তায়ফায়ে নাখ্চির দর ওয়াদিয়ে খেশ,
বুদে শাঁ আজ শেরে দায়েম কাশমা কাশ।
বছকে আঁ শের আজ কমিনে দরমী রেবুদ,
আঁ চেরা বর জুমলা না খোশ গাস্তাহ্ বুদ।
হীলা কর দান্দ আমদান্দ ইঁশা ব শের,
কাজ ওজীফা মা তোরা দারেম ছায়ের।
যুজ ওজীফা দর পায়ে ছায়েদে মইয়া,
তা না গরদাদ তলখে বরমা ইঁ গোয়া।
অর্থ: কোনো এক জঙ্গলে বন্য পশুরা বাস করিত, কিন্তু একটা বাঘের উৎপাতে ইহারা বিপদগ্রস্ত ছিল। বাঘ যে সময় ইচ্ছা করিত সেই সময়ই আসিয়া পশুদের যাহাকে ইচ্ছা বদ করিয়া লইয়া যাইত। এই জন্য ঐ জায়গায় চারণভূমি পশুদের নিকট অশান্তিদায়ক মনে হইত। অবশেষে সমস্ত পশুরা পরামর্শ করিয়া একটি পদ্ধতি ঠিক করিয়া বাঘের নিকট যাইয়া বলিল, আমরা আপনার দৈনিক খোরাক নির্ধারিত করিয়া দেই। ধারাবাহিকভাবে নিয়মিত আপনার কাছে খাদ্য আসিয়া পৌঁছিবে এবং আপনি সর্বদা উহা খাইয়া তৃপ্তিলাভ করিতে পারিবেন। অতএব, আপনার দৈনিক সাধারণ খাদ্যের জন্য শিকার করিতে আসিবেন না। কারণ, তাহাতে আমাদের নিকট এই সবুজ ভূমি ভীতিজনক ও অশান্তিদায়ক বলিয়া মনে হয়।
গোফ্ ত আরেগার ওফা বীনাম না মকর,
মক্রেহা বছ দীদাম আজ জীদো ও বকর
মান্ হালাকে ফেলো ও মকরে মর দমাম্
মান গোজিদাহ্ জখ্মে মারো ও কাজ দমাম্।
নফ্ছে হরদম আজ দরুনাম দর কামীন।
আজ হামা মরদাম তবরে দর মক্রো ও কীন।
গোশে মান্ লা ইউল দাগুল মোমেনে শানীদ,
কউলে পয়গম্বর বজানো ও দেল গোজীদ।
অর্থ: বাঘ উত্তর করিল যে, তোমাদের প্রস্তাব মানিয়া নিতে কোনো ক্ষতি নাই। কিন্তু আমাকে দেখিয়া নিতে হইবে, তোমরা তোমাদের প্রতিজ্ঞা পূর্ণ কর কি না? অথবা ইহার মধ্যে তোমাদের ধোকাবাজী আছে কি না? কেননা, আমার এই বয়সে আমি বহুত লোকের ধোকাবাজী দেখিয়াছি এবং অনেক প্রকার লোকের ধোকায় ও ফেরেববাজীতে পড়িয়া অনেক মার খাইয়াছি। অনেক ক্ষতিকারক বস্তুর আঘাতপ্রাপ্ত হইয়াছি। এইজন্য এখন আর আমার বিশ্বাস হয় না। মাওলানা এই প্রসঙ্গে বলিতেছেন, এই রকমভাবে প্রত্যেকের অন্তরে নফস্ ওত পাতিয়া বসিয়া রহিয়াছে। সুযোগ বুঝিয়া প্রত্যেককে ধোকা দিতে ও হিংসা করিতে প্রেরণা যোগায়। তাহার পর বাঘের কথা উল্লেখ করিয়া বলিতেছেন, বাঘ বলিল, আমার কর্ণে ঐ কথা শুনিয়াছি যে মোমেন ব্যক্তি দ্বিতীয়বার বিপদে পদক্ষেপ করেন না। অর্থাৎ, যে কাজে একবার বিপদ ঘটিয়াছে, সেই কাজ মোমেন ব্যক্তি দ্বিতীয়বার করেন না। অতএব, আমি যখন লোকের বিশ্বাসঘাতকতা দেখিয়াছি, তখন উহার উপর বিশ্বাস স্থাপন করা ভুল হইবে। আমি পয়গম্বর (দ:)-এর কথা জান ও দেল দিয়া গ্রহণ করিয়া লইয়াছি। এখন আর কাহারো কথায় কর্ণপাত করি না।
জুম্লা গোফ্তান্দ আয় আমীরে বা খবর,
আল হজর দায়া লাইছা ইয়াগনী আন্কদর।
দর হজর শুরিদানে শুর ও শর আস্ত,
রাও তাওয়াক্কুল কুন তাওয়াক্কুল বেহতেরাস্ত।
বা কাজা পানজাহ্ মজান আয়তন্দ ও তেজ,
তা না গিরাদ হাম কাজা বাতু ছেতীজ।
মুরদাহ্ বাইয়াদ বুদে পেশে আমরে হক,
তা নাইয়ায়েদ জখমে আজ রব্বেল ফালাক।
অর্থ: সমস্ত বন্য পশুরা বলিল, আপনি সকল ভয় ও সন্দেহ ত্যাগ করুন। কেননা, ভীতি ও সন্দেহ তক্দীরের বিরুদ্ধে কিছুই করিতে পারিবে না। সন্দেহ করার মধ্যে শুধু হৈ চৈ ছাড়া কিছুই হয় না। তাওয়াক্কুল করা চাই, তাওয়াক্কুল-ই উত্তম। কাজা ও কদরের বিরুদ্ধাচরণ করিবেন না। তাহা হইলে কাজা ও কদর আপনার প্রতি অশান্তি দান করিবে। আল্লাহতায়ালার আদেশের সম্মুখে একদম মৃত্যের ন্যায় হইয়া যাইবেন। তাহা হইলে আল্লাহর তরফ হইতে আপনার কোনো কষ্ট হইবে না।
গোফ্তে আরে গার তাওয়াক্কুল বেহতেরাস্ত,
ইঁ ছবাব হাম ছুন্নাতে পয়গম্বরাস্ত।
গোফ্তে পয়গম্বর বা আওয়াজে বলন্দ,
বা তাওয়াক্কুল জানুয়ে আশ্তর বা বন্দ।
রমজেল কাছেবে হাবিবাল্লাহ শোনো,
আজ তাওয়াক্কুল দের ছবাবে কাহেল মানো।
দর তাওয়াক্কুল জোহোদো ও কছবো আওলাতরাস্ত,
তা হাবিবে হক্কে শওবী ইঁ বেহ্তরাস্ত।
রো তাওয়াক্কুল কুন তু বা কছবে আয় আমু,
জোহ্দে মীকুন কছবে মীকুন মু বমো।
জোহ্দে কুন জেন্দে নুমা তা ওয়ার হী,
ওয়ার তু আজ জোহদাশ বেমানী আবলাহী।
অর্থ: বাঘে উত্তর করিল, তোমাদের কথা সর্বজন মান্য এই মর্মে যে, তাওয়াক্কুল অতি উত্তম বস্তু। কিন্তু অসীলা অবলম্বন করাও শেষ পর্যন্ত নবী (দ:)-এর সুন্নাত। যেমন একদিন এক ব্যক্তি উটে আরোহণ করিয়া আসিয়া মসজিদে নববীর দরজার উপর উট বসাইয়া রাখিয়াছিল, কোনো রশি দিয়া বাঁধিয়া রাখে নেই। তাহাকে তখন নবী করিম (দ:) উচ্চস্বরে বলিয়াছিলেন, শুধু তাওয়াক্কুল করিও না। তাওয়াক্কুলের সহিত রশি দিয়া জানোয়ারও বাঁধিয়া রাখ, যাহাতে হাঁটিয়া যাইতে না পারে। কষ্ট করিয়া অর্জনকারীকে আল্লাহর বন্ধু বলা হয়। ইহা দ্বারা কষ্ট করিয়া অর্জন করার মহত্ব অনুমান করিতে পারা যায়। তাওয়াক্কুল করার দরুন চেষ্টা করার মধ্যে অলসতা করিও না। তাওয়াক্কুলের অবস্থায়ও চেষ্টা করা ও অর্জন করা উত্তম। তাহা হইলে তুমি হাবীবুল্লাহ, অর্থাৎ, আল্লাহর বন্ধুরূপে পরিগণিত হইতে পারিবে। অতএব, তাওয়াক্কুল কষ্ট করিয়া কামাই করার সহিত করা চাই। চেষ্টা ও তদবীর অতি উত্তমরূপে করা চাই, তবেই অলসতা হইতে মুক্তি পাইবে। আর যদি চেষ্টা ও তদবীর যাহাকে আল্লাহতায়ালা অসীলা নির্দিষ্ট করিয়া দিয়াছেন, উহা হইতে বিরত থাক, তবে বোকা বলিয়া বিবেচিত হইবে।
কওমে গোফ্ তান্দাশ ছবাবে আজ জুয়ুখে ফলক,
লোকমায়ে তাজবীরে দাঁ বর কদরে হলক।
পাছ বেদাঁকে কছবেহা আজ জুয়োফে খাছাস্ত,
দর তাওয়াক্কুল তাকিয়া বর গায়েরে খাতাস্ত।
নিস্তে কছবে আজ তাওয়াক্কুল খুবে তর,
চীস্ত আজ তাছলীমে খোদ মাহবুব তর।
বছ গরীজান্দ আজ বালা ছুয়ে বালা,
বছ জাম্বাদ আজ মারে ছুয়ে আজদাহা।
হলিা ফরদ ইনছানো ও হীলাশ দামে বুদ,
আঁফে জান পেন্দাস্ত খুনে আশাম বুদ।
দরবাবস্ত ও দুশমন আন্দরখানা বুদ।
হীলায়ে ফেরআউন জেইঁ আফছানা বুদ।
ছদ্ হাজারানে তেফলে কোশ্ত আঁকীনা কাশ,
ও আঁকে উ মী জুস্ত আন্দার খানাশ।
অর্থ: বন্য পশুরা বলিল, সাবাব বা অসীলা প্রচলিত হওয়ায় লোকের সৎসাহস কমিয়া গিয়াছে। যেমন খাদ্যের লোকমা হলকুমের (কণ্ঠনালির) আন্দাজে তৈয়ার করা হয়। রোগীর পথ্য খাদ্যের নামে প্রস্তুত করা হয়। কেননা, পুষ্টিকর শক্তিশালী খাদ্য হজম করিতে পারিবে না বলিয়া হালকা হজমের খাদ্য তৈয়ার করিয়া দেওয়া হয়। অতএব, জানিয়া রাখ, চেষ্টা তদবীর শুধু দুর্বলদের জন্য সৃষ্টি করা হইয়াছে। না হইলে তাওয়াক্কুলের মধ্যে অন্যের উপর ভরসা করা অত্যন্ত দোষ। কেননা, আসবাব তো অন্যই। তাই তাওয়াক্কুল ব্যতীত অন্য কিছু্ই উত্তম হইতে পারে না। উপরন্তু, নিজেকে খোদার নিকট সমর্পণ করিয়া দেওয়ার চাইতে আর কী উত্তম হইতে পারে? অনেক মানুষ এমন আছে যে, বিপদ হইতে ভাগিয়া বিপদের মধ্যেই পতিত হয়। যেমন সাপের ভয়ে পালাইয়া আজদাহার নিকট যাইয়া উপস্থিত হয়। অর্থাৎ, মানুষে নিজের ভালাইর জন্য তদবীর করে। কিন্তু ঐ তদবীর-ই তাহার জন্য ফাঁদ হইয়া দেখা দেয়। যাহাকে বন্ধু মনে করিয়াছিল, সে-ই ঘাতক বলিয়া প্রমাণিত হয়। এইরূপ দৃষ্টান্ত হইতে পারে যে, কেহ শত্রুর ভয়ে ঘরের দরজা বন্ধ করিল। ঘটনাক্রমে ঘরের মধ্যেই শত্রু রহিয়া গেল। যেমন ফেরাউনের চেষ্টাও এই প্রকারের ছিল। লক্ষ লক্ষ শিশু বাচ্চা হত্যা করিয়া ফেলিল, কিন্তু যাহাকে হত্যা করার উদ্দেশ্য ছিল, সে তাহার ঘরেই ছিল, অর্থাৎ, হজরত মূসা (আ:)। ইহা দ্বারা বুঝা যায় যে, চেষ্টা ও তদবীর দ্বারা কিছুই ফল লাভ করা যায় না।
দীদায়ে মা চুঁ বছে ইল্লাতে দরুস্ত,
রউফানা কুন দীদে খোদ দর দীদে দোস্ত।
দীদে মারা দীদে উ নেয়ামূল এউজ,
ইয়াবি আন্দার দীদে উ কুল্লি গরজ।
তেফ্লে তা গীর উ তা পুইয়া না বুদ।
মারকাবাশ জয্ গরদানে বাবা না বুদ।
চুঁ ফজুলি করদো ও দস্তো পা নামুদ,
দর ইনা উফ্তাদ ও কোরো ও কাবুদ।
অর্থ: যখন আমাদের চেষ্টা ও তদবীরের মধ্যে হাজারো খারাবি দেখা যায়, তখন আমাদের চেষ্টা ও তদবীর আল্লাহর নিকট সমর্পণ করাই উত্তম। ইহাকেই তাওয়াক্কুল বলা হয়। কেননা, আল্লাহর তদবীর আমাদের তদবীরের পরিবর্তে কত উত্তম। যদি আমাদের চেষ্টা ও তদবীর ত্যাগ করিয়া দেই, তবে আল্লাহ আমাদের জন্য বন্দোবস্ত করিবেন এবং তাঁহার তদবীরের মারফত আমরা সব কিছুই হাসেল করিতে পারিব। ইহার দৃষ্টান্ত, যেমন বাচ্চা যখন পর্যন্ত হাত দিয়া ধরিতে না শিখে এবং পা দিয়া হাঁটিতে না পারে, ততদিন পর্যন্ত ধাইমার কাঁধে চড়িয়া বেড়ায়। যদি নিজে ইচ্ছা করিয়া হাত পা বাড়ায় তবে কষ্টে পতিত হয়। ঐরূপভাবে বান্দারও একই অবস্থা; যদি তাওয়াক্কুল করিয়া হাত পা শূন্য হইয়া যায়, তবে আল্লাহ তাহার জন্য সাহায্যকারী হইয়া যান। আর যে ব্যক্তি নিজে নিজে কামাই রোজগারের চেষ্টা ও তদবীর করে, সে নিজেই নিজের জিম্মাদার হইয়া যায়।
জানে হায়ে খলকে পেশ আজ দস্তো পা,
মী পরিদান্দ আজ ওফা ছুয়ে ছাফা।
চুঁ বা আমরে ইহ্বেতু বন্দি শোদান্দ,
হাবছে খশমো ও হেরছো খো রছান্দি শোদান্দ।
বা আয়ালে হজরতেম ও শের খাহ্,
গোফ্তেল খলকে আয়ালুন লিল ইলাহ্।
আঁ কে উ আজ আছমান বারাঁ দেহাদ,
হাম তাওয়ানাদ কো জে রহমত নানে দেহাদ।
অর্থ: মাওলানা বলেন, আমাদের রূহসমূহ দেহের মধ্যে আবদ্ধ হওয়ার আগে আল্লাহর মহব্বতে আল্লাহর দরবারে উড়িতেছিল। যখন আল্লাহর আদেশে দেহের মধ্যে আবদ্ধ হইল, তখন হইতেই রূহসমূহ মানবিক গুণে, অর্থাৎ, লোভ, লালসা, ক্রোধ ও খুশীর গুণে গুণান্বিত হইল এবং আল্মে সাফা হইতে অবতরণ করিয়া এই দুনিয়ায় আসিল। মাওলানা বলেন, আমরা ঐ আলমে আরওয়াহর মধ্যে খোদার নিকট শিশু বাচ্চার ন্যায় দুধ পান করিতাম। হাত পায়ের কোনো প্রয়োজন ছিল না। উড়িয়া বেড়াইতাম। মহা আনন্দে কাল কাটাইতাম। সেইখান থেকে পৃথক হইয়া আসিয়া আমরা দুঃখজনক অবস্থায় পতিত হইয়াছি। তাই আমাদের রূহ সর্বদা বিরহ বেদনায় কাঁদিয়া কাটাইতেছে। যেমন, এই ’মসনবী’র প্রথমেই বিরহ বেদনার কথা উল্লেখ করা হইয়াছে। আমরা যেমন আলমে আরওয়াহের মধ্যে হাত-পা হীন অবস্থায় আল্লাহর প্রতিপালনে ও তাঁহার হেফাজতে ছিলাম। এখন হাত পা থাকা অবস্থায়ও সেই রকম থাকাই ভাল। আল্লাহর কাছেই আমরা আমাদের রোজীর প্রার্থনা করিব। তদবীর কেন করিব? কেননা, আল্লাহ নিজেই আসমান হইতে বৃষ্টি দান করেন, যদ্বারা আমরা কৃষির কাজ করি। তিনি ইহাও পারেন যে, তাঁহার রহমত দ্বারা আমাদিগকে রুটি দান করিবেন। আমরা সোজা পথে ইহা কামনা করিব না কেন?
রোজে দীগার ওয়াক্তে দউয়ানো ও লেকা,
শাহ ছোলাইমান গোফ্তে আজরাইল রা।
কা আঁ মোছলমান রা বখশমে আজ চেছবাব,
বেংগরিদী বাজে গো আয় পেকে রব।
আয় আজব ইঁ করদাহ বাশী বহরে আঁ
তা শওয়াদ আওয়ারাহ্ উ আজ খানোমান।
গোফতাশ আয় শাহে জাহাঁ বজওয়াল,
ফাহ্মে কাজ কর্দ ও নামুদ উ রা খেয়াল।
মান দরু আজ খশমে কায়ে করদাম নজর,
আজ তায়াজ্জুব দীদামাশ দররাহে গোজার।
কে মরা ফরমুদে হক কা মরো জেহাঁ,
জানে উ রা তু ব হিন্দুস্তান ছেতা।
দীদামাশ ইঁজা ও বছ হয়রাণ শোদাম,
দর তাফাক্কুর রফতাহ্ ছার গরদান শোদাম।
আজ আজব গোফতাম গার উ রা ছদ পোরুস্ত,
জু বা হিন্দাস্তান শোদান দূর আন্দারাত।
চুঁ বা আমরে হক ব হিন্দুস্তান শোদাম,
দীদামাশ আঁজা ও জানাশ বছতাদাম।
তু হামা কারে জাহাঁ রা হাম চুনিঁ,
কুন কিয়াছ ও চশমে ব কোশাও বা বীনিঁ।
আজ কে ব গোরিজেম আজ খোদ আয় মহাল,
আজ কে বর তা বেম আজ হক আয় ওবাল।
অর্থ: দ্বিতীয় দিন হজরত সোলাইমান (আ:) যখন দরবারে বসিলেন এবং হজরত আজরাইল (আ:)-এর সাথে সাক্ষাৎ হইল, তখন হজরত সোলাইমান (আ:) হজরত আজরাইল (আ:)-কে জিজ্ঞাসা করিলেন, কী কারণে আপনি ঐ গরীব মোসলমান বেচারাকে ক্রোধের দৃষ্টিতে দেখিলেন? ইহা বড় আশ্চর্যের ব্যাপার। এইজন্য কি আপনি তাহার প্রতি কুপিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়াছেন যে, তাহার মান-ইজ্জাত হইতে বিমুখ করিয়া দিতে চান? হজরত আজরাইল (আ:) উত্তর করিলেন, হে দীনের বাদশাহ! সে ব্যক্তি ভুল বুঝিয়াছে, আমার ক্রোধান্বিত হওয়া তাহার খেয়ালের বুঝ। নচেৎ আমি তাহাকে কখন ক্রোধের নজরে দেখিয়াছি? বরং তাহাকে আমি শুধু রাস্তায় চলিতে দেখিয়া আশ্চর্যান্বিত হইয়াছি। কেননা, আল্লাহতায়ালা আমাকে আদেশ করিয়াছেন যে তাহাকে আজ হিন্দুস্তানে বসিয়া জান কবজ করিয়া আনো। তাই আমি এখন তাহাকে এখানে দেখিয়া হয়রান হইয়া পড়িয়াছি এবং চিন্তায় মাথা ঘুরিতেছিল। আশ্চর্যান্বিত হইয়া বলিতেছিলাম, যদি ইহার হাজারো পাখা বাহির হইয়া আসে তবুও সে হিন্দুস্তানে যাইয়া পৌঁছিতে পারিবে না। তারপর যখন হিন্দুস্তানে যাইয়া পৌঁছিল, এবং আমিও যাইয়া সেখানে তাহাকে পাইলাম, জান কবজ করিয়া লইলাম। মওলানা এখন নসীহাতচ্ছলে বলিতেছেন যে, তোমরা সমগ্র পৃথিবীর কাণ্ডকারখানা এই রকমভাবে মনে করিয়া লও এবং ভালভাবে অনুমান করিয়া লও, চক্ষু খুলিয়া দেখিয়া লও যে, বান্দা তাকদীর হইতে ভাগিয়া যাইয়া তাকদীরের জালেই আবদ্ধ হইল। আমরা কী হইতে ভাগিয়া যাই? নিজের ধাত হইতে ভাগিয়া যাই? ইহা সম্পূর্ণ অসম্ভব। অর্থাৎ, যেমন নিজের জ্ঞান হইতে ভাগিয়া যাওয়া অসম্ভব, সেই রকম আল্লাহতায়ালা, যিনি জানের চাইতেও নিকটবর্তী তাঁহার নিকট হইতে ভাগিয়া যাওয়া আরো অসম্ভব। দ্বিতীয় পংক্তিতে পরিষ্কার করিয়া বলা হইয়াছে যে, আমরা কাহার নিকট হইতে মুখ ফিরাইয়া লই? আল্লাহর নিকট হইতে? ইহা মস্ত বড় বিপদের কথা।
শের গোফ্তে আরে ওয়ালেকীন হাম বা বীন,
জোহদ হায়ে আম্বিয়া ও মুরছালীন।
ছায়ীয়ে আবরারো জেহাদে মোমেনাঁ,
তাবদীঁ ছায়াতে জে আগাজে জাহাঁ।
হক তায়ালা জোহ্দে শানেরা বাসত্ কর্দ,
আঁ চে দীদান্দ আজ জাফা ও গরমে ছরদ।
হীলা হা শানে জুমলা হালে আমদ লতিফ,
কুল্লু শাইয়েম মেন জরিফেন হো জরীফ।
দামেহা শানে মোরগ গেরদনী গেরেফ্ত,
নকচেহা শানে জুমলা আফ্জুনি গেরেফ্ত।
জোহদ মী কুন তা তাওয়ানী আয়কেয়া,
দর তরীকে আম্বিয়া ও আওলিয়া।
বা কাজা পাঞ্জা জাদান নাবুদ জেহাদ,
জা আঁকে ইঁরাহাম কাজা বর মানেহা।
কা ফেরাম মান গার জীয়ানে করদাস্ত কাছ,
দররাহে ঈমান ও তায়াতে এক নফছ।
ছার শেকাস্তাহ নিস্তে হায়েঁ ছাররা বন্দ,
এক দো রোজাক জোহদ কুন বাকী ব খান্দ।
অর্থ: বাঘ উত্তর করিল, তোমাদের কথা স্বীকৃত। কিন্তু, হজরত আম্বিয়া ও মুরসালীন (আ:)-গণের চেষ্টা ও কষ্ট করা, নেক লোকদের কষ্ট করা ও মোমিনদের জেহাদ করা দুনিয়ার প্রথম হইতে আজ পর্যন্ত যাহা কিছু ঘটিয়াছে, উহাও দেখা দরকার। শেষ পর্যন্ত তাঁহারা যত প্রকার কষ্ট ও যাতনা ভোগ করিয়াছেন, আল্লাহতায়ালা তাঁহাদের চেষ্টা ও যত্নকে ঠিক বলিয়া গণ্য করিয়া নিয়াছেন। এবং তাহাদের চেষ্টা ও তদবীর সব সময়ই আল্লাহর নিকট প্রিয় বলিয়া বিবেচিত হইয়াছে। আর হইবেই বা না কেন? যাহা ভালোর তরফ হইতে হইয়া থাকে, উহা ভাল বলিয়া বিবেচিত হয়। নবী-আম্বিয়া (আ:)-গণের কাজের লাগাম আসমানী মোরগ ধরিয়া থাকে। তাঁহাদের ধর্মে যাহা কমতি ছিল, তাহা উন্নতি লাভ করিয়া গিয়াছে। যখন চেষ্টা ও তদবীর আম্বিয়া (আ:)-গণের সুন্নাত বলিয়া প্রমাণ হইল, তখন হে মানুষ, তুমি যত চালাকই হওনা কেন, যতদূর সম্ভব আওলিয়া (রহ:) ও আম্বিয় (আ:)-গণের পথে চলিতে চেষ্ট কর। কাজার উপর হাতে চেষ্টা করা কাজার সাথে যুদ্ধ করা হয় না। কেননা, উহা ত কাজা দ্বারাই নির্দিষ্ট করা হইয়াছে। মাওলানা কসম করিয়া বলিতেছেন, যদি কোনো ঈমানদার ব্যক্তি খোদার ইবাদাতে কষ্ট করিয়া ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তথাপি তাহাকে কষ্ট করিয়া চেষ্টা করা হইতে বিরত হওয়া চলিবে না। তোমার হাত-পা সুস্থ থাকিতে উহাকে বেকার রাখা, যেমন তোমার মাথা সুস্থ ও সঠিক আছে, কোনো জখম হয় নাই, তবুও মাথায় পট্টি বাঁধা চলিবে না। সামান্য কালের জন্য কিছু মেহনত করিয়া লও, যদ্বারা নেক আমলের কিছু সম্বল জমা করা হয়। তার পর সর্বদা শান্তিতে ও খুশীতে থাকিতে পারিবে।
বদ মহালে জুস্তো কো দুনিয়া বা জুস্ত,
নেক হালে জুস্তো কো উক্রা বা জুস্ত।
মকরেহা দর কছবে দুনিয়া বারেদন্ত,
মকরেহা দর তরকে দুনিয়া ওয়ারেদাস্ত।
মকরে আঁ বাশদ কে জেন্দানে হুফরাহ্ করদ্,
আঁ কে হুফরাহ্ বস্তে আঁ মকরীস্ত ছরদ।
ইঁ জহান জেন্দানে ওমা জেন্দানিয়া
হুফ্রাহ্ কুন জেন্দানে ও খোদরা ওয়ারে হাঁ।
অর্থ: এখানে পরকালের শাস্তির দিক লক্ষ্য রাখিয়া দুনিয়ায় নেক আমল করার জন্য উৎসাহ দিয়া মাওলানা বলিতেছেন, যে ব্যক্তি দুনিয়ার শান্তির জন্য শুধু পরিশ্রম করে, সে অত্যন্ত খারাপ কাজ করে এবং ভিত্তিহীন কাজ করে। আর যে ব্যাক্তি পরকালের শান্তির জন্য কাজ করে, সে প্রশংসনীয় কাজ করে। তাহা দ্বারা সে পরকালে শান্তির পথ পাইবে। দুনিয়ার কামাইয়ের জন্য তদবীর করা বোকামী ছাড়া আর কিছুই নহে। দুনিয়া তরক করার জন্য আয়াতে কোরানে ও হাদীসে নির্দেশ আছে। দুনিয়া মুমিনদের জন্য কয়েদখানা স্বরূপ। অতএব, কয়েদখানা ভাঙ্গিয়া মুক্তি পাইবার জন্য চেষ্টা ও তদবীর করা উত্তম কাজ। আর যে ব্যক্তি কয়েদখানায় থাকিয়া উহা ভাঙ্গিয়া বাহির হইবার চেষ্টা করে না, বরং স্থায়ীভাবে কয়েদখানায় থাকিবার চেষ্টা করে, সে চিরদিনই কয়েদখানায় আবদ্ধ থাকিবে। যেমন, ইহকালে দুনিয়ার কষ্টে আবদ্ধ থাকে, তেমন পরকালেও দোজখের মধ্যে অগ্নিতে আবদ্ধ থাকিবে।
চীস্তে দুনিয়া আজ খোদা গাফেল বুনাদ,
নায়ে কামাশ ও নকরা ও ফরজান্দো জন।
মালেরাগার বহ্রে দীনে বাশী হামুল,
নেয়মা মালুন ছালেহুন খোন্দাশ রছুল।
আবে দর কাস্তি হালাকে কাস্তি আস্ত,
আবে আন্দর জীরে কাস্তি পুস্তি আস্ত।
চুঁকে মালো ও মূলকেরা আজ দেল বুরান্দ,
জে আঁ ছোলাইমানে খেশ জুয্ মিকীন নাখান্দ।
কুজায়ে ছার বস্তাহ্ আন্দর আবে জাফাত,
আজ দেল পুরবাদ ফওকে আবে রাফাত।
বাদে দরবেশী চু দর বাতেনে বুয়াদে,
বরছারে আবে জাহাঁ ছাকেন বুয়াদ।
আবে না তাওয়ানাদ মর উরা গোতাহ্ দাদ্
কাশে দে আজ নফখাহ্ ইলাহী গাস্তশাদ।
গারচে জুমলাহ্ ইঁ জাহাঁ মুলকে ওয়ারেস্ত,
মুলকে দর চশমে দেলে উ লাশায়েস্ত।
পাছ দেহানে দেল বা বন্দ ও মহর কুন,
পুর কুনাশ আজ বাদে কেবরা মিল্লাদুন।
অর্থ: এখানে মাওলানা দুনিয়ার প্রকৃত অবস্থা বর্ণনা করিতেছেন। তিনি বলেন, দুনিয়া অর্থ খোদাতায়ালা হইতে ভুলিয়া যাওয়া। কোনো ধন-দৌলত বা স্ত্রী-পুত্রের নাম নয়, প্রকৃত পক্ষে দুনিয়া ঐ অবস্থার নাম, যে অবস্থা মানুষের মৃত্যুর পূর্বক্ষণে হয়। চাই সে অবস্থা ভাল হউক অথবা মন্দ। যদি সে অবস্থা আখেরাতের জন্য শুভ না হয়, তবে সে দুনিয়া মন্দ এবং দুনিয়া শব্দ প্রায়ই এই অর্থে ব্যবহার করা হয়। আর যদি আখেরাতের জন্য শুভ হয়, তবে সে দুনিয়া অতি উত্তম। আখেরাতে শুভ ফলদায়ক দুনিয়া কোনো সময়ই মন্দ নয়। কেননা, সম্পদ যদি নিজের কাছে দ্বীনের খেদমতের জন্য রাখ, যেমন নবী করিম (দ:) ফরমাইয়াছেন, নেয়মাল মালুছ ছালেহো লিররাজুলেছ ছালেহ্। অর্থাৎ, নেক লোকের জন্য নেক মাল অতি উত্তম বস্তু। মাল দুনিয়ায় ক্ষতিকারক বস্তু নয়। মালের মহব্বত অন্তরে দূষণীয়। ইহার দৃষ্টান্ত এইরূপ, যেমন, পানি যদি নৌকার মধ্যে প্রবেশ করে তবে নৌকা ডুবিয়া যায়। আর যদি নৌকার নিচে হয়, তবে নৌকা চলনে খুব সুবিধা হয়। অতএব, দুনিয়া পানির ন্যায় এবং অন্তর নৌকার মতন। যদি দুনিয়া এবং ইহার ধন-সম্পদের মহব্বত অন্তরে বিঁধিয়া যায়, তবে অন্তর নিশ্চয়ই খারাপ হইয়া যায়। আর যদি দুনিয়ার মাল-সম্পদ অন্তরের বাহিরে থাকে, অর্থাৎ হাতে থাকে তবে দ্বীনের সাহায্য হইতে পারে। এই কারণেই হজরত সোলাইমান (আ:) এত মরতবা এবং ধন-দৌলতের অধিকারী হইয়াও তাঁহার অন্তরে বাদশাহী ও ধন-দৌলতের মহব্বত প্রবেশ করিতে পারে নাই। এই জন্যই তিনি নিজেকে মিসকীনের ন্যায় মনে করিতেন। বিলকীস বিবিকে যে পত্র দিয়াছিলেন, তাহাতে তিনি শুধু ’সোলাইমানের তরফ হইতে’ এই বাক্য লিখিয়াছিলেন। বাদশাহ্দের ন্যায় কোনো উপাধি বা পদের নাম উল্লেখ করেন নাই। ইহা দ্বারা বুঝা যায় যে, হজরত সোলাইমান (আ:)-এর অন্তরে দুনিয়ার কোনো মহব্বত প্রবেশ করে নেই। দুনিয়াদারী অর্থ দুনিয়ার মহব্বত অন্তরে থাকা। দ্বিতীয় উদাহরণ হইল, একটি ঘটি বা লোটার মুখ বন্ধ করিয়া দিয়া গভীর পানিতে ছাড়িয়া দিলে উহার ভিতরে বায়ু পরিপূর্ণ থাকে বলিয়া পানিতে ডুবিয়া যায় না। পানির উপরে ভাসিতে থাকে। এইভাবে আল্লাহর মহব্বতের জোশে অন্তর পরিপূর্ণ থাকিলে, সে দুনিয়ার উপর শান্তিতে বসবাস করিতে পারিবে। দুনিয়ার মহব্বতে কোনো সময় পড়িবে না এবং ডুবিয়াও যাইবে না। কেননা, তাহার অন্তর আল্লাহর মহব্বতের বায়ুতে সর্বদা পরিপূর্ণ। সে শান্তিতে সন্তুষ্ট থাকিবে। যদিও সে সমস্ত জাহানের বাদশাহ হয়, তথাপি তাহার নজরে বাদশাহী কিছু না বলিয়াই মনে হইবে। ইহা দ্বারা বুঝা গেল, যাহার অন্তর ইশকে এলাহী মা’রেফাতে রব্বানীতে পরিপূর্ণ, সে কখনও দুনিয়ার মহব্বতে ডুবিয়া যাইবে না। অতএব, তোমাদের উচিত তোমাদের অন্তর আল্লাহর বুজর্গির বায়ু দ্বারা পরিপূর্ণ করিয়া মোহর মারিয়া অন্তরের মুখ বন্ধ করিয়া দেওয়া। আল্লাহ ব্যতীত অন্য কিছুর মহব্বত অন্তরে প্রবেশ করিতে দিও না, তবে তুমি মুখ বন্ধ করা ঘটির ন্যায় দুনিয়ার উপর ভাসিতে পারিবে।
কছবে কুন জোহ্দে নুমা ছায়ী বকুন।
তা বদানী ছেররে এল্মে মিল্লাদুন।
জোহদ হকাস্ত ও দাওয়া হকাস্ত ও দরদ,
মুনকার আন্দর নফি জোহ্দাশ জোযদ করদ।
গারচে ইঁ জুমলা জাহাঁ পোর জোহ্ দ শোদ,
জোহদ কে দর কামে জাহেল শহদ শোদ।
অর্থ: এখানে মাওলানা বলিতেছেন, তোমরা কষ্ট কর, চেষ্টা কর, তবে তোমরা আল্লাহর এলেমের রহস্য বুঝিতে পারিবে যে, কাজ এবং কাজের সাবাবের মধ্যে কী কী সম্বন্ধ নিহিত আছে। কষ্ট করা চাই, ইহা ঠিক সত্য। ব্যথা সত্য, দাওয়াও সত্য। যেমন ব্যথা কারণ হিসাবে দেখা দেয় ঔষধ ব্যবহার করার জন্য। আবার ঔষধ কারণ হয় চেষ্টা ও কষ্ট করিয়া ঔষধ হাসেল করার জন্য। এই সব প্রমাণ দেওয়া হইতেছে সাবাবকে সত্য প্রমাণ করার জন্য। জোহদ (কৃচ্ছ্বব্রত) অস্বীকারকারী নিজেই জোহদ করিয়া জোহদকে অস্বীকার করে। যদি জোহদ শুধু বাতেল হইত, তবে সে কেন জোহদ করিয়া অস্বীকার করে? যাহার মধ্যে অজ্ঞতা বিরাজ করিতেছে, তাহার অবস্থা এইরূপই হয়। যদি সমগ্র জাহান জোহদ দ্বারা পরিপূর্ণ হইয়া যায়, দিন রাত ইহার ধারা প্রবাহিত থাকে, তাহা হইলেও অজ্ঞ লোকের মগজে ইহা মধু হইয়া কখনও কি ঢুকিবে?
জীঁ নম্তে বেছিয়ার বুরহানে গোফ্ত শের,
কাজ জওয়ারে আঁ যবরিয়ানে গাস্তান্দ ছায়ের।
রোবা ও আহু ও খরগোশ ও শেগাল,
যবর্রা ব গোজাস্তান্দ ও কীল ও কাল।
আহাদ্হা করদান্দ বা শেরে জিয়াঁ,
কান্দরীঁ বয়েতে না ইয়াফতাদ দর জবান।
কেছমে হর রোজাশ বইয়ায়েদ বে জরার,
হাজতাশ নাবুদ তাকাজায়ে দিগার।
আহাদে চুঁ বছতান্দ ও রফতান্দ আঁ জমান,
ছুয়ে মারয়া আয়মান আজ শেরে জিয়ান।
জমায়া ব নেশাছতান্দ একজা আঁ ওহুশ,
উফতাদাহ্ দরমীয়ানে জুমলা জোশ।
হর কাছে তদবীর ওয়ারায়ে মীজাদান্দ,
হর একে দর খুনে হর এক মী শোদান্দ।
আকেবাত শোদ ইত্তেফাকে জুমলা শাঁ,
তা বইয়ায়েদ কোরয়া আন্দর মীয়া।
কোরয়া বর হরকে উফ্তাদ উ তায়ামাস্ত,
বে ছোখান শেরে জীয়ানেরা লোক্মাস্ত।
হাম বর ইঁ করদান্দ আঁ জুমলা করার,
কোরয়া আমদ ছার বছার রা ইখতিয়ার।
কোরয়া বর হর কোফ্তাদে রোজে রোজ,
ছুঁয়ে আঁ শের উ দাবীদে হামচু ইউজ।
অর্থ: বাঘ এমনভাবে চেষ্টা ও তদবীরের প্রমাণাদি পেশ করিল যে, বন্য পশুদের আর উত্তর করিবার সুযোগ রহিল না। প্রত্যেকে যবর সম্বন্ধে উচ্চবাচ্য করা ত্যাগ করিল। হিংস্র বাঘের নিকট প্রতিজ্ঞা করিল যে, প্রতিজ্ঞার মুদ্দাতের মধ্যে বাঘের কোনো প্রকার কষ্ট স্বীকার করিতে হইবে না। প্রত্যেক দিন তাহার নিকট প্রত্যেক দিনের খাবারের ভাগ বিনা কষ্টে যাইয়া পৌঁছিবে এবং তাহাকে কোনো কিছুর জন্য বলিতে হইবে না। এইরূপ ওয়াদা ও প্রতিজ্ঞা করিয়া ও করাইয়া বন্য পশুরা সকলেই নিশ্চিন্তায় চারণভূমিতে ফিরিয়া গেল, এবং সকলেই একত্রিত হইয়া এক জায়গায় বসিল। প্রত্যেকের মধ্যেই এক প্রকার উত্তেজনা প্রকাশ পাইতেছিল। প্রত্যেকেই বিভিন্ন রায় এবং তদবীর পেশ করিতেছিল, প্রত্যেকেই চিন্তা করিতেছিল যে, নিজে বাঁচিয়া যাইবে এবং অন্যকে বাঘের খোরাক হিসাবে পাঠাইবে। অবশেষে সিদ্ধান্ত হইল যে, লটারি ধরিয়া নির্ণয় করিতে হইবে। যাহার নাম লটারিতে উঠিবে, তাহাকেই বাঘের খাদ্য হিসাবে পাঠাইবে। এই সিদ্ধান্তে সকলেই বাধ্য হইল, লটারী ধরাই সবে পছন্দ করিল। তারপর এই নিয়মই হইল যে, যাহার নাম লটারীতে উঠে, সেই-ই দৌড়াইয়া বাঘের নিকট যাইয়া উপস্থিত হইত। চীতা বাঘের ন্যায়, অর্থাৎ, খুব তাড়াতাড়ি দৌড়াইয়া বাঘের মুখের কাছে হাজির হইত।
চুঁ ব খরগোশ আমদ ইঁ ছাগের ব দাউর,
বাংগে জাদ খরগোশ কা আখের চান্দে জওর।
কওমে গোফ্তান্দাশ কে চান্দে ইঁ গাহে মা,
জান ফেদা করদেম দর আহাদো ওফা।
তু মজো বদনামী সা আয় অনুদ,
তা রঞ্জাদ শেরে রো তু জুদে জুদ।
অর্থ: যখন বাঘের খাদ্যের জন্য যাইবার পালা খরগোশের আসিল, তখন খরগোশ চিৎকার করিয়া উঠিয়া বলিল, শেষ পর্যন্ত এই রকম জুলুম কতদিন পর্যন্ত চলিতে থাকিবে? অন্য পশুরা বলিল, দেখো, এতদিন পর্যন্ত আমরা আমাদের ওয়াদা পূরণ করার জন্য আমাদের জান কোরবান করিয়া দিয়া আসিতেছি। যাহাতে বাঘের সাথে ওয়াদা খেলাফী না হয়। তুমি এখন আমাদের বদনাম করিও না, তুমি জলদি করিয়া যাও। তাহা হইলে বাঘে কষ্ট পাইবে না।
গোফ্তে আয় ইয়ারাণে মরা মেহলাত দেহেদ,
তা ব মকরাম আজ বালা বীরুঁ জাহীদ।
তা আমান ইয়াবদ ব মকরাম জানে তান,
মানাদ ইঁ মীরাছ ফরজান্দানে তান।
হর পয়ম্বর উম্মাতানেরা দর জাহাঁ,
হামচুনীঁ তা মোখলেচী মী খানাদ শাঁ।
কাজ ফালাক রাহে বীরুঁ শো দীদাহ্ বুদ,
দর নজরে চুঁ মরদেমাক পীচীদাহ্ বুদ।
মরদামাশ চুঁ মরদেমাক দীদান্দ খোরদ,
দর বোজর্গি মরদেমাক কাছরাহ্ নাবোরদ।
অর্থ: খরগোশ বলিল, আমাকে কিছু সময় দাও, তাহা হইলে আমার তদবীর দ্বারা দৈনিক মুসিবত হইতে রেহাই পাইবে এবং তোমাদের জানসমূহ মুক্তি পাইবে। তোমাদের ফরজন্দেরা মীরাস্ সূত্রে এই সবুজ চারণভূমির মালিক হইবে। তাহা না হইলে যদি এইরূপ প্রথা তোমাদের চলিতে থাকে, তবে একদিন আপন হইতেই সকলের শেষ হইয়া যাইতে হইবে এবং চারণভুমি বাঘের অধীনে চলিয়া যাইবে। অতঃপর মাওলানা বলিতেছেন, এইভাবে সমস্ত আম্বিয়া আলাইহেমুচ্ছালামগণ নিজ নিজ উম্মৎদিগকে তাহাদের মুক্তির পথে ডাকিতে থাকিতেন। কেননা, তাঁহারা এই আকাশ দ্বারা সীমাবদ্ধ দুনিয়া হইতে বাহির হইয়া যাইবার রাস্তা অন্তরের আলো দিয়া দেখিতেন এবং সেই পথে নিজেদের উম্মৎদিগকে নিয়া যাইবার চেষ্টা-তদবীর করিতেন। কেননা, সমস্ত আম্বিয়াগণের চেষ্টা ও কষ্ট করার উদ্দেশ্য এই ছিল যে, দুনিয়ার সম্বন্ধ ত্যাগ করিয়া আখেরাতের সহিত সম্বন্ধ কর। কিন্তু সাধারণ লোকের জানা ছিল না যে, আম্বিয়া আলাইহেমুচ্ছালামগণের এইরূপ দেখার শক্তি আছে। কেননা, সাধারণ লোকের চক্ষে তাঁহারা নয়নের পুতুলের ন্যায় ছিলেন। তাঁহাদের অভ্যন্তরীন অবস্থা গুপ্ত ছিল। প্রকাশ্য দৃষ্টিতে তাঁহাদিগকে ছোট দেহবিশিষ্ট এবং সামান্য মরতবা-ওয়ালা দেখিতে লাগিত। লোকের খেয়াল হইত না যে, তাঁহাদের মধ্যে এত বড় দেখার শক্তির গুণ নিহিত আছে। কিন্তু বুঝিয়া লও, তাঁহাদের দৃষ্টিশক্তির প্রখরতা কত পরিমাণ ছিল। এইভাবে আম্বিয়াগণকে (আঃ) নয়নের পুতুলের ন্যায় ছোট মনে করিয়াছে। কিন্তু পুতুলের বুজর্গির মধ্যে কেহ চিন্তা করে নাই।
কওমে গোফতান্দাশকে আয় খরগোশে জার,
খেশরা আন্দাজায়ে খরগোশে দার।
হায়েঁ চে লাফাস্ত ইঁ কে আজ তু মেহতরাঁ,
দর নাইয়া ওরদান্দ আন্দর খাতেরে আঁ।
মায়াজাবী ইয়াখোদ কাজা মান দর পায়েস্ত।
ওয়ারনা ইঁ দম লায়েক চুঁ তু কায়েস্ত।
অর্থ: বন্য পশুরা বলিল, হে হীন খরগোশ! নিজে নিজেকে খরগোশের মরতবায় রাখ, ইহা তুমি জংলী বৃদ্ধ পশুর ন্যায় বলিতেছ। কেননা, যে তোমার চাইতে বড়, সে ত তোমার ন্যায় এই রকম কথার খেয়ালও করে নাই। অতএব, ইহা হয়ত তুমি নিজেই পছন্দ করিয়া বিপদে পতিত হইতেছ। অথবা আমাদের সকলের মৃত্যু ঘনাইয়াছে। এত বড় লম্বা চওড়া দাবী তোমার মত জীবের করা সমুচিত বলিয়া মনে হয় না। কেননা, তুমি সব দিক দিয়াই হীন।
গোফতে আয় ইয়ারানে হকাম এলহাম দাদ,
মর জয়ীফেরা কওমী রায়ে ফাতাদ।
আঁচে হক আমুখত মর জম্বুরে রা,
আঁ নাবাশদ শেরেরাও গোরে রা।
খানেহা ছাজাদ পুর আজ হালওয়ায়ে তর,
হক বর ওয়া এলমে রা বকোশাদ দর।
আঁচে হক আমুখত করমে পীলারা,
হীচ পীলে দানাদ আঁ গোঁহীলারা।
অর্থ: খরগোশ উত্তর করিল, প্রকৃতপক্ষে আমি দুর্বল ও হীন, আমি কী এবং আমার রায়-ই বা কী? কিন্তু ইহা আমার রায়ের ফলাফল নয়। বরং আল্লাহতায়ালা আমার কাছে যে এলহাম (ঐশী প্রত্যাদেশ) পাঠাইয়াছেন, ঐ এলহামের দরুন এক দুর্বলের অন্তঃকরণে শক্তিশালী রায় আসিয়া পৌঁছিয়াছে। দুর্বল সৃষ্ট জীবের নিকট এলহাম আসা কোনো আশ্চর্যের বিষয় নয়। যেমন দেখ, আল্লাহতায়ালা মধুমক্ষিকাকে এল্হামের মারফত যাহা শিক্ষা দিয়াছেন, উহা মহা শক্তিশালী বাঘ ও বন্য গাধাকেও শিক্ষা দেন নাই। কেননা, মধুমক্ষিকা ফুল চোষণ করিয়া মধু তৈয়ার করে, তাহারা নিজেদের ঘর কীরূপ সুন্দর করিয়া তৈয়ার করে। ব্যাঘ্র বা বন্য গাধা এইরূপ হেকমাত কোথায় পাইবে? তাই মাওলানা বলেন, মধুমক্ষিকা এমন সুন্দর সুন্দর ঘর তৈয়ার করে যে ইহা মধুপূর্ণ থাকে। আল্লাহ তায়ালা এইরূপ বিশেষ বিদ্যা ঐ মধুমক্ষিকাকে শিক্ষা দিয়াছেন। এইভাবে আল্লাহতায়ালা রেশমের পোকাকে রেশম তৈয়ার করার ক্ষমতা শিক্ষা দিয়াছেন। হাতী এত বড় জানোয়ার হইয়াও রেশম বানানোর তদবীর জানে না। অতএব, ইহা দ্বারা বোঝা গেল যে এল্হাম আসা ও না আসার ভিত্তি, শক্তি অথবা দুর্বলতার উপর নির্ভর করে না।
আদ্মে খাকী জে হক্ আমুখত এল্ম,
তা ব হাপ্তমে আছমান আফ্রুখত এল্ম।
নামো নামুচ্ছে মুলকেরা দর শেকাস্ত,
মোরে আঁ কাছফে বা হক্কে দর শেকাস্ত।
জাহেদে শশছদ হাজারানে ছালাহ্ রা
পুজেবন্দে ছাখতে আঁ গোছালারা।
তা নাতানাদ শেরে এলমে দীনে কাশীদ,
তা না গরদাদ গেরদে আঁ কাছরে মাশীদ।
ইলমে হায়ে আহ্লে হেচ্ছে শোদ পুজে বন্দ,
তা না গীরাদ শেরে আজ আঁ এলমে বলন্দ।
অর্থ: আল্লাহতায়ালা দুর্বলকে এমন বিদ্যা দান করেন, যাহা শক্তিশালীকে দান করেন না। যেমন মাটির তৈরী হজরত আদম (আ:)-কে আল্লাহতায়ালা সকল বস্তুর রহস্য সম্বন্ধে বিদ্যা দান করিয়াছেন, উহা দ্বারা তিনি সপ্তম আসমান ও জমিন আলোকিত করিয়া দিয়াছেন। এমন কি, আরশে মোয়াল্লা পর্যন্ত আলোকিত করিয়া দিয়াছেন। প্রধান প্রধান ফেরেস্তারাও হজরত আদম (আ:)-এর ইলমের কথা অনুভব করিতে পারিয়াছেন, যাহাতে তাঁহাদের মরতবা ও গৌরব নষ্ট হইয়া গিয়াছে। অবশেষে বাধ্য হইয়া তাঁহারা বলিয়াছেন, যেমন পবিত্র কুরআনে উল্লেখ আছে, “হে খোদা, আমরা তোমার পবিত্রতা বর্ণনা করিতেছি, তুমি যাহা শিক্ষা দিয়াছ, তাহা ব্যতীত আমাদের কোনো বিদ্যা নাই। মাওলানা বলেন, ইহা সত্ত্বেও যদি কোনো ব্যক্তি আল্লাহর কুদরাতের উপর সন্দেহ করে, তবে সে অন্ধ ব্যতীত আর কিছুই না।” মাটির তৈরির অবস্থা ত এই প্রকার। কিন্তু অগ্নির তৈরির অবস্থা কিছু বর্ণনা করা দরকার। ইবলিস শয়তান ছয় লক্ষ বৎসর আল্লাহর ইবাদতে মশ্গুল থাকিয়াও অজ্ঞতা এবং বর্বরতায় গরুর বাছুরের ন্যায় ছিল। তাহার চেহারার উপর জুলমাত ও জেহালাতের একটা ছাপ মারা ছিল। যাহাতে ইলমে দীনের হাকিকাত না দেখিতে পারে এবং উহা দ্বারা ফায়দা হাসেল না করিতে পারে। হজরত আদম (আ:)-এর অভ্যন্তরীণ রহস্য অনুমান করার শক্তি ছিল না এবং তাঁহার উচ্চ মরতবার নিকটবর্তীও হইতে পারিত না। সমস্ত বৈজ্ঞানিকগণ, যাহাদের অন্তরে খোদাপ্রদত্ত বিদ্যার আলো প্রবেশ করে নাই, তাহাদের নিকট বিদ্যা যেমন ঘোড়ার লাগামের ন্যায়। এলমে মারেফাত হইতে কোনো অংশ লাভ করিতে পারে নাই।
কাতরায়ে দেলরা একে গওহার ফাতাদ,
কা আঁ বদরিয়া হাও গেরদো হা নাদাদ।
অর্থ: বিদ্যা শিক্ষাপ্রাপ্ত হইবার মূল ভিত্তি শক্তি বা প্রকাশ্য দুর্বলতার উপর নয়। যেহেতু, মানুষের অন্তর, যাহা একবিন্দু রক্ত মাত্র, উহা এমন একটি মূল্যবান বস্তু মানবকে দান করা হইয়াছে, যাহা বড় বড় সাগর বা উচ্চ আসমানসমূহকেও প্রদান করা হয় নাই। ইহা সত্ত্বেও অন্তরের পরিমাণ ও আন্দাজের দিক দিয়া বড় বড় সাগর ও সুউচ্চ আসমানের তুলনায় কিছুই নয়। এইসব প্রমাণ দ্বারা প্রকাশ পায় যে, কোনো বস্তুর বাহ্যিক আকৃতি ও গঠনের দিক দিয়া কোনো মূল্য বোধ হয় না, প্রকৃতপক্ষে অভ্যন্তরীণ নিহিত মূল রহস্য দ্বারা বস্তুর মূল্য নির্ধারণ করিতে হইবে।
চান্দে ছুরাত আখের আয় ছুরাত পোরোস্ত,
জানেবে মায়ানিয়াত আজ ছুরাত নারোস্ত।
গারবা ছুরাতে আদমী ইনছাঁ বুদে,
আহ্মদ ও বু জাহেল হাম একছাঁ বুদে।
আহ্মদ ও বু জাহেল দর বুতখানা রফত,
জে ইঁ শোদান তা আঁ শোদান ফরকীস্ত যফ্ত।
ইঁ দর আইয়াদ ছার নেহান্দ উরা বতাঁ,
উ দর আইয়াদ ছার নেহাদ চুঁ উম্মাতাঁ।
অর্থ: মাওলানা বলেন, যখন প্রকাশ্য গঠন ও আকৃতির কোনো মূল্য নাই, তখন তোমাদের সুরাতে জাহেরীর পূজা করা উচিৎ না। এই রকমভাবে জাহেরী সুরাতের পূজা করিতে করিতে তোমাদের অন্তঃকরণ অবুঝ রহিয়াছে। প্রকৃত রহস্য অনুধাবন করিতে পার না। শুধু সুরাত দ্বারা কিছুই বুঝা যায় না। কেননা, যদি সুরাত দ্বারাই মানুষের মনুষ্যত্ব প্রকাশ পাইত, তবে হজরত মোহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) এবং আবু জাহেল একই রকম হইত। কেননা, মানুষের গঠনের দিক দিয়া ত একই রকম ছিল। কিন্তু উভয়ের মধ্যে আসমান ও জমিন পরিমাণ পার্থক্য ছিল। আরো ধরা যায় যে, আবু জাহেল ও হজরত মোহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) উভয়ই বুতখানায় যাওয়া প্রকাশ্যে একই রকম দেখায়, কিন্তু নবী (দ:)-এর যাওয়া এবং আবু জাহেলের যাওয়ার মধ্যে বহুত পার্থক্য আছে। হজরত (দ:) যদি তাশরীফ আনিতেন, তবে মূর্তিসমূহ হজরতের (দ:) সম্মুখে মাথা নত করিয়া সেজদায় পড়িয়া যাইত এবং আবু জাহেল যখন যাইত, তখন সে নিজেই বুতকে মাথা নত করিয়া সেজদা দিত।
নকশে বর দউয়ারে মেছলে আদমাস্ত
বেংগর আন্দর ছুরাতে উ চে কমাস্ত
জানে কমাস্ত আঁ ছুরাতে বেতাব আ
রও বজ্যে আঁ গওহরে নাইয়াবরা
শোদ ছারেশেরাণে আলমে জুমলা পোস্ত,
চুঁ ছাগে আছহাবেরা দাদান্দ দাস্ত
কায়ে জিয়ানাতাশ আজ আঁ নকশে নফুর,
চুঁকে জানাশ গরকে শোদদর বহরে নূর।
অর্থ: দেয়ালের উপর মানুষের যে ছবি অঙ্কন করা হয়, উহা অবিকল মানুষের ন্যায় হয়। বল দেখি, উহার প্রকাশ্য সুরাত মানুষের চাইতে কোন্ দিক দিয়া কম? শুধু একটি প্রাণশক্তি উহার মধ্যে কম। এই জন্য উহাকে বে-জান বলা হয়। এখন অমূল্য ধন প্রাণশক্তি তালাশ কর, ঐ বে-জান সুরাত ত্যাগ কর। আসহাবে কাহাফের কুকুরের দিকে লক্ষ্য কর, যখন আল্লাহ্তায়ালা কাজায় কুদরাত সাহায্যে ইহাদিগকে মারেফাতে কামাল দ্বারা পরিপূর্ণ করিয়া দিয়াছেন, তখন ইহাদের সম্মুখে সমস্ত পৃথিবীর বাঘের মাথা নত হইয়া গিয়াছে। তবে কুকুরের আকৃতিতে দোষ কী? ইহার প্রমাণ আল্লাহর মারেফাতের নূর দ্বারা পরিপূর্ণ হইয়া গিয়াছে।
ওয়াছফে ছুরাত নিস্তে আন্দর ভামে হা,
আলেম ও আদেল বুদ দর নামে হা।
আলেম ও আদেল হামা মায়ানীস্ত ও বছ,
কাশে নাইয়াবী দর মাকানে পেশ ও পাছ।
মী জানাদ বরতন জে ছুয়ে লা মাকান,
মী না গোঞ্জাদ দর ফালাকে খুরশীদে জান।
অর্থ: মাওলানা আরো উদাহরণ দ্বারা পরিষ্কার করিয়া দিতেছেন, যেমন-লিখনে মানুষের উপাধি যে আলেম বা আদেল লিখা হয়। ঐ সমস্ত গুণাগুণ সুরাত হিসাবে লিখা হয় না, বরং নিহিত গুণের হিসাবে লিখা হয়। ঐ সমস্ত গুণ কোনো জায়গায় পাওয়া যায় না। কেননা ইহা দেহের গুণাগুণ নয় যে কোনো স্থানে পাওয়া যাইবে। এই সমস্ত গুণ ও আওসাফ রূহের; রূহ্ কোনো পদার্থ নয়। ইহা খোদার হুকুম মাত্র। এইজন্য ইহার কোনো জায়গার দরকার হয় না। রূহ্ এমন এক প্রকার আলো, যাহার আলো বিস্তার সমস্ত আসমান জমিনে সামাই হয় না। শূন্যস্থান হইতে রূহের ক্রিয়া দেহের উপর পতিত হয়।
ইঁ ছুখান পায়ানে না দারাদ হুশে দার,
গাশে ছুয়ে কেচ্ছা খরগোশে দার,
গোশে খর ব ফেরুশ ও দীগার গোশে খর,
কা ইঁ ছুখানরা দর নাইয়াবদ গোশে খর।
রো তু রো বা বাজী খরগোশে বীঁ,
মকর ও শের আন্দাজী খরগোশে বীঁ।
অর্থ: মাওলানা বলেন, উপরোক্ত দৃষ্টান্তসমূহের শেষ নাই। তবে এখন সতর্কতা সহকারে খরগোশের কেচ্ছা শুন, কিন্তু বাহ্যিক কান গাধার কানের ন্যায় ইহা ত্যাগ কর, অন্য প্রকারের কান দিয়া শুন। কেননা, এই কেচ্ছা দিয়া যে রহস্য বাহির হইবে, ইহা অন্তরের কান না হইলে বুঝিতে পারিবে না। খরগোশের হীলাবজী ও ফেরেব দেখ, কেমন করিয়া সে বাঘকে কুপের মধ্যে নিক্ষেপ করিল।
খাতেমে মূলকে ছোলাইমানাস্ত এলম,
জুমলা আলম ছুরাতো ও জানাস্ত এলম।
আদমী রা জীঁ হুনার বেচারা গাস্ত,
খলকে দরিয়া হাও খরকে কোহ্ও দাস্ত।
জু পালং ও শেরে তরছা হামচু মূশ,
জু শোদাহ পেনহা বদস্তো কে ওহুশ।
জু পরী ও দেও ছা হল হা গেরেফ্ত,
হরকে দর জায়ে পেনহা জা গেরেফ্ত।
অর্থ: খরগোশের তদবীর-বিদ্যার মাখা ছিল বলিয়া মাওলানা বিদ্যা সম্বন্ধে কিছু ফজিলত বর্ণনা করিয়া বলিতেছেন যে, বিদ্যা হজরত সোলাইমান (আ:)-এর আংগোটির ন্যায়, অর্থাৎ, হজরত সোলাইমান (আ:) যেমন আংগোটির ক্রিয়ায় সমস্ত জ্বীন ও ইন্সান এবং পশু-পক্ষী ইত্যাদি সবই আয়ত্তে রাখিয়াছিলেন, সেই রকম খোদার দান বিদ্যা দ্বারা ইহ-জগতে সব কিছু অধীনস্থ করা যায়। এই অমূল্য সম্পদ আল্লাহতায়ালা মানুষকে দান করিয়াছেন বলিয়া মানুষ শ্রেষ্ঠ জীব ও অন্যান্য সৃষ্ট প্রাণী সব মানুষের অধীনস্থ; মানুষকে ভয় করে। সাগরের প্রাণীসমূহ, পাহাড় ও জঙ্গলের বড় বড় হিংস্র প্রাণীসকল মানুষকে ভয় করে। জ্বীন, পরী ও দেও-দানব মানুষের ভয়েতে দূরদূরান্তে সাগরের কিনারায় ও বন জঙ্গলে বাস করে। প্রত্যেকেই মানুষের ভয়ে মানুষ হইতে বহু দুরে বনে, জঙ্গলে, পাহাড়ে, পর্বতে লুকাইয়া বাস করে। অতএব, ইহাতে বুঝা গেল যে বিদ্যা এমন একটি বস্তু, যাহার দরুন মানুষ সমস্ত পশু-পক্ষী ও জ্বীন জাতিকে কয়েদ করিয়া নিতে পারে এবং কষ্টও দিতে পারে। এইজন্য সকলেই মানুষ হইতে পালাইয়া থাকে।
আদমী রা দুশমনে পেনহা বছে আস্ত,
আদমী বা হজরে আকেল কাছে আস্ত।
খলকে খুব ও জেস্তে হাস্ত আজ মানে হাঁ,
মী জানাদ বরদেল বহরদমে কোবে শাঁ।
বহর গোছলে আর দররুয়ে দর জুয়েবার,
বরতু আপচে জানাদ দর আবেখার।
গারচে পেনহানে খার দর আবাস্ত পোস্ত,
চুঁ কে দর তু ম খালাদ দানিকে হাস্ত।
খারেকার হেচ্ছে হাও ও ছুছাহ্,
আজ হাজারাণে কাছ বুদেবে এক কাছাহ্।
বাশ তা হেচ্ছে হায়ে তু মাবদাল শওয়াদ,
তা বা বীনি শানো মশ্কেল হল শওয়াদ।
তা ছুখান হায়ে কেয়া রদ কর্দাহ্,
তা কেয়াঁ রা ছারওয়ার খোদ কর্দাহ্।
অর্থ: উপরে মানুষের বাহ্যিক শত্রুর কথা বর্ণনা করা হইয়াছে। এখানে মানুষের অভ্যন্তরীণ বাতেনী শত্রুর কথা বর্ণনা করিতে যাইয়া মাওলানা বলিতেছেন যে, মানুষের অন্তরে নিহিত কতগুলি শত্রু আছে। যে ব্যক্তি ইহা ভয় করিয়া সাবধানতা অবলম্বন করিয়া চলে, সে ব্যক্তি জ্ঞানী। যেভাবে বাতেনী শত্রু আছে, সেই রকম বাতেনী মিত্রও আছে, যেমন ফেরেস্তারা। অতএব, চরিত্রের ভাল-মন্দ আমাদের নিকট সুপ্তভাবে নিহিত আছে। যদিও আমরা উহা প্রকাশ্যে স্বচক্ষে দেখিতে পারি না বা অনুভব করিতে পারি না, কিন্তু উহার ক্রিয়া সর্বদা আমাদের অন্তরে পৌঁছিতে থাকে। ইহা দ্বারা বুঝা যায়, যে কোন বস্তু অন্তরে ক্রিয়া করিতেছে। যেমন হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হয়, রসূলুল্লাহ (দ:) ফরমাইয়াছেন – “মানুষের উপর এক শয়তান আসর করিতে থাকে এবং অন্য প্রকার আসর ফেরেস্তারা করিতে থাকে। অতএব, খারাপ কাজের খেয়াল শয়তান হইতে আসে, আর ভাল কাজের খেয়াল ফেরেস্তার তরফ হইতে আসে। মাওলানা উদাহরণ দিয়া বুঝাইয়া দিয়াছেন, কাজের ক্রিয়া দ্বারা কারণ অনুভব করা যায়, যদিও কারণ প্রকাশ্যে দেখা যায় না। যেমন তুমি নদীতে গোসল করিতে গেলে, পানির মধ্যে পায়ে কাঁটা বিঁধিয়া গেল। কাঁটা গভীর পানির নিচে, তাহা দেখা যায় না। কিন্তু তোমার পায়ে বিঁধিতেছে, তুমি নিশ্চয় করিয়া বুঝিতেছ যে কাঁটা আছে। এই রকম শয়তান যদিও দেখা যায় না, কুমন্ত্রণা দানে বুঝা যায় যে, শয়তান ক্রিয়া করিতেছে। এ রকমও মনে করা ঠিক না যে শয়তান মাত্র একটা। হাজার হাজার শয়তান আছে। যেমন হাদীস দ্বারা জানা যায় যে, অজুর মধ্যে ধোকা দেয় সেই শয়তানের নাম খানজাব; আর নামাজের মধ্যে যে ওয়াসওয়াসা দেয়, তাহার নাম ওলহান। এই রকম প্রত্যেক কাজের জন্য ভিন্ন ভিন্ন শয়তান আছে। এই সমস্ত ফেরেস্তা এবং শয়তান বিদ্যমান থাকার অবস্থা প্রমাণাদি দ্বারা বুঝা গেল। যদি স্বচক্ষে দেখিতে চাও, তবে ধৈর্য ধারণ কর, তোমার অনুভূতি-শক্তি পরিবর্তন হইয়া যাইবে। হয়ত মৃত্যুর পরে অথবা জীবিত অবস্থায় মারেফাতে রব্বানীর আলোতে দেখিতে পাইবে।
বাদে আজ আঁ গোফ্তান্দ কা আয়ে খরগোশে চোস্ত,
দরমীয়ানে আর আঁচে দর এদরাকে তুস্ত।
একে তু বাশেরে দর পিচিদায়ে,
বাজে গো রায়ে কে আন্দে শীদায়ে।
মোশওয়ারাতে এদরাকে ও হুশিয়ারী দেহাদ,
আকলেহা মর আকলেরা ইয়ারে দেহাদ।
গোফ্তে পয়গম্বর বকুন আয়রায়ে জন,
মোশওয়ারাতে কাল মোছতাশারে মোতামান।
কওলে পয়গম্বর বজানে বাইয়াদ শনুদ,
বাজে গো তা চীস্তে মাকছুদে তু জুদ।
অর্থ: বন্য পশুরা বলিল, হে চালাক খরগোশ! তুমি যে যুক্তির খেয়াল করিয়াছ, উহা প্রকাশ করিয়া বল। তুমি হীন ও দুর্বল হওয়া সত্ত্বেও শক্তিশালী বাঘের সহিত যে চাল চালিতে যাইতেছ, উহা প্রকাশ করিয়া বল। কেননা, পরামর্শ করায় অনুভূতি ও হুঁশিয়ারি বৃদ্ধি পায় এবং এক বুদ্ধির সহিত শত বুদ্ধির শক্তি যোগ হয়। পয়গম্বর (দ:) ফরমাইয়াছেন, যদি কোনো ব্যক্তি কোনো মত পোষণ করে, তবে উহা পরামর্শ করিয়া লওয়া উচিত। যখন হুজুর (দ:) পরামর্শের জন্য তাকিদ করিয়াছেন, তখন পরামর্শ করা অত্যন্ত আবশ্যকীয় বিষয় বলিয়া বুঝা উচিত। এইজন্য মাওলানা উৎসাহ দিয়া বলিতেছেন যে, পয়গম্বর (দ:)-এর এই এরশাদ মন ও প্রাণ দিয়া পালন করা চাই।
গোফ্ত হর রাজে না শাইয়াদ বাজে গোফ্ত,
জোফ্তে তাকে আইয়াদ গাহে গাহ্ তাকে জুফত্
আজ ছাফা গরদাম জনে বা আয়না,
তেরাহ্ গরদাদ জুদে বামা আয়না।
দর বয়ানে ইঁ ছে কম জম্বানে বস্ত,
আজ জেহাবে ও আজ জাহাবে ও জানাদ বস্ত।
কা ইঁ ছে রা বেছিয়ারে খছমাস্ত ও আদু,
দর কমিনাত ইস্তাদ চুঁ দানাদ উ।
ওয়ার বগুই বা একে গো আলবেদা,
কুল্লু ছেররেন জাওয়াজাল উছনাইনে শায়া।
গেরদো ছার পরেন্দাহ্ রা বন্দী বহাম,
বর জমীনে মনেন্দে মাহবুছ আজ আলাম।
অর্থ: খরগোশ উত্তর করিল, পরামর্শ নিশ্চয় উত্তম বস্তু। কিন্তু প্রত্যেক রহস্য প্রকাশ করা উচিত নহে। জোড় বাক্য কোনো সময় বেজোড় হইয়া যায়, এবং বেজোড় বাক্য কোনো কোনো সময় জোড় বাক্যে পরিণত হয়। অতএব, প্রকাশ করিলেই বাক্য নিজের শক্তি হইতে অন্যের অধীনে চলিয়া যায়। ইহাও সম্ভব যে, যাহার জন্য প্রস্তাব করা হয়, উহাতে না প্রয়োগ করিয়া অন্য বিষয় ব্যবহার করা হয়। এইজন্য প্রকাশ না করাই ভাল। সকল কাজের জন্য পরামর্শ করার আদেশ দেওয়া হয় নাই। বরং ঐ সমস্ত কাজের জন্য পরামর্শ করার আদেশ দেওয়া হইয়াছে, যাহা ব্যক্ত হইলেও কোনো ক্ষতির আশংকা নাই। যেমন, তুমি যদি আয়নার উপর ফুঁক দাও, তবে নিশ্চয়ই আয়নার পরিচ্ছন্নতা নষ্ট হইয়া যাইবে। এই রকম বাক্য উচ্চারণকারীর রহস্য মুখ হইতে বাহির হইয়া গেলে, আয়নায় ফুঁক দিবার মত হইয়া যায়। যেমন, আয়নায় ফুঁক দিলে অস্বচ্ছ হইয়া যায়। এই রকম যতক্ষণ পর্যন্ত রহস্য প্রকাশ না করা হয়, ততক্ষণ শ্রোতার অন্তঃকরণ আয়নার ন্যায় পরিষ্কার থাকে। তারপর যখনই তাহাকে রহস্য সম্বন্ধে জানান হয়, অধিকাংশ সময়েই দেখা যায় শ্রোতার অন্তরের পরিচ্ছন্নতা দূর হইয়া চালাকিতে পরিণত হয় এবং ক্ষতি করার চেষ্টা আরম্ভ করিয়া দেয়। অস্বচ্ছ আয়নার ন্যায় অপরিষ্কার হইতে আরম্ভ হয়। এইজন্য গুপ্ত রহস্য প্রকাশ করা অনুচিত। বিশেষ করিয়া নিম্নলিখিত তিনটি বিষয় – এমনকি মুখেও আনিতে হয় না। প্রথম হইল নিজের কোনো স্থানে যাইবার অবস্থা; যেমন কখন যাইবে, কীভাবে যাইবে ইত্যাদি। দ্বিতীয় নিজের টাকা পয়সার পরিমাণ কোথায় আছে, কাহারও নিকট প্রকাশ করিবে না। তৃতীয় গন্তব্যস্থান। কোথায় যাইয়া পৌঁছিবে, কাহারও কাছে প্রকাশ করিবে না। কেননা, এ তিন বিষয়ের অনেক শত্রু আছে। যদি কোনো শত্রু জানিতে পারে, তবে সে ওঁত পাতিয়া থাকিবে, যে কীভাবে ক্ষতি করা যায়। যদি একজনের নিকটও প্রকাশ করা হয়, তবে তুমি বেশ করিয়া জানিয়া রাখ, যে গুপ্ত রহস্য দ্বিতীয় ব্যক্তির কাছে যায়, উহা প্রকাশ হইয়া গিয়াছে বলিয়া ধরিয়া নিতে হইবে। গুপ্ত রহস্য প্রকাশ হইবার দ্বিতীয় উদাহরণ দিয়া মাওলানা বলিতেছেন, দুইটি বা চারিটি পাখী ধরিয়া একে অন্যের সহিত মিলাইয়া বাঁধিয়া জমিনে ফেলিয়া রাখ। তবে দেখিবে বিপদগ্রস্ত হইয়া অসহায় অবস্থায় জমিনের উপর পড়িয়া থাকিবে। যদি তুমি ইহাদিগকে খুলিয়া দাও, তবে উড়িয়া যাইবে। এই রকমভাবে তোমার গুপ্ত রহস্য যতক্ষণ পর্যন্ত তোমার অন্তরে আবদ্ধ থাকিবে, প্রকাশ পাওয়া হইতে নিরাপদ মনে করিবে এবং যখন ঐ কয়েদকানা হইতে বাহির করিয়া দিবে তখন চতুর্দিকে প্রকাশ হইয়া যাইবে।
মোশাওয়ারাতে দারীদ ছের পুশিদাহ্ খুব,
দরকেনায়াতে বা গলতে আফগান মশোব।
মোমাওয়ারাত কর্দী পয়ম্বর বস্তা ছার,
গোফ্তে ইশানাদ জওয়াবো বেখবর।
দর মেছালে বস্তা গোফ্তি রায়রা,
তা নাদানাদ খছমে আজ ছেররে পায়রা।
উ জওয়াবে খেশে বগেরেফ্তে আজু,
ওয়াজ ছেওয়াশ মী না বোরদে গায়রেবু।
অর্থ: মাওলানা বলেন, আমি উপরে উল্লেখ করিয়াছি গুপ্ত রহস্য সম্বন্ধে পরামর্শ করা উচিত না এবং সর্ব বিষয় পরামর্শ করা চাই না। বরং গুপ্ত বিষয়ের পরামর্শ ইশারা বা কেনায়া দ্বারা হওয়া উত্তম। এমন বাক্য দ্বারা হওয়া চাই, যাহাতে শ্রোতারা ভুল বুঝের মধ্যে পড়ে। প্রকৃত ঘটনা বুঝিতে পারিবে না। পরামর্শ ত হইল কিন্তু সন্দেহজনকভাবে। ইহাতে পরামর্শ করাও হইয়া গেল আর গুপ্ত বিষয় গুপ্তই থাকিয়া গেল। হজরত (দ:) গুপ্ত বিষয়ের প্রকৃত ঘটনা আবৃত রাখিয়া পরামর্শ করিতেন, শ্রোতারা শুনিয়া জওয়াব দিতেন। কিন্তু ঘটনা সম্বন্ধে কেহই অবগত হইতে পারিতেন না। যেমন, কোনো উদাহরণের মধ্যে প্রকৃত ঘটনা পেশ করিয়া মতামত চাওয়া হইত। বিরুদ্ধবাদীরা মূল ঘটনা সম্বন্ধে কিছুই জানিতে পারিত না। ঐ উদাহরণের জওয়াবে হুজুর (দ:) নিজের প্রশ্নের জওয়াব ঠিক করিয়া নিতেন, অন্য কেহ হুজুরের (দ:) উদ্দেশ্য বুঝিতে পারিত না।
ইঁ ছুখান পায়ানে নাদারাদ বাজে গরদ,
ছুয়ে খরগোশ দেলাওয়ার তা চে করদ।
হাছেল আঁ খরগোশ রায়ে খোদ না গোফ্ত,
মকর আন্দেশীদ রা খোদ তাক ও জোফ্ত।
বা ওহুশ আজ নেক ও বদ না কোশাদ রাজ,
ছেররে খোদ দরজানে খোদ মীরাজ বাজ।
অর্থ: এই গুপ্ত রহস্যের বিষয় বর্ণনার শেষ নাই। অতএব, এখন খরগোশের কেচ্ছা বর্ণনা করা উচিত। খরগোশ নিজের উদ্দেশ্য সাধনের জন্য নিজের অন্তরের ভেদ অন্য কাহারও কাছে ব্যক্ত করে নাই। নিজের অন্তরে বিভিন্ন রকমের ফন্দির কথা চিন্তা করিতেছিল। অন্য পশুদের নিকট ভাল-মন্দ কিছুই প্রকাশ করে নাই। নিজের গুপ্ত তদবীর নিজের অন্তরেই চালাইতেছিল।
ছায়াতে তাখীর করদ আন্দর শোদান,
বাদে আজ আঁ শোদ পেশে পেরে পাঞ্জা জান।
জে আঁ ছবাব কা আন্দার শোদান উমানাদ দের,
খাকে রা মী কুনাদ ওয়ামী গরীদ শের।
গোফ্তে মান গোফতাম কে আহাদে আঁ খাছান,
খাকে বাশদ খামো ছুছ্ত ও নারেছান।
দমে দমাহ্ ইশানে মরা আজ খর ফাগান্দ,
চান্দে বফরীবাদ মরা ইঁ দহর চান্দ।
ছখত দর মানাদ আমীরে ছুছতে রেশ,
চুঁ না পাছ বীনাদ না পেশে আজ আহমকেশ।
অর্থ: খরগোশ বাঘের সম্মুখে যাইতে বহুত দেরী করিয়া গিয়াছে। খরগোশের দেরী করিয়া যাওয়ার কারণে বাঘ ক্রোধে জমিনের সমস্ত মাটি উল্টাইয়া ফেলিতেছিল এবং ক্রোধে গরগর করিতে করিতে বলিতেছিল, আমি ত প্রথমেই বলিয়াছিলাম যে এই সমস্ত অনুপযুক্তদের ওয়াদা অসার ও অসম্পূর্ণ হইবে। ইহাদের ধোকাবাজী ও ফেরেবে আমাকে ধোকায় ফেলিয়াছে। ইহাদের ধোকায় আমাকে গাধার চাইতেও বোকা বানাইয়া ছাড়িয়াছে। আমি জানিনা, এই জামানার পশুরা আমাকে আর কত ধোকা দিবে। নির্বোধ হাকীম বোকামীর দরুণ সম্মুখ পিছন না ভাবিয়া রায় দিলে মহাবিপদে পড়িতে হয়। যেমন না ভাবিয়া এই বন্য পশুদের ওয়াদার উপর বিশ্বাস করিয়া আমার অবস্থা ঘটিয়াছে।
রাহে হামওয়ারাস্ত ও জীরাশ দামেহা,
কাহাতে মায়ানী দরমিয়ানে নামেহা।
লফ্ জেহাও নামেহা চু দামে হাস্ত,
লফ্জে শিরিন রেগে আবে ওমরে মাস্ত।
ওমরে চুঁ আবস্ত ওয়াক্তে উ রা চু জু,
খুলকে বাতেন রেখে জুই ওম্রে তু।
অর্থ: এখানে মাওলানা বলিতেছেন, জাহেরী কাজের পরিণাম চিন্তা না করিয়া কাজ করিলে যেমন ভুলে পতিত হইতে হয়, সেইরূপ বাতেনী কার্যকলাপের পরিণাম সম্বন্ধে অবগত না হইয়া তরীকা অবলম্বন করিলে পথভ্রষ্ট হইয়া বিপদগ্রস্ত হইতে হয়। অনেক ধোকাবাজ নকল পীর, মিষ্টি কথা ও বাহ্যিক পোষাক-পরিচ্ছদ দ্বারা মানুষকে ভুলাইয়া ফেলে। জনসাধারণ ধোকায় পড়িয়া তাহার হাতে বায়াত হয়, প্রকৃত অবস্থার তদারক করে না। এইজন্য মাওলানা বলিতেছেন, অনেক সময় রাস্তার উপর দিয়া মসৃণ দেখা যায়, কিন্তু উহার নিচে ফাঁদ বিছান থাকে। এই সমস্ত স্থানে বুদ্ধিমানের হুঁশিয়ারির আবশ্যকতা আছে। ধোকাবাজ নকল কামেলের উপরিভাগটা খুব পরিচ্ছন্ন-পবিত্র দেখায়, কিন্তু তাহার ধোকাবাজী ও খারাবী ভিতরে গুপ্ত ফাঁদের ন্যায় নিহিত থাকে। বাহ্যিক নামধামের মধ্যে এমন গুণের শব্দ বা বাক্য ব্যবহার করে, যাহার অর্থের দিক দিয়া তাহার মধ্যে কিছুই পাওয়া যায় না। যেমন শাহ্ সাহেব, মিয়া সাহেব, জাকেরে শাগেল, আবেদ ও জাহেদ ইত্যাদি। এই সমস্ত আওসাফের শব্দের অর্থের কিছুই তাহাদের মধ্যে পাওয়া যায় না। এইসব শব্দ তাহাদের নামে ব্যবহার করা হয় শুধু অশিক্ষিত জনসাধারণকে ধোকা দিবার জন্য। মিষ্টি বাক্য আমাদের জীবনের জন্য বালুর ন্যায়, যে বালু পানি চোষণ করিয়া নিয়া যায়। এই রকম মারেফাত শিক্ষার্থীর জীবন ধোকাবাজ দরবেশে ধ্বংস করিয়া দেয়। ধোকাবাজ দরবেশের নিকট গোমরাহী ছাড়া আর কিছুই শিক্ষা পাওয়া যায় না। শিক্ষার্থী ফেরেববাজীতে আবদ্ধ হইয়া অন্য কাহারও নিকট যাইতেও পারে না। এইরূপভাবে ধোকাবাজ পীরের খেদমতে আবদ্ধ হইয়া গেলে, মানুষের জীবন নষ্ট হইয়া যায়। মানুষের জীবন পানির ন্যায়; আর ওয়াক্ত, অর্থাৎ, জমানা ঐ জীবনের একটা অংশ মাত্র। তোমার মধ্যে যে খারাপ স্বভাব আছে, উহা তোমার জীবনের জন্য বালুর ন্যায়, অর্থাৎ, মন্দ স্বভাবে তোমার জীবনকালকে ধ্বংস করিয়া দিতেছে।
আঁ একে রেগে কে জুশোদ আব আজ উ,
ছখতে কামইয়াবাস্ত রাও আঁ রা বজু।
হাস্তে আঁ রেগ আয় পেছার মরদে খোদা,
কে বহক্কে পউস্ত ও আজ খোদ শোদ জুদা।
আবে আজব দীনে হামী জুশোদ আজু,
তালেবানে রা আজু হায়াতাস্ত ও নামু
গায়রে মরদে হক চু রেগে খোশ্কে দাঁ,
কা আবে ওমরাত রা খোরদে উ হর জমাঁ।
অর্থ: ভণ্ড ও ধোকাবাজ দরবেশের কথা বর্ণনা করার পর মাওলানা হাকিকী দরবেশের কথা বর্ণনা করিয়া দিতেছেন, তাহা হইতে তালেবের পক্ষে অনুসন্ধান করিয়া লওয়া সহজ হইবে; এবং খাঁটি কামেলের হাতে বায়াত হইতে বেগ পাইতে হইবে না। যেহেতু বাহ্যিক দৃষ্টিতে উভয় প্রকার দরবেশ একই রকম হইতে পারে, কিন্তু বাতেনী অবস্থার দিক দিয়া পার্থক্য নিশ্চয়ই থাকে; কিন্তু তা’সীরের দিক দিয়া পার্থক্য আছে। কোনো বালু এমন হয়, যাহার মধ্য হইতে পানি নির্গত হয়। এইরূপ বালুর সাথে কামেল শায়েখের তুলনা দেওয়া হয় আর কোনো বালু এমন হয় যে পানি যাহা থাকে, তাহাও চুষিয়া লইয়া যায় । এই প্রকার বালুর সাথে ধোকাবাজ পীরের তুলনা দেওয়া হইয়াছে। তাই মাওলানা বলিতেছেন যে, এক প্রকার বালু উহা হইতে পানি উথলিয়া নির্গত হয়। পীরে কামেল ঐ বালুর ন্যায়। তাঁহার মধ্য হইতেও বিদ্যা, মারেফত ও হাকিকাত উথলিয়া বাহির হইতে থাকে। এই প্রকার বালু সফলকাম হইয়া থাকে। ইহা তালাশ কর, অর্থাৎ, প্রকৃত আল্লাহর অলি, যিনি আল্লাহর নৈকট্য লাভ করিয়াছেন। পাপ তাঁহার নিকট হইতে দূর হইয়া গিয়াছে। দ্বীনের মিষ্টি পানি তাঁহার ভিতর হইতে যোশ মারিয়া বাহির হয়। ইহা দ্বারা প্রকৃত শিক্ষার্থীর উপকার হয়। আর যে ধোকাবাজ দরবেশ হয়, সে শুকনা বালুর ন্যায়। তোমার জীবনের রস সব সময় চুষিয়া খায়। অর্থাৎ, তোমার জীবনের বিদ্যা, আমল ও বয়স সব কিছুরই ক্ষতি করিয়া ফেলে।
হেকমাত শো আজ মরদে হেকীম,
তা আজ উ গরদী তু বেনিয়া ও আলীম।
মাম্বায়া হেকমত শওয়াদ্ হেকমত তলব,
ফারেগ আইয়াদ্ উ জে তাহ্ ছীলো ছবাব।
লোহে হাফেজ লোহে মাহ্ফুজী শওয়াদ্,
আকলে উ আজরূহে মাহ্ফুজে শওয়াদ্।
চুঁ মোয়াল্লেম বুয়াদ্ আকলাশ জে ইবতে দা,
বাদে আজ আঁ শোদ আকলে শাগেরদী ওরা।
আকলে চুঁ জিবরীলে গুইয়াদ আহ্মাদা,
গার একে গামে নেহাম ছুজাদ মরা।
তু মরা বোগজার জেইঁ পাছ পেশ রাঁ,
হদ্দে মান ইঁ বুয়াদ আয় ছুলতানে জাঁ।
অর্থ: যখন মানুষ দুই প্রকার প্রমাণ হইল, এক প্রকার শায়েখে কামেল, অন্য প্রকার ধোকাবাজ গণ্ডমূর্খ। অতএব, তুমি শায়েখে কামেল হইতে মারেফত শিক্ষা কর। তাহা হইলে তুমি নিজে জ্ঞানী ও কামেল ব্যক্তি হইতে পারিবে। যে ব্যক্তি মারেফতের অন্বেষণকারী হয়, সে একদিন মারেফতের উৎপত্তিস্থল, অর্থাৎ, মারেফতের ভাণ্ডার হইয়া যায়। মারেফতের ভাণ্ডারে পরিণত হইলে, জাহেরী এলেম শিক্ষার আবশ্যক হয় না। কেননা, সে আল্লাহর তরফ হইতে এল্মে লাদুনী প্রাপ্ত হইতে থাকে। ঐ ব্যক্তি এল্মে মারেফত শিক্ষার সময় লোহে হাফেজ ছিল, অর্থাৎ, শায়েখ হইতে শুনিয়া নিজের কলবের মধ্যে হেফাজত করিতেছিল। এলমে লাদুনী হাসেল হওয়ার পরে নিজের কলব লোহে মাহ্ফুজের ন্যায় হইয়া যায়। আল্লাহর তরফ হইতে তাঁহার কলবে এলমে হাকীকির নক্শা হইয়া যাইতে থাকে এবং তাহার জ্ঞান পবিত্র রূহের হেফাজতে থাকে। এলমে মারেফত শিক্ষা করার পূর্বে তাহার জ্ঞান চালক ছিল। মারেফতে কামালাত হাসেল করার পর আকল রূহের শাগরীদ হইয়া যায়। অর্থাৎ, পবিত্র রূহের দ্বারা আকল পরিচালিত হয়। তারপর আকল তাহাকে বলিতে থাকে, যেমন হজরত জিবরাইল (আ:) হজরত আহমদে মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামকে বলিয়াছিলেন, “যদি আমি সম্মুখে আর এক কদম অগ্রসর হই, তবে আল্লাহর নূরের তাজাল্লিতে পুড়িয়া ছাই হইয়া যাইব। আপনি আমাকে এখন এখানে থাকিতে দেন আর আপনি নিজে আগে তশরীফ রাখেন, আমার এই পর্যন্ত-ই সীমা ছিল। এই স্থানে যেমন হজরত জিবরাইল (আ:) প্রথম পথপ্রদর্শক ছিলেন, পরে অপারগ হইয়া গেলেন। এই রকমভাবে আকল প্রথমে পথ দেখাইয়া মারেফত শিক্ষা দিতে নিয়াছে। পরে আকল নিজেই অপারগ হইয়া যায়।
হর্কে মানাদ আজ কাহেলী বে শোকর ও ছবর,
উ হামী দানাদ কে গীরাদ পায়ে জবর।
হর্কে ষবর আওরাদ ও খোদ রঞ্জুরে করদ,
তা হুমানে রঞ্জুরেশে দর গোরে করদ।
গোফ্তে পয়গম্বর কে রঞ্জুরে বা লাগ,
রঞ্জে আরাদ তা বমীরাদ চুঁ চেরাগ।
অর্থ: এখানে মাওলানা যে ব্যক্তি অলসতা করিয়া শায়েখে কামেল হইতে শিক্ষা গ্রহণ না করে, তাহার কুফলের কথা বর্ণনা করিয়া বলিতেছেন, যে ব্যক্তি অসলতা করিয়া না শোকর ও বে-সবর থাকিয়া গেল, অর্থাৎ, খোদাপ্রদত্ত শিক্ষা, শক্তি কাজে না লাগাইয়া বেকার থাকিয়া গেল, সে যেন আল্লাহর নেয়ামতের শোকর আদায় করিল না, কষ্ট সহ্য করিয়া এলেম কামাই করিল না, অধৈর্য হইয়া পড়িল। মাওলানা বলেন, যে ব্যক্তি অলসতা সহকারে যবরিয়া হইয়া বসে, সে যেন নিজেকে রোগী বানাইয়া বসিল। অবশেষে ঐ রোগেই তাহাকে কবরে পৌঁছাইয়া দেয়। যেমন, হুজুর (দ:) ফরমাইয়াছেন যে ঝুট-মুট এবং হাসি-তামাসা রোগ বৃদ্ধি করিয়া দেয়। আর সততায় রোগীকে সুস্থ করিয়া দেয়। অতএব, অলসতার দরুন মিথ্যার ভান করিতে হয় না; তাহা হইলে প্রকৃতপক্ষে মিথ্যার দরুন ধ্বংস হইতে হইবে।
যবর চে বুদ বুস্তানে আশেকাস্তারা,
ইয়া বা পেওস্তান রগে বগোস্তারা।
চুঁ দর ইঁ রাহ্ পায়ে খোদ নাশেকাস্তা,
বরফে মী খান্দি চে পারা বস্তা।
ও আঁফে পায়াশ দর রাহে কোশন শেকাস্ত,
দর রছীদে উ রা বুরাফ ও বর নেছাস্ত,
হামেলে দীনে বুদ উ মাহ্মুল শোদ,
কাবেলে ফর্মানে বুদ উ মকবুলে শোদ।
তা কনুঁ ফরমানে পেজিরফতী জেশাহ্,
বাদে আজ ইঁ ফর্মান রেছানাদ বর ছপাহ্।
তা কানুঁ আখ্তারে আছর কর্দে দরুউ,
বাদে আজ আঁ বাশদ আমীরে আখতারে উ।
গার তোরা এশকালে আইয়াদ দর নজর,
পাছ তু শক দারী দর ইনশাক্কাল কামার।
অর্থ: এখানে মাওলানা যবরিয়া মতবাদের উত্তর দিতেছেন যে, যবর কী? যবর শব্দের অর্থ ভাঙ্গাকে গড়া। অথবা ছিন্ন রগকে জোড়ান। তুমি পথ চলিতে যাইয়া পা ভাঙ্গো নাই বা কোনো রগ ছিন্ন হয় নাই, যাহা তুমি জোড়া লাগাইবে বা পট্টি বাঁধিয়া গড়াইবে। বরং যে ব্যক্তির পা মোজাহেদা করার পথে ভাঙ্গিয়া গিয়াছে, অর্থাৎ, নিজের শক্তি অনুযায়ী মোজাহেদাহ করিতে করিতে শক্তি ক্ষয় হইয়া গিয়াছে, এখন আর শক্তি নাই, অপারগ হইয়া গিয়াছে, এস্থলে বলা হইয়াছে যে পা ভাঙ্গিয়া গিয়াছে। তাহার জন্য আল্লাহতায়ালার আকর্ষণ আসিয়া পৌঁছিবে। সেই আকর্ষণের দরুন সে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করিবে। যে ব্যক্তি মোজাহেদা ও মোশক্কাত করিয়া আল্লাহর নৈকট্য লাভ করে, সে প্রথমে ধর্মের বিধান পালন করার কষ্ট মাথায় বহন করিত। যখন আল্লাহর ইশ্কের নূর হাসেল হইয়া যায়, তখন তাহাকে আর কষ্ট স্বীকার করিতে হয় না। তাহাকেই বহন করিয়া নেওয়া হয়। গায়েবী আকর্ষণ তাহাকে গন্তব্যস্থানে নিয়া পৌঁছাইয়া দেয়। প্রথমে আল্লাহতায়ালার আদেশ নিষেধ পালন করিতে হইত, এখন সে আল্লাহর দরবারে কবুল হইয়া যাইবে। যেমন, কোনো ব্যক্তি কোনো বাদশাহর বাধ্যগত চলিত। কিছু দিন পরে পদের উন্নতি হওয়ায় নিজেই এখন সৈন্যদের উপর আদেশ নিষেধ চালাইতে পারে; এই রকমভাবে আহলে মারেফাতের অবস্থা হয়। প্রথমে আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী চলিতে হয়। পরে নিজে কামেল হইয়া অপরকে তালীম ও তরবিয়াত দিতে পারে। কামালাতের দরজা হাসেল করার আগে তাহার উপর তারকাসমূহের ক্রিয়া চলে। কামালাতের দরজায় পৌঁছিয়া গেলে, তারপর সে নিজেই তারকাসমূহের উপর হুকুমাত চালনা করিতে পারে। অর্থাৎ, তাহার ইচ্ছায় তারকা চালিত হয়। প্রকৃতপক্ষে তারকাসমূহ খোদার ইচ্ছায় চালিত হয়। কিন্তু বান্দা খোদার নিকট মকবুল হইয়া গেলে, খোদার ইচ্ছার সাথে বান্দার ইচ্ছা সামঞ্জস্য হইয়া যায়। সেই হিসাবে শায়েখে কামেল সব কিছু চালনার শক্তি হাসেল করেন। মাওলানা বলেন, তুমি যদি এই সম্বন্ধে সন্দেহ পোষণ কর, তবে তুমি নিশ্চয়ই চন্দ্র দ্বিখণ্ডিত হওয়া সম্বন্ধে সন্দেহ পোষণ কর ধরিয়া নিতে হইবে। নবী (আ:)-দের নিকট হইতে যে কাজ মোজেজা হিসাবে প্রকাশ পাইয়াছে, পরে ঐরূপ কাজ তাঁহাদের মকবুল উম্মাত শায়েখে কামেল হইতে কারামত হিসাবে প্রকাশ পাওয়ায় কোনো নিষেধ নাই। কিন্তু মোজেজায় কুরআন, পবিত্র কুরআনের ন্যায় ঐরূপ মোজেজা কেহ দেখাইতে পারিবে না। পবিত্র কুরআনেই সে কথা উল্লেখ করিয়া দিয়াছেন। বাকী সম্বন্ধে কোনো অসম্ভাব্যতার প্রমাণ নাই। খোদায় ইচ্ছা করিলে ঐরূপ কাজ কারামত হিসাবে তাঁহার দ্বারাও প্রকাশ করাইতে পারেন।
তাজাহ্কুন ঈমান না আজ গোফ্তে জবান,
আয় হাওয়া রা তাজাহ কর্দাহ দরনেহাঁ।
তা হাওয়া তাজাহাস্ত ঈমান তাজাহ্ নিস্ত,
কে ইঁ হাওয়া জুয্ কুফলে আঁ দরওয়াজা নিস্ত।
কর্দায়ে তাওবীলে লফ্জে বকরে রা,
খেশেরা তাওবীলে কুল নায়ে জেকরেরা।
ফেক্রে তু তাওবীলে করদাহ্ জেকরে রা,
জেকরে রা মানো বগেরদাঁ ফেকরে রা।
বর হাওয়া তাওবীলে কুরআন মী কুনী,
পুস্তো কাজ শোদ আজ তু মায়ানী ছুনী।
অর্থ: উপরে চন্দ্র দ্বি-খণ্ডিত হওয়া মোজেজা সম্বন্ধে যে প্রমাণ দেওয়া হইয়াছে, উহাতে কেহ সন্দেহ না করিতে পারে, এইজন্য মাওলানা সন্দেহ দূর করার জন্য বলিতেছেন, তোমরা সত্যবাদিতা সহকারে মনে প্রাণে ঈমান তাজা কর। শুধু মুখ দিয়া ঈমান প্রকাশ করিলে যথেষ্ট হয় না, তোমরা অন্তরে খাহেশে নফ্সানী তাজা করিয়া রাখিয়াছ। ইহার দরুনই তোমরা চন্দ্র দুই খণ্ড হওয়া অস্বীকার করিতে পার। কেননা, আহলে বেদায়াত (বেআতী)-রা খাহেশে নফসানীর প্রভাবে আয়াতে কুর্য়ানীর মধ্যে রদ বদল আরম্ভ করিয়া দেয়। অতএব, যতক্ষণ পর্যন্ত খাহেশে নফসানী তাজা থাকিবে, ততক্ষণ পর্যন্ত ঈমান তাজা বা সবল হইবে না। হাদীসে উল্লেখ আছে যে, হুজুর (দ:) ফরমাইয়াছেন, তোমাদের মধ্যে কেহ-ই পূর্ণ ঈমানদার হইতে পারিবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত সে খাহেশে নফসানীর অনুসরণ করিবে। কেননা, খাহেশে নফ্সানী ঈমানের দরজার তালাস্বরূপ, যদ্বারা ঈমান ও আমল প্রকাশ পাইতে পারে না। অতএব, তুমি যতক্ষণ পর্যন্ত খাহেশে নফসানী দূর করিতে না পারিবে, ততক্ষণ পবিত্র কুরআন ও হাদীসের মর্ম অনুধাবন করিতে পারিবে না। তোমার মূর্খতা ও অজ্ঞতার কারণে সুরক্ষিত কোরআন ও হাদীসসমূহের মধ্যে তাওবীল করিতে আরম্ভ কর। পবিত্র কুরআনের শব্দ ও বাক্যসমূহের তাওবীল না করিয়া নিজেকে তাওবীল কর। নিজের নফ্সকে সংশোধন কর, তবে তুমি কোরআন ও হাদীসের মর্ম ও রহস্য অনুধাবন করিতে পারিবে। তোমার চিন্তাধারা ও ফেকের দ্বারা পবিত্র কুরআনকে পরিবর্তন করিতে চাও। ইহা না করিয়া কোরআনকে কোরানের স্থানে থাকিতে দাও, বরং তোমার চিন্তাধারাকে পরিবর্তন কর। তোমার চিন্তাধারা অনুযায়ী পবিত্র কুরআনের ব্যাখ্যা করিলে কুরআন পরিবর্তন হইয়া যায়। এইজন্যই হুজুর (দ:) বর্ণনা করিয়াছেন, যে ব্যক্তি নিজের চিন্তাধারা অনুযায়ী পবিত্র কুরআনের ব্যাখ্যা করিবে, সে কাফের হইয়া যাইবে।
খানাদ আহ্ওয়ালাতে বদাঁ তরফা মাগাছ,
কো হামী পেন্দাশত খোদরা হাস্তে কাছ।
আজ খোদী ছার মস্তে গাস্তাহ বেশরাব,
জর্রায়ে খোদ্রা বদীদাহ্ আফতাব।
ওয়াছফে বাজাঁ রা শনিদাহ্ দর বয়ান,
গোফ্তে মান উনকায়ে ওয়াক্তাম বে গুমান।
গোফ্তে মান দরিয়াও কাস্তি খান্দাম,
মুদ্দাতে দর ফেক্রে আঁ মী মান্দাম।
আঁ মাগাছ বর বরগে কাহে ও বউলে খর,
হাম চু কাস্তিয়াঁ হামী আফরাস্তে ফর।
ইঁ নাক ইঁ দরিয়াও ইঁ কাস্তি ও মান,
মরদে কাস্তি বাঁ ও আহ্লে রায়ে ও ফান।
বর্ছারে দরিয়া হামী রানাদ ও আমাদ,
মী নামুদাশ আঁকদরে বীরুঁ জে হদ।
বুদে বে হদ আঁ চেমীন নেছবাত বদু,
আঁ নজর কো বীনাদ আঁ রা রাস্তে কু।
আলমাশ চান্দাঁ বুদে কাশ বীনাশাস্ত,
চশমে চান্দি ইঁ বহরে হাম চান্দিনা শাস্ত।
ছাহেবে তাওবীলে বাতেল চুঁ মাগাছ,
ও হাম উ বউলে খর ও তাছবীরে খাছ।
গার্ মাগাছ তাওবীলে বোগজারাদ বরায়ে,
আঁ মাগাছ রা বখতে গরদান্দ হুমায়ে।
আঁ মাগাছ নাবুদে কাশ ইঁ গায়রাতে বুদ,
রূহে উ নায়ে দর খোরে ছুরাতে বুদ।
হাম চু আঁ খরগোশে কো বর শেরে জাদ,
রূহে উ কায়ে বওয়াদ আন্দর খোরদে কাদ।
অর্থ: উপরোক্ত বয়াত-সমূহে মাওলানা বাতেল ব্যাখ্যাসমূহের দৃষ্টান্ত দিয়া প্রকাশ করিতেছেন, বাতেল ব্যাখ্যাকারীর অবস্থা যেমন আশ্চর্যজনক ক্ষুদ্র এক মাছির ন্যায়। ঐ ক্ষুদ্র মাছি নিজেকে নিজে মস্ত বড় একটি প্রকাণ্ড প্রাণী বলিয়া মনে করিত। শরাব পান ইহার মাথায় ঘুরপাক মারিতে থাকিত এবং ক্ষুদ্র নিজেকে আফ্তাব মনে করিত। কোনো স্থানে বাজ পাখীর কেচ্ছা শুনিলে বলিত, আমি বর্তমান সময়ের উন্কা পাখী। উন্কা বাজ পাখীর চাইতেও অনেক বড়। এই রকম খেয়ালের একটি মাছি ঘটনাক্রমে একদিন এক গাধার পেশাবের মধ্যে ভাসমান একটা শুকনা খড়ের উপর যাইয়া বসিল। তারপর বিজ্ঞ মাঝির ন্যায় গর্ব করিয়া বলিতে লাগিল যে আমি সাগর আর নৌকার কেচ্ছা কেতাবে পাঠ করিয়াছিলাম। বহুদিন পর্যন্ত এই চিন্তায় ছিলাম, দরিয়া এবং নৌকা কীরূপ হইয়া থাকে? এখন বুঝিতে পারিলাম যে দরিয়া ইহাকেই বলে। অর্থাৎ, গাধার পেশাব, আর এই শুক্না খড় নৌকা হইবে এবং আমি বিজ্ঞ মাঝি। ঐ দরিয়ায় বসিয়া সে আনন্দ করিতেছিল। ঐ পরিমাণকেই সে সীমার বাহিরে মনে করিতেছিল। প্রকৃতপক্ষেই এতখানি গাধার পেশাব ইহার নিকট সীমাহীন বলিয়া মনে হইতেছিল। এই রকম চিন্তা শক্তি আর কোথায় পাওয়া যায় যে ইহাকে শুদ্ধ বলিয়া মনে করিবে। মাছির পৃথিবী ত এতখানি, যতখানি সে চক্ষে দেখে। যখন দৃষ্টিশক্তি এতখানি, তখন তাহার দরিয়াও অতটুকু হইবে। দৃষ্টিশক্তির পরিমাণ যখন কম ছিল, তখন অতটুকু গাধার পেশাব তাহার নিকট কিনারাহীন দরিয়া ও সীমাহীন পৃথিবী মনে হইতেছিল। অতএব, ভুল ব্যাখ্যাকারীদেরও অবস্থা ঐ ক্ষুদ্র মাছির ন্যায়। নিজেকে বিদ্বান ও বিজ্ঞ পণ্ডিত বলিয়া মনে করে। তাহার ধ্যান-ধারণা গাধার পেশাবের ন্যায় ভুল দরিয়া। যদি মাছি নিজের জ্ঞান-আন্দাজ রায় না দিত, বরং কামেল বোযুর্গের অনুসরণ করিত, ইহাকে শরিয়তের গণ্ডির মধ্যে রাখিত, তবে রায় দ্বারা পরিষ্কার জানা যাইত যে দলিলে শরিয়ত দ্বারা ব্যাখ্যা করা জায়েজ আছে। তাহা হইলে ঐ ক্ষুদ্র মাছির বলন্দ নসিব হাসেল হইত। ক্ষুদ্র জ্ঞানী ও আহ্লে বাতেল (বাতেল লোকেরা) কামেলের সোহবাত দ্বারা আহলে হক ও কামেল হইতে পারে। মাওলানা বলেন, ঐ ক্ষুদ্র মাছি মাছি-ই থাকিবে না; যাহার এই রকম গায়েরাত হইবে। যে শরিয়তের মধ্যে ঐ রকম নিজের রায় দ্বারা কাজ না করে, তবে ঐ ব্যক্তিকে অসম্পূর্ণ মনে করা চাই না। যদিও বাহ্যিক পড়াশুনা করার দিক দিয়া শূন্য। এই রকম অনেক কামেল লোক অতিবাহিত হইয়া গিয়াছেন, যাহারা বাহ্যিক পড়াশুনা করেন নাই, কিন্তু আলেমদের সোহবাতে থাকিয়া বাহ্যিক বিদ্যা হাসেল করিয়া লইয়াছেন। প্রকৃত রহস্যসমূহ এলম দ্বারা মালুম করিয়া লইয়াছেন। তাহাদের প্রকাশ্য সুরাত বাতেনী রূহের সহিত সামঞ্জস্য ছিল না। যদিও প্রকাশ্যে এলম বা বিদ্যাশূন্য বলিয়া মনে হইত। কিন্তু হাকিকতের দিক দিয়া পূর্ণ কামেল ছিলেন। যেমন পরে মাওলানা খরগোশের ঘটনা উল্লেখ করিয়া প্রমাণ করিয়া দিতেছেন যে, খরগোশ যদিও আকৃতিতে ক্ষুদ্র, তথাপি ইহা জ্ঞানের দিক দিয়া পূর্ণ কামেল ছিল।
শের মী গোফ্ত আজ ছারে তেজী ও খশ্ম,
কাজ রাহে গোশাম আদু বর বস্তে চশম।
মকরে হায়ে যবরিয়া নাম বস্তা কর্দ।
তেগে চৌ বীনে শানে তনাম রা খাস্তা কর্দ।
জে ইঁ ছেপাছ মান না শনুম আঁ দমদমা,
বাংগে দেও আনাস্ত ও গুলানে আঁ হামা।
বর দরানে আ বদেলে তু ইশাঁরা মাইস্ত,
পোস্তে শাঁ বর কুনফে গায়েরে গোস্ত নীস্ত।
অর্থ: খোরগোশের যখন যাইতে দেরী হইল, তখন বাঘ রাগান্বিত হইয়া গর্জন করিয়া বলিতেছিল যে, এই সমস্ত বন্য দুশ্মনেরা কানের দিক দিয়া আমার চক্ষু অন্ধ করিয়া রাখিয়াছে। অর্থাৎ, সত্য মিথ্যা কথা বলিয়া প্রকৃত ঘটনা আমার নিকট গুপ্ত রাখিয়াছে। ঐ যবরিয়াদের ধোকায় আমাকে শিকার করা হইতে আবদ্ধ করিয়া রাখিয়াছে এবং ইহাদের সত্য ও মিথ্যায় আমার দেহ জখম হইয়া গিয়াছে। ইহার পর হইতে আমি কখনও ইহাদের ধোকাবাজীর কথা শুনিব না। কেননা, ইহাদের সকল কথাই শয়তানদের কথার ন্যায়। পথিকদিগকে ডাকিয়া ডাকিয়া পথ ভুলাইয়া দেয়। আচ্ছা! হে মন, তুমি ইহাদিগকে শাস্তি দাও, কখনও থামিও না। ইহাদের চামড়া খসাইয়া ফেল। কেননা, ইহাদের মধ্যে চামড়া ব্যতীত অন্য কোন ভাল গুণ নাই। ওয়াদা পূরণ করে না, সত্য কথা বলে না। তাই ইহাদিগকে শাস্তি দেওয়া দরকার।
পোস্ত চে বুদ গোফ্ তাহায়ে রংগে রংগে,
চু জরাহ বর আবেকাশ নাবুদ দেরেঙ্গ।
ইঁ ছুখান চুঁ পোস্তে মায়ানী মগজে দাঁ,
ইঁ ছুখান চুঁ নকশে মায়ানী হামচু জাঁ।
পোস্তে বাশদ মগ্জে বদরা আয়েবে পোশ,
মগজে নেকুরা জে গায়েরাত গায়েবে পোশ।
চুঁ জে বা দস্তাত কলমে দফতর জে আব,
হরচে বনাওবেছী ফানা গর্দাদ শেতাব।
নকশে আবাস্ত আর ওফা জুই আজ আঁ,
বাজে গর্দী দস্তে হায়ে খোদ গোজাঁ।
অর্থ: এখানে মাওলানা চামড়া সম্বন্ধে বলিতেছেন, তোমরা কি জানো চামড়া কী বস্তু? ইহা অতিরঞ্জিত নানা প্রকার রংয়ের কথাবার্তা। ইহা দ্বারা ভিতরের বস্তু ঢাকিয়া রাখে। ইহার দৃষ্টান্ত যেমন পানির উপর বাতাসের দ্বারা যে ঢেউয়ে ফেনা তৈয়ার হইয়া যায়, ইহার কনো স্থায়িত্ব নাই। এইভাবে জাহেরী কালাম-সমূহকে খালের ন্যায় মনে কর এবং ইহার মায়ানী ও হাকিকাতকে মগজের ন্যায় মনে কর। আরো দৃষ্টান্ত দেওয়া যাইতে পারে। যেমন জাহেরী কালামকে নক্শা ও দেহের সাথে তুলনা করা যায়, আর উহার মায়ানীকে রূহের সহিত উপমা দেওয়া যায়। খেয়াল কর, যেমন খাল ও নকশা উদ্দেশ্যবিহীন হয়, আর মগজ ও রূহ্ আসল উদ্দেশ্য থাকে। এইভাবে প্রকাশ্যে বাক্য দ্বারা কোনো উদ্দেশ্য থাকে না, আসল উদ্দেশ্য হইল ইহার অর্থ। চামড়া বা খালের স্বভাব হইল ভিতরের বস্তু ঢাকিয়া রাখা। যদি ভিতরে খারাপ জিনিস থাকে, তবে উহা লুকাইয়া রাখে, যাহাতে উপর দিয়া খারাবি দেখা না যায়। আর যদি ভিতরে উত্তম জিনিস থাকে, তবে নিজের আত্মসম্মান বজায় রাখার জন্য সম্মানহীনদের নজরে যাহাতে না পড়ে, সেই জন্য ঢাকিয়া রাখে। এইভাবে কালামেরও স্বভাব আছে। প্রায় ভণ্ড দাবীদারদের কালাম-ই অতিরঞ্জিত ও চটকদার হইয়া থাকে, ঐ কালামের দরুণ তাহাদের প্রকৃত অবস্থা অশিক্ষিত জনসাধারণের নিকট লুপ্ত থাকে, প্রকাশ পায় না এবং আহালে হকদের কালাম প্রায়-ই সাদাসিধা, সংক্ষেপে রংবিহীন আকারে বলা হয়। ইহার আড়ালে বোজর্গ লোকদের কামালাত জনসাধারণের নিকট প্রকাশ পায় না, গুপ্ত থাকে। এইজন্য জাহেরী কালামকে চামড়ার সাথে তুলনা করা হইয়াছে। অতএব, এই জাহেরী কালাম ক্রিয়া ও স্বভাবের দিক দিয়া চামড়ার ন্যায়, বিশেষ করিয়া অতিরঞ্জিত কালাম-গুলি স্থায়িত্বের দিক দিয়া পানির ফেনার ন্যায়। যেমন উপরের বয়াতে উল্লেখ করা হইয়াছে। সেইদিকে লক্ষ্য করিয়া মওলানা বলিতেছেন যে, যখন বায়ুর কলম ও পানির দফতর, তবে যাহা কিছু লিখা হয়, উহা শীঘ্রই ফানা হইয়া যাইবে। কেননা, উহা শুধু পানির উপরের নকশা মাত্র। ইহা হইতে যদি ওয়াফা-দারীর আশা কর, তবে পরিণামে যাইয়া হতাশা প্রকাশ করিতে হইবে। এই রূপভাবে রঙ্গীন বাক্যের উচ্চারণকারীর নিকট ওয়াদা পূরণের আশা করা চাই না।
বাদে দর মরদম হাওয়াও আরজুস্ত,
চুঁ হাওয়া বগোজাস্তী পয়গামে হুস্ত
খোশে বুদ পয়গাম হায়ে কের্দে গার,
কো জেছার তা পায়ে বাশদ পায়েদার।
খোতবায়ে শাহানে বগরদাদ ও আঁকেয়া,
জয কেয়া ও খোতাব হায়ে আম্বিয়া।
জা আঁকে বুশে বাদশাহানে আজ হাওয়াস্ত,
বারে নামা আম্বিয়া আজ কিবরিয়াস্ত।
আজ দরমেহা নামে শাহানে বর কুনান্দ,
নামে আহ্মাদ তা কিয়ামত মী জানান্দ।
নামে আহ্মাদ নামে জুমলা আম্বিয়াস্ত,
চুঁকে ছদ আমদ নূদে হাম পেশে মাস্ত।
ইঁ ছুখান পায়ানে না দারাদ আয় পেছার,
কেচ্ছায়ে খরগোশে গো ও শেরে নর।
অর্থ: মাওলানা বলেন, মানুষের মধ্যে যে হাওয়ায়ে নফ্সানী ও আকাঙ্ক্ষাসমূহ আছে, ইহা বায়ুর সাথে তুলনা রাখে। অতএব, যে সমস্ত কাজ ও কথা ঐ হাওয়ায়ে নফসানী দ্বারা উৎপত্তি হয়, উহার মধ্যে সত্য মিথ্যার কোনো পার্থক্য থাকে না; ইহা শুধু পানির উপর বুদবুদের ন্যায়, ইহার কোনো স্থায়িত্ব নাই এবং বিশ্বাসযোগ্যও নহে। যদি এই খাহেশে নফ্সানী পরিত্যাগ করা যায়, তবে কলবের মধ্যে সত্যকাজের প্রেরণা আসে এবং আল্লাহর তরফ হইতে গায়েবী এলেম ও মদদ পাওয়া যায়। তারপর যে সমস্ত কথা অন্তারে খেয়াল হয়, নিশ্চয়ই ইহার স্থায়িত্ব থাকে এবং বিশ্বাসযোগ্যও হয়। যেমন, মাওলানা বলেন, আল্লাহতায়ালার তরফ হইতে যে হুকুম হয় উহাই উত্তম এবং স্থায়ী হয়। বাদশাহদের খোতবা ও তাহাদের নেতৃত্ব পরিবর্তন হইয়া যায়। যেমন একজন বাদশাহ মরিয়া গেল। তাহার নাম খুতবা হইতে বাদ দেওয়া হয় এবং তাহার রাজত্বকাল চলিয়া যায়। কিন্তু আম্বিয়া (আ:)-গণের নেতৃত্ব ও তাঁহাদের খুতবা-সমূহ, তাঁহারা মৃত্যুমুখে পতিত হইলেও তাহার পরেও শেষ হয় না। বাদশাহদের কার্যকলাপ মনের খেয়ালে ও দুনিয়ার শখে করা হয়। আর হজরত আম্বিয়া (আ:)-গণের সৌন্দর্য্য ও মরতবা শরিয়তের নির্দেশ অনুযায়ী আল্লাহর তরফ হইতে প্রাপ্ত হয়। এইজন্য কোনো বাদশার মৃত্যু হইলে তাহার নামের মোহর টাকার উপর দেওয়া বন্ধ করিয়া দেয়া হয়। আম্বিয়া (আ:)-গণের শান এই রকম যেমন হজরত আহ্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের নাম মোবারক কিয়ামত পর্যন্ত জিন্দা থাকিবে। ইহাতে বুঝা যায়, যে কাজ নিজের মনের খেয়ালে শখের জন্য করা হয়, উহা স্থায়ী হয় না। যাহা আল্লাহর তরফ হইতে করা হয়, উহা স্থায়ী থাকে। মাওলালা বলেন, সমস্ত আম্বিয়া (আ:)-এর প্রসঙ্গ উল্লেখ করিয়া শুধু হজরত পাক (দ:)-এর নাম মোবারক বলা হইল। ইহার কারণ, হজরত আহ্মদ মোস্তাফা সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের নামের মধ্যে সকলের নাম-ই নিহিত আছে, অর্থাৎ, ‘আহ্মদ’ সব আম্বিয়া (আ:)-গণের মোবারক নাম। কেননা, হুজুর (দ:) সমস্ত আম্বিয়া (আ:)-গণের কামালাতের সমষ্টি। অতএব, হুজুর পাক (দ:)-এর নাম লওয়া অর্থ সমস্ত আম্বিয়া (আ:)-গণের নাম লওয়া। আহমদী শরিয়ত বাকী থাকা অর্থ সমস্ত নবীদের শরিয়ত বাকী থাকা। এই জন্য সবের নাম না উল্লেখ করিয়া হযরত আহমদ মোস্তফা (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)-এর নাম মোবারক উল্লেখ করা হইয়াছে এবং তাঁহার দ্বীন বাকী থাকার কথা উল্লেখ করিয়া সমস্ত আম্বিয়া (আ:)-দের দ্বীন বাকী থাকা প্রমাণ করা হইয়াছে। ইহার দৃষ্টান্ত যেমন একশত উল্লেখ করিলে ইহার মধ্যে নব্বইকে পাওয়া হয়। আল্লাহর তরফ হইতে যাহা হয়, ইহা স্থায়ী হয়। এরূপ দৃষ্টান্ত বহু দেওয়া যায়, ইহার কোনো সীমা নাই। অতএব, এখন শেষ করিয়া খরগোশের কেচ্ছা বলা উচিত।
দরশোদানে খরগোশ বছতারিখে কর্দ,
মক্রে রা বা খেশতনে তাকরীরে কর্দ।
দররাহে আমদ বাদে তাখীরে দরাজ,
তা বগোশে শেরে গুইয়াদ এক দোরাজ।
অর্থ: খরগোশ বাঘের সম্মুখে যাইতে খুব দেরী করিল। নিজের মনে অনেক ধোকা ও তদবীর চিন্তা করিয়া বাহির করিয়া লইল। তারপর রাস্তায় বাহির হইয়া চলিতে লাগিল, এবং মনে মনে স্থির করিল যে, নিজের চিন্তা করা ধোকার দুই একটা উপযোগী সময়ে বাঘের কানে বলিবে।
তাচে আলেম হাস্ত দর ছুদায়ে আকল,
তাচে বা পেন হাস্ত ইঁ দরিয়ায় আকল।
বহরে পে পায়ামে বুদ আকলে বাশার,
বহরে রা গেওয়াজ বাইয়াদ আয় পেছার।
ছুরাতে মা আন্দরে ইঁ বহরে আজাব,
মী দুদ চুঁ কাছেহা বরবোয়ে আব।
তা নাশোদ পুর বর ছারে দরিয়া তোশ্ত।
চুঁকে পুরশোদ তোশ্তে দর ওয়ে গর্কে গাস্ত।
আকলে পেনহাস্ত ও জাহেরে আলমে,
ছুরাতে মা মউজু ইয়া আজ ওয়ে নমে।
হরচে ছুরাতে মী ওছিলাতে ছাজাদাশ,
জে আঁ ওছিলাতে বহরে দূর আন্দাজাদাশ।
তা না বীনাদ দেল দেহেন্দাহ রাজেরা,
তা না বীনাদ তীরে দূর আন্দাজেরা।
অর্থ: মাওলানা বলেন, জ্ঞানের খেয়ালে কত রকম মূল্যবান বিষয় পড়িয়া রহিয়াছে। তোমরা চিন্তা করিয়া দেখ। জ্ঞানের সাগর কত বড় প্রশস্ত ভাবিয়া দেখ। ক্ষুদ্র খরগোশ অত্যন্ত ক্ষীণ দেহ নিয়া বাঘকে ধ্বংস করার সাহস সঞ্চয় করিয়াছে এবং নিজের শক্তি ও খেয়ালে কী রকম ফন্দি আঁটিয়াছে। প্রাণীর জ্ঞান শুধু প্রশস্ত-ই, কিন্তু মানুষের জ্ঞান সীমাহীন সাগর। এই সাগরে ডুব দেওয়া দরকার। এই সীমাহীন সাগরে ডুব দিয়া অমূল্য সম্পদ, জ্ঞান, হাসেল করা আবশ্যক। তাহা না হইলে মানুষের জ্ঞান ও পশুর বুদ্ধি একই রকম হইয়া যায়। কেননা, যে দরিয়ায় গওহর আছে, তাহা যদি ডুব দিয়া বাহির করা না যায়, তবে যে দরিয়ায় গওহর নাই, সেই দরিয়া এবং গওহর বিশিষ্ট দরিয়া একই প্রকার হওয়া লাজেম আসে। এখন মাওলানা ঐ মূল্যবান বস্তু জ্ঞান আর দেহের সাথে সম্বন্ধ বর্ণনা করিতেছেন যে, আমাদের দেহের আকৃতি জ্ঞানের সাগরে এমনভাবে দৌড়াইয়া ফিরিতেছে, যেমন পানির উপর পেয়ালা ভাসিতেছে। যতক্ষণে পেয়ালায় পানি পরিপূর্ণ না হইবে, ততক্ষণ ভাসিতে থাকিবে। যখন পেয়ালার মধ্যে পানি পূর্ণ হইয়া যাইবে, তখন পানির মধ্যে ডুবিয়া যাইবে। এই রকমভাবে মানুষের দেহ যতক্ষণ পর্যন্ত জ্ঞানের আলো দ্বারা পরিপূর্ণ না হইবে, ততক্ষণ শারীরিক বিধানগুলি জয়ী থাকিবে। আর রূহানী শক্তি আবৃত থাকিবে। যেমন খালি পেয়ালা পানির উপর ভাসিতে ছিল, পানি নিচে ছিল। যখন দেহ জ্ঞানের আলোতে পরিপূর্ণ হইবে এবং ভবিষ্যৎ জ্ঞান যথেষ্ট পরিমাণ হাসেল হইবে, তখন শারীরিক বিধানসমূহ যথা খাহেশ ও ক্রোধ পরাস্ত হইয়া যাইবে। রূহানী বিধানসমূহ যথা মহব্বত ও মারেফত জয়ী হইয়া যাইবে। যেমন উল্লেখিত দৃষ্টান্তে পেয়ালার পানি পরিপূর্ণ হইয়া পানি পেয়ালার উপরে উঠিয়াছে। পেয়ালা পানির মধ্যে চলিয়া গিয়াছে। আমাদের জ্ঞান আবৃত। যেমন পানির উপরে পাত্র দ্বারা পানি আবৃত থাকে। আমাদের বাহ্যিক দেহ প্রকাশ্য পানির উপর পেয়ালার ন্যায়। আমাদের দেহ ঐ জ্ঞানের সাগরে একটি ঢেউয়ের ন্যায় অথবা একটি বিন্দুর মত। দেহ জ্ঞানের অধীনস্থ, ঢেউ পানির অধীনস্থ। তবুও ঢেউ যদি অধিক পরিমাণে বাড়িয়া যায়, তবে পানি ঢাকিয়া ফেলে। ঐ রকম দেহের বিধানগুলি জয়ী হইলে জ্ঞানকে লুকাইয়া ফেলে। যখন জ্ঞান নেতা এবং দেহ অধীনস্থ প্রমাণ হইল, তখন যদি কেহ জ্ঞানকে ছাড়িয়া দেহকে আঁকড়াইয়া ধরে, তবে ইহার ক্ষতি সম্বন্ধে বর্ণনা করা হইয়াছে যে, যদি কেহ পার্থিব বস্তুকে অসীলা নির্দিষ্ট করিয়া আল্লাহকে পাইতে চায়, যেমন কাফেররা মূর্তি পূজা করিয়া আল্লাহর সন্তুষ্টি হাসেল করিতে চায়, তাহা হইলে অসীলা নির্দিষ্ট করার জন্য জ্ঞানের সাগর তাহাকে জ্ঞান হইতে অনেক দূরে নিক্ষেপ করিয়া ফেলে। কেননা, আকৃতির সাথে কেন সে মশগুল হইল, এবং আকৃতিকে কেন সে অসীলা বানাইল? আল্লাহর নিকট পৌঁছিবার প্রকৃত অসীলা মারেফত ও তলব। ইহা জ্ঞানের শক্তি, যাহা জ্ঞানের সাগর হইতে হইতে হাসেল করা যায়। এইজন্য জ্ঞানের শক্তিকে আল্লাহর নিকট পৌঁছিবার মত উপযুক্ত করা চাই। কোনো আকৃতিকে উপযুক্ত করা যায় না। যেহেতু ইহা যদিও কোনো অংশে অসীলা হইবার উপযুক্ততা অর্জন করে, তবে উহা উত্তম বিশ্বাস ও সততার উপর নির্ভর করে এবং তাহা অন্তরের কাজ। আর অন্তর এবং জ্ঞান মূলে একই বস্তু। এই জন্য মাওলানা বলিতেছেন যে, কোনো আকৃতিবিশিষ্ট বস্তু আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্য অসীলা হইতে পারে না। কেননা, আকৃতির পূজারী রূহ দেখিতে পারে না। রূহ্ মিন আমরিল্লাহ। রূহ ব্যতীত আল্লাহকে পাওয়া যাইবে না।
আছপে খোদ্রা ইয়া ওয়াহ্ দানাদ ওজে ছেতীজ,
মী দাওয়ানাদ আছপে খোদ দর্রাহে তেজ।
আছপে খোদ্রা ইয়া ওয়াহ্ দানাদ আঁ জওয়াদ,
ওয়াছপে খোদ উরা কাশান কর্দাহ্ চু বাদ।
দরফাগানো জুস্তে জু আঁ খীরাহ্ ছার,
হর তরফে পুরছালো জুইয়ানে দর বদার।
কা আঁকে দোজদীদ আছপে মারা কোওকীস্ত,
ইঁ কে জীরে রানে তুস্ত ই খাজা চীস্ত।
আরে ইঁ আছপাস্ত লেকে আঁ আছপে কো,
বা খোদ আ আয়ে শাহ ছওয়ার আছপেজো।
ওয়াছফেহারা মোস্তামেয় গুইয়াদ বা রাজ,
তা শেনাছাদ মরদে আছপে খেশে বাজ।
জানে জে পয়দাই ও নজদী কীস্ত গোম,
চুঁ শেকেম পুর আবো লবে খুশকে চুখোম।
দর দরুনে খোদ বফজা দর্দেরা।
তা বা বীনি ছবেজো ছুরখো জর্দেরা।
অর্থ: মাওলানা উপরে রূহ্ এবং দেহের কথা বর্ণনা করিয়াছেন যে, রূহ্ নেতা এবং দেহ তাহার অধীন। দেহ কখনও আল্লাহর নৈকট্য লাভের অসীলা হইতে পারে না। রূহ্ আল্লাহর নৈকট্য লাভের একমাত্র উপায়। তাই রূহ কোথায়, কীভাবে আছে ও তাহাকে জানার উপয় কী? এই সম্বন্ধে বলিতে যাইয়া তিনি বলিতেছেন যে, যদি কেহ জিজ্ঞাসা করে যে রূহ্ কোথায়? আমারা কেমন করিয়া তাহাকে অসীলা বানাইতে পারি? ইহার উত্তরে মাওলানা জওয়াব দিতেছেন যে, রূহ্ তোমার অতি নিকট, তোমারই সাথে আছে। কিন্তু তোমার অজ্ঞতার কারণে ইহা তোমা হইতে দূরে এবং লুকান বলিয়া ধারণা হয়। বাস্তবে রূহ অতি নিকটে কিন্তু জ্ঞাত হওয়ার দিক দিয়া বহু দূরে বলিয়া মনে হয়। ইহা একটি বাস্তব দৃষ্টান্ত দিয়া পরিষ্কার করিয়া বুঝাইয়া দেওয়া হইয়াছে। যেমন, এক ব্যক্তি নিজের ঘোড়ার উপর সওয়ার হইয়া চলিতেছে, ভুলবশতঃ নিজের ঘোড়া হারাইয়া গিয়াছে মনে করিয়া অজ্ঞতার দরুন নিজের ঘোড়াকে পথে খুব তেজের সহিত চালাইতেছিল। নিজের ঘোড়া হারাইয়া গিয়াছে বলিয়া মনে করিতেছিল। প্রকৃতপক্ষে তাহার নিজের ঘোড়া তাহাকে নিয়া বায়ুবেগে চলিতেছিল। ঐ ব্যক্তি চুতুর্দিকে দৌড়াইয়া জিজ্ঞাসা করিতেছিল, আমার ঘোড়া চুরি করিয়া কে নিল? সে কোথায়? কোনো এক ব্যক্তি উত্তর করিল, মিয়া তোমার রানের নিচে ঐটি কী? সে উত্তর করিল, হাঁ এটি ঘোড়া, কিন্তু আমার ঘোড়া কোথায়? লোকটি বলিল, আরে তুমি নিজে হুঁশ কর। লোকটি সওয়ারের নিকট চুপে চুপে তাহার অবস্থা ও ঠিকানা বাতলাইয়া দিল, যাহাতে তাহার নিজের ঘোড়া বলিয়া চিনিতে পারে। অতএব, এই ব্যক্তি যেমন নিজের ঘোড়ার উপর সওয়ার হওয়া অবস্থায় আছে এবং প্রকৃতপক্ষে ঘোড়া তাহার নিজের নিকটই আছে, কিন্তু অনুভূতি নষ্ট হইয়া যাওয়ার দরুন অজানা হইয়া গিয়াছে। কেননা, সে জ্ঞানশূন্য হইয়া গিয়াছে। তাই ঘোড়া হারান গিয়াছে এবং বহু দূরে গিয়াছে বলিয়া মনে করে। রূহের অবস্থাও এই রকম ঘোড়ার ন্যায় মানুষ লইয়া দৌড়াইয়া ফিরে। কেননা, দেহ যত কিছু করুক না কেন, সবই রূহের অসীলায় করে। রূহ ব্যতীত কিছুই করিতে পারে না। ইহা সত্ত্বেও মানুষ রূহকে চিনিতে পারে না। এইজন্য মানুষ রূহ হইতে অজ্ঞাত রহিয়াছে এবং আশ্চর্যান্বিত হইয়া রূহ সম্বন্ধে প্রশ্ন করে। প্রকৃতপক্ষে রূহ তাহার অতি নিকটেই প্রকাশ আছে। কিন্তু তাহার অনুভূতি হারাইয়া গিয়াছে। যেমন মট্কা পানি পূর্ণ আছে; বহির্ভাগ শুষ্ক। পানি পূর্ণ মটকা হওয়া সত্ত্বেও পানি গুপ্ত থাকে। এই রকম রূহ দেহের মধ্যে থাকা সত্ত্বেও গুপ্ত রহিয়াছে। এখন যদি কেহ বলে যে, রূহ এই রকম গুপ্ত থাকিলে, ইহাকে কেমন করিয়া মা‘লুম করা যায় এবং আল্লাহর নৈকট্য লাভের অসীলা বানান যায়? উত্তরে বলা হইয়াছে যে, নিজের অন্তরে তালাশ করার ইচ্ছাশক্তি তৈয়ার কর। অন্তরে আল্লাহর ভালোবাসার ব্যথা সৃষ্টি কর। তাহা হইলে তোমার মধ্যে নিহিত বিভিন্ন বস্তুসমূহের রহস্য জানিতে পারিবে। যেমন লাল, সবুজ ও হলুদ রংয়ে অনেক কিছু জানিতে পারিবে। এখানে মাওলানা অভ্যন্তরীণ লতিফা-সমূহের দিকে ইশারা করিয়াছেন।
কায়ে বা বীনি ছোরখো ছবজো ও বুরেরা,
তা না বীনি পেশে আজ আঁ ছে নুরে রা।
লেকে চুঁ দর রংগে গমশোদ হুশে তু,
শোদ জে নূরে আঁ রংগে হা রোপোশে তু।
চুঁ কে শবে আঁ রংগেহা মস্তুরে বুদ,
পাছ বদিদী দীদে রংগে আজ নূরে বুদ।
নীস্তে দীদে রংগে বে নূরে বেরুঁ,
হাম চুনীঁ রংগে খেয়ালে আন্দরুঁ।
ইঁ বেরু আজ আফতাবে ও আজ ছুহাস্ত,
ও আ দরুঁ আজ আকছে আনওয়ারে আলাস্ত।
নূরে নূরে চশমে খোদ নূরে দেলাস্ত,
নূরে চশমে আজ নূরে দেলহা হাছেলাস্ত।
বাজ নূরে নূরে দেল নূরে খোদাস্ত,
কো জে নূরে আকলো হেচ্ছে পাকো জুদাস্ত।
শবে না বুদ নূর ও নাদিদী রংগেরা।
পাছ ব জেদ্দে নূরে পয়দা শোদ তোরা।
শবে নাদিদী রংগে কাঁবে নূরে বুদ,
রংগে চে বুদ মোহরা কো রো কাবুদ।
দীদানে নূরাস্ত আঁগাহ দীদে রংগ,
ওয়া ইঁ বজেদ্দে নূরে দানী বেদে রংগ।
রঞ্জো গমেরা হক পায়ে আঁ ফরিদ,
তা বদীঁ জেদ্দে খোশ দেলী আইয়াদ পেদীদ।
পাছ নেহানী হা ব জেদ্দে পয়দা শওয়াদ,
চুঁকে হক্কেরা নীস্ত জেদ্দে পেনহা বওয়াদ।
কে নজরে বর নূরে বুয়াদ আঁগাহ্ ব রংগ,
জেদ্দে বজেদ্দে পয়দা বওয়াদ চুঁরুম ও জংগ।
পাছ ব জেদ্দে নূরে দানাস্তী তু নূর,
জেদ্দে জেদ্দেরা মী নুমাইয়াদ দর ছদূর।
নূরে হক রা নীস্তে জেদ্দে দর ওজুদ,
তা বজেদ্দে উরা তাওয়াঁ পয়দা নামুদ।
লা জারাম আবছারে নালা তুদরেক্হু,
ওয়া হুয়া ইউদরেকু বীঁ তু আজ মুছা ও কোহু।
অর্থ: মাওলানা বলেন, তুমি কেমন করিয়া লাল, সবুজ ও গোলাপী ইত্যাদি রং সমূহ দেখিবে, যদি তুমি এই তিন রং দেখিবার পূর্বে প্রকাশ্য আলো দেখিতে না পাও? কিন্তু দেখিবার সময় তোমার খেয়াল যদি সম্পূর্ণ আলোর মধ্যে ডুবিয়া যায়, তাহা হইলে ঐ রং আলো হইতে আবৃত থাকিবে। কেননা, রংয়ের দিকে খেয়াল করিলে আলো গুপ্ত হইয়া যায়। আলোর দিকে খেয়াল থাকে না। রাত্রে অন্ধকারে রং ঢাকিয়া যায়, দেখা যায় না। তখন তুমি মনে কর আলো দ্বারাই দেখা যায়। তাই যেমন জাহেরী (প্রকাশ্য) রং সমূহ জাহেরী আলো ব্যতীত দেখা যায় না। এই রকম বাতেনী আলোর অবস্থা, যাহাকে খেয়াল বলা হয়। খেয়াল অর্থ অনুভূতি-শক্তি। চাই প্রকাশ্য বস্তুর অনুভূতি অথবা বাতেনী বস্তুর অনুভূতি-শক্তি। অনুভূতি সব জায়গায়-ই দরকার। এই অনুভূতির জন্য বাতেনী আকলের দরকার। প্রকাশ্যে সূর্যের আলো অথবা তারকার আলো থাকে। আর বাতেনী আলো, ইহা সর্বশক্তিমান আল্লাহতায়ালার আলোর প্রতিবিম্ব। সূর্য ও তারকারাজির আলোও আল্লাহর আলো হইতে উপকৃত হয়। যেমন আমাদের চক্ষের দৃষ্টিশক্তির আলো অন্তর হইতে প্রাপ্ত হওয়া যায়। কেননা, ইহা প্রমাণিত হইয়াছে যে অনুভূতি-শক্তি প্রকৃতপক্ষে বাতেনী শক্তি। প্রকাশ্য অনুভূতি হাতিয়ার-যন্ত্রপাতি ও স্পর্শশক্তি ছাড়া আর কিছুই না। অতএব, চক্ষুর আলো প্রকাশিত হওয়া জ্ঞানের শক্তির উপর নির্ভর করে। তাই প্রকৃতপক্ষে বস্তু প্রকাশ পাওয়া ও জ্ঞাত হওয়া আকলের উপরই নির্ভর করে বলিয়া প্রমাণিত হইল। এইজন্য অন্তঃকরণের আলোকে চক্ষুর আলো বলা হইয়াছে। তারপর অন্তরের আলো, ইহা খোদাপ্রদত্ত আলো। ইহা জ্ঞানের ও স্পর্শশক্তির আলো হইতে পবিত্র ও অন্য রকম। রাত্রি অন্ধকার বলিয়া ইহার মধ্যে রং দেখা যায় না। ইহা দ্বারা আলোর জ্ঞান পরিষ্কার হইয়া ফুটিয়া উঠে। কেননা, বিপরীত বস্তু দ্বারা জিনিষের পরিচয় উত্তমরূপে জানা যায় রং কী বস্তু? উহা মহ্রা কোরে কাবুদের ন্যায়। উহার মধ্যে আলোশক্তি নাই, যদ্বারা নিজে প্রকাশিত হইতে পারে। তাই ইহাকে দেখিতে হইলে প্রথমে আলো দেখা চাই, তারপর রং দেখিতে হয়। একথা আগেই প্রমাণ হইয়া গিয়াছে যে, আলো ইহার বিরীত বস্তু দ্বারা বিনা চিন্তায় অনুমান করা যায়। অন্য উদাহরণ দিয়া দেখান হইতেছে, যেমন আল্লাহতায়ালা দুঃখ-কষ্ট সৃষ্টি করিয়াছেন, ইহা দ্বারা সন্তুষ্টির প্রকৃত অবস্থা ভালরূপে বুঝা যাইবে। অতএব, বুঝা গেল যে গুপ্ত বস্তু অথবা অপ্রকাশ্য বিষয় ইহার বিরুদ্ধে বস্তু দ্বারা অনুধাবন করা সহজ হইয়া পড়ে। কিন্তু আল্লাহতায়ালার কোনো বিরুদ্ধ নাই, এইজন্য তিনি গুপ্ত রহিয়াছেন। সর্বদা তাঁহার নূরের উপর নজর ফেলিতে হইবে। তারপর রংয়ের উপর নজর দিতে হইবে। ইহা দ্বারা প্রত্যেক বস্তুর হাকীকাত জানার পূর্বে আল্লাহতায়ালার জাতে পাকের আলো প্রকাশ পাইতে হইবে। পরে অন্য বস্তু প্রকাশ পাইবে; এইভাবে এক বস্তুর বিরুদ্ধ দিয়া অন্য বস্তু প্রকাশ পাইবে। যেমন ইউরোপবাসীদের দেখিয়া আফ্রিকাবাসীদেরকে অনুমান করা যায়। কিন্তু আল্লাহতায়ালাকে বিপরীত বস্তু দিয়া হাসেল করা যায় না। কারণ তাঁহার বিরুদ্ধ বা বিপরীত কিছু-ই নাই। এইজন্য আল্লাহতায়ালা নিজেই বলিয়া দিয়াছেন, আমাকে কোনো চক্ষু দেখিতে পারিবে না। তিনি সবাইকে দেখেন। ইহার সত্যতা প্রমাণ পাওয়া যায়, হজরত মূসা (আ:)-এর তূর পর্বতের ঘটনার দিকে লক্ষ্য করিলে। ঐ ঘটনায় চক্ষু দিয়া দেখিতে পারে নাই, চক্ষু দিয়া দেখা ত দূরের কথা স্বয়ং পাহাড়-ই তাঁহার গরমি সহ্য করিতে পারে নাই। ইহা খোদার এক বিশেষ তাজাল্লি ছিল, যাহা ইচ্ছা করিয়াও অনুধাবন করিতে পারে নাই। আর বয়াত-সমূহের মধ্যে যাহা উল্লেখ করা হইয়াছে, উহা খেয়ালহীনের সম্বন্ধে বলা হইয়াছে। এইজন্য বিরুদ্ধ নাই বলিয়া বলা হইয়াছে, যে বিরুদ্ধ দ্বারা খেয়াল ফিরাইয়া লইবে। অতএব, আল্লাহকে পাইতে আল্লাহর আলো রূহের মধ্যে পাইতে হইবে। এইজন্য মারেফাতের মধ্যে মোজাহেদা করা আবশ্যক।
ছুরাতে আজ মায়ানী চু শেরে আজ বেশা দাঁ,
ইয়া চু আওয়াজ ও ছুখান জে আন্দেশা দাঁ।
ইঁ ছুখান ও আওয়াজ আজ আন্দেশা খাস্ত,
তু নাদানি বহরে আন্দেশা কুজাস্ত।
লেকে চুঁ মউজে ছুখান দীদে লতিফ,
বহরে আ দানী কে বাশদ হাম শরীফ।
চুঁ জে দানেশ মউজে আন্দেশা বতাখ্ত,
আজ ছুখান ও আওয়াজে উ ছুরাতে বছাখ্ত।
আজ ছুখানে ছুরাতে বজাদ ও বাজে মরদ,
মউজে খোদ্রা বাজে আন্দর বহ্রে বোরাদ।
ছুরাতে আজ বেছুরাতে আমদ বেরুঁ,
বাজে শোদ কা না ইলাইহে রাজউন।
অর্থ: এখানে মাওলানা আরো উদাহরণ দিয়া পরিষ্কার করিয়া বুঝাইতে চেষ্টা করিয়াছেন যে, জ্ঞানের সাগর প্রকাশ্য জগতের চাইতে অধিক স্থায়ী এবং সব সুরাতের মূল বস্তু। তাই তিনি বলেন, বাস্তব আকৃতি এবং আকৃতির মূল উৎপত্তিস্থান জ্ঞান, এই দুইয়ের মধ্যে সম্বন্ধ যেমন বাঘ জঙ্গল হইতে বাহির হয়। অথবা এইরূপ মনে করিয়া লও, যেমন কথা ও ইহার আওয়াজ। কথার আওয়াজ বাহিরে প্রকাশ পায় আকল দ্বারা। কথার রূপ ও নক্শা প্রথমে জেহেনের মধ্যে তৈয়ার হয়। পরে উচ্চারিত হইলেই বাহিরে শব্দ শুনা যায়। মূলে আকল হইতেই বাক্য সৃষ্টি হয়। এই দৃষ্টান্ত দ্বারা বুঝা যায় যে, জঙ্গল দিয়া বাঘ বাহির হয়। অতএব জঙ্গল আসল এবং জঙ্গলের স্থায়িত্বও অধিককাল পর্যন্ত থাকে। কেননা, একই জঙ্গল দিয়া হাজার হাজার বাঘ আগে ও পরে মৃত্যু হইয়া চলিয়া যায়। কিন্তু জঙ্গল বাকী থাকে। এই দিক দিয়া দেখা যায় জঙ্গল আসল আর বাঘ শাখা এবং কালাম জ্ঞানের অনুপাতে শাখা, তাহা বর্ণনা করার দরকার করে না। অতএব, সুরাত বাঘ ও কালামের ন্যায় শাখা এবং ক্ষণস্থায়ী আর আকল জঙ্গলের ন্যায় আসল এবং দীর্ঘস্থায়ী ও মজবুত। তাই মাওলানা বলিতেছেন, দেখো, বাস্তব সুরাত বাতেনী সুরাত আকল দ্বারা প্রকাশ পায়। সুরাতে জেহেনিয়া আকলের একটা কার্য মাত্র, কাজের জন্য কর্তার আবশ্যক, ইহা বর্ণনা করা দরকার করে না। কিন্তু ইহা মালুম করা যায় না, যেহেতু মূল্যবান জ্ঞান আল্লাহর হুকুম। ইহা কোনো জায়গা বা স্থানের সহিত সীমাবদ্ধ না। যখন ইহার জন্য কোনো জায়গা নাই, তখন নির্দিষ্ট স্থান কেমন করিয়া হইবে? কালামের উৎপত্তিস্থল জেহেন, অর্থাৎ, মেধাশক্তি আর মেধাশক্তির উৎপত্তির স্থান আকল অর্থাৎ জ্ঞান। অতএব, জ্ঞানের শক্তি স্পর্শ দ্বারা বুঝা যায় না। কিন্তু ইহার ক্রিয়া স্বরূপ যে বাক্য নির্গত হয় তাহা অনুভব করা যায়।
অতএব, বাক্য দ্বারা জ্ঞানের বিদ্যমান হওয়া বুঝা যায়। মওলানা এই কথার প্রমাণ আগের বয়াতে করিতেছেন যে, যখন বাক্যসমূহ নেক ও সারমর্মপূর্ণ পাওয়া যায়, তবে মনে করিতে হইবে ইহার উৎপত্তিস্থান জ্ঞানের সাগর বোজর্গ হইবে। যখন কথা উত্তম হইবে, তখন জ্ঞানও উত্তম বলিয়া বিবেচিত হইবে। এইভাবে জ্ঞানের বিদ্যমান হওয়ার প্রমাণ পাওয়া যায়। যখন জ্ঞান দ্বারা মেধাশক্তির বাক্যগুলি নির্গত হইতে থাকে, তখন বাক্য এবং উহার আওয়াজ একই হইয়া যায়। বাক্যে আওয়াজ করিয়া পুনরায় উৎপত্তিস্থান আকলের মধ্যে ফিরিয়া যায়। যেমন সমুদ্রের ঢেউ, পানি হইতে উৎপত্তি হইয়া পুনরায় পানিতে মিশিয়া যায়। বিনা আকৃতিতে যে সুরাত, অর্থাৎ, কালাম বাহির হইয়া আসিয়াছিল, ইহা আবার ফিরিয়া নিজ স্থানে যায়। যেমন, আল্লাহ বলিয়াছেন যে আমরা নিশ্চয়ই তাঁহার নিকট ফিরিয়া যাইব। অর্থাৎ, আমরা যেথা হইতে আসিয়াছি, সেই স্থানেই আবার ফিরিয়া যাইব। এখানে বাক্যের বেলায়ও সেইরূপ যে স্থান হইতে উৎপত্তি হইয়াছে সেই জায়গায় আবার ফিরিয়া যায়। অর্থাৎ, স্মরণের স্থানে যাইয়া থাকে। হয়ত বহুদিন পর ভুলিয়া যাইতে পারে।
পাছ তোরা হর লেহাজা মরগো রেজায়াতিস্ত
মোস্তফা ফরমুদ দুনিয়া ছায়াতিস্ত।
ফেকরে মা তীরিস্ত আজ হাওয়া দর হাওয়া,
দর হাওয়াকে পাইয়াদ আইয়াদ তা খোদা।
হর নফছে নওমে শওয়াদ দুনিয়া ও মা,
বে খবর আজ নও শোদান আন্দর বাকা।
ওমরে হাম চুঁ জওয়ে নও নও মীরছাদ,
মোস্তামারে মী নোমাইয়াদ দর জাছাদ।
আঁ জে তেজী মোস্তামার শেক্লে আমদাস্ত,
চুঁ শর রকশে তেজ জম্বানে বদস্ত।
শাখে আতশ্রা বজম্বানে বছাজ,
দর নজরে আতেশে নোমাইয়াদ বছদরাজ।
ইঁ দরাজী মুদ্দাতে আজ তেজী ছানায়া,
মী নুমাইয়াদ ছুরায়াত আংগীজী ছানায়া।
তালেবে ইঁ ছারে আগার আল্লামা ইস্ত,
নকে হুচ্ছামদ্দিন ফে ছামী নামা ইস্ত।
ওয়াছফে উ আজ শরাহ মোস্তাগানা বুদ,
রু হেকায়েত গোকে বে গাহ মী শওয়াদ।
অর্থ: মাওলানা বলেন, কালাম যেমন আকল হইতে প্রত্যেক মুহূর্তে বাহির হইতে পারে এবং বন্ধও হইতে পারে, সেইরূপ জীবনও প্রত্যেক মুহূর্তে মরে এবং ফিরিয়া আসে। যেমন হাদীসে হজরত (দ:) ফরমাইয়াছেন যে, দুনিয়ার জীবন এক মুহূর্তের জন্য মাত্র। আমাদের চিন্তা ও খেয়াল যেমন কোনো ব্যক্তি উপরে বায়ুর তীর নিক্ষেপ করে। এইভাবে আমাদের চিন্তা আল্লাহর তরফ হইতে আসে। ঐ তীর বায়ু ভরিয়া থাকে না; তীর নিক্ষেপকারীর নিকট ফিরিয়া আসে। এই রকমভাবে আমাদের চিন্তা ও খেয়াল অস্থায়ী হিসাবে আমাদের কাছে থাকে না। উহা আল্লাহর নিকট ফিরিয়া যায়। কেননা, প্রত্যেক মুহূর্তে সমস্ত দুনিয়া নূতন সৃষ্টি হয়।
আমরা প্রকাশ্যে বিদ্যমান আছি বলিয়া ঐ নূতন সৃষ্টির খবর রাখি না। আমাদের জীবনকাল প্রত্যেক মুহূর্তে নূতন হইয়া সৃষ্টি হয় এবং আমরা নূতন নূতন জীবন লাভ করি। যেমন নহরে পানি প্রবাহিত হয়, সব সময়েই উপরের দিক হইতে পানি আসে, কিন্তু জীবনকাল উভয় মুহূর্ত দেহে বিদ্যমান ও স্থায়ী বলিয়া মনে হয়। কিন্তু প্রথম মুহূর্তে পানি যে জায়গায় ছিল, উহা প্রবাহিত হওয়ার কারণে বহু দূরে চলিয়া গিয়াছে। কিন্তু একই রকম পানি মিলিত প্রবাহের কারণে বহু দূরে চলিয়া যাওয়া অনুমান করা যায় না। কেননা ঐ স্থানে একই রকম পানি আসিয়া পৌঁছিয়াছে। এই অবস্থা-ই বিদ্যমান কালের অবস্থা। পূর্ব মুহূর্তের অবস্থা এক আর পর মুহূর্তের অবস্থা অন্য রকম। মাঝখানে নাই অবস্থা ছিল। এইরূপ না হইলে বাস্তবে বিদ্যমান বস্তুর পরিবর্তন হইত না। মুহূর্তগুলি এত তেজে আসে এবং যায়, যাহাতে পৃথক হওয়ার ধারণা করা যায় না। মনে হয় যেন মিলিত ভাবে সর্বদা আসিতেছে। যেমন যদি কেহ অগ্নিস্ফুলিঙ্গ হাতে লইয়া খুব তেজের সহিত ঘুরাইতে থাকে, তবে মনে হয় যেন সবই আগুন। চতুর্দিকে একটি আগুনের কুণ্ডলীর ন্যায় মনে হইবে। প্রকৃতপক্ষে অত লম্বা দরাজ আগুন নয়, মাত্র এক টুকরা আগুন তেজী চলনের দরুণ সমস্ত জায়গা ব্যাপিয়া আগুন মনে হইতেছে। ঐ রূপভাবে আমাদের জীবনের মুহূর্তগুলি এত তাড়াতাড়ি আসে এবং যায়, মনে হয় যেন মাঝে শুন্য নয়। প্রকৃতপক্ষে মাঝখানে না হওয়া মুহূর্তগুলি আছে, আমরা বুঝিতে পারি না। এই লম্বা দরাজ জীবনকাল আমাদের তেজী কারিগরীর দরুণ। অর্থাৎ, বিদ্যমান হওয়া মুহূর্তটি খুব তাড়াতাড়ি দান করেন। এইরূপ সূক্ষ্ম বিষয়ের জ্ঞান যদি কাহারও থাকে এবং সে বিজ্ঞ পণ্ডিত হয়, তবে তাহাকে আল্লামা ও আরেফ বলা যাইতে পারে। তাহার আমলনামা পাপের কাজ হইতে খালি বলিয়া উচ্চ সম্মান লাভ করিল। এই রকম আরেফের কোনো প্রকার প্রশংসা করা দরকার হয় না। তাঁহার কথা ত্যাগ করিয়া ঘটনা বর্ণনা কর। সময় চলিয়া যায়।
শেররা আফজুদ খশমো শো নাফুর,
দীদ কাঁ খরগোশ মী আইয়াদ জে দুর।
মী দূদ বেদাহাশাত ও গোস্তখে উ,
খশমেগীন ও তুন্দ ও তেজ ও তরাশ রো।
কাজ শেকাস্তাহ আমদান তোহমাত বুদ,
ওয়াজ দেলীরী দাফেয় হর রাইবাত বুদ।
চুঁ রছীদ উ পেশতর নজদীকে ছফ,
বাংগে বরজাদ শেরে হাঁ আয় না খোলফ্।
মানফে পায়লান রা আজ হাম বদরীদাম,
মানকে গোশে শেরে না মালীদাম।
নীমে খরগোশে কে বাশদ কো চুনীঁ,
আমরে মারা আফগানাদ উবর জমীঁ।
তরকে খাবো গফ্লাত খরগোশে কুন,
গোর্রাহ ইঁ শের আয় খরগোশ কুল।
অর্থ: বাঘের ক্রোধ অত্যন্ত বাড়িয়া গেল, দেখিল যে জঙ্গলের খরগোশ দূর হইতে আসিতেছে না। কেননা, ভয়তে সংকোচিত হইয়া আসিলে দোষী বলিয়া মনে হইবে, এবং নির্ভয়ে বাহাদুরের ন্যায় আসিলে সন্দেহ দূর হইতে থাকে। যখন খরগোশ বাঘের নিকট আসিল, তখন বাঘ খুব শাসাইল যে, আমি অমুক-সমুক, সামান্য খরগোশ হইয়া আমার আদেশ অমান্য কর। এখন খরগোশী ধারণা ত্যাগ কর, আমার গড়গড়া শোন, তোমার শাস্তির সময় ঘনাইয়া আসিয়াছে।
গোফ্তে খরগোশ আল আমান ওজরেম হাস্ত,
গার দোহাদ্ আফু খোদাওয়ান্দিয়াতে দস্ত।
বাজে গুইয়াম চুঁ নও দস্তুরে দিহী,
তু খোদাওয়ান্দী ও শাহী মান রাহীঁ।
গোফ্ত চে ওজর আয় কছুরে আবলেহান,
ইঁ জমানে আইয়াদ দরপেশে শাহান।
মোরগেবে ওয়াক্তে ছারাত বাইয়াদ বুরীদ।
ওজরে আহমক রা নমী বাইয়াদ শনীদ।
ওজরে আহমক বদতর আজ জোরমাশ
ওজরে নাদান জহ্রে হরর দানেশে বুদ।
ওজরাত আয় খরগোশ আজ দানেশ তিহী,
মান না খরগোশাম কে দর গোশাম নিহী।
গোফ্তে আয় শাহা নাকাছেরা কাছ শুমার,
ওজরাস্তাম দীদায়েরা গোশে দার।
খাছ আজ বহরে জে কাত্তাতে জাহে খোদ,
গোমরাহে রাতু মর আঁ আজ রাহে খোদ।
বহরে কো আবে বহর জুয়ে দেহাদ,
হর খাছেরা বর ছারো রুয়ে মী নেহাদ।
কম না খাহাদ গাস্তে দরিয়া জে ইঁ করম,
আজ কর্মে দরিয়া না গরদাদ বেশ ও কম।
গোফ্তে দারাম মান করমে বর জায়ে উ,
জমা হর কাছ বোরাম বালায়ে উ।
অর্থ: খরগোশ নিরাপদ আশ্রয় প্রার্থনা করিয়া বলিল, যদি আপনি আমাকে ক্ষমা করেন, তবে আমার একটি ওজর আছে, ইজাজত পাইলে বলিব। বাঘ পলিল, কী ছাই তোমার ওজর? বোকা, বাদশাহদের সম্মুখে এখন আসিয়াছ, অসময়ে আসায় তুমি মোরগে বে ওয়াক্ত হইয়াছ। তোমার মাথা দ্বিখণ্ডিত করা আবশ্যক। বোকার ওজর শোনা অনুচিত। কেননা, বোকার আপত্তি শোনা অপরাধের চাইতেও বড় অপরাধ এবং গণ্ডমূর্খের ওজর শুনিলে বিদ্যা ও জ্ঞান সবই ধ্বংস হইয়া যায়। খরগোশ বলিল, নিঃসন্দেহে আমি বোকা ও অনুপযুক্ত। কিন্তু সামান্য সময়ের জন্য আমাকে উপযুক্ত মানিয়া লন। আমার ওজরটা একটু শুনিয়া লন। আপনার সম্মান ও মরতবার সদকা মনে করিয়া আমাকে দূর করিয়া দিবেন না, দেখুন দরিয়া নিজের দয়ায় নহরসমূহে পানি দান করে; খড়-কুটাকে নিজের উপর ভাসাইয়া লয়, ইহাতে দরিয়ার কোনো অংশ কমিয়া যায় না। অতএব, আপানিও দরিয়ার মত আমার উপর দয়া করিবেন। বাঘ বলিল, আমি দয়াও সুযোগ বুঝিয়া করি। যেমন লোকে বলিয়া থাকে, প্রত্যেক ব্যক্তি তাহার পোষাক নিজের কাঁধ আন্দাজ কাটিয়া থাকে। অতএব, এখন তোমাকে দয়া করার সময় না, তোমাকে দয়া করা হইবে না।
গোফ্তে বেশনু গার নাবাশদ জায়ে নুতফ্,
ছার নেহাদাম পেশে আজ দরহায়ে উন্ফ।
মান ব ওয়াক্তে চাস্তে দর রাহে আমদাম,
বা রফিকে খোদ ছুয়ে শাহ আমদাম,
বা মান আজ বহরে তু খরগোশে দিগার,
জোফ্ত ও হামরাহ্ করদাহ্ বুদান্দ আঁন কর।
শেরে আন্দর রাহে কছদে বান্দাহ করদ,
কছদে হর দো মাহরাহে আয়েন্দাহ করদ।
গোফতামাশ মা বান্দাহ শাহেন শাহাম,
খাজা তা শানে কে আঁদর গাহেম।
গোফ্তে শাহান শাহ্কে বাশদ শোদাম দার
পেশে মানতু ইয়াদে হর নাকেছ মইয়ার।
হাম তোরা ও হাম শাহাত রা বর দারাম,
গার তু বা উয়ারাত ব করদী আজ দেরাম।
গোফ্তামাশ বোগজার তা বারে দীগার,
রুয়ে শাহ্ বীনাম বোরাম আজ তু খবর।
গোফ্তে হামরাহ্ রা গেরো নেহ পেশে মান,
ওয়ার না কোরবাণী তু আন্দর কীশে মান,
লাবা করদামেশ বাছে ছুদে না করদ,
ইয়ারে মান বস্তাদ মরা বগোজাস্ত ফরদ।
মানাদ আঁ হামরা গেরো দরপেশে উ,
খুন রওয়াঁ শোদ আজ দেলে বে খোশে উ।
ইয়ারাম আজ জেফাতে ছে চান্দা বুদ কেমান,
হাম ব লুতফে ও হাম বখুবি হাম বা তন।
বাদে আজ ইঁ জে আঁশের ইঁ রাহ বস্তাহ শোদ,
হালে মা ইঁ বুদ বা তু গোফ্তা শোদ।
আজ অজিফা বাদে আজইঁ উমেদ বুর,
হক হামী গুইয়েম তোরা আল হক্কু মুর্রা।
গার অজিফা বাইয়েদাত রাহ পাক কুন,
হায়েঁ বইয়াও দাফেয় আঁবে বাক কুন।
অর্থ: খরগোশ বলিল, আমি যদি দয়ার পাত্র না হই, তবে আমি শক্ত আজদাহার সম্মুখে পড়িয়া যাইতে বাধ্য থাকিব। আগে আপনি আমার কথা শুনিয়া লন। ঘটনা হইল যে, আমি আমার এক বন্ধুকে সাথে নিয়া চাশ্ত ওয়াক্তের সময় আপনার নিকট আসিবার জন্য রওয়ানা হইলাম। বন্য পশুরা আপনার জন্য আমার সাথে আরও একটি খরগোশ দিয়াছিল। পথিমধ্যে অন্য আর একটি বাঘের সাথে দেখা হইল। সে আমাদের উভয়কেই নিতে চাহিল। আমি তাহাকে বলিলাম, আমি শাহানশাহের গোলাম। তাহার দরবারের সামান্য রকমের খাদেম। কিন্তু সে বলিল, কে তোর বাদশাহ? আমার সম্মুখে না-লায়েকদের কথা উল্লেখ করিস না। আমি তোকে আর তোর বাদশাহকে ফাঁড়িয়া ফেলিব। তখন আমি বলিলাম, তবে কিছু সময়ের জন্য আমাকে ছাড়িয়া দেন, আমি আমার বাদশাহর সহিত একবার দেখা করিয়া তাহাকে আপনার সংবাদ জানাইয়া আসি। সে উত্তর দিল, আচ্ছা, তোমার সাথীকে আমার কাছে বন্ধক রাখিয়া যাও, না হইলে আমার মোজাহাবে তোমাকে হালাল করিয়া ছাড়িব। আমি তাহাকে অনেক তোষোমোদ করিলাম যে আমাদের উভয়কেই যাইতে দেন। কিন্তু তাহাতে কোনো উপকার হইল না। অবশেষে আমার সাথীকে লইয়া গেল, এবং আমাকে একা ছাড়িয়া দিল। ঐ বেচারা আমার সাথী তাহার নিকট বন্ধক রহিয়া গেল। সে বেচারা কাঁদিতে কাঁদিতে চক্ষু দিয়া রক্ত বাহির করিয়া ফেলিয়াছে। কিন্তু বাঘের দেল ইহাতে ভীত না। আমার সাথী আমার চাইতে তিনগুণ মোটা বেশী ছিল। সৌন্দর্য্য, মাধুর্য্য ও পুষ্টির দিক দিয়া অতি উত্তম ছিল। এখন আগামীতে ঐ বাঘের দরুণ ঐ রাস্তা একদম বন্ধ মনে করিবেন। আপনার কাছে আমাদের আর কোনো পশু আসিতে পারিবে না। আপনার অভ্যাস অনুযায়ী দৈনিক খাদ্য পাইবার আশা বন্ধ করিতে পারেন। আমি সম্পূর্ণ সত্য কথা বলিলাম, যদিও সত্য কথা তিক্ত মনে হয়। যদি আপনার দৈনিক খাদ্যের দরকার হয়, যাহা বন্য পশুদের তরফ হইতে ওয়াদা অনুযায়ী আসিতেছিল, তবে রাস্তা পরিষ্কার করুন, এবং আসুন, ঐ সাহসী বাঘকে দূর করুন, না হইলে সে সব সময় এই রকম রাস্তা হইতে পশু ছিনাইয়া লইবে।
গোফ্ত বিছমিল্লাহ বইয়া তা উ কুজাস্ত,
পেশে রো শো গারহামী গুই তোরাস্ত।
তা ছাজায়ে উ ও ছদ চুঁউ দেহাম,
ওয়ার দোরু গাস্ত ইঁ ছাজায়ে তু দেহাম।
আন্দার আমদ চুঁ কালা ও জী বা পেশ,
তা বোরাদ উরা বছুয়ে দামে খেশ।
ছুয়ে চাহে কো নেশানাদশ করদা বুদ,
চাহে মগ্রা দামে জানাশ করদা বুদ।
মী শোদান্দ ইঁ হরদো তা নজদীকে চাহ,
ইঁ নাত খরগোশে চু আবে জীরে কাহ্।
আবে কাহে রা ভামুন মী বুরাদ
আবে কোহেরা আজব চুঁমী বুরাদ।
দামে মকরে উ কামান্দে শেরে বুদ,
তরফা খরগোশেকে শেরেরা রেবুদ।
অর্থ: বাঘ খরগোশকে বলিল, আচ্ছা বিসমিল্লাহ। চলো, ঐ বাঘ কোথায়? দেখিব, তুমি যদি সত্য হও, তবে আগে চলিয়া পথ দেখাও, উহাকে এবং উহার মত শতটা হইলেও সকলকেই শাস্তি দিব। আর যদি এই কথা মিথ্যা হয়, তবে ঐ শাস্তি-ই তোমাকে দিব। অতএব, খরগোশ আগে আগে পথ দেখাইয়া চলিতে লাগিল। খরগোশের উদ্দেশ্য ছিল বাঘকে ফাঁদে ফেলিয়া মারিবে। তাই যে কূপ এই কাজের জন্য নির্দিষ্ট করিয়া রাখিয়াছিল এবং কূপটি অত্যন্ত গভীর ছিল, আর যাহাকে মারার অসীলা করিয়াছিল, এইভাবে উভয়ে কূপের নিকটে গেল। মাওলানা আশ্চর্যান্বিত হইয়া বলেন, দেখ! সামান্য খরগোশ কত বড় ধোকাবাজ। ইহা ত সব সময়ই হইয়া আসিতেছে যে পানি মাঠের ও জঙ্গলের সামান্য ঘাস ভাসাইয়া লইয়া যায়। ইহাও রীতি যে, পানি পাহাড়কেও ভাসাইয়া লইয়া যায়। পানি যেমন পাহাড়কে ভাসাইয়া নেয়, সেই রকম বাঘ এবং খরগোশ বড় ছোট হিসাবে পাহাড় ও পানির সহিত তুলনা রাখে। অর্থাৎ, খরগোশ এমন ফাঁদ বিস্তার করিয়াছে যে বাঘ ইহার মধ্যে আবদ্ধ হইয়া পড়িয়াছে। প্রকৃতপক্ষে আজব খরগোশ বাঘকে উড়াইয়া দিল।
মূছা ফেরআউন রা তা রোদে নীল,
মী কাশাদবালস্কর ও জমায়া ছাকীল।
পোশ্শায়ে নমরূদেরা বা নীমে পর,
মী শেগাকাদ মী রওয়াদ মগজেছার।
অর্থ: মাওলানা আশ্চর্যজনক আরো দুইটি ঘটনার দিকে ইশারা করিয়াছেন যে, তোমরা হজরত মূসা (আ:)-এর ঘটনা মনে করিয়া দেখ, সাজ ও সরঞ্জামের দিক দিয়া অত্যন্ত দুর্বল ছিলেন, ফেরাউনের মত এত বড় শক্তিশালী বাদশাহকে তাহার সৈন্য-সামন্তসহ টানিয়া নিয়া নীলনদে ডুবাইয়া দিলেন। আর সামান্য একটি মশা, যাহার দুই পাখের মাত্র একটি পাখ ছিল যাহার জন্য অর্ধ-পাখবিশিষ্ট বলা হইয়াছে, সে নমরুদের মত পরাক্রমশালী বাদশাহর মাথা ফাঁড়িয়া মগজ পর্যন্ত ঢুকিয়া গিয়াছিল। ইহা দ্বারা প্রমাণ হয় যে খোদার কুদরাত যখন ইচ্ছা করেন দুর্বলকে শক্তিশালীর উপর জয়ী করিয়া দেন।
হালে আঁ কো কউলে দুশমনরা, শনুদ,
বী যাজায়ে আংকে মোদ ইয়ারে হাছুদ
হালে ফেরাউনে কে হামান রা শনুদ,
হালে নমরূদে কে শয়তান রা ছেতুদ
দুশমনে আরচে দোস্তানা গুইয়াদাত,
দামে দানে গারছে জে দানা গুইয়াদাত
গার তোরা কান্দে হেদাদ আঁ জহরে দাঁ,
গার বতু লুৎফে কুনাদ আঁ কহরে দাঁ।
অর্থ: মাওলানা এখানে বলিতেছেন, শত্রুর কথার প্রতি আমল করিলে তাহার পরিণাম ফল দুঃখজনক হয়। তাই মাওলানা বাঘ ও খরগোশের ঘটনার প্রতি লক্ষ্য রাখিয়া বলিতেছেন, যে ব্যক্তি শত্রুর কথা অনুযায়ী কাজ করে, তাহার পরিণাম ঐ বাঘের ন্যায় হয়। আর যে ব্যক্তি হিংসুককে অনুসরণ করে, তাহার পরিণাম ফেরাউনের কথা মনে করিয়া চিন্তা করিয়া দেখ। কেননা, ফেরাউন তাহার মন্ত্রী হামানের কথা শুনিত। সে ফেরাউনের ধর্মের শত্রু ছিল। দুনিয়ার দিক দিয়া হামান দোস্ত ছিল। আর নমরূদেরও এই রকম অবস্থা হইয়াছিল, সে শয়তানের পরামর্শে চলিত। অতএব, শত্রু যদি তোমাকে বন্ধুর ন্যায় কথা বলে, তথাপি তাহার কথাকে ফাঁদের ন্যায় মনে করিবে, যদিও সে জ্ঞানী লোকের ন্যায় কথা বলে। সে যদি তোমাকে মিষ্টি দান করে, তবে তুমি ইহাকে বিষ বলিয়া মনে করিবে। যদি তোমাকে মেহেরবানীর সহিত ব্যবহার করে, তবে তুমি উহাকে গজব মনে করিবে। মূল উদ্দেশ্য হইতেছে নফস ও শয়তানের দিকে ইশারাহ করা। কেননা তোমাদের নফস ও ইবলিস শয়তান তোমাদের জন্য বড় শত্রু। ইহাদের প্রেরণা হইতে সর্বদা সাবধান থাকিবে।
চুঁ কাজা আউয়াদ না বীনি গায়েরে পোস্ত,
দুশমনিয়ানেরা বাজে না শেনাছি জে দোস্ত।
চুঁ চুনী শোদ ইবতেহালে আগাজ কুন,
নালা ও তাছবীহ ও রোজা ছাজে কুন
নালা মী কুন কা আয় তু আল্লামুল গুইউব,
জীরে ছংগে মকরে বদ মারা ম কোব।
ইনতেকামে আজ মা মকোশ আন্দর জুনুব,
ইয়া করিমোল আফু ছাত্তারুল উইয়ুব
আঁচে দর কাউনাস্ত আসিয়া হরচে হাস্ত
ওয়াইন্নামা জানেরা বহরে ছুরাত কে হাস্তা।
গার ছাগী করদেম আয় শেরে আফরী,
শেরেরা মগুমার বর মা জী কামীন
আবে খোশরা ছুরাতে আতেশে মদেহ,
আন্দর আতেশ ছুরাতে আবে মনেহ্।
আজ শরাবে কাহ্রে চুঁ মস্তি দিহী,
নিস্তে হারা চুঁরাতে হাস্তি দিহী,
চীস্তে মস্তী বন্দে চশমে আজ দীদে চশম,
তা নুমাইয়াদ ছংগে গওহার পশমে পশম।
চীস্তে মস্তী চেচ্ছেহা মবদাল শোদান,
চুবে গঞ্জ আন্দর নজরে ছন্দাল শোদান।
অর্থ: মাওলানা বলেন, যখন আল্লাহর হুকুম হয়, তখন প্রকাশ্য অবস্থা ছাড়া আর কিছুই দেখা যায় না, এবং শত্রু ও মিত্র সম্বন্ধে কোনো পার্থক্য করিতে পারে না। এই জন্য শত্রু হইতে বিরত থাকিতে পারে না, শত্রুর ফাঁদে আটকাইয়া যায়। যখন এই রকম অবস্থা হয়, তবে শুধু নিজের জ্ঞান ও তদবীরের ভরসার উপর নির্ভর করিও না। বরং আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল ও আল্লাহর দিকে মনোনিবেশ কর। জ্ঞান ও তদবীর ত্যাগ করিও না। তদবীর ও জ্ঞানের সহিত আল্লাহর নিকট নম্রতা সহকারে অনুনয়-বিনয় করিয়া প্রার্থনা করিতে থাক যে, হে আলেমুল গায়েব! আমাকে ধর্মের শত্রুর ক্ষতি হইতে দিও না। যদিও আমাদের পাপের দরুন আমরা গজবের পাত্রের উপযুক্ত। কিস্তু তুমি পাপের শাস্তি দিও না, দয়াপরবশ হইয়া আমাদিগকে ক্ষমা কর। তুমি সাত্তারুল আয়েব, এবং যে পরিমাণ বস্তু ইহ-জগতে মওজুদ আছে, ঐ পরিমাণ আমাদের কলব খুলিয়া দাও, যেন নেক আর বদের মধ্যে পার্থক্য করিতে পারি। আর কোনো ধোকাবাজের ধোকায় আবদ্ধ না হই। যদিও আমরা অন্যায় কাজ করিয়াছি, কিন্তু বাঘের ন্যায় যে শত্রু আমাদের নফস ও শয়তান, ইহাকে আমাদের উপর গালেব (বিজয়ী) করিও না। তাহারা যেন আমাদের অজ্ঞাতসারে বাহির হইয়া আমাদিগকে ধ্বংস করিয়া না দেয়। শান্তির পানিকে অগ্নিতে পরিণত করিয়া দিও না, এবং আগুণের মধ্যে পানির সুরাত দিও না। অর্থাৎ, আমাদের উপকারী কার্যসমূহ আমাদের নফসের কাছে যেন অপছন্দ না হয়, এবং অপকারী কাজগুলি যেন আমাদের নফস পছন্দ না করে। কেননা, আপনার গজব দ্বারা যখন কাহারও জ্ঞান লোপ করিয়া নিবেন, যেমন শরাব পান করিলে জ্ঞান লোপ পাইয়া যায়, তখন অবিদ্যমান বস্তুকে বিদ্যমান দেখে, যাহাতে মোটেও উপকার নাই, তাহার মধ্যে অনেক উপকার আছে বলিয়া মনে করে। ইহা আল্লাহর গজবের নমুনা জানিতে হইবে। জ্ঞান লোপ হইয়া যাওয়ার অর্থ, চক্ষের দৃষ্টিশক্তি হইতে মারেফাতের শক্তি লোপ পাওয়া। যেমন পাথরকে গওহর মনে করা। মাস্তির অর্থ অনুভূতি শক্তি লোপ পাওয়া।