আল্লাহ্তায়ালা ভালো মন্দ- সকল কাজের স্রষ্টা। কিন্তু তাঁর সন্তুষ্টি ভালো কাজের সঙ্গে এবং অসন্তুষ্টি খারাপ কাজের সঙ্গে সম্পর্কিত। ‘ইচ্ছা’ এবং ‘সন্তুষ্টি’র মধ্যে সূক্ষ্ম পার্থক্য বিদ্যমান। স্খলনমুক্ত দল আহলে সুন্নত ওয়াল জামাত কেবল এই পার্থক্যের প্রতি জ্ঞান রাখে। অন্যান্য দল এই পার্থক্যের জ্ঞান না পাওয়ায় ভ্রষ্টতায় নিপতিত। যেমন মোতাজিলা সম্প্রদায়ের বিশ্বাস- প্রত্যেক ব্যক্তি তার নিজ কাজের স্রষ্টা। আর কুকাজ এবং গোনাহর সৃষ্টিকর্তা মানুষই। শায়েখ মুহিউদ্দিন এবং তাঁর অনুগামীগণের বক্তব্য থেকেও বোঝা যায় যে, ইমান এবং সৎকর্ম যেমন আল্লাহ্তায়ালার ‘আল হাদী’ নামের পছন্দনীয় এবং কাম্য, তেমনি কুফর এবং গুনাহ্ও তাঁর ‘আল মুদিলু’ বা ‘ভ্রষ্টকারী’ নামের মনঃপুত এবং অভীপ্সিত। তাঁর এই বাক্যও সত্যবাদী আলেমগণের বিরুদ্ধে এবং আল্লাহ্তায়ালার প্রতি বাধ্যতা আরোপকারী। সূর্য যেমন কিরণ দিতে বাধ্য তার ইচ্ছা ও সন্তুষ্টির এখানে কোনো মূল্যই নেই। কিন্তু সূর্যের সৃষ্টিকর্তা তো সেরকম নন। বাধ্যতায় নয়, বরং স্ব-ইচ্ছায় ও অনুগ্রহে সকল কাজ তিনিই সৃষ্টি করেন। তাঁর সন্তোষ উত্তম কাজের সঙ্গে। আর অসন্তোষ অনুত্তম কাজের সঙ্গে। একথা অবশ্যস্মরণীয়।
বান্দাদেরকে ইচ্ছা করবার ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। যাতে তাদের অর্জন তাদেও নিজেদের ইচ্ছার কারণে হয়। অতএব, ব্যাপারটা দাঁড়ালো এরকম যে ‘সৃজন’ আল্লাহ্তায়ালার দিক থেকে আর ‘অর্জন’ বান্দাদের সঙ্গে সংশিষ্ট।
আল্লাহ্তায়ালার ফিতরত বা আত্মভাব এরকম যে, বান্দারা কাজের ইচ্ছা করলে আল্লাহ্তায়ালার সৃজনশৈলী তার সঙ্গে সংশিষ্ট হয় এবং ঘটনা বা কাজে রূপ নেয়। বান্দার ইচ্ছাই যেহেতু কাজ সৃষ্টির সূচনা বা কারণ, তাই প্রশংসা অথবা তিরস্কার (সওয়াব অথবা গোনাহ্) তার প্রতিই বর্তায়। অনেকে বলেন, বান্দার ‘এখতিয়ার’ বা ইচ্ছাশক্তি দুর্বল। আল্লাহ্তায়ালার এখতিয়ার বা ইচ্ছাশক্তির তুলনায় দুর্বল একথা অবশ্য ঠিক, কিন্তু ‘নির্দেশিত কাজ সম্পাদনে তার ইচ্ছাশক্তি যথেষ্ট নয়’ একথা ঠিক নয়। কারণ আল্লাহ্তায়ালা আয়ত্তাতীত বিষয়ের দায়িত্ব প্রদান করেন না। এরশাদ হয়েছে-
বরং তিনি বান্দার প্রতি সহজ করতে চান। কঠিন করতে চান না’।
— সূরা বাকারা, ১৮৫ আয়াত
পৃথিবীর সাময়িক কাজের বদলে চিরস্থায়ী বিনিময় প্রদান- আল্লাহ্তায়ালারই অনুগ্রহসিক্ত পরিমান নির্ধারণ। নির্ধারিত হয়েছে যে, সাময়িক কুফরের প্রতিফল চিরস্থায়ী আজাব এবং সাময়িক ইমানের বিনিময় চিরস্থায়ী বেহেশত। আল্লাহ্তায়ালার এরশাদ এরকম-
এটা মহাপরাক্রমশালী ও সুকৌশলী আল্লাহ্তায়ালার পরিমাণ নির্ধারণ’।
— সূরা ইয়াসিন, ৩৮ আয়াত
হজরত মোজাদ্দেদে আলফে সানি র. বলেন, আল্লাহ্তায়ালার দয়ায় আমরাও বুঝতে পারি যে, যিনি সকল প্রকার বাহ্যিক এবং অভ্যন্তরীণ নেয়ামত দান করেছেন, যিনি আকাশ ও পৃথিবীর স্রষ্টা- সকল পূর্ণতা, পবিত্রতা ও শ্রেষ্ঠত্ব তাঁর অস্তিত্বেই বিদ্যমান। এরকম পবিত্রতম সত্তার প্রতি অস্বীকৃতির প্রতিফল কঠিনতম হওয়াই যুক্তিযুক্ত। তাই অস্বীকৃতির শাস্তি চিরকাল দোজখবাস। অপরপক্ষে শয়তান এবং প্রবৃত্তির প্রাধান্য সত্ত্বেও পবিত্রতম, মহোত্তম ও অদৃশ্য আল্লাহ্তায়ালার প্রতি ইমান আনা এবং তাঁর প্রত্যাদেশকে সত্য জানার প্রতিদান সর্বশ্রেষ্ঠ হওয়াই শোভনীয়। অনন্ত— বেহেশতবাস তাই তার পারিতোষিক নির্ধারণ করা হয়েছে। কোনো কোনো মাশায়েখ বলেছেন, বেহেশতলাভ আল্লাহ্তায়ালার অনুগ্রহের উপর নির্ভরশীল। কিন্তু একে ইমানের সঙ্গে সম্পৃক্ত করার কারণ এই যে, কর্মের প্রতিফল হিসাবে পারিতোষিক প্রাপ্তির ধারণা অধিক আনন্দময়। এ ফকিরের ধারণা, বেহেশতলাভ প্রকৃতপক্ষে ইমানের প্রতিই নির্ভরশীল। আর ইমান আল্লাহ্তায়ালার সর্বশ্রেষ্ঠ অনুগ্রহ। নিছক দয়া। পক্ষান্তরে দোজখভুক্তি কুফরের প্রতি ন্যস্ত এবং কুফর নফসে আম্মারা, অর্থাৎ অসৎ প্রবৃত্তিজাত অপবিত্রতা। আল্লাহ্পাক এরশাদ করেন-
উৎকৃষ্ট যা কিছু তুমি পাও তা আল্লাহর দিক থেকে। আর নিকৃষ্ট যা কিছু লাভ করো তা তোমারই প্রবৃত্তিজাত।
— সূরা নিসা, ৭৯ আয়াত
বেহেশতপ্রাপ্তি ইমানের কারণে জানা, প্রকৃতপক্ষে ইমানকে সম্মান করা, বরং যাঁর প্রতি ইমান আনা হয়েছে, তাঁরই সম্মান করা। এজন্যই চরমতম এবং উচ্চতম পারিতোষিক ইমানদার বান্দাকে দেওয়া হয়েছে। আবার দোজখভুক্তিকে কুফরের সঙ্গে সম্পৃক্ত করা কুফরকে অপমান করা এবং একই সঙ্গে পবিত্রতম ও অতুলনীয় ওই সত্তার সম্মান করা, যাঁর প্রতি অবিশ্বাস করা হয়েছে। তাই চরমতম এবং নিকৃষ্টতম বিনিময় তার প্রতিদান ।
পূর্ববর্তী পেইজ | পরবর্তী পেইজ |
(১২) আল্লাহ্তায়ালার সৃজনশীলতা | (১৪) আল্লাহ্তায়ালার দর্শন |
সূচীপত্র | এরকম আরো পেইজ |