বিশাল এই পৃথিবীটা একটুখানি ভালোবাসার ফসল। সে ভালোবাসা সৃষ্টির প্রতি মহান স্রষ্টার ভালোবাসা। নূরে মুহাম্মদির প্রতি মহান আল্লাহর ভালোবাসা। স্বনামধন্য শাইখুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক সহিহ বোখারির অনুবাদ গ্রন্থ 'বোখারি শরিফ'-এর পঞ্চম খণ্ডে লিখেছেন,
অনাদি রূপে এক আল্লাহতায়ালাই ছিলেন; অন্য কিছু বলিতে আর কিছুই ছিল না। আল্লাহ ছাড়া আর কিছুই নাই। এই শূন্যতার সমাপ্তি ঘটাইতে ইচ্ছা করিলেন স্বয়ং আল্লাহতায়ালা।
অতঃপর সর্বপ্রথম মহান আল্লাহ নূরে মোহাম্মদিকে সৃষ্টি করেন। হজরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
আমি একবার রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে নিবেদন করলাম, 'হে আল্লাহর রাসুল! আল্লাহতায়ালা জগতের কোন জিনিসকে সর্বপ্রথম সৃষ্টি করেছিলেন, সে বিষয়ে আমাকে একটু অবহিত করুন। আপনার চরণে আমার মাতা-পিতা উৎসর্গিত হোক!'
জবাবে রাসুল (সা.) বললেন, 'হে জাবের, আল্লাহতায়ালা সব কিছুর আগে তোমার নবীর নূরকে স্বীয় নূর থেকে সৃজন করেন। আর তখন লাওহে কলম, বেহেশত-দোজখ, আসমান-জমিন, চন্দ্র-সূর্য, মানব-দানব আর ফেরেশতা কিছুই ছিল না।'
আল্লাহতায়ালা নিজের সৃষ্টি নূরে মুহাম্মদিকে এতই ভালোবেসে ফেললেন যে তাঁর প্রদর্শনীর জন্য নিখিল জগৎকে সৃষ্টি করলেন।" আল্লামা আজিজুল হকের ভাষায়,
কোনো শিল্পী নিজ দক্ষতায় সুন্দর গঠনের একটি জিনিস তৈরি করে, তা এতই সুন্দর হয় যে স্বয়ং গঠনকারী শিল্পী তারই হাতে গঠিত জিনিসটির প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ে, সে তাকে আদর করে এবং ভালোবাসে। তদ্রূপ মহান আল্লাহ হাকিকতে মুহাম্মাদিয়াকে সৃষ্টি করে স্বয়ং তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হন, তাঁকে ভালোবাসেন, সর্বাধিক আদরের পাত্র বানিয়ে নেন।
রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর ভালোবাসার কারণেই মহান আল্লাহ সমগ্র বিশ্বজগৎ সৃষ্টি করেছেন, এটা বহু হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। যেমন_এক হাদিসে হজরত সালমান ফারসি (রা.) বর্ণনা করেছেন,
একবার হজরত জিবরাইল (আ.) রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে এসে বললেন, 'আপনার রব এই মর্মে সংবাদ পাঠিয়েছেন যে ইবরাহিম আমাকে বন্ধু বানিয়েছে আর আমি তার বন্ধুত্ব গ্রহণ করেছি, আর আমি স্বয়ং আপনাকে বন্ধু বানিয়েছি। আর আমি দ্বিতীয় এমন কোনো কিছু সৃষ্টি করিনি, যা আমার কাছে আপনার চেয়ে অধিক সম্মানিত। আর আমি পৃথিবী ও এর মধ্যে যা কিছু আছে, সব কিছু সৃষ্টি করেছি, আমার কাছে আপনার মহান মর্যাদা ও উচ্চাসনের বিষয়টি তাদের কাছে প্রকাশ করার জন্য। যদি আমি আপনাকে সৃষ্টি না করতাম তাহলে বিশ্বজগতের কোনো কিছুই সৃষ্টি করতাম না
— ইবনে আসাকির
যাঁর ভালোবাসায় মহান সৃষ্টি মুগ্ধ, যাঁর ভালোবাসা জগৎ সৃষ্টির উৎস, সেই মহামানবের প্রতি ভালোবাসা না থাকলে যে ইমান থাকে না, এটা অত্যন্ত স্বাভাবিক কথা। আর সে জন্যই হাফিজে হাদিস হুজ্জাতুল ইসলাম ইমাম বোখারি (রা.) সহিহ বোখারিতে একটি অধ্যায়ের শিরোনাম দিয়েছেন, 'হুব্বুর রাসুলি মিনাল ইমান' অর্থাৎ রাসুলের প্রতি ভালোবাসা ইমানের অংশ। আলোচ্য শিরোনামের অধীনে ইমাম বোখারি (রা.) যে হাদিসটি উল্লেখ করেছেন,
হজরত আবু হোরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, সেই আল্লাহর শপথ, যার কুদরতি হাতে আমার জীবন, তোমাদের কেউ ততক্ষণ পর্যন্ত পূর্ণাঙ্গ মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না আমার প্রতি তার ভালোবাসা, তার মাতা-পিতা, সন্তান-সন্ততির ভালোবাসার চেয়ে বেশি হবে।
— বোখারী
অন্য এক হাদিসে হজরত আনাস (রা.) বর্ণনা করেছেন,
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, 'তোমাদের কেউ কিছুতেই মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না আমি তার কাছে তার মা-বাবা, সন্তান-সন্ততি এবং পৃথিবীর অপরাপর সব মানুষ অপেক্ষা অধিক প্রিয় হব'
— বোখারি
যেসব ইমানের দাবিদার রাসুল (সা.)-এর ভালোবাসাকে তাদের জীবনে সর্বোচ্চ পর্যায়ে অগ্রাধিকার দিতে ব্যর্থ, মহান আল্লাহ তাদের প্রতি ধমকের সুরে বলেছেন,
হে নবী! আপনি তাদের বলে দিন, যদি তোমাদের পিতৃপুরুষরা, তোমাদের পুত্রসন্তানরা, তোমাদের ভাইরা, তোমাদের জ্ঞাতি-গোষ্ঠী, তোমাদের উপার্জিত সম্পদ এবং তোমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য, যা বন্ধ হয়ে যাওয়ার ভয়ে তোমরা শঙ্কিত আর তোমাদের বাসস্থানগুলো, যার সৌন্দর্য তোমাদের আকৃষ্ট করে_এগুলো তোমাদের কাছে আল্লাহ ও তাঁর রাসুল অপেক্ষা এবং আল্লাহর রাস্তায় জিহাদের চেয়ে বেশি প্রিয় হয়, তাহলে তোমরা অপেক্ষা করো আল্লাহর নির্দেশ আসা পর্যন্ত। আর আল্লাহ ফাসিক লোকদের হেদায়েত দেন না'।
— সুরা তওবা, আয়াত-২৪
আলোচ্য আয়াতে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের চেয়ে পার্থিব কোনো কিছুকে যারা বেশি ভালোবাসে, তাদের ফাসিক বলা হয়েছে। আর এর পরিণতি যে অত্যন্ত ভয়াবহ সে বিষয়ে হুঁশিয়ার করে দেওয়া হয়েছে। মুহাককিক উলামায়ে কেরাম বলেছেন, ভালোবাসা দুই ধরনের
(১) তবঈ বা সৃষ্টিগত, অভ্যাসগত।
যেমন_মানুষ সৃষ্টিগতভাবেই তার মা-বাবা, সন্তান-সন্ততি, ভাইবোন, স্ত্রী ও স্বজনদের ভালোবাসে। এ ভালোবাসাকে মানুষ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। মহান আল্লাহ একাধিক স্ত্রীর প্রতি ইনসাফের নির্দেশ দিয়ে বলেছেন, 'আর যদি তোমাদের আশঙ্কা হয় যে একাধিক স্ত্রীর মধ্যে সমতা রক্ষা করতে পারবে না, তাহলে তোমাদের জন্য একটা স্ত্রী গ্রহণ করাই অনুমোদিত' (সুরা নিসা, আয়াত-৩)। মানুষ বাহ্যিক বিষয়ে সমতা বিধান করতে পারে, কিন্তু অন্তরের স্বভাবজাত ভালোবাসাকে নিয়ন্ত্রণ বা বণ্টনের ক্ষমতা মানুষের নেই। রাসুলে করিম (সা.)-এর হৃদয়ও হজরত আয়শা (রা.)-এর প্রতি বেশি অনুরক্ত ছিল। তাই তিনি আল্লাহর কাছে দোয়া করতেন, 'হে আল্লাহ! আমি আমার সাধ্য অনুযায়ী স্ত্রীদের মধ্যে অধিকার বণ্টন করেছি; কিন্তু যে বিষয়টি আমার আয়ত্তে নয় (অন্তরের ভালোবাসা), যা তোমার কর্তৃত্বাধীন, সে বিষয়ে তুমি আমাকে পাকড়াও করো না' (তিরমিজি, আবু দাউদ, ইবনে মাজা, নাসাঈ)। যেহেতু স্বভাবজাত বা প্রকৃতিগত ভালোবাসা মানুষের নিয়ন্ত্রণাধীন নয়, সেহেতু ওলামায়ে কেরামের অভিমত হলো, এটি ইমানের জন্য শর্তায়িত নয়।
(২) ভালোবাসার দ্বিতীয় প্রকার হলো আকলি বা বিবেচনাপ্রসূত।
মানুষ তার জ্ঞানের আলোকে নির্বাচিত উত্তম জিনিসকে ভালোবাসে। এটা মানুষের ইচ্ছাধীন। আর এ ধরনের ভালোবাসাই ইমানের জন্য শর্তায়িত। বিবেচনা ও জ্ঞান দ্বারা নির্বাচনের ক্ষেত্রে শুধু মা-বাবা, সন্তান-সন্ততি আর অপরাপর মানুষ থেকেই নয়, বরং নিজের জীবনের চেয়েও যদি রাসুল (সা.)-এর প্রতি ভালোবাসাকে অগ্রাধিকার দেওয়া না যায়, তাহলে ইমানদার হওয়া যাবে না। ইমাম আহমাদ (রহ.) বলেন,
জুহরা ইবনে মা'বাদ স্বীয় পিতামহ থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন, "একবার আমরা রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সঙ্গে কোথাও যাচ্ছিলাম। রাসুলুল্লাহ (সা.) ওমরের হাত নিজের হাতের মধ্যে রেখে পথ চলছিলেন। একসময় ওমর বললেন, 'হে আল্লাহর রাসুল, নিশ্চয়ই আপনি আমার কাছে আমার নিজ সত্তা ছাড়া পৃথিবীর সব কিছুর চেয়ে বেশি প্রিয়।' তখন রাসুল (সা.) বললেন, 'কোনো ব্যক্তির কাছে যতক্ষণ আমি তার নিজ সত্তা অপেক্ষা বেশি প্রিয় না হব, ততক্ষণ পর্যন্ত সে মুমিন হতে পারবে না।' অতঃপর ওমর বললেন, 'আল্লাহর কসম! এখন আপনি আমার কাছে নিজ সত্তা অপেক্ষা বেশি প্রিয়।' তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, 'হে ওমর, এখন তুমি (মুমিন হলে)।
হাদিসটি ইমাম বোখারি (রহ.) আবদুল্লাহ ইবনে হিশাম থেকে বর্ণনা করেছেন। সাহাবায়ে কেরাম নিজেদের জীবনের চেয়েও রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে বেশি ভালোবাসতেন। এর বহু প্রমাণ হাদিস ও ইতিহাসের গ্রন্থগুলোতে পাওয়া যায়।
এ পর্যায়ে হিজরতের সফরে গারে সওরের ঘটনা বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। মক্কা থেকে পাঁচ মাইল পথ অতিক্রম করে রাতের আঁধারে মহানবী (সা.) ও তাঁর বিশ্বস্ত সঙ্গী আবু বকর সিদ্দিক (রা.) সওর পাহাড়ে পেঁৗছলেন। পাহাড়ের জঞ্জালপূর্ণ গুহার মুখে আল্লাহর রাসুল (সা.)-কে অপেক্ষা করার মিনতি জানিয়ে আবু বকর গুহাভ্যন্তরে প্রবেশ করলেন। ভেতরকার সব জঞ্জাল পরিষ্কার করলেন। গুহার মধ্যে কিছু ছিদ্র দেখে সাপ-বিচ্ছুর গর্ত মনে করে নিজের সঙ্গে থাকা অতিরিক্ত কাপড় টুকরো করে সেগুলোর মুখ বন্ধ করলেন। কিন্তু দুটি ছিদ্র বাকি থাকতেই কাপড় শেষ হয়ে যাওয়ায় ছিদ্র দুটি নিজের গোড়ালিচাপা দিয়ে রাসুল (সা.)-কে ভেতরে আহ্বান করলেন। আল্লাহর রাসুল (সা.) ক্লান্ত শরীরে হজরত আবু বকরের বিছিয়ে দেওয়া ঊরুতে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়লেন। ওদিকে গর্তের ভেতর থেকে বিষাক্ত বিচ্ছু আবু বকরের পায়ে বারবার দংশন করে চলেছে। বিষক্রিয়ায় তাঁর চেহারা বিবর্ণ হয়ে গেছে। জীবন যাওয়ার উপক্রম। কিন্তু রাসুলের প্রতি গভীর ভালোবাসা, নড়াচড়া করলে প্রিয় রাসুলের ঘুম ভেঙে যাবে ভয়ে অসহ্য যন্ত্রণাসহ আবু বকর স্থির ছিলেন। কিন্তু বিষক্রিয়ার প্রাবল্যে তাঁর অজ্ঞাতে এক ফোঁটা অশ্রু রাসুলের মুখে ঝরে পড়ায় আল্লাহর হাবিবের ঘুম ভেঙে যায়। তিনি জিজ্ঞাসা করেন, 'আবু বকর, আপনি কাঁদছেন? আবু বকর জবাব দিলেন, 'ইয়া রাসুলাল্লাহ, আপনার প্রতি আমার মাতা-পিতা উৎসর্গিত হোক! আমাকে বিচ্ছু দংশন করেছে।' রাসুল (সা.) ক্ষতস্থানে থুতু লাগিয়ে দিতেই আবু বকর বিষযন্ত্রণা থেকে আরোগ্য লাভ করেন। আর আল্লাহর রাসুল তাঁর জন্য দোয়া করেন, 'আল্লাহ আপনার প্রতি রহম করুন, মানুষ যখন আমাকে অবিশ্বাস করেছে, তখন আপনি আমাকে বিশ্বাস করেছেন; মানুষ যখন আমাকে অপদস্থ করেছে, তখন আপনি আমাকে সাহায্যে করেছেন; আপনি আমার ওপর ইমান এনেছেন, যখন মানুষ আমাকে অস্বীকার করেছে আর উদ্বিগ্ন অবস্থায় আপনি আমাকে সাহচর্য দান করেছেন' (বোখারি)।
রাসুলের প্রতি ভালোবাসার চূড়ান্ত পরীক্ষা দিয়েছিলেন সাহাবায়ে কেরাম উহুদের যুদ্ধের সময়। মুসলমানরা যখন খালিদ ইবনে ওয়ালিদের আকস্মিক আক্রমণে দিশেহারা হয়ে পড়লেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) যখন নিরাপত্তাহীন অবস্থায়, তখন হজরত আবু দুজানা (রা.) নিজেকে ঢাল বানিয়ে রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে রক্ষা করতে লাগলেন। কাফিরদের অবিরাম নিক্ষিপ্ত তীরগুলো তাঁর পিঠে বিদ্ধ হচ্ছিল, আর তিনি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে আড়াল করে ঝুঁকে দাঁড়িয়েছিলেন। হজরত সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রা.) আল্লাহর রাসুলের ওপর কাফিরদের আক্রমণ প্রতিরোধের চেষ্টা করছিলেন। হজরত সাদ বলেন, 'আবু দুজানা একটার পর একটা তীর আমাকে দিয়ে চলেছেন আর বলছেন, তুমি তীর নিক্ষেপ করতে থাকো' (সিরাতে ইবনে হিশাম)।
ঘটনার ধারাবিবরণী থেকে মনে হয়, আবু দুজানা নিজের শরীরে বিদ্ধ তীরগুলো খুলে সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাসকে সরবরাহ করছিলেন। রাসুলের প্রতি নিজ জীবনের চেয়ে বেশি ভালোবাসার প্রমাণ আর কী থাকতে পারে! উহুদের যুদ্ধ সমাপ্তির পর কাফিররা রণাঙ্গন ছেড়ে চলে যাওয়ার পর রাসুলুল্লাহ (সা.) শহীদ ও আহতদের খবর নিতে লাগলেন। হজরত জায়েদ ইবনে সাবেত (রা.) বলেন, "রাসুলে করিম (সা.) আমাকে সাদ ইবনে রবির খোঁজ নিতে পাঠালেন। রাসুল (সা.) আমাকে বলে দিলেন, 'যদি সাদকে পাওয়া যায়, তাহলে তাকে আমার সালাম দেবে এবং জিজ্ঞাসা করবে, সে এখন কেমন বোধ করছে।' আমি শহীদদের লাশের মধ্যে তাকে খুঁজে পেলাম। দেখলাম তিনি মৃত্যুযন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন। তাঁর শরীরে তীর, বর্শা ও তলোয়ারের সত্তরটি আঘাত লেগেছিল। আমি তাঁর কাছে গিয়ে বললাম, 'হে সাদ, আল্লাহর রাসুল আপনাকে সালাম দিয়েছেন এবং জানতে চেয়েছেন, আপনি এখন কেমন অনুভব করছেন।' হজরত সাদ ইবনে রবি (রা.) বললেন, 'আল্লাহর রাসুলকে আমার সালাম জানাবে, রাসুলকে জানাবে আমি জান্নাতের খুশবু পাচ্ছি। আমার আনসার ভাইদের বলবে, যদি তোমাদের একটি চোখের স্পন্দন বাকি থাকা অবস্থায় শত্রুরা আল্লাহর রাসুলের কাছে পৌঁছতে পারে, তাহলে আল্লাহপাকের দরবারে তোমাদের কোনো ওজর-আপত্তি কাজে আসবে না।' এ কথা বলার পরই তিনি ইন্তেকাল করেন'" (আর রাহিকুল মাখতুম)।
মহিলারাও রাসুলের প্রতি ভালোবাসার চরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করেছিলেন উহুদের দিনে। ইবনে হিশাম লিখেছেন,
বনু দিনারের আরেক মহিলা তার স্বামী, ভাই ও বাবা উহুদের যুদ্ধে শহীদ হয়েছিল। তাঁকে তাঁর ওই সব আপনজনের নিহত হওয়ার খবর শোনানো হলে সে নির্বিকারভাবে বলল, 'রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কী অবস্থা?' সবাই বলল, তিনি ভালো। তুমি যেমন পছন্দ করো তিনি সে রকমই আছেন। মহিলা বলল, 'রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে একটু দেখাও। আমি তাঁকে দেখে নিই।' তখন রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে দেখানো হলো। মহিলা দেখেই বললেন, 'ইয়া রাসুলাল্লাহ, আপনি নিরাপদে আছেন, এটা দেখার পর আমার কাছে অন্য কোনো মুসিবত নিতান্তই তুচ্ছ
— সিরাতে ইবনে হিশাম
এভাবেই সাহাবায়ে কেরাম নিজেদের জীবনের চেয়েও আল্লাহর রাসুলকে ভালোবেসে তাঁদের ইমান পূর্ণাঙ্গ করেছিলেন।
রাসুল (সা.)-কে রাসুল হিসেবে ভালোবাসা ইমানের অংশ। অন্য কোনো কারণে রাসুলকে ভালোবাসলে সেটা ইমানের দাবি পূর্ণ করে না। হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর ব্যক্তিত্ব, চরিত্র, সত্যবাদিতা, পরোপকার, দয়ার্দ্রতা ইত্যাদি কারণে অনেকেই তাঁকে ভালোবাসত। কিন্তু তারা রাসুল হিসেবে তাঁকে মেনে নেয়নি। ফলে তারা মুমিন হিসেবে গণ্য হবে না। রাসুলের চাচা আবু তালেব রাসুলকে প্রাণাধিক ভালোবাসতেন। কিন্তু সে ভালোবাসা ছিল কুরাইশের একজন আদর্শবান ছেলের প্রতি, নিজ ভাতুষ্পুত্রের প্রতি; আল্লাহর রাসুলের প্রতি নয়। সে কারণে আবু তালেব মুসলমান হিসেবে গণ্য হবেন না । সাহাবায়ে কেরাম আল্লাহর রাসুলকে নিজেদের জীবনের চেয়েও বেশি ভালোবাসতেন। কারণ তাঁরা দেখেছিলেন, রাসুল (সা.) তাঁদের তথা মানুষকে নিজের জীবনের চেয়ে বেশি ভালোবাসতেন।' যে তায়েফবাসীর নিষ্ঠুর নির্যাতন ইতিহাসের পাতায় রক্ত ঝরায়, সেই তায়েফবাসীর শাস্তির জন্য যখন আল্লাহর পক্ষ থেকে ফেরেশতা প্রেরিত হয়েছিল, তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) তাদের পক্ষ থেকে আল্লাহর দরবারে ক্ষমা প্রার্থনা করেছিলেন। রাসুল বলেছিলেন,
আজ তায়েফবাসী আল্লাহর দ্বীনকে অনুধাবন করতে না পারলেও হয়তো তাদের পরবর্তী বংশধর ইসলামের ছায়াতলে সমবেত হবে।
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বর্ণনা করেছেন,
একবার রাসুলুল্লাহ (সা.) আমার থেকে সুরা নিসার তিলাওয়াত শুনছিলেন। যখন আমি এই আয়াতে পৌঁছলাম, কী অবস্থা হবে তখন, যখন প্রত্যেক উম্মতের নবীকে তাদের সম্পর্কে সাক্ষ্যরূপে এবং আপনাকেও আপনার উম্মতের ব্যাপারে সাক্ষীরূপে উপস্থিত করব। এই আয়াতে পেঁৗছামাত্রই রাসুল (সা.) আমাকে তিলাওয়াত বন্ধ করতে বললেন। আমি তাকিয়ে দেখি রাসুল (সা.)-এর দুচোখ থেকে অঝোর ধারায় অশ্রু প্রবাহিত হচ্ছে। হাশরের ময়দানে উম্মতের বিপদের কথা আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে। তা শুনে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর হৃদয় অস্থির হয়ে পড়েছে' ।
— বোখারি
পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে,
নিশ্চয়ই তোমাদের কাছে এমন একজন রাসুল আগমন করেছেন, যিনি তোমাদেরই শ্রেণীভুক্ত। তোমাদের কষ্ট তাঁর জন্য অসহনীয়। তোমাদের মঙ্গল ও কল্যাণের প্রতি তিনি লালায়িত, ইমানদারদের প্রতি অতিশয় দয়ালু'
— সুরা তওবা, আয়াত-১২৮
যে রাসুল উম্মতের ভালোবাসায় জীবনের সব কিছু বিসর্জন দিয়েছেন, তাঁর ভালোবাসা না থাকলে ইমানদার হওয়া যাবে না। এটা খুবই স্বাভাবিক কথা। রাসুলের প্রতি ভালোবাসার অর্থ হলো, রাসুলের সুন্নতকে ভালোবাসা, জীবন দিয়ে হলেও রাসুলের আদর্শ অনুযায়ী জীবন ও সমাজ গড়ে তোলা। মহান আল্লাহ ইরশাদ করেছেন,
হে নবী, আপনি বলে দিন, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালোবেসে থাকো, তাহলে আমাকে অনুসরণ করো। তাহলেই আল্লাহ তোমাদের ভালোবাসবেন'
— সুরা আলে ইমরান, আয়াত-৩১