বিশনু আজ না এচুঁ হেকাইযে মিকুনাদ,
ওয়াজ জুদাই হা শিকাইয়েত মীকুনাদ।
অর্থ: মাওলানা রুমী (রহ:) বলেন, বাঁশের বাঁশি যখন বাজে, তখন তোমরা মন দিয়া শোন, সে কী বলে। সে তাহার বিরহ বেদনায় অনুতপ্ত হইয়া ক্রন্দন করিতেছে।
ভাব: এখানে বাঁশের বাঁশি মানব-রূহের সাথে তুলনা করা হইয়াছে।মানব রূহ আলমে আরওয়াহের মধ্যে আল্লাহর পবিত্র স্থায়ী ভালোবাসায় নিমগ্ন ছিল। ইহ-জগতে আগমন করিয়া পার্থিব বস্তুর ভালোবাসার প্রভাবে আল্লাহর ভালোবাসা ভুলিয়া গিয়াছে। এখন যদি ঐশী ইচ্ছার আকর্ষণে বা কোনো কামেল লোকের সাহচর্যে অথবা কোনো প্রেমের কাহিনী পাঠে নিজের প্রকৃত গুণাবলী ও অবস্থার প্রতি সজাগ হয়, তখন খোদার প্রেমও চিরশান্তির জন্য অনুতপ্ত ও দুঃখিত হইয়া নিজের ভাষায় যে রূপ অনুশোচনা প্রকাশ করে, উহাকেই বাঁশি সুরের সাথে তুলনা করিয়া প্রকাশ করা হইয়াছে।মানব-রূহের বিভিন্ন গুণ আছে। যেমন-মহব্বতে রব্বানী, মারেফাতে ইলাহী ও জেকরে দায়েমী। ইহ-জগতে ইহার প্রত্যেকটিতেই কিছু না কিছু ক্ষতিগ্রস্ত হয় বলিয়া এক একটি স্মরণ করিয়া অনুতপ্ত হইয়া দুঃখ প্রকাশ করিতে থাকে। এইজন্য মাওলানা বলেন, বাঁশি কয়েক প্রকার বিরহের ব্যথা প্রকাশ করিতেছে।
কাজ নাইয়াছতান তা মরা ব বুরিদাহআন্দ,
আজ নফিরাম মরদো জন নালিদাহআন্দ।
অর্থ: বাঁশি বলে আমি বাঁশের ঝাড়ের মধ্যে আপন জনের সাথে সুখে শান্তিতে বসবাস করিতেছিলাম। সেখান থেকে আমাকে কাটিয়া পৃথক করিয়া আনা হইয়াছে। সেই জুদাইর কারণে আমি ব্যথিত হইয়া বিরহ যন্ত্রণায় ক্রন্দন করিতেছি। আমার বিরহ ব্যথায় মানবজাতি সহানুভূতির ক্রন্দন করিতেছে।
ছিনাহ খাহাম শরাহ শরাহ আজ ফেরাক,
তা বগুইয়াম শরেহ দরদে ইশতিয়াক।
অর্থ: বাঁশি বলিতেছে – আমার বিচ্ছেদের ব্যথা অনুভব করার জন্য ভুক্তভোগী অন্তরের আবশ্যক। পাষাণ অন্তঃকরণ আমার যাতনা অনুভব করিতে পারিবে না। তাই, যে অন্তঃকরণ বিচ্ছেদের ব্যথায় টুকরা টুকরা হইয়া গিয়াছে, সেই অন্তঃকরণ পাইলেই আমার ব্যথা ব্যক্ত করিবো। অন্যথায় আমার রোদন বৃথা যাইবে।
ভাব: যে ব্যক্তির রূহ আলমে আরওয়াহের ভালোবাসার কথা স্মরণ করিয়া কাঁদিতেছে, সেই ব্যক্তি-ই বাঁশির সুরের মর্ম অনুধাবন করিয়া মর্মাহত হইবে। অন্য কেহ সুরের মর্ম বুঝিতে পারিবে না।
হরকাছে কো দূরে মানাদ আজ আছলে খেশ,
বাজে জুইয়াদ রোজে গারে ওয়াছলে খেশ।
অর্থ: যে ব্যক্তি নিজের আপনজন হইতে দূরে সরিয়া পড়ে, নিশ্চয়ই সে আপন জনের সাথে মিলিত হইবার জন্য আকাঙ্ক্ষা রাখে। সেই রকম মানব রূহ ও আলমে আরওয়াহের স্থায়ী শান্তি হইতে বহু দূরে সরিয়া পড়িয়াছে, পুনঃ সেই স্থান পাইবার জন্য ব্যাকুল রহিয়াছে।
মান বাহর জামিয়াতে নাঁলানে শোদাম,
জুফতে খোশ হালানো বদ হালানে শোদাম।
অর্থ: বাঁশি বলিতেছে যে আমার দুঃখ ও ক্রন্দনের অবস্থা কাহারও নিকট অপ্রকাশ্য নাই। ভাল-মন্দ প্রত্যেকের নিকট-ই আমার অবস্থা প্রকাশ হইয়া রহিয়াছে।
হরকাছে আজ জন্নে খোদ শোদ ইয়ারে মান
ওয়াজ দরুনে মান না জুস্ত আছরারে মান।
অর্থ: প্রত্যেকেই নিজ নিজ অবস্থা অনুসারে আমার প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করিয়াছে।আমার জন্য দুঃখ প্রকাশ করিয়াছে।কিন্তু আমার অভ্যন্তরীণ প্রকৃত ব্যথা কেহ-ই বুঝিতে পারে নাই। আর কেহ ব্যথার কারণও অন্বেষণ করে নাই।
ছিররে মান আজ নালায়ে মা দূরে নিস্ত,
লেকে চশমো গোশেরা আঁনূরে নিস্ত।
অর্থ: বাঁশি বলিতেছে, আমার ক্রন্দন হইতে ক্রন্দনের রহস্য পৃথক নয়। কিন্তু প্রকাশ্য চক্ষু ও কর্ণে উহা দেখিবার সেই আলো ও শুনিবার সেই শক্তি নাই। অর্থাৎ, শুধু ইন্দ্রিয়ের দ্বারা উহা অনুভব করা যায় না। ইন্দ্রিয়ের সাথে অনুভূতি শক্তির দরকার। যাহার অনুভূতি শক্তি অতি প্রখর, সে-ই আমার ব্যথা অনুভব করিতে পারিবে। যেমন, ক্ষুধার্তের ক্ষুধার জ্বালা ইন্দ্রিয় দ্বারা অনুভব করা যায় না। ভুক্তভোগী ছাড়া অন্যে অনুভব করিতে পারে না। সেই রকম বাঁশির বিরহ ব্যথা ভুক্তভোগী ছাড়া অন্য কেহ বুঝিতে পারে না।
তন জে জান ও জান জেতন মস্তুরে নিস্ত,
লেকে কাছরা দিদে জান দস্তুরে নিস্ত।
অর্থ: উপরোক্ত ভাবকে আরো সম্প্রসারণ করিয়া বলিতেছে যে, যেমন দেহ হইতে আত্মা এবং আত্মা হইতে দেহ দূরে নয়, বরং একত্রিত; কিন্তু কাহকেও কেহ দেখিবার বিধান নাই; সেই রকম আমার কান্না হইতে কান্নার ভেদ ভিন্ন নয়। কান্নার অন্তর্নিহিত কান্নার ভেদ প্রকাশ পাইতেছে। কিন্তু শুধু চক্ষু ও কর্ণ দ্বারা বুঝিবার শক্তি নাই।
আতেশাস্ত ইঁ বাংগে সায়ে ও নিস্তে বাদ,
হরফে ইঁ আতেশে নাদারাদ নিস্তে বাদ।
অর্থ: বাঁশির সুর আগুনের ন্যায় অন্যের অন্তর প্রজ্জ্বলিত করিয়া চলিতেছে। বাঁশির সুরে যাহার অন্তঃকরণ জ্বলিয়া না উঠে, তাহার অন্তঃকরণ না থাকা-ই ভাল। এমন অন্তঃকরণ ধ্বংস হওয়া-ই উত্তম। ভাব: প্রকৃত খোদা-প্রেমিকের সাহচর্যে থাকিলে, তাহার অন্তরেও খোদার প্রেম জাগরিত হইয়া উঠে।
আতেশে ইশ্ কাস্ত কান্দর নায়ে ফাতাদ
জোশশে ইশ্ কাস্ত কান্দর মায়েফাতাদ।
অর্থ: প্রেমের অগ্নি বাঁশির সুরে নিহিত আছে এবং প্রেমের উত্তেজনা শরাবের মধ্যে বিরাজ করিতেছে। ভাব: আল্লাহর মহব্বত পবিত্র শরাব-স্বরূপ। যে ব্যক্তির মধ্যে আল্লাহর মহব্বত জ্বলিয়া উঠে, আল্লাহর জন্য পাগল হইয়া যায়, তাহাকেই আশেকে হাকিকী বলে।
নায়ে হারিফে হরকে আজ ইয়ারে যুরিদ,
পরদাহায়েশ পরদাহায়ে মা দরিদ।
অর্থ: যে ব্যক্তি প্রিয়জনের বিরহ যাতনায় জ্বলিতেছে, সেই ব্যক্তি-ই বাঁশির বন্ধুরূপে পরিগণিত হইয়াছে। মাওলানা রুমী বলিতেছেন, বাঁশির সুরের অন্তর্নিহিত মর্মে আমার অন্তর্নিহিত বেদনা জ্বলিয়া উঠিয়াছে। ভাব: প্রত্যেক মানব-রূহ আলমে আরওয়াহ্ হইতে ইহ-জগতে আসিয়া আল্লাহর মহব্বত হইতে দূরে নিপতিত হইয়া মানব দেহের মধ্যে থাকিয়া সে সর্বদা আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্য বাঁশির ন্যায় ক্রন্দন করিতেছে। কিন্তু, মানবজাতি দুনিয়ার মহব্বতে পড়িয়া উক্ত রূহের অবস্থা অনুভব করিতে পারে না। যদি কোনো কামেল লোকের সাহায্য অবলম্বন করিয়া দুনিয়ার মহব্বত অন্তর হইতে বিদূরিত করিতে পারে, তখন সে রূহের অবস্থা অনুভব করিতে পারিবে।
হামচু নায়ে জহরে ও তরইয়াকে কেদীদ,
হামচু নায়ে ও মছাজে ও মুশ্ তাকে কেদীদ।
অর্থ: বাঁশির সুরের ক্রিয়ার কথা যখন উপরে উল্লেখ করা হইয়াছে, তাই মাওলানা এখন বলিতেছেন, বাঁশির সুরের ন্যায় মৃত অন্তরকে জীবিত করিতে অন্য কোনো তরিয়াক বা অমোঘ ঔষধ নাই। বাঁশির সুরের ন্যায় উপযুক্ত উত্তেজনাকারী আর কিছু দেখা যায় না।
নায়ে হাদীসে রাহে পোর খুন মী কুনাদ,
কেচ্ছাহায়ে ইশকে মজনুন মী কুনাদ।
অর্থ: বাঁশির সুরে প্রেমের রাস্তা রক্তাক্ত করিয়া তুলে। সে প্রকৃত আশেকের অবস্থা বর্ণনা করিতে থাকে।
মোহররমে ইঁ হুশে জুযবে হুশে নিস্ত।
মর জবান রা মুশতারি চুঁ গোশে নিস্ত।
অর্থ: বাঁশির কেচ্ছা দ্বারা ইহা পরিষ্কার বুঝা যায় যে, প্রকৃত আশেকের নিকট মাশুক ব্যতীত অন্য কাহারও খেয়াল না থাকা-ই ইশকের সুস্থ জ্ঞানের লক্ষণ।
ভাব: প্রকৃত খোদা-প্রেমিক খোদা ব্যতীত অন্য কাহারও খেয়াল না করা-ই খাঁটি বান্দার পরিচয়। যেমন – মুখে কথা বলিলে কর্ণেই শুনে, অন্য কোনো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের শুনার অধিকার নাই; সেইরূপ খাটি আশেকের মাশুক ব্যতীত অন্য কাহাকেও তলব করার অধিকার থাকে না।
গার না বুদে নালায়ে নায়ে রা সামার,
নায়ে জাহান রা পুর না করদে আজ শাক্কর।
অর্থ: যদি বাঁশির ক্রন্দনে কোন ফল লাভ না হইত, তবে ইহ-জগতে বাঁশির সুর মধুরতায় পূর্ণ হইত না।
ভাব: আশেকের ইশকের দরুন যাহা লাভ করা যায়, বাঁশির সুরের দরুন উহাই হাসিল করা যায়।
দরগমে মা রোজেহা বেনাহ-শোদ,
রোজেহা বা ছুজেহা হামরাহ শোদ।
অর্থ: বাঁশি বলে, আমার বন্ধুর বিরহ-যাতনার দুঃখে আমার জীবনকাল অনর্থক কাটিতেছে। জীবনকাল দুঃখময় হইয়া অতিবাহিত হইতেছে। ভাব: প্রকৃত বন্ধু অন্বেষণকারী বন্ধুর মিলনেও শান্তি পায় না। কেননা, মিলনের অনেকগুলি স্তর আছে। ঐগুলি অতিক্রম করার জন্য সর্বদা ব্যস্ত থাকে। অতএব, প্রকৃত আশেকের জন্য কোনো অবস্থা-ই শান্তি বা তৃপ্তির নয়। সদা-সর্বদা পরিপূর্ণতা লাভের জন্য ব্যাকুল থাকে।
রোজেহা গার রফত গো রাওবাকে নিস্ত
তু বেমাঁ আযে আঁকে চুঁতু পাকে নিস্ত।
অর্থ: যদিও আমার অতীত জীবন বেহুদা কাটিয়া গিয়াছে, তথাপি আফসোসের কোনো কারণ নাই। কেননা, যাহা বেহুদা ছিল বা বিপদ-আপদ ছিল, তাহা চলিয়া গিয়াছে; এখন খাঁটি ও পবিত্র প্রেম বাকি রহিয়াছে।
ভাব: বহুদিন বিরহ, যাতনা ও বেদনার পর যদি বন্ধুর মিলন হয়, তবে পিছনের দুঃখ-কষ্টের জন্য আফসোস করিতে হয় না। কেননা, যাহা কিছু অনর্থক দুঃখকষ্ট ভোগ করার ছিল তাহা অতিক্রান্ত হইয়া গিয়াছে। এখন শুধু ভালোবাসা বা প্রেম স্থায়ী রহিয়াছে।
হরকে জুজ মাহী জে আবশ ছায়েরে শোদ,
হরকে বেরোজী ইস্ত রোজশ দের শোদ।
অর্থ: এখানে আশেকের প্রকার বর্ণনা করিতে যাইয়া মওলানা বলিতেছেন, এক প্রকার আশেক আছে, যাহারা মাশুকের কিছু প্রাপ্ত হইলেই তৃপ্তি লাভ করে। আরেক প্রকার আছে, যাহারা মাশুককে লাভ করিতে পারে নাই, তাহাদিগকে বে-রুজি বলা হইয়াছে। তাহাদের চেষ্টা বিফল হইয়াছে। তাহাদের জীবন বৃথা অতিবাহিত হইয়া গিয়াছে। উদ্দেশ্য পণ্ড হইয়া গিয়াছে। ভাব: প্রেমিকের জন্য প্রেমের পথে চলিতে কখনও থামিতে হয় না, সর্বদা চলিতে থাকিলেই উদ্দেশ্য সফল হয়। নিরাশ হবার কোনো কারণ নাই।
ওয়ার নাইয়াবদ হালে পোখতাহ হিচে খাম,
পাছ ছুখান কোতাহ বাইয়াদ ওয়াচ্ছালাম।
অর্থ: বিফল ব্যক্তি কখনও সফল ব্যক্তির অবস্থা অনুভব করিতে পারে না। কামেল ব্যক্তির অবস্থা বিনা কামেল-ব্যক্তি কখনও বুঝিতে পারে না। এই জন্য উপরোল্লিখিত পূর্ণ প্রেমের উত্তেজনার ফলাফল বর্ণনা করা এখন সংক্ষেপ করিয়া শেষ করা হইল। শেষ করা-ই উত্তম।
বন্দে বগছাল বাশ আজাদ আয়ে পেছার,
চান্দে বাঁশি বন্দে ছীমো বন্দে জর।
অর্থ: মাওলানা বলেন, ওহে যুবক! তুমি যদি খোদার প্রেমে পরিপূর্ণতা লাভ করিতে চাও, তবে তুমি দুনিয়ার ধন-দৌলত ও স্বর্ণ-রৌপ্যের মহব্বত ত্যাগ কর; তবে খোদার ভালোবাসা লাভ করিতে পারিবে। কেননা, দুনিয়ার ধন-দৌলতের মহব্বত রাখিলে আল্লাহর মহব্বত হাসিল করা যায় না। দুনিয়ার ভালোবাসা আল্লাহর মহব্বত হইতে ফিরাইয়া রাখে।পার্থিব বস্তুর মহব্বত যত কম হইবে, ততই আল্লাহর মহব্বত বেশি হইবে। আস্তে আস্তে, ক্রমান্বয়ে কামেল হইতে থাকিবে।
গার বা রিজি বহরেরা দর কুজায়ে,
চান্দে গুনজাদ কিসমতে এক রোজায়ে।
অর্থ: মাওলানা দুনিয়ার লোভীর পরিণতি সম্বন্ধে বলিতে যাইয়া বলিতেছেন যে, অধিক লালসা করায় কোনো ফলোদয় হয় না। যেমন, সমস্ত সমুদ্রের পানি যদি একটি সামান্য পেয়ালার মধ্যে ঢালা হয়, তবে উহার মধ্যে পেয়ালা আন্দাজ পানি থাকিবে, অতিরিক্ত পানি উহাতে কিছুতেই থাকিবে না; শুধু একদিনের পরিমাণ পানি থাকিতে পারে।
ভাব: এখানে পিয়ালাকে মানুষের অদৃষ্টের সাথে তুলনা করা হইয়াছে। যাহার অদৃষ্টে যে পরিমাণ নির্দিষ্ট করা আছে, উহার চাইতে কিছুতেই সে বেশি পাইবে না। অতএব, অধিক লোভ-লালসায় মত্ত হওয়া কোনো উপকারে আসে না, বরং খোদার মহব্বত হইতে বঞ্চিত হইতে হয়।
কুজায়ে চশমে হারিছান পুর না শোদ,
তা ছাদাপে কানে না শোদ পুর দুর না শোদ।
অর্থ: লোভী ব্যক্তির চক্ষু কোনো সময়েই পরিপূর্ণ হয় না। অর্থাৎ, লালসার আশা মিটে না, কখনও তৃপ্তি লাভ করিতে পারে না। যদি ইহ-জগতে যাহা পায় তাহাতে তৃপ্তি লাভ না করে, তবে ঝিনুকের ন্যায় যদি এক ফোঁটা বৃষ্টি পাইয়া তৃপ্তি লাভ করিয়া মুখ বন্ধ না করে, তাহা হইলে সে কী-রূপে পূর্ণ এক খণ্ড মূল্যবান মুক্তায় পরিণত হইতে পারিবে? অতএব, আল্লাহর তরফ হইতে বান্দার কিসমতে যাহা কিছু মাপা হয়, তাহাতেই সন্তুষ্টি লাভ করিয়া ধৈর্য্ ধারণ করিয়া থাকিলে খোদার প্রিয় বান্দা বলিয়া পরিগণিত হইতে পারে।
হরকেরা জামা জে ইশকে চাকে শোদ,
উ জে হেরচো আয়েবে কুল্লি পাকে শোদ।
অর্থ: যে ব্যক্তির জামা ইশকের কারণে ফাঁড়িয়া গিয়াছে, সে ব্যক্তির অন্তর লোভ-লালসা ও অন্যান্য কু-ধারণা হইতে পবিত্র হইয়া গিয়াছে।
ভাব: যে ব্যক্তির অন্তর খোদার মহব্বতে পরিপূর্ণ হইয়া গিয়াছে, তাহার অন্তঃকরণ হইতে পার্থিব বস্তুর ভালোবাসা দূর হইয়া গিয়াছে। তিনি প্রকৃত কামেল হইতে পারিয়াছেন।
শাদে বশ্ ইশকে খোশ্ ছুদায়ে মা
আয়ে তবিবে জুমলায়ে ইল্লাত হায়ে মা।
অর্থ: এখানে মাওলানা ইশকের প্রশংসা করিতে যাইয়া বলিতেছেন, হে ইশক! তোমাকে ধন্যবাদ দিতেছি। কারণ, তোমার অসিলায় অভ্যন্তরীণ কু-ধারণাসমূহ বিদূরিত হয়। তোমার-ই কারণে অন্তঃকরণ পবিত্র হয়। অতএব, হে চিকিৎসক! তোমাকে আমার আন্তরিক ধন্যবাদ জ্ঞাপণ করিতেছি।
আয়ে দাওয়ায়ে নাখুত ও নামুছে মা,
আয়ে তু আফলাতুনো জালিয়ে নুছেমা।
অর্থ: হে ইশক, তুমি আমার কু-ধারণা ও কু-প্রবৃত্তির ঔষধস্বরূপ। তুমি আমার পক্ষে জালিয়ানুসের ন্যায় একজন বিজ্ঞ ডাক্তার। অর্থাৎ, প্রকৃত প্রেমিক ব্যক্তি কোনো সময়ে অ-সুন্দর বা না-পছন্দ কাজ করিতে পারেন না। খাঁটি প্রেমের কারণে না-পছন্দ গুণসমূহ তাহার অন্তর হইতে বিদূরিত হইয়া যায়।
জেছমে খাক আজ ইশকে বর আফলাকে শোদ,
কুহে দর রকছে আমদ ও চালাক শোদ।
অর্থ: মাটির শরীর খোদার ইশকের দরুন আকাশ ভ্রমণ করিয়াছে। মুছা (আঃ)-এর ইশকের দৃষ্টিতে তূর পর্বতের প্রাণ সঞ্চার হইয়াছিল এবং ইশকের জোশে ফাটিয়া চূর্ণ-বিচূর্ণ হইয়া গিয়াছিল ও হজরত মূছা (আ:) বে-হুশ হইয়া রহিলেন।
ইশকে জানে তুরে আমদ আশেকা,
তুরে মস্তো খাররা মুছা ছায়েকা।
অর্থ: পরবর্তী লাইন-দ্বয়ে মাওলানা পরিষ্কার করিয়া বর্ণনা করিয়া দিয়াছেন, যেমন হজরত মূসা (আ:)-এর খোদার প্রেমপূর্ণ দৃষ্টি যখন তূর পর্বতের উপর পতিত হইল, তখন-ই তূর পর্বত ইশকের ক্রিয়ায় নড়া-চড়ার শক্তি পাইল এবং নাচিতে আরম্ভ করিল। অবশেষে সে চূর্ণ-বিচূর্ণ হইয়া পড়িল এবং মূসা (আঃ) খোদার জ্যোতির প্রভাবে বে-হুশ হইয়া রহিলেন।
বা লবে ও মছাজে খোদ গার জোফতামে,
হামচু নায়ে মান গোফতানিহা গোফতামে।
অর্থ: উপরোক্ত লাইন-দ্বয়ে মাওলানা ইশকের ফজিলত ও শওকাত বর্ণনা করিতেছিলেন এবং খুব ভালভাবে ইশকের মরতবা বর্ণনা করার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু, তিনি যখন ভাবিলেন যে ইশকের রহস্য ও শওকাত বাহ্যিক ইন্দ্রিয় দ্বারা অনুভব করা সম্ভব নয়, প্রকৃত আশেক না হইলে ইশকের স্বাদ গ্রহণ করিতে পারে না; ইশকের মধ্যে এমন গুরুত্বপূণ রহস্য আছে, যাহা বয়ান করিলে কোনো কোনো লোক বেঈমান হইয়া যাইবার আশষ্কা আছে, তখন তিনি নিজের কৈফিয়ৎ হিসাবে ওজর বর্ণনা করিতেছেন যে যদি আমার সম্মুখে আমার বর্ণনা শুনার জন্য কোনো খাঁটি আশেক থাকিত, তবে আমি বাঁশির ন্যায় ইশকের কেচ্ছা বর্ণনা করিতাম।
হরফে উ আজ হামজবানে শোদ জুদা,
বে নাওয়া শোদ গারচে দারাদ ছদ নাওয়া।
অর্থ: যে ব্যক্তি নিজের ভাষা-ভাষী হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া পড়ে, তখন সে সম্বলহীন অবস্থায় অসহায় হইয়া পড়ে। যদিও তাহার নিকট শত ধন-দৌলত থাকে, তথাপিও সে নিজেকে অসহায় মনে করে। কেননা, সে নিজের মনোবাসনা প্রকাশ করিতে পারে না।
চুঁকে গোল রফতো গুলিস্তান দর গুজাস্ত,
নাশ নুবি জীঁ পাছ জে বুলবুল ছার গুজাস্ত।
অর্থ: মাওলানা উপরোক্ত ভাবের বর্ণনায় দৃষ্টান্ত দিয়া বলিতেছেন, দেখ, যখন ফুল ফোটার মৌসুম চলিয়া যায়, তখন ফুলের বাগিচা ফুলশূন্য হইয়া পড়ে এবং দেখিতে অসুন্দর দেখায়। বুলবুল পাখি আর গান করিতে আসে না। কারণ ফুলের সুঘ্রাণের আকর্ষণে সে গান করিতে আসিত। এখন ফুল ফোটে না আর সে-ও গান গাহিতে আসে না। এইরূপভাবে যদি শ্রোতা আকর্ষণকারী প্রেমিক না হয়, তবে বর্ণনাকারীও বর্ণনা করিতে স্বাদ পায় না। অতএব, বর্ণনা হইতে বিরত থাকে।
ছেররে পেনহা নাস্ত আন্দর জীরো বাম,
ফাশ আগার গুইয়াম জাহাঁ বরহাম জানাম।
অর্থ: মাওলানা বলিতেছেন, আমি যে কাহিনী চুপে চুপে নিম্নস্বরে বা উচ্চস্বরে বর্ণনা করিতেছি, ইহার ভেদ ও রহস্য আওয়াজের ভিতরে নিহিত আছে। যদি প্রকাশ্যে বর্ণনা করি, তবে সমস্ত জাহান ধ্বংস হইয়া যাইবে।
আঁচে নায়ে মী গুইয়াদ আন্দরইঁ দো বাব,
গার বগুইয়াম মান জাহাঁ গরদাদ খারাব।
অর্থ: যাহা কিছু বাঁশি উচ্চস্বরে ও নিম্নস্বরে ব্যক্ত করিতেছে, আমি যদি উহা ব্যক্ত করি, তবে ইহ-জগৎ ধ্বংস হইয়া যাইবে।
ভাব: বাঁশির সুরে নিহিত রহস্য ইহাই প্রকাশ করিতেছে যে, এই বিশ্বে এক আল্লাহতায়ালা ব্যতীত অন্য কিছুরই অস্তিত্ব দেখা যায় না। যাহা কিছু বিরাজ করিতেছে, সবই আল্লাহর অস্তিত্ব মা ছেওয়ায়ে আল্লাহর কিছুই দেখা যায় না। বিশ্বে যাহা কিছু সৃষ্টি করা হইয়াছে সবই মানুষের জন্য। যদি মানুষ না থাকে, তবে কিছুই থাকিবে না। যেমন আল্লাহতায়ালা বলিয়াছেন, যদি আমি মানুষের কর্মফলের দরুন সবাইকে উঠাইয়া নেই, তবে পৃথিবীর বুকে অন্য কোন প্রাণী দেখিতে পাইবে না।
জুমলা মা শু কাস্ত ও আশেক পরদাহই,
জেন্দাহ মা শু কাস্ত ও আশেক মোরদাহই।
অর্থ: মাওলানা বলিতেছেন, এই পৃথিবীতে যাহা কিছু দেখিতেছ, সবই আল্লাহর অস্তিত্বের নমুনা, সবই আল্লাহর। খাঁটি আল্লাহর আশেক যাহারা, তাহাদের পক্ষে যাহা কিছু দেখা যায়, সবই আল্লাহর নমুনা। সেইজন্য মাওলানা এখানে সকলকেই মাশুক বলিয়াছেন। অর্থাৎ, প্রেমিকের পক্ষে ইহ-জগতের সবই মাশুক। সকলকেই ভালবাসিবে। কিন্তু মানুষ আশেক; আশেকের মন পার্থিব বস্তুর আকর্ষণে নিহিত, আল্লাহর মহব্বতকে অনুভব করিতে পারে না। এইজন্য আশেককে পর্দার আড়ালে বলিয়াছেন। অর্থাৎ পৃথিবীর সকল বস্তুই মাশুক, কিন্তু আশেক পর্দার আড়ালে রহিয়াছে। মাশুককে চক্ষে দেখে না। এইজন্য দ্বিতীয় লাইনে বলা হইয়াছে যে, মাশুক জীবিত বিদ্যমান। কিন্তু আশেকরা মৃত অবস্থায় আছে। জীবিত থাকিয়াও মৃত্যের ন্যায় কোন কাজ করিতেছে না।
ভাব: ইহ-জগতে যাহা কিছু খোদার সৃষ্টি দেখা যায়, সবই খোদার কীর্তিকলাপ। ইহা দেখিয়া খোদাকে পাইবার জন্য ব্যাকুল হইয়া উঠিতে হয়। কিন্তু মানুষ ইহ-জগতের লোভ লালসায় মত্ত হইয়া খোদাকে ভুলিয়া রহিয়াছে। তাই মানুষকে মৃত বলিয়া আখ্যা দেওয়া হইয়াছে।
চুঁ নাবাশদ ইশকেরা পরওয়ায়ে উ,
উঁচু মোরগে মানাদ বে পরওয়ায়ে উ।
অর্থ: যদি ইশক বা মহব্বতের কোনো ক্রিয়া না থাকিত, তবে বান্দাগণ পাখাবিহীন পাখির ন্যায় অসহায় অবস্থায় পড়িত।
ভাব: ইশকের দরুন বান্দাহ্ আল্লাহর নৈকট্য লাভ করিতে পারে। যদি ইশকের কোনো তাসির না হইত, তবে মানুষ খোদার নৈকট্য লাভ করিতে পারিত না। পাখাশূন্য পাখির ন্যায় দুর্দশায় পতিত হইত। কখনও আল্লাহর প্রিয় বান্দাহ হইতে পারিত না।
মানচে গুনা হুশে দারাম পেশ ও পাছ,
চুঁ নাবাশদ নূরে ইয়ারাম হাম নফছ।
অর্থ: মাওলানা বলিতেছেন, যদি আল্লাহর তরফ হইতে আমার প্রতি ইশকের নূরের সাহায্য বর্ষিত না হয়, তবে আমার ভূত ও ভবিষ্যৎকাল কেমন করিয়া শান্তিতে কাটিবে? পদে পদে আমার শত্রুরা সজাগ আছে, যদি মেহেরবান খোদা আমাকে রক্ষা না করেন, তবে আমার ধ্বংস অনিবার্য।
নূরে উদর ইয়ামন ওইয়াছার ও তাহাতো ফাউক,
বর ছারো বর গেরদানাম মানান্দ তাউক।
অর্থ: মাওলানা আল্লাহর নূরের সাহায্যের কথা বর্ণনা করিতে যাইয়া বলিতেছেন, আল্লাহর নূরের দান ও রহমত আমাকে বেষ্টন করিয়া রাখিয়াছে। আমার ডাইন-বাম ও উপর-নিচ চতুর্দিক দিয়াই আল্লাহর নূরে ঘিরিয়া আছে। কোনো অবস্থায়েই আমি আল্লাহর দানের বাহিরে নহি।
ইশক খাহাদ কেইঁ চুখান বিরুঁ রওয়াদ,
আয়নায়ে গাম্মাজ নাবুদ চুঁ বওযাদ।
অর্থ: মাওলানা বলেন, ইশকের কাহিনী বহু লম্বা-চওড়া, উহার কোনো সীমা নাই। কারণ, আল্লাহতায়ালা অসীম। তাঁহার কাহিনীও সীমাহীন। ইহা অনুভব করার জন্য পুতঃপবিত্র অন্তর চাই। সাধারণের ইহা বুঝিবার শক্তি নাই। তাই সংক্ষেপ করিলাম। পরিষ্কার আয়না না হইলে যেভাবে প্রতিচ্ছবি সঠিক পতিত হয় না, সেইরূপ পবিত্র অন্তর না হইলে খোদার প্রেমের কাহিনীর রহস্য সঠিক অনুধাবন করিতে পারে না।
আয়ে নাত দানি চেরা গাম্মাজ নিস্ত,
জাঁকে জংগার আজ রোখশে মোমতাজ নিস্ত।
অর্থ: শ্রোতাগণ ইশকের কাহিনী পরিপূর্ণভাবে অনুধাবন করিতেছে না কেন? মওলানা উহার কারণ ব্যাখ্যা করিতেছেন যে, শ্রোতাদের অন্তঃকরণ পবিত্র নাই। দুনিয়ার মহব্বতের কারণে অন্তরে মরিচা পড়িয়া গিয়াছে। অন্তর হইতে আল্লাহর মহব্বতের আলো বাহির হয় না। তাই, আল্লাহর মহব্বতের আকর্ষণ পাইতেছে না, অন্ধকারে রহিয়াছে।
আয়নায়ে কাজ জংগো আলায়েশ জুদাস্ত,
পুর শোয়ায়ে নূরে খুরশীদে খোদাস্ত।
অর্থ: মাওলানা পবিত্র অন্তঃকরণের বর্ণনা করিতে যাইয়া বলিতেছেন, যে সকল অন্তঃকরণ ময়লা ও আবর্জনা হইতে পবিত্র ও পরিষ্কার, ঐসব অন্তঃকরণ আল্লাহর নূরে আলোকিত থাকে। এবং তাহাদের উপর আল্লাহর অনুগ্রহ বর্ষণ হইতে থাকে।
রাও তু জংগার আজ রুখে উ পাকে কুন,
বাদে আজাঁ আ নূরে রা ইদরাকে কুন।
অর্থ: মাওলানা বলিতেছেন, তোমাদের অন্তরকে ময়লা ও মরিচা হইতে পরিষ্কার করা উচিত। অন্তঃকরণ পবিত্র কর, তবে দেখিতে পাইবে যে, তোমার অন্তর আল্লাহর নূরে আলোকিত হইয়া গিয়াছে। আল্লাহর মহব্বতে দেল পরিপূর্ণ হইয়া গিয়াছে।