প্রাপ্ত বয়স্ক ও সুস্থ বিবেকের অধিকারী মুসলমানকে দু’শ্রেণীতে ভাগ করা যায়, মুজতাহিদ ও গায়র মুজতাহিদ। মুজতাহিদ হলো, এমন মুসলমান যিনি নিজ জ্ঞান ও যোগ্যতায় কুরআনী ইঙ্গিত ও রহস্যাবলী বুঝতে পারেন, কালামের উদ্দেশ্য অনুধাবন করার যোগ্যতা রাখেন, গবেষণা করে মাসাইল বের করতে পারেন, নাসিখ ও মানসুখ সম্পর্কে পূর্ণ জ্ঞান রাখেন, ‘ইলমে ছরফ, নাহব বালাগাত (অলংকার শাস্ত্র) ইত্যাদি বিষয়ে পূর্ণ পারদর্শিতা অর্জন করেছেন, যাবতীয় আহকামের সাথে সম্পর্কযুক্ত সমস্ত আয়াত ও হাদীছসমূহ সম্পর্কে যথার্থ জ্ঞান রাখেন, সর্বোপরি যিনি মেধা, প্রজ্ঞা ও বোধশক্তির অধিকারী হন। (তাফসীরাতে আহমদীয়া ইত্যাদি তাফসীর গ্রন্থ দেখুন) আর যে ব্যক্তি ঐ স্তরে পৌঁছতে পারে নি যার মধ্যে উল্লেখিত যোগ্যতা নেই, সে হলো গায়র-মুজতাহিদ বা মুকালিদ (অনুসারী)। গায়র-মুজতাহিদের জন্য মুজতাহিদের তাকলীদ একান্ত জরুরী। আর মুজতাহিদের জন্য তাকলীদ বা অপরের অনুসরণ করা নিষিদ্ধ। মুজতাহিদের ছয় শ্রেণী আছে। যথা-
(১) শরীয়তের মুজতাহিদ,
(২) মাযহাবের অন্তভুর্ক্ত মুজতাহিদ,
(৩) মাসাইলের মুজতাহিদ,
(৪) আসহাবে তাখরীজ,
(৫) আসহাবে তারজীহ ও
(৬) আসহাবে তমীয
(মুকাদ্দমায়ে শামী ‘তবকাতে ফুকহা’ এর বিবরণ দ্রষ্টব্য)
(ইমাম ইবনে আবেদীন শামীঃ রুদ্দুল মুখতারঃ ১/৭২ পৃ.)
যাদের মধ্যে উল্লেখিত ছয়টি স্তরের কোনটির যোগ্যতা নেই, তারা নিছক অনুসারী বা মুকালিদ হিসেবে পরিগণিত। যেমন, আমরা ও আমাদের যুগের সাধারণ আলিমগণ। তাঁদের একমাত্র কাজ হলো কিতাব দেখে বা অধ্যয়ন করে জনগণকে মাসাইল শিক্ষা দেয়া।
আমি আগেই বলেছি যে, মুজতাহিদের জন্য অপরকে অনুসরণ করা হারাম। অতএব, উল্লেখিত ছয় স্তরের মধ্যে যিনি যেই স্তরের মুজতাহিদ হবেন, তিনি সে স্তরের অন্য কারো তাকলীদ করবেন না; তিনি উপরের স্তরের মুজতাহিদের তাকলীদ করবেন। উদাহরণ স্বরূপ, ইমাম আবু ইউসুফ (رحمة الله) ও ইমাম মুহাম্মদ (رحمة الله)) মৌলিক নীতিমালার ব্যাপারে ইমাম আবু হানীফা (رحمة الله) এর মুকালিদ বা অনুসারী, কিন্তু মাসাইলের ক্ষেত্রে নিজেরাই মুজতাহিদ। এজন্য মাসাইলের ব্যাপারে তাঁরা কারো অনুসারী নন।
আমার উপরোক্ত আলোচনার মধ্যে নিম্নবর্ণিত লা-মাযহবাীদের অনেক অবান্তর প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাওয়া যায়। তাঁরা প্রশ্ন করে থাকেন, ইমাম আবু ইউসুফ (رحمة الله) ও ইমাম মুহাম্মদ (رحمة الله) যখন হানাফী মাযহাবের অনুসারী, তখন তাঁরা বিভিন্ন মাসাইলে ইমাম আবু হানীফা (رحمة الله) এর বিরোধিতা করেন কেন? এর উত্তরে বলতে হবে যে তাঁরা মৌলিক নীতিমালার ব্যাপারে ইমাম আবু হানীফা (رحمة الله) এর অনুসারী, যার জন্য নির্ধারিত নীতিমালার ক্ষেত্রে কোন বিরোধিতা করেন না। তবে আনুসঙ্গিক অনেক মাসাইলে ভিন্নমত পোষণ করেন, কেননা এগুলোর ব্যাপারে তাঁরা নিজেরাই মুজতহিদ, অন্য কারো অনুসারী নন।
নিম্নে উল্লেখিত প্রশ্নেরও অবতারণা করার আর অবকাশ রইল না। তারা প্রশ্ন করতে পারেন, আপনারা অনেক মাসাইলে ইমাম আবু হানীফা (رحمة الله) এর উক্তিকে বাদ দিয়ে সাহেবাইন (رحمة الله) এর উক্তি অনুযায়ী ফাতওয়া দিয়ে থাকেন। এরপরেও আপনারা হানাফী মতাবলম্বী হলেন কিভাবে? এর উত্তর হলো, ফকীহগণের মধ্যে আসহাবে তারজীহ এর যোগ্যতা ও গুণাবলীর অধিকারী ফকীহ বিদ্যমান আছেন, যাঁরা কয়েকটি উক্তির মধ্য থেকে একটিকে প্রাধান্য দেন। এ জন্য আমরা তাঁদের প্রাধান্য দেয়া উক্তি অনুসারে ফাত্ওয়া দিয়ে থাকি।
তারা আরও প্রশ্ন করতে পারেন, আপনারা নিজেদেরকে হানাফী বলে কেন দাবী করেন, আপনাদের ইউসুফী বা মুহাম্মদী বা ইবনে মুবারকী বলাই বাঞ্ছনীয় নয় কি? কেননা অনেক জায়গায় আপনারা ইমাম সাহেব (رحمة الله) এর উক্তিকে বাদ দিয়ে উনাদের উক্তি অনুযায়ী আমল করে থাকেন। এর উত্তর হলো ইমাম আবু ইউসুফ (رحمة الله) ইমাম মুহাম্মদ (رحمة الله) ও ইমাম ইবনে মুবারক (رحمة الله) প্রমুখের সমস্ত উক্তি ইমাম আবু হানীফা (رحمة الله) এর নির্ধারিত নীতিমালার উপর ভিত্তি করেই বর্ণিত হয়েছে। সুতরাং, তাদের উক্তিকে গ্রহণ করা মানে প্রকৃতপক্ষে ইমাম সাহেব (رحمة الله) এর উক্তিকে গ্রহণ করা। যেমন, হাদীছ অনুযায়ী আমল করা মানে প্রকৃতপক্ষে কুরআন অনুযায়ী আমল করা। কেননা, মহান প্রভুইতো এ নির্দেশ দিয়েছেন। উদাহরণ স্বরূপ,
ইমাম আবু হানীফা (رحمة الله) বলেছেন,
“যদি কোন হাদীছ সহীহ প্রমাণিত হয়ে যায়, তখন সেটাই হবে আমার মাযহাব।”
এমতাবস্থায় যদি মাযহাবের অন্তভুর্ক্ত কোন মুজতাহিদ কোন সহীহ হাদীছ পেয়ে সে অনুসারে আমল করেন, তাহলে তিনি লা-মাযহাবী হবেন না বরং হানাফীই থেকে যাবেন। কেননা, তিনি ইমাম সাহেব (رحمة الله) এর উক্ত নীতিমালা অনুযায়ী হাদীছ অনুসারে আমল করেছেন। মুকাদ্দমায়ে শামীতে,
صَحَّ عَنِ الْاِمَامِ اِذَا صَحَّ الْحَدِثُ فَهُوَ مَذْهَبِىْ
-‘‘যখন কোন কোন সহিহ হাদিস পাওয়া যাবে সেটাই আমার মাযহাব।’’
এর বর্ণনা প্রসঙ্গে এর বিস্তারিত বিবরণ দেখুন। ইমাম সাহেব (رحمة الله) এর উপরোক্ত উক্তির মর্ম এও হতে পারে যে, যখন কোন হাদীছ নিভুর্ল প্রমাণিত হলো, তখনই সেটা আমার মাযহাবরূপে গণ্য হল। অর্থাৎ প্রত্যেক মাস আলা ও হাদীসকে আমি পর্যাপ্ত বিচার বিশেষণ ও খুটিনাটি সব কিছুর পর্যালোচনা করে গ্রহণ করেছি। বস্তুতঃ ইমাম সাহেব (رحمة الله) এর নিকট প্রত্যেকটি মাসআলা নিয়ে ব্যাপক বিচার-বিশেষণ করা হতো, এবং মুজতাহিদ শিষ্যদের সঙ্গে প্রাসঙ্গিক সব কিছুর ব্যাপক তাত্ত্বিক পর্যালোচনার পর ওটা গ্রহণ করা হতো।
এই সংক্ষিপ্ত আলোচনাটুকু স্মরণ রাখলে ইনশাআল্লাহ অনেক সমস্যা সমাধান করা যাবে, সুখী পাঠকমন্ডলীর অনেক কাজ আসবে। কোন কোন লা-মাযহাবী আলিম বলে থাকেন- যেহেতু আমাদের ইজতিহাদ প্রয়োগ করার ক্ষমতা আছে, সেহেতু আমরা কাউকে অনুসরণ করি না। এ অবান্তর উক্তির জন্য দীর্ঘ আলোচনার প্রয়োজন নেই। ইজতিহাদের জন্য কতটুকু জ্ঞান দরকার আর তারা কতটুকু জ্ঞানের অধিকারী শুধু সে প্রসঙ্গে আলোচনা করার প্রয়াস পাচ্ছি।
হযরত ইমাম রাযী (رحمة الله) ইমাম গায্যালী (رحمة الله) ইমাম তিরমিযী (رحمة الله), ইমাম আবু দাউদ (رحمة الله) গাউছে পাক (رحمة الله) বায়যীদ বুস্তামী (رحمة الله) শাহ বাহা উদ্দিন নকশবন্দী (رحمة الله) প্রমুখ ইসলামে এত উন্নত মর্যাদার অধিকারী ও মাশায়িখ ছিলেন যে, তাঁদের নিয়ে মুসলমানগণ যতই গর্ববোধ করুক না কেন, তা তাঁদের জ্ঞান গরিমা ও প্রজ্ঞার তুলনায় নেহায়ত কিঞ্চিতকররূপে প্রতিভাত হবে। অথচ উনাদের মধ্যে কেউ মুজতাহিদরূপে স্বীকৃতি পাননি। বরং তাঁরা ছিলেন মুকালিদ বা অনুসারী।
কেউ ইমাম শাফেয়ীর (رحمة الله) আর কেউ ইমাম আবু হানীফার (رحمة الله) অনুসারী ছিলেন। বর্তমান জামানায় উনাদের সমপরিমাণ মর্যাদা ও যোগ্যতার অধিকারী কেউ আছেন? যখন উনাদের জ্ঞান মুজতাহিদ এর স্তরে উপনীত হওয়ার জন্য যথেষ্ট নয়, তখন যারা বিভিন্ন হাদীছ গ্রন্থের নামগুলো পর্যন্ত ঠিকমতো বলতে পারে না, তারা কোন পর্যায়ে পড়বেন?
জনৈক ভদ্রলোক মুজতাহিদ হওয়ার দাবী করেছিলেন। আমি তাকে শুধু এতটুকু জিজ্ঞাসা করেছিলাম আচ্ছা বলুন দেখি, সুরা তাকাছুর থেকে কয়টি মাসাইল বের করতে পারেন এবং এর মধ্যে ‘হাকীকত’, ‘মাজায’ ‘সরীহ’ ‘কিনায়া’ ‘জাহির’ ও ‘নাস’ কয়টি আছে? সে বেচারা নাকি (উসুলে ফিকহ শাস্ত্রে ব্যবহৃত উক্ত পারিভাষিক) শব্দগুলোর নামও শুনেনি।
পূর্ববর্তী পেইজ | পরবর্তী পেইজ |
(০৮) কোন ধরনের মাসাইলে তাকলীদ করা হয় | (১০) তাকলীদ ওয়াজিব হওয়ার দলীলাদির বিবরণ |
সূচীপত্র | এরকম আরো পেইজ |