হাদিসে উল্লেখ রয়েছে যে, আল্লাহর রাসুল সঃ জীবনে একবার হাবশার বাদশা নাজাশীর মৃত্যুতে সাহাবীদের নিয়ে তার গায়েবানা জানাযা আদায় করেছেন।
— সহীহ বুখারী ১/১৯৭,৪৪৩,৪৪৬, হাঃ১১৮৮,১২৫৪,১২৬৩ সহীহ মুসলিম ১/৬৫৬ হাঃ৯৫২
ঘটনার সারসংক্ষেপঃ
বাদশা নাজাশীরর হাব্শার (বর্তমান আবিসিনিয়ার) মুসলিম শাসক ছিলেন । সেসময় তাঁর রাজ্যে মুসলমান বলতে একমাত্র তিনিই ছিলেন । তিনি আবিসিনিয়ায় আগত সকল মুসলমানদের সর্বাত্তক সাহায্য-সহযোগিতা করতেন । আল্লাহর রাসুল (সঃ)কে তিনি বড়ই মহব্বত করতেন এবং মুহাম্মাদ (সঃ)ও তাঁকে মুহাব্বাত করতেন। তাঁর ইন্তেকালের পর সেখানে তাঁর জানাজা পড়ানোর মত এক জনও ছিল না। আর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর নিকট এটা কষ্টকর ছিল যে, এইরূপ একজন রাসূল প্রেমিক মুসলমানের জানাজা হল না! তাই তিনি গায়েবানা জানাযার নামায পড়িয়েছিলেন। কিন্তু উনি (সাঃ) যখন পড়াচ্ছিলেন তখন তাঁর চোখের পর্দা সড়ে গিয়েছিল এবং নাজাশী বাদশাহের লাশ সামনে দেখতে পাচ্ছিলেন। আর তাই গায়েবে জানাযা শুধুমাত্র উনার (সাঃ) জন্যই খাস ছিল। আর কারও জন্য কখনই নয়।
ঐ একমাত্র ঘটনার পর রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বা কোন সাহাবী (রাঃ) বা তাবেয়ী বা তাবে তাবেয়ীন (রঃ) কোনদিন কোন মুসলিমের গায়েবানা জানাযা পড়েছেন বলে জানা যায় না।
— লামেউদ দুরারী ৪/৪৩২, ফত হুল ক্বদীর ১/৪৩২
বহু সাহাবী (রাঃ) দূর দুরান্তে শহীদ হয়েছে কেউ মারা গেছে কিন্তু রাসুলুল্লাহ (সাঃ) আর কারও গায়েবানা জানাযা পড়েন নাই। ঈমাম শাফেয়ী (রঃ) ছাড়া বাকি ৩ ইমাম (রঃ) এর বিরোধি ছিল। তবে শাফেয়ীদের এক্ষেত্রে শর্ত হচ্ছে- দূর দুরান্ত মাইয়েত যার জানাযা পড়ানো হয় নাই তার জন্য ই এ জানাযা সবাই একবার ই আদায় করা যাবে।
— যাদুল মা'আদ ইবনুল কাইয়ুম
হানাফী, মালেকী ও হাম্বলীদের ঊলামায়েকেরামদের মতে জানাযার নামাযে মৃত ব্যাক্তির সামনে থাকা জরুরী নতুবা গায়েবানা জানাযা পড়া যাবেনা আর গায়েবানা জানাযা সুন্নাহ সম্মত নয়।।
— বাহরুর রায়েক; ফতোয়ায়ে শামী; আহকামুল মাইয়েত; বেহেশতী জেওয়ার; যাদুল মা'আদ- বাবে সলাতুল জানায়েয; আল মাজমূ'-৫/২৫৩; আল মুগনী ২/৩৮৬; যারকানী ২/১০; ইলাউস সুনান ২/২৩৪; ফয়দুল বারী ২/৪৬৯; মুগনী মুহতাজ ১/১৬৫; কাশফুল কান্না ২/১২৬; শরহুছ ছগীর ১/৫৬৯
ইমাম আযম আবু হানিফা (রঃ) ও ইমাম মালেক (রঃ) এর মতে জানাজার নামাজ শুদ্ধ হওয়ার জন্য মাইয়্যেত ইমামের সম্মুখে উপস্থিত থাকা আবশ্যক। কাজেই কোন অনুপস্থিত মাইয়্যেতের জন্য সাধারণভাবে দু’আ করা যায় কিন্তু গায়েবানা জানাজা পড়া শুদ্ধ নয়। কারন প্রিয় নবী (সাঃ) এর জীবদ্দশায় মদিনা শরীফের দূরে অদূরে অনেক সময় অনেক সাহাবীর ইন্তিকাল কিম্বা শহীদ হওয়ার সংবাদ তাঁর কাছে পৌঁছত। এ সময় তিনি তাদের জন্য কেবল দু’আই করেছেন। তাদের জন্য গায়েবানা জানাজার কোন আয়োজন করেন নি। যদি গায়েবানা জানাজা শুদ্ধ হত তাহলে প্রিয় নবী (সাঃ) তাঁর ঐ সকল সাহাবীকে জানাজার নামাজ থেকে বঞ্চিত রাখতেন না। সাহাবীদের যুগেও কখনও কেউ গায়েবানা জানাজা পড়েন নি।
তবে প্রিয় নবী (সাঃ) সাধারণ নিয়ম বহির্ভূতভাবে একজনের জন্য গায়েবানা জানাজা পড়েছেন বলে হাদিসে পাওয়া যায়। তিনি হলেন হাব্শার বাদশাহ নাজাশী। হাদিসের আলোকে আরো বুঝা যায় যে, গায়াবানা নামাজটি তাদর জন্য একান্ত ও বিশেষ অনুমতি ছিল। কাজেই এ ঘটনার উপর অন্যদের আমল করার অবকাশ নেই। এ কারনেই সাহাবীগণ প্রিয় নবীর ওফাতের পর কখনও কারোর জন্য গায়েবানা জানাজা পড়েন নি।
তাছাড়া দু’জনের জন্য প্রিয় নবী (সাঃ) যে জানাজ আদায় করেছেন সেটিকে গায়েবানা জানাজা বলাও সর্বাংশে শুদ্ধ নয়। কেননা সে ক্ষেত্রে আল্লাহ্ তা’আলা মাইয়্যেতকে প্রিয় নবীর সম্মুখস্ত করে দিয়েছিলেন। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন, নাজাশী বাদশাহ্র শবদেহ ও প্রিয় নবীর মধ্যবর্তী সকল অন্তরায় তুলে দেওয়া হয়। ফলে প্রিয় নবী তাঁর লাশ স্বচক্ষে অবলোকন করেন এবং জানাজার নামাজ আদায় করেন। (ওয়াহিদী ও আস্বাবুন) সুতরাং মাইয়্যেত দৃশ্যত না হলে জানাজার নামাজ পড়া শরীয়ত সম্মত নয় ।<ref>সংগৃহীত ফতোয়া ও মাসাইল -ইসলামিক ফাউন্ডেশন (জানাজার নামাজ অধ্যায়)</ref>
মারেফুল কুরানে মুফতী শফী রাহ, ইমাম ইবনে তাইমিয়াহ তার মাজমূয়ায়ে ফতোয়া আর ইমাম ইবনুর কাইয়ুম রাহ, তার যাদু মা'আদ এ লিখেছেনঃ ‘যেই রাসুলুল্লাহর আমল থেকে ১ বার আর যেভাবে প্রমানিত হয়েছে সেই আমল জীবনে ১ বার ঠিক সেভাবেই আদায় করা হচ্ছে সুন্নাহ। এদিকে খেয়াল করলে প্রচলিত গায়েবানা জানাযার নামাজের কোন ভিত্তি ই থাকে না।
আহলে হাদীসদের প্রিয় নেতা মুফতী কাজী ইবরাহীম এবং শাহ ওয়ালিউল্লাহ সাহেবও একই মত পোষন করেছে।
এছাড়া আহলে হাদীস নেতা ডঃ আব্দুল্লাহ জাহাংগীর গায়েবানা জানাযার ব্যপারে লিখেন
জীবনে সর্বদা(রাসুল) যা বর্জন করেছেন এই ১টি ঘটনায় তিনি তা করলেন..... বিষয়টি তার জন্য খাছ ছিল। আল্লাহ তা'লা নাজাসীকে মর্যাদা প্রদান করে তার মৃতদেহ রাসুলুল্লাহর চাক্ষুস করে দেন (যার ফলে তিনি গায়েবানা নয় মাইয়েত কে সামনে রেখেই) তিনি জানাযা আদায় করেন...... কিন্তু কোন অবস্থায় আমরা রাসুলুল্লাহর একদিনের কাজ কে আমাদের রীতি বানিয়ে নিতে পারিনা। তাহলে তার(রাসুলের) সব সময়ের রীতি বর্জন করব। এভাবেই আমরা বিদ'আতে নিপতিত হব।
— এহ ইয়াউস সুনানের ৫ম অধ্যায়ঃ সুন্নত বনা খেলাফে সুন্নত পৃঃ৩৭৫
ইবনে তাইমিয়া বলেন
নাজাশী যেহেতু কাফেরদের এলাকায় মারা গেছে আর তার জানাযা পড়ানো হয় নাই তাই রাসুল্লাহ তার জানাযা পড়িয়েছেন...... মনে রাখবেন রাসূলুল্লাহ থেকে গায়েবানা জানাযা নামাজ পড়া ও পরিত্যাগ করা ২ টাই প্রমানিত তবে প্রত্যেকটির ক্ষেত্র ভিন্ন
— যাদুল মা'আদ ১/৫০১
ইবনুল কাইয়ুম ও তার যাদুল মা'আদের ১/৫০০ এর নামাজ অধ্যায় অনুবাদ করেছেন ডঃ আব্দুশ শহীদ নাসীন ও কুস্টিয়া ইসলামী ইউনিভার্সিটির ডঃ যাকারিয়া । অনুদিত কিতাবের বাংলা নাম "আল্লাহর রসুল কিভাবে নামাজ পড়তেন" । অনূদিত কিতাবের পৃঃ ১৯৮ তে ইবনুল কাইয়ুমের গায়েবানা জানাযার হুকুম উল্লেখ্য আছে যার সার সংক্ষেপ হচ্ছে- গায়েবানা জানাযা পড়া হাদীস ও সুন্নাহ সম্মত নয়।
মাহমূদুল হাসান দেওবন্দী রচিত ‘কাফন- দাফনের মাসয়ালা-মাসায়েল’ কিতাবে জানাযা ও গায়েবানা জানাযার হুকুম বিস্তারিত আলোচনা করেছেন।
মূল সারাংশ হল, গায়েবানা জানাযার নামাজের প্রধান শর্তই হলো লাশের উপস্থিত থাকা লাগবে, নতুবা তা হবে না। বর্তমানে আমাদের দেশে প্রায় প্রত্যেকটা লাশই তাদের আত্বীয় স্বজনরা খুঁজে পায় এবং তারাই ব্যক্তিগতভাবে জানাযার নামাযের ব্যবস্থা করে। আর যে সব ক্ষেত্রে লাশই পাওয়া যায় না সে সব ক্ষেত্রে তো গায়েবে জানাযার প্রশ্নই আসে না। তাই গায়েবে জানাযার কোনো বিন্দুমাত্র দরকার হয় না। আর সবার শেষ কথা হল, গায়েবে জানাযা শুধুমাত্র রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর জন্য খাস ছিল, আর কারও জন্য কখনই নয়।