হযরত আয়েশা (রা) থেকে বর্ণিত আছে- রাসূলুল্লাহ্ (সা) হেরা গুহায় ছিলেন, তখন জিবরাঈল (আ) এসে বললেন, পড়–ন! (অন্য বর্ণনায় এসেছে- তাঁর সামনে রেশমের একটি চাদর, যাতে সোনালী অক্ষরে কিছু লেখা ছিল, মেলে ধরে বলা হলো, পড়ুন।) রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেনঃ আমি পড়তে পারি না। রাসূল (সা) বলেন- তখন জিবরাঈল (আ) আমাকে তাঁকে বুকে জড়িয়ে এমন জোরে চাপ দিলেন যে, আমি কাহিল হয়ে পড়লাম। তারপর আমাকে ছেড়ে দিয়ে বললেনঃ পড়ুন ! বললাম- আমি পড়তে পানি না। তিনি আবাক আমাকে তাঁর বুকে জড়িয়ে ধরে সজোরে চাপ দিলেন। ফলে আমি নিস্তেজ হয়ে গেলাম। ছেয়ে দিয়ে পুরনায় বললেনঃ পড়ুন ! আমি আবার বললাম- আমি তো পড়তে পারি না। আবার আমাকে ধরে বুকের সাথে সজোরে চাপ দিলেন, আমি শক্তিহীন ও নিস্তেজ হয়ে পড়লাম। আমাকে অতঃপর ছেড়ে দিয়ে বললেনঃ
আপনার প্রতিপালকের নামে পড়ুন, যিনি সৃষ্টি করেছেন; সৃষ্টি করেছেন মানুষকে জমাট রক্ত থেকে। পড়ুন, আপনার পরওয়ারদেগার মহা মহিমান্বিত, যিনি শিক্ষা দিয়েছেন কলম দ্বারা। শিক্ষা দিয়েছেন মানুষকে যা তারা জানত না।
এ ঘটনার পর রাসূল (সা) গুহা থেকে বের হয়ে বাড়ি ফিরে এলেন। ভয় আর বিস্ময়ে তাঁর সমস্ত শরীর কাঁপছিল। ব্যস্তভাবে খাদিজা (রা)-কে বললেনঃ আমাকে কাপড় দিয়ে ঢেকে দাও।
তারপর ভয় ও ক্লান্তি দূর হলে না খাদিজা (রা)-এর কাছে সব ঘটনা খুলে বললেন। আরও বললেনঃ আমি যেন মরণের আশস্কা করছি। হযরত খাদিজা (রা) বললেন, কখনই নয়। আল্লাহ্ আপনাকে ক্ষতিগ্রস্ত করবেন না। আপনি আত্মীয়তার পুরো হক আদায় করেন, সর্বদা সত্য কথা বলেন, দুর্বলের বোঝা নিজে বহন করেন, গরীবদের অর্থ সাহায্য করেন, মোহমানদের সেবা করেন, বিপদে মানুষের সাহায্য করেন।
তারপর খাদিজা (রা) তাঁকে নিয়ে নিজ চাচাত ভাই ওয়ারাকা ইব্ন নাওফেলের কাছে গেলেন। যিনি ঐ জাহিলিয়াত যুগে খৃস্টধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। ইবরানী ভাষার একজন পন্ডিত লেখক এবং ইঞ্জিল কিতাবের অনেকাংশের ব্যাখ্যাকারী ছিলেন। এ সময় তিনি অতি বৃদ্ধ এবং অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন।
খাদিজা (রা) তাঁকে বললেনঃ আপনার এ ভাতিজার কথাগুলো শুনুন। ওয়ারাকা রাসূলুল্লাহ্ (সা)-কে বললেনঃ ‘ব্যাপার কি, বলুন তো।’ রাসূল (সা) তাঁকে সব ঘটনা খুলে বললেন। সব শুনে ওয়ারাকা বললেনঃ ইনি তো সেই (নামুস) জিবরাঈল, যিনি মূসা (আ)-এর কাছে আসতেন। হায় ! আমি যদি এখন সামর্থ্যবান যুবক থাকতাম ! আমি যদি সে সময় পর্যন্ত জীবিত থাকতাম যখন আপনার জাতির লোকেরা আপনাকে দেশ থেকে বের করে দেবে।
রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেনঃ তারা কি আমাকে দেশ থেকে বের করে দেবে ? ওয়ারাকা বললেন, হ্যাঁ ! আপনার ন্যায় নবুওয়াত নিয়ে যাঁরাই এসেছেন, তাঁদের সাথেই চরম শত্রুতা করা হয়েছে। সে সময় পর্যন্ত বেঁচে থাকলে সর্বশক্তি দিয়ে আমি আপনার সহায়তা করব। তার (কিছুদিন) পর ওয়ারাকা ইনতিকাল করলেন এবং ওহী আসাও স্থগিত রইল। তিন বছর তা স্থগিত ছিল।
ইব্ন শিহাব যুহরী বলেন, আবূ সালমা ইব্ন আবদুর রহমান বলেছেন যে, ওহী স্থগিত থাকা সম্পর্কে জাবির ইব্ন আবদুল্লাহ্ আনসারী বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা) নিজে ইরশাদ করেনঃ আমি চলছিলাম, আসমান থেকে একটা আওয়াজ শুনলাম। তাকিয়ে দেখি হেরা পাহাড়ের গুহায় যিনি আমার কাছে এসেছিলেন সেই ফেরেশতা আসমান ও জমিনের মাঝখানে কুরসীতে বসে আছেন। আমি ভয় পেয়ে বাড়ি চলে এলাম এবং আমাকে চাদর দিয়ে ঢেকে দিতে বললাম। তখন আল্লাহ্ তা’আলা আমার উপর এ আয়াত নাযিল করলেনঃ
হে চাদরাবৃত ! ওঠ এবং মানুষকে (তার পরিণাম সম্পর্কে) সর্তক করো এবং তোমার পরওয়ারদিগারের বড়ত্ব ঘোষণা কর, তোমার পরিধেয় বস্ত্র পবিত্র করো, অপবিত্রতা পরিত্যাগ করো।
— সূরা মুদাস্সিরঃ ১-৫
এরপর থেকে ওহী একনাগাড়ে নাযিল হতে থাকে। (বুখারী ও মুসলিম)
বর্ণিত আছে- সর্বপ্রথম যা তিনি দেখেছিলেন তা ছিল একটি স্বপ্ন। ভয় পেয়ে তা তিনি হযরত খাদিজা (রা)-এর কাছে বলেন। তিনি তাঁকে সান্ত্বনা দেন।
মূসা ইব্ন উকবা এবং শিহাব ইব্ন যুহারী বর্ণনা করেন- (হযরত খাদিজার সান্ত্বনা প্রদানের পর) রাসূলুল্লাহ্ (সা) খাদিজা (রা)-এর কাছ থেকে বাইরে গেলেন। কিছুক্ষণ পর আবার ফিরে এলেন এবং বললেন, আমি দেখলাম যে আমাকে বিদীর্ণ করা হলো, ধৌত করে পাক করা হলো, আবার পূর্বের ন্যায় করে দেওয়া হলো। খাদিজা (রা) বললেন, আল্লাহর কসম ! এটা তো খুবই মঙ্গলময়। আপনি সুসংবাদ গ্রহণ করুন।
এরপর জিবরাঈল (আ) প্রকাশ্যে আগমণ করেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা) তখন মক্কায় উঁচু এলাকায় ছিলেন। হযরত জিবরাঈল আমীন তাঁকে একটি আশ্চর্য সস্মানিত আসনে বসান। রাসূল (সা) বলতেন, জিবরাঈল (আ) আমাকে দুধের ফেনার মত পরিষ্কার সাদা একটা বিছানায় বসালেন, যা মোতি ও ইয়াকুত দ্বারা সাজানো ছিল। তারপর জিবরাঈল (আ) তাঁকে নবুওযাতের সুসংবাদ দান করেন। এতে তিনি উৎসাহিত হলেন। তারপর জিবরাঈল (আ) বললেনঃ 'ইকরা বি'সমি রাব্বিকা' থেকে 'মা লাম ইয়া'লাম' পর্যন্ত ।
হযরত রাসূলুল্লাহ্ (সা) আপন রব প্রদত্ত রেসালত কবুল করে যখন ফিরে আসছিলেন, পথে প্রতিটি গাছ ও পাথর তাঁকে সালাম করল। তিনি প্রফুল্ল ও আনন্দিত হয়ে ঘরে ফিরে এলেন। যে মহান কিছু তিনি দেখেছিলেন তার প্রতি তাঁর পূর্ণ একিন ছিল।
খাদিজা (রা)-এর কাছে এসে তিনি বললেন যে, যে ঘটনাটি আমি স্বপ্নে দেখেছিলাম এবং ভীত হয়ে তোমার কাছে বর্ণনা করেছিলাম তা আজ বাস্তবে ঘটল। প্রকাশ্যে জিবরাঈল (আ) আমার কাছে এসেছেন। আমার বর তাঁকে আমার কাছে পাঠিয়েছেন। তারপর জিবরাঈল (আ) আল্লাহর পক্ষ থেকে যে পয়গাম এনেছিলেন তা তিনি খাদিজা (রা)-কে শোনালেন। খাদিজা (রা) বললেনঃ সুসংবাদ ! আল্লাহ্ আপনার সাথে মঙ্গলময় আচরণ করবেন। আল্লাহর পক্ষ থেকে যে পয়গাম আপনি গ্রহণ করুন। এটা অবশ্যই সত্যি। আপনি অবশ্যই আল্লাহর রাসূল ।
তারপর খাদিজা (রা) ঘরের বাইরে এলেন। এবং উতবা ইব্ন রাবীয়ার গোলাম আদাসের কাছে গেলেন। আদাস ছিলেন নিনুয়ার অধিবাসী,নাসারা। তিনি আদাসকে আল্লাহর কসম দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি জিবরাঈল (আ) সম্পর্কে কিচু জানো ? আদাস বললেন, কুদ্দুসুন, কুদ্দুসুন-জিবরাঈল, এ মূর্তিপূজার দেশে তাঁর নাম মুখে নেওয়াও নিরাপদ নয়। খাদিজা (রা) বললেনঃ তুমি তাঁর সম্পর্কে যা জানো, বলো।
আদাস বললেনঃ জিবরাঈল (আ) হলেন আল্লাহ্ ত’আলার এবং নবীগণের মাঝে বিশ্বসী দূত-পয়গামবাহী। তিনি মূসা (আ) ও ঈসা (আ)-এর উজির।
খাদিজা (রা) তাঁর কাছ থেকে চলে এসে ওয়ারাকা ইব্ন নাওফেলের কাছে সবকিছু খুলে বললেন। সব শুনে ওয়ারাকা বললেন, ‘নিশ্চয়ই তোমার স্বামী সেই প্রতীক্ষিত নবী, আহলে কিতাব যার যার অপেক্ষা করে আছে। এবং যার বর্ণনা তারা তাওরাত ও ইঞ্জিলে পেয়েছে।’ (বায়হাকী ও মুসলিম)
ইব্ন রিস্তা যুহারী থেকে রেওয়ায়েত করেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা) হেরা গুহায় ছিলেন, এ সময় ফেরেশতা তাঁর কাছে রেশমী কিংখাবের একটি কাপড় নিয়ে আসেন, যাতে আরবী হরফে প্রথম অবতীর্ণ আয়াতসমূহ লিখিত ছিল। (কিতাবুল মোছারেফ ও মাদারেজুন্নাবুওয়াত)
এ কাপড়খানা সামনে মেলে ধরেই জিবরাঈল রাসূলুল্লাহ্ (সা)-কে বলেছিলেন, পড়ুন! আর জওয়াবে রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেছিলেন, আমি তো পড়তে জানি না।
পূর্ববর্তী পেইজ | পরবর্তী পেইজ |
(০২৫) গাছ ও পাথরের সালাম | (০২৭) বৃক্ষ ও পাথরের দেওয়া সালাম হযরত আলী (রাঃ)ও শুনতে পেলেন |
সূচীপত্র | এরকম আরো পেইজ |