’
{ইমাম কাজী নাসিরুদ্দীন বায়যাভীঃ তাফসীরে বায়যাভীঃ ১/৩০৮ পৃ.}
‘তাফসীরে খাযেনে’ আছে,
لَكِنَّ اللهَ يَصْطَفِىْ وَبَخْتَارُ مِنْ رُسُلِهِ مَنْ يُّشَاءُ فَيُطْلِعُهُ عَلَى بَعْضِ عِلْمِ الْغَيْبِ
-‘‘কিন্তু আল্লাহ তা’আলা রাসূলগণের মধ্যে যাদেরকে ইচ্ছে করেন মনোনীত করেন, আংশিক ইলমে গায়ব সম্পর্কে তাঁদেরকেই অবহিত করেন।’’
{ইমাম খাযেনঃ তাফসীরে খাযেনঃ ১/৩০৮ পৃ.}
‘তাফসীরে কাবীরে’ এ আয়াতের ব্যাখ্যায় লিখা হয়েছে,
فَاَمَّا مَعْرَفَةُ ذَلِكَ عَلَى سَبِيْلِ الْاِعْلاَمِ مِنَ الْغَيْبِ فَهُوَ مِنْ خَوَاصِّ الْاَنْبِيَاءِ
-‘‘খোদা প্রদত্ত অদৃশ্য জ্ঞানের ফলশ্রুতি স্বরূপ সে সমস্ত অদৃশ্য বিষয়াদি জেনে নেয়া নবীগণ (ﷺ) এরই বৈশিষ্ট্য।’’
জুমুলে উল্লেখিত আছে,
اَلْمَعْنَى لَكِنَّ اللهَ يَجْتَبِىْ اَنْ يَصْطَفِىَ مِنْ رُسُلِهِ مَنْ يَّشَاءُ فَيُطْلِعُهُ عَلَى الْغَيْبِ
-‘‘আয়াতের অর্থ হলো, আল্লাহ তা’আলা রাসূলগণের মধ্যে যাঁকে ইচ্ছে করেন, মনোনীত করেন। অতঃপর তাঁকে গায়ব সম্পর্কে জ্ঞান দান করেন।’’
{ইমাম ফখরুদ্দীন রাজীঃ তাফসীরে কবীরঃ ৯/১১১ পৃ.}
তাফসীরে জালালাইনে উল্লেখিত আছে,
{وَمَا كَانَ اللَّه لِيُطْلِعكُمْ عَلَى الْغَيْب} فَتَعْرِفُوا الْمُنَافِق مِنْ غَيْره قَبْل التَّمْيِيز {وَلَكِنَّ اللَّه يَجْتَبِي} يَخْتَار {مِنْ رُسُله مَنْ يَشَاء} فَيُطْلِعهُ عَلَى غَيْبه كَمَا أَطْلَعَ النَّبِيّ صَلَّى اللَّه عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَلَى حَال الْمُنَافِقِينَ
-‘‘আল্লাহ তা’আলা তোমাদেরকে গায়ব সম্পর্কে অবহিত করবেন না, যা’তে মুনাফিকদেরকে আল্লাহ কতর্ৃক পৃথকীকরণের পূর্বেই তোমরা চিনতে না পার, কিন্তু আল্লাহ তা’আলা যাকে ইচ্ছে করেন, তাঁকে মনোনীত করেন, তাঁর অদৃশ্য বিষয় সম্পর্কে অবহিত করেন যেমন নবী করীম (ﷺ)কে মুনাফিকদের অবস্থা সম্পর্কে অবহিত করেছিলেন।’’
{ইমাম জালালুদ্দীন সূয়তীঃ তাফসীরে জালালাইনঃ ৯২ পৃ.}
তাফসীরে ‘রূহুল বয়ানে’ আছে,
فَاِنَّ غَيْبَ الْحَقَائِقِ وَالْاَحْوَالِ لاَ يَنْكَشِفُ بِلاَ وَاسِطَةِ الرَّسُوْلِ
-‘‘কেননা, রাসূল (ﷺ) এররহস্যাবৃত অবস্থাও মৌলতত্ত্ব প্রকাশ করা হয় না।
{আল্লামা ইসমাঈল হাক্কীঃ তাফসীরে রুহুল বায়ানঃ ২/১৬২ পৃ.}
এ আয়াত ও ব্যাখ্যাসমূহ থেকে বোঝা গেল যে, খোদার খাস ইলমে গায়ব রাসূলের নিকট প্রকাশিত হয়। কোন কোন তাফসীরকারক, যে ইলমে গায়বের কিয়দংশের কথা বলেছেন, এ ‘কিয়দংশ’ কথাটি দ্বারা আল্লাহর অসীম জ্ঞানের তুলনায় নবীর অদৃশ্য জ্ঞানকে ‘কিঞ্চিত পরিমাণ’ বলা হয়েছে। কেননা সৃষ্টির ঊষালগ্ন থেকে যা কিছু ঘটছে ও যা ঘটবে, এর সম্পূর্ণ জ্ঞানও আল্লাহর জ্ঞানের তুলনায় আংশিক বা যৎসামান্যই বটে।
وَعَلَّمَكَ مَا لَمْ تَكُنْ تَعْلَمُ وَكَانَ فَضْلُ اللَّهِ عَلَيْكَ عَظِيمًا
-‘‘এবং আপনাকে শিখিয়ে দিয়েছেন, যা’ আপনি জানতেন না। আপনার উপর আল্লাহর এটি একটি বড় মেহেরবাণী।’’
{সূরাঃ নিসা, আয়াতঃ ১১৩}
তাফসীরে জালালাইনে এ আয়াতের তাফসীরে লিখা হয়েছে,
اَىْ مِنَ اْلاَحْكَامِ وَالْغَيْبِ
-‘‘যা’ তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জানতেন না, তা হচ্ছে ধর্মের অনুশাসন ও অদৃশ্য বিষয়াদি।’’
{ইমাম জালালুদ্দীন সূয়তীঃ তাফসীরে জালালাইনঃ ৯৭পৃ.}
‘তাফসীরে খাযেনে’ আছে,
اَنْزَلَ اللهُ عَلَيْكَ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ وَاَطْلَعَكَ عَلَى اَسْرَارِ هِمَا وَوَافَقَكَ عَلَى حَقَائِقِهِمَا
-‘‘আল্লাহ তা’আলা আপনার উপর কুরআন ও হিকমত (জ্ঞান-বিজ্ঞান ও দর্শন) অবতীর্ণ করেছেন, উহাদের গুপ্ত ভেদসমূহ উদ্ভাসিত করেছেন এবং উহাদের হাকীকত সমূহ সম্পর্কেও আপনাকে অবহিত করেছেন।’’
{ইমাম খাযেন, তাফসীরে খাযেন}
‘তাফসীরে মাদারেকে’ উল্লেখিত আছে,
يَعْنِىْ مِنْ اَحْكَامِ الشَّرْعِ وَاُمَوْرِ الدِّيْنَ وَقِيْلَ عَلَّمَكَ مِنْ عِلْمِ الْغَيْبِ مَالَمْ تَكُنْ تَعْلَمُ وَقِيْلَ مَعْنَاهُ عَلَّمَكَ مِنْ خَفِيَّاتِ الْاُمُوْرِ وَاَطْلَعَكَ عَلَى ضَمَائِرِ الْقُلُوْبِ وَعَلَّمَكَ مِنْ اَحْوَالِ الْمُنَافِقِيْنَ وَكَيْدِهِمْ
-‘‘শরীয়তের আহকাম ও ধর্মীয় বিষয়াদি আপনাকে শিখিয়েছেন। বলা হয়েছে যে, আপনাকে ইলমে গায়বের আওতাভুক্ত সে সমস্ত বিষয়াদিও শিখিয়েছেন, যা’ আপনি জানতেন না। আরও বলা হয়েছে যে, এর অর্থ হলো আপনাকে রহস্যাবৃত, গোপণীয় বিষয়সমূহ শিখিয়েছেন, অন্তরের লুকায়িত বিষয় সম্পর্কে অবহিত করেছেন, মুনাফিকদের ধোকাবাজি ও বাওতাবাজি সম্পর্কে অবহিত করেছেন।
{ইমাম নাসাফীঃ তাফসীরে মাদারিকঃ ১/২৮২ পৃ.}
‘তাফসীরে মাদারেকে’ আরও আছে,
مِنْ اُمَوْرِ الدِّيْنِ وَالشَّرَ ائِعِ اَوْمِنْ خَفِيَّاتِ الْاُمُوْرِ وَضَمَاِئرِ القُلُوْبِ
-‘‘দ্বীন ও শরীয়তের বিষয়সমূহ শিখিয়েছেন আপনাকে এবং গোপনীয় বিষয়াদি ও মানুষের অন্তরের গোপণীয় ভেদ ইত্যাদিও শিখিয়ে দিয়েছেন।’’
{ ইমাম নাসাফীঃ তাফসীরে মাদারিকঃ ১/২৮২ পৃ.}
তাফসীরে হুসাইনী এ আয়াতের ব্যাখ্যা বাহরুল হাকায়েক’ এর উদ্ধৃতি দিয়ে বলছে,
اں علم ماكان ومايكون هست كه حق سبحانه درشب اسرا بداں حضرت عطافرمود، چنانچه درحديث معراج هست كه من درزير عرش بودم قطره درخلق من ريختند فَعَلِمْتُ مَا كَانَ وَمَا يَكُوْنَ
এটা হচ্ছে পূর্ববর্তী ও পরবর্তী যাবতীয় বিষয়ের জ্ঞান, যা’ আল্লাহ তা’আলা হুজুর (ﷺ)কে পবিত্র মি’রাজের রজনীতে দান করেছিলেন। এ মর্মে মেরাজের হাদীছে উল্লেখিত আছে, আমি আরশের নিচে ছিলাম, তখন একটি ফোটা আমার কণ্ঠনালীতে ঢেলে দেওয়া হল, এরপর আমি অতীত ও ভবিষ্যতের সমস্ত ঘটনাবলীর জ্ঞান লাভ করলাম।
{আল্লামা মঈনুদ্দীন কাশেফীঃ তাফসীরে হুসাইনীঃ ১/১৯২ পৃ.}
‘জামেউল বয়ান’ তাফসীর গ্রন্থে আছে-
قَبْلَ نُزُوْلِ ذَلِكَ مِنْ خَفِّيَاتِ الْاُمُوْرِ
-‘‘আপনাকে সে সমস্ত বিষয় আল্লাহ বলে দিয়েছেন, যা’ কুরআন অবতীর্ণ হওয়ার আগে আপনার জানা ছিল না।’’
{ইমাম ত্ববারীঃ জামিউল বয়ানঃ ৫/২৭০ পৃ.}
এ আয়াত ও বর্ণিত ব্যাখ্যা সমূহ থেকে বোঝা গেল যে, হুজুর (ﷺ)কে অতীত ও ভবিষ্যতের সমস্ত ঘটনাবলী সম্পর্কে অবহিত করা হয়েছিল। আরবী ভাষায় مَا শব্দটি ব্যাপকতা প্রকাশের নিমিত্তে ব্যবহৃত হয়। তাই উক্ত আয়াত থেকে বোঝা গেল যে, শরীয়তের বিধি বিধান, দুনিয়ার সমস্ত ঘটনাবলীর, মানুষের ঈমানী অবস্থা ইত্যাদি, যা’ কিছু তাঁর জানা ছিল না, তাঁকে সম্যকরূপে অবগত করান হয়। “কেবলমাত্র ‘ধর্মীয় বিধানাবলীর’ জ্ঞান দান করা হয়েছিল” আয়াতের এরূপ সীমিত অর্থ গ্রহণ করা মনগড়া ভাবার্থ গ্রহণ করার নামান্তর, যা’ কুরআন, হাদীছ ও উম্মতের আকীদার পরিপন্থী। এ সম্বন্ধে সামনে আলোচনা হবে।
مَا فَرَّطْنَا فِي الْكِتَابِ مِنْ شَيْءٍ
আমি এ কিতাবে (কুরআনে) কিছু বাদ দিইনি।
{সূরাঃ আনআম, আয়াতঃ ৩৮}
ইমাম খাযেন এই আয়াতের ব্যাখ্যায় লিখেন-
اِنَّ الْقُرْاَنَ مُشْتَمِلٌُ عَلَى جَمِنْعِ الْاَحْوَالِ
কুরআন করীমে সমস্ত অবস্থার বিবরণ রয়েছে।
{ইমাম খাযেনঃ তাফসীরে খাযেনঃ ২/১১১ পৃ.}
‘তাফসীরে আনওয়ারুত তানযীলে’ এ আয়াতের ব্যাখ্যায় লিখা হয়েছে,
يَعْنِى اللَّوْحَ الْمَحْفُوْظَ فَاِنَّهُ مَشْتَمِلُّ عَلَى مَايَجْزِىْ فِىْ الْعَالَمِ مِنْ جَلِيْلٍ وَّدَقِيْقٍ لَمْ يُهْمَلْ فِيْهِ اَمْرُ حَيْوَانٍ وَلاَ جَمَادٍ
-‘‘কিতাব’ শব্দ দ্বারা লওহে মাহফুজকেই নির্দেশ করা হয়েছে। কেননা, এ লওহে মাহফুজে জগতের সমস্ত কিছুই উল্লেখিত, প্রত্যেক প্রকাশ্য, সূক্ষ্ম বিষয় বা বস্তু, এমনকি, কোন জীব জন্ত বা জড় পদার্থের কথাও বাদ দেয়া হয়নি।’’
{ইমাম খাযেনঃ তাফসীরে খাযেনঃ ২/১১১ পৃ.}
‘তাফসীরে আরায়েসুল বয়ানে’ এ আয়াতের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে,
اَىْ مَافَرَّطْنَا فِى الْكِتَابِ ذِكْرَ اَحَدٍ مِنَ الْخَلْقِ لَكِنْ لاَ يَبْصُرُ ذِكْرَهُ فِى الْكِتَابِ اِلاَ الْمُؤْيَّدُوْنَ بِاَنْوَارٍ الْمَعْرِفَةِ
অর্থাৎ- এ ‘কিতাবে’ সৃষ্টিকূলের কোন কিছুরই কথা বাদ রাখা হয়নি, কিন্তু মারেফতের আলোকে মদদপুষ্ট ব্যক্তিবর্গ ছাড়া তা’ কারো দৃষ্টি গোচর হয় না।
প্রখ্যাত সূফী ইমাম শা’রানী (রহমতুল্লাহে আলাইহে) ‘তবকাতে কুবরার’ মধ্যে লিখেছেন (ইদখালুস সেনান’ গ্রন্তের ৫৫ পৃষ্ঠা হতে সংগৃহীত।)
وَلَوْ فَتَحَ اللهُ عَنْ قُلُوْبِكُمْ اَقْفَالَ السُّدَدِ لاَطُّلَعْتُمْ عَلَى مَافِى الْقُرْاَنِ مِنَ الْعُلُوْمِ وَاسْتَغْنَيَمْ عَنِ النَّظْرِ فِىْ سِوَاهُ فَاِنَّ فِيْ جَمِيْعِ مَارُقِمَ فِىْ صَفْحَاتِ الْوُجُوْدِ قَالَ اللهُ تَعَالَى مَافَرَّطْنَافِى الْكِتَابِ مِنْ شَئٍّ
-‘‘যদি আল্লাহ তা’আলা তোমাদের হৃদয়ের তালাবদ্ধ প্রকোষ্টের তালা খুলে দেন, তাহলে তোমরা কুরআনের জ্ঞান-ভান্ডারের সন্ধান পাবে এবং কুরআন ভিন্ন অন্য কিছুর মুখাপেক্ষী হতে হবে না। কেননা কুরআনের মধ্যে অস্তিত্ববান সব কিছুই বিধৃত আছে। আল্লাহ তা’আলা ফরমান, এমন কিছু নেই, যা আমি কুরআনে বর্ণনা করিনি।’’
এ আয়াত ও এর বর্ণিত তাফসীর সমূহ থেকে বোঝা গেল যে, ‘কিতাবের’ মধ্যে দুনিয়া ও আখিরাতের সমস্ত অবস্থার কথা বিদ্যমান আছে। ‘কিতাব’ বলতে কুরআন বা লওহে মাহফুজকে বোঝানো হয়েছে। কুরআন হোক বা লওহে মাহফুজ হোক, উভয়ের জ্ঞান হুজুর (ﷺ) এর আছে। এ সম্পর্কে সামনে বিস্তারিত আলোচনা হবে। ফলস্বরূপ, দুনিয়া ও আখিরাতের যাবতীয় বিষয় হুজুর (ﷺ) এর জানা আছে। কেননা কুরআন ও লওহে মাহফুজ সমস্ত জ্ঞানের আধার, উভয়টি সম্পর্কে হুযুর পুর-নুর (ﷺ) ওয়াকিবহলা।
وَلاَرَطَبٍ وَّلاَ يَابِسٍ اِلاَّفِىْ كِتَابٍ مُّبِيْنٍ.
-‘‘এবং শুষ্ক ও আর্দ্র এমন কিছুই নেই, যা উজ্জ্বল ‘কিতাবে’ লিপিবদ্ধ হয়নি।’’
{সূরাঃ আনআম, আয়াতঃ ৫৯, পারাঃ ৭}
‘তাফসীরে ‘রূহুল বয়ানে’ উক্ত আয়াতের তাফসীর এভাবে করা হয়েছে,
هُوَ اللَّوْحُ الْمَحْفُوْظُ فَقَدْ ضَبَطَ اللهُ فِيْهِ جَمِيْعَ الْمَقْدُوْرَاتِ الْكَوْنِيَّةِ لِفَوَائِدِ تَرْجِعُ اِلَى الْعِبَادِ يَعْرِ فُهَا الْعُلَمَاءُ بِاللهِ
-‘‘উজ্জ্বল কিতাব’ দ্বারা লওহে মাহফুজের কথাই বলা হয়েছে। এতে আল্লাহ তা’আলা বান্দার কল্যাণার্থে সম্ভাব্য সকল বিষয় একত্রিত করেছেন। উলামায়ে রব্বানীই এসব বিষয়ে অবগত।’’
{আল্লামা ইসমাঈল হাক্কীঃ তাফসীরে রুহুল বয়ানঃ ৩/৫৭ পৃ.}
‘তাফসীরে কাবীরে’ এ আয়াতের ব্যাখ্যায় লিখা হয়েছে,
وَفَائِدَةُ هَذَا الْكِتَابِ أُمُورٌ: أَحَدُهَا: أَنَّهُ تَعَالَى إِنَّمَا كَتَبَ هَذِهِ الْأَحْوَالَ فِي اللَّوْحِ الْمَحْفُوظِ لِتَقِفَ الْمَلَائِكَةُ عَلَى نَفَاذِ عِلْمِ اللَّه تَعَالَى فِي الْمَعْلُومَاتِ وأنه لا يغيب عنه مما في السموات وَالْأَرْضِ شَيْءٌ. فَيَكُونُ فِي ذَلِكَ عِبْرَةٌ تَامَّةٌ كَامِلَةٌ لِلْمَلَائِكَةِ الْمُوَكَّلِينَ بِاللَّوْحِ الْمَحْفُوظِ لِأَنَّهُمْ يُقَابِلُونَ بِهِ مَا يَحْدُثُ فِي صَحِيفَةِ هَذَا الْعَالَمِ فَيَجِدُونَهُ مُوَافِقًا لَهُ
-‘‘(লওহে মাহফুজে) এ ধরনের লিখার পিছনে কয়েকটি উদ্দেশ্য রয়েছে। প্রথমতঃ আল্লাহ তা’আলা ওই সমস্ত বিষয়াদি লওহে মাহফুজে এ জন্য লিখেছেন, যা’তে ফিরিশতাগণ সর্বাবস্থায় খোদার ইলম জারী হওয়া সম্পর্কে অবগত হন। সুতরাং এটা লওহে মাহফুজের দায়িত্বে নিয়োজতি ফিরিশতাগণের জন্য পুরোপুরি শিক্ষা গ্রহণের বিষয়ে পরিণত হয়। কেননা তাঁরা জগতে নিয়ত ঘটমান নতুন নতুন বিষয়কে ওই লিখার সঙ্গে মিলিয়ে দেখেনও লওহে মাহফুজের লিখার অনুরূপ সবকিছু সংঘটিত হতে দেখতে পান।’’
{ইমাম ফখরুদ্দীন রাজীঃ তাফসীরে কবীরঃ ৫/১২ পৃ.}
তাফসীরে খাযেনে এ আয়াতের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে লিখা হয়েছে,
وَالثَّاِنِى اَنَّ الْمُرَادَ بِالْكِتَابِ الْمُبِيْنَ هُوَ اللَّوْحُ الْمَحْفُوْظُ لِاَنَّ اللهُ كَتَبَ فِيْهِ عِلْمَ مَايَكُوْنَ وَمَاقَدْ كَانَ قَبْلَ اَنْ يَخْلُقَ السَّمَوَتِ وَالْاَرْضَ وَفَائِدَةُ اِحْصَاءِ الْاَشْيَآءِ كُلِّهَا فِىْ هَذَا الْكِتَابِ لِتَقِفَ الْمَلَئِكَةُ عَلَى اِنْفَاذِ عِلْمِهِ
-‘‘দ্বিতীয় অর্থে كِتَبٌُ مُبِيْنَ বলতে লওহে মাহফুজকে বোঝানো হয়েছে। কেননা যা কিছু হবে এবং আসমান যমীন সৃষ্টির পূর্বে যা কিছু হয়েছে, আল্লাহ তা’আলা সব কিছুর বিবরণ এতে লিখে দিয়েছেন। এসব কিছু লিখার উপকারিতা হলো ফিরিশতাগণ তাঁর (আল্লাহর) জ্ঞান জারী করার বিষয়ে অবগতি লাভ করতে সক্ষম হন।
{ইমাম খাযেনঃ তাফসীরে খাযেনঃ ২/১১৯ পৃ.}
‘তাফসীরে মাদারেকে’ এ আয়াতের ব্যাখ্যায় উল্লেখ করা হয়েছে
وَهُوَ عِلْمُ اللهِ اَوِالْلَوْحِ
অর্থাৎ- আয়াতে উল্লেখিত ‘উজ্জ্বল কিতাব’ দ্বারা খোদার জ্ঞান বা লওহে মাহফুজকে নির্দেশ করা হয়েছে।
{ইমাম নাসাফীঃ তাফসীরে মাদারিকঃ ১/৩৬৩ পৃ.}
‘তাফসীরে তানভীরুল মিক্কাস ফি তাফসীরে ইবনে আব্বাসে’ এ আয়াতের ব্যাখ্যায় উল্লেখিত আছে,
كُلُّ ذَلِكَ فِى اللَّوْحِ الْمُحْفُوْظِ مُبِيْنٌُ مِقْدَارُهَا وَوَقْتُهَا
-‘‘এসব বিষয় লওহে মাহফুজে উল্লেখিত আছে। অর্থাৎ সে সব কিছুর পরিমাণ ও সময় উল্লেখিত আছে।’’
{ইবনে আব্বাস, তাফসীরে ইবনে আব্বাসঃ ১/১৪২ পৃষ্ঠা.}
উল্লেখিত আয়াত ও এর তাফসীর সমূহ থেকে প্রতীয়মান হলো যে, লওহে মাহফুজে কঠিন, তরল, উৎকৃষ্ট, নিকৃষ্ট প্রত্যেক কিছুর উল্লেখিত আছে। এ লওহে মাহফুজ সম্পর্কে ফিরিশতা ও আল্লাহর প্রিয় বান্দাগণ সম্যকরূপে অবগত। যেহেতু এসব হুজুর (ﷺ) এর জ্ঞানের অন্তভুর্ক্ত, সেহেতু, এ সমস্ত জ্ঞান হুজুর (ﷺ) এর জ্ঞান সমুদ্রের কয়েক ফোঁটা মাত্র।
نَزَّلْنَا عَلَيْكَ الْكِتَابَ تِبْيَانًالِكُلِّ شَئٍى
-‘‘হে নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আমি তোমার প্রতি কুরআন অবতীর্ণ করেছি, যা প্রত্যেক কিছুর সুস্পষ্ট বিবরণ সম্বলিত।’’
{সূরাঃ নাহল, আয়াতঃ ৮৯, পারাঃ ১৪}
‘তাফসীরে হুসাইনী’তে এ আয়াতের ব্যাখ্যায় উল্লেখিত আছে,
نزلنا فر ستاديم، عليك الكتاب برتوقر ان بتبيانالكل شئ بيان روشن برائے همه چيز ازامورين ودنيا تفصيل واجمال
-‘‘আমি আপনার কাছে দ্বীন-দুনিয়ার প্রত্যেক বিষয়ের বিস্তারিত ও সংক্ষিপ্ত বর্ণনায় ভরপুর কুরআন অবতীর্ণ করেছি।
{আল্লামা মঈনুদ্দীন কাশেফীঃ তাফসীরে হুসাইনীঃ সূরা নাহলঃ ৮৯}
তাফসীরে ‘রূহুল বয়ানে’ এ আয়াতের তাফসীরে উল্লেখিত আছে-
يَتَعَلَّقُ بِاْمُوْرِ الدِّيْنِ مِنْ ذَلِكَ اَحْوَالُ الْاُمَمِ وَاَنْبِيَاءِهِمْ
-‘‘ধর্মীয় বিষয় সমূহের সহিত সম্পৃক্ত বিবরণের জন্য (কুরআন অবতীর্ণ করা হয়েছে)। এতে উম্মত ও তাদের নবীগণের অবস্থাও অন্তভুর্ক্ত।’’
{আল্লামা ইসমাঈল হাক্কীঃ তাফসীরে রুহুল বায়ানঃ ৫/৮৫ পৃ.}
তাফসীরে ‘ইতকানে’ এ আয়াতের ব্যাখ্যায় উল্লেখিত আছে,
قَالَ الْمُجَاهِدُ يَوْمًا مَامِنْ شَيْئٍ فِى الْعَالَمٍ اِلَّاهُوَفِىْ كِتَابِ اللهِ فَقِيْلَ لَهُ فَاَيْنَ ذِكْرُ الْخَانَاتِ فَقَالَ فِىْ قَوْلِهِ لَيْسَ عَلَيْكُمْ جُنَاحٌُ اَنْ تَدْخُلُوْا بُيُوْتًا غَيْرَ مَسْكُوْنَةٍ فِيْهَا مَتَاعٌُ لَّكُمْ
-‘‘একদিন হযরত মুজাহিদ (রহমতুল্লাহে আলাইহে) বলেছিলেন, জগতে এমন কোন জিনিস নেই, যার উল্লেখ কুরআনে নেই। তখন তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হলোঃ সরাইখানা সমূহের উল্লেখ কোথায় আছে?
তখন তিনি বললেন,
لَيْسَ عَلَيْكُمْ جُنُاحً اَنْ تَدْخُلُوْ بُيُوْتًا غَيْرَ مَسْكُوْنَةٍ
এ আয়াতেই উহাদের উল্লেখ আছে। আয়াতটির অর্থ হলোঃ যেসব ঘরে কেউ থাকে না, অথচ যেখানে তোমাদের আসবাবপত্র, সাজসরঞ্জাম রাখা হয়, সে সমস্ত ঘরে প্রবেশ করলে তোমাদের কোন গুনাহ হবে না।’
{আল্লামা ইমাম জালালুদ্ধীন সূয়তীঃ আল-ইতকানঃ ২/১৬০ পৃ.}
এ আয়াত ও এর ব্যাখ্যা সমূহ থেকে এ কথাই বোঝা গেল যে, কুরআনের মধ্যে উৎকৃষ্ট-নিকৃষ্ট প্রত্যেক কিছুর উল্লেখ আছে। আল্লাহ তা’আলা তাঁর মাহবুব (ﷺ)কে কুরআন শিক্ষা দিয়েছেন। সুতরাং সমস্ত কিছুই হযরত মুস্তাফা (ﷺ)র জ্ঞানের আওতাধীন।
পূর্ববর্তী পেইজ | পরবর্তী পেইজ |
(১৭) ইলমে গায়েবের বিভিন্ন পর্যায়ের বর্ণনা | (১৮/২) আল-কুরআন থেকে ইলমে গায়বের প্রমাণ সম্বলিত বর্ণনা |
সূচীপত্র | এরকম আরো পেইজ |