প্রখ্যাত হাদিসবেত্তা হাফেজ ইবনে কাইয়্যিম জিকিরের উপকারিতার বিষয়ে রচিত তাঁর 'আলওয়াবিলুছ ছাইয়্যিব' নামক গ্রন্থে সবিস্তার আলোচনা করেছেন। লিখেছেন, জিকিরের মধ্যে রয়েছে একশতটিরও বেশী উপকারিতা। সেখান থেকে চুয়াত্তরটি উপকারিতার কথা এখানে আমরা উল্লেখ করলাম। যেমন-
১. জিকির শয়তানকে তাড়িয়ে দেয় ও তার শক্তি খর্ব করে।
২. জিকির আল্লাহ্র পরিতোষ লাভের উপায়।
৩. হৃদয়ের বিষণ্ণতা দূর করে।
৪. মনে আনে আনন্দ।
৫. উজ্জীবিত ও প্রফুল্ল রাখে হৃদয় শরীরকে।
৬. চেহারা ও অন্তরকে করে জ্যোতির্ময়।
৭. উত্তম রিজিক আকর্ষণ করে।
৮. জিকিরকারীকে প্রভাব ও প্রশান্তির পোশাক পরানো হয়। তাকে দেখলে সমীহবোধ যেমন জাগে, তেমনি জাগে ভালোবাসা।
৯. হৃদয় ভরে দেয় আল্লাহর ভালোবাসায়।
১০. জিকিরের দ্বারা লাভ হয় মোরাকাবা (ধ্যনমগ্নতা) যা পৌঁছে দেয় এহসানের স্তরে।
১১. সকল বিষয়ে আল্লাহই হন একমাত্র আশ্রয়স্থল।
১২. লাভ হয় আল্লাহ্র নৈকট্য।
১৩. খুলে যায় মারেফতের দরজা।
১৪. অর্জিত হয় আল্লাহ্র ভয়।
১৫. আল্লাহ্ তাকে স্মরণ করেন। যেমন বলা হয়েছে 'ফাজকুরুনী আজকুরকুম' (তোমরা আমাকে স্মরণ করো, আমিও তোমাদেরকে স্মরণ করবো)। সুরা বাকারা আয়াত ১৫২। হাদিস শরীফে বর্ণিত হয়েছে 'মান জাকারানি ফী নাফসিহি জাকারতুহু ফী নাফসী' (যে আমাকে মনে মনে স্মরণ করে, আমিও তাকে মনে মনে স্মরণ করি)।
১৬. দিলকে জিন্দা করে।
১৭. জিকির হচ্ছে কলব ও রূহের আহার।
১৮. কলবের মরিচা দূর করে দেয়।
১৯. দূর করে দেয় ত্রুটি-বিচ্যুতি ও ভুল-ভ্রান্তি।
২০. গাফিলতি বা অমনোযোগিতা দূর করে।
২১. বান্দা যে জিকির আজকার করে, তা আরশের চতুর্দিকে ওই বান্দার জিকির করে ঘুরতে থাকে।
২২. সুখের সময় যে জিকির করে, তার দুঃখের সময় আল্লাহ্ তাকে স্মরণ করেন।
২৩. জিকির আল্লাহর আযাব থেকে নাজাতের ওসীলা।
২৪. জিকিরের কারণে সাকিনা অবতীর্ন হয়।
২৫. জিকিরের বরকতে জবান গীবত, চোগলখুরী, অসত্য ও অনর্থক কথা থেকে নিরাপদ থাকে।
২৬. জিকিরের মজলিস হচ্ছে ফেরেশতাদের মজলিস।
২৭. জিকিরের বদৌলতে জিকিরকারীর সঙ্গী-সাথীরাও সৌভাগ্যবান হয়।
২৮. কিয়ামতের দিনে জিকিরকারীদের কোনো আক্ষেপ থাকবে না।
২৯. ক্রন্দনকারী জিকিরকারী কিয়ামতের দিনে আল্লাহর আরশের ছায়ায় আশ্রয় লাভ করবে।
৩০. দোয়াকারীগণের চেয়ে জিকিরকারীদের অধিক প্রাপ্তি ঘটে। হাদিসে কুদসিতে বর্ণিত হয়েছে, আল্লাহ্ সুবহানাহু তায়ালা এরশাদ করেন, আমার জিকিরের কারণে যে দোয়া করার ফুরসত পায় না, আমি তাকে দোয়াকারীদের চেয়ে বেশী দান করি।
৩১. সবচেয়ে সহজ ইবাদত হওয়া সত্ত্বেও জিকির সকল ইবাদতের চেয়ে উত্তম।
৩২. আল্লাহ্র জিকির জান্নাতের ছায়াগাছ।
৩৩. জিকিরের জন্য যে প্রতিদান ও পুরস্কারের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে, অন্য কোনো আমলের জন্য সেরকম প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়নি। হাদিস শরীফে বলা হয়েছে 'লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহাদাহু লা শারীকালাহু লাহুল মুলকু ওয়া লাহুল হামদু ইউয়ী ওয়া ইউমিতু ওয়া হুয়া আলা কুল্লি শাইয়্যিন কুদীর' এই দোয়া যদি কেউ দিনে একশত বার পাঠ করে, তবে তাকে দেওয়া হয় দশজন ক্রীতদাস মুক্ত করে দেওয়ার সওয়াব, তার আমলনামায় লিখে দেওয়া হয় একশত নেকি এবং গোনাহ্ মাফ করে দেওয়া হয় একশতটি। আর সন্ধ্যা পর্যন্ত সে শয়তানের আক্রমণ থেকে হেফাজতে থাকে।
৩৪. নিজের কল্যাণের কথা ভুলে যাওয়ার বিপদ থেকে রক্ষা করে। রোধ করে কলবের মৃত্যুকে।
৩৫. জিকির মানুষের অশেষ উন্নতি সাধন করে। যার কলব জিকিরে জাগ্রত, তার নিদ্রিত অবস্থাও গাফেল রাত্রি জাগরণকারী অপেক্ষা উত্তম।
৩৬. জিকিরের নূর দুনিয়ায় সঙ্গে থাকে, সঙ্গে থাকে কবরেও। আর পুলসিরাতে চলতে থাকবে আগে আগে। রসুলেপাক স. এই নূরের জন্যই প্রার্থনা করতেন এভাবে- হে আমার আল্লাহ্! আমার মাংসে, অস্থিতে, চর্মে, পশমে, কানে, চোখে, উপরে, নিচে, ডানে, বামে, সম্মুখে, পশ্চাতে নূর দান করো। আরো বলতেন, আমার আপাদমস্তক নূরে ভরপুর করে দাও।
৩৭. জিকির তাসাউফ শাস্ত্রের মৌলিক বিষয়গুলির মূল। সকল তরিকার পীর-মোর্শেদগণ এ ব্যাপারে একমত। যার জন্য জিকিরের দ্বার উন্মুক্ত হয়েছে, তার জন্য খুলে গিয়েছে মারেফতের পথ।
৩৮. মানুষের অন্তরে এমন একটি কোণ আছে, যা জিকির ছাড়া অন্য কোনো কিছু দ্বারা পূর্ণ করা যায় না। হৃদয়ের পূর্ণ পরিসর যখন জিকিরে ভরে যায়, তখন ওই বিশেষ কোণটিও ভরপুর হয়ে যায় জিকিরের নূরে। তখন জিকিরকারী সম্পদ ব্যতিরেকেই হয়ে যায় সম্পদশালী। আত্মীয়-স্বজন ও জনবল ছাড়াই লাভকরে প্রভূত সম্মান। সাম্রাজ্য ছাড়াই হয়ে যায় সম্রাট। আর যে জিকির করে না, সে আত্মীয়-পরিজন, বিত্ত-সম্পদ ও রাজত্ব থাকা সত্ত্বেও হয় লাঞ্ছিত ও অপদস্থ।
৩৯. জিকির বিক্ষিপ্ত বিষয়াবলীকে একত্র করে, একত্রকে করে বিক্ষিপ্ত। দূরবর্তীকে করে নিকটবর্তী, আর নিকটবর্তীকে ঠেলে দেয় দূরে। অর্থাৎ হৃদয়ের সকল অসৎভাবনাকে দূরে ঠেলে দিয়ে অন্তরে আনে শান্তি ও আল্লাহপ্রেম। দুর্ভাগ্যকে করে দূরবর্তী, আর নিকটে এনে দেয় সকল সৌভাগ্যকে।
৪০. জিকির হৃদয়ের ঘুম ভাঙায়। সতর্ক করে।
৪১. জিকির এমন একটি বৃক্ষ, যাতে ফল ধরে মারেফতের। সুফিয়ায়ে কেরাম ওই ফলকে বলেন হাল ও মাকামের ফল। জিকির যতো গভীর হবে, ওই বৃক্ষের শিকড় হবে ততো সুদৃঢ়। ফলও ধরবে বেশী।
৪২. জিকিরকারী আল্লাহ্পাকের সঙ্গী। যেমন আল্লাহতায়ালা এরশাদ করেন 'ইন্নাল্লাহা মায়াল্লাজীনাত্তাক্বাও' (আল্লাহ্ মুত্তাকীদের সঙ্গে আছেন)। সুরা নাহল, আয়াত ১২৮। হাদিস শরীফে বলা হয়েছে, আল্লাহ্পাক বলেন 'আনা মাআ' আ'বদি মা জাকারানী' (আমি বান্দার সাথে থাকি, যতক্ষণ সে আমার জিকির করতে থাকে)। এক হাদিসে আছে, আল্লাহ্পাক বলেন, আমার জিকির যারা করে, তারা আমার আপন জন। তাদেরকে আমি কখনোই আমার রহমত থেকে দূরে সরিয়ে দেই না। যদি তারা তওবা করে, তবে আমি তাদের বন্ধু হই। না করলে তাদের চিকিৎসক হই। গোনাহ্ থেকে তাদেরকে পবিত্র করার নিমিত্তে তাদেরকে দুঃখ-কষ্টে ফেলে দেই।
৪৩. জিকির ক্রীতদাস মুক্ত করে দেওয়ার সমতুল। আল্লাহ্র পথে অর্থ ব্যয় তুল্য। আল্লাহ্র রাস্তায় জেহাদ করার সমান।
৪৪. জিকির শোকরের মূল। যে ব্যক্তি আল্লাহ্ জিকির আদায় করে না, সে আল্লাহ্ শোকরও আদায় করে না।
এক হাদিসে আছে, একবার মহাপ্রেমিক মুসা নবী আ. আল্লাহ্পাকের উদ্দেশ্যে নিবেদন করলেন, হে আমার প্রিয় প্রভুপালক! তুমি আমার উপরে অসংখ্য এহসান করেছো। সুতরাং আমাকে এমন একটি পদ্ধতি শিখিয়ে দাও, যাতে আমি তোমার অত্যধিক শোকর আদায় করতে পারি। আল্লাহ্পাক জানালেন, তুমি যতো বেশী আমার জিকির করবে, ততবেশী হতে পারবে শোকর-গুজার। আরেক হাদিসে আছে, হজরত মুসা বললেন, কীভাবে তোমার মহামর্যাদার অনুকূল কৃতজ্ঞচিত্ততা প্রকাশ করবো? আল্লাহ্ বললেন, তোমার রসনা যেনো আমার জিকিরে সদা সিক্ত থাকে।
৪৫. পরহেজগার লোকদের মধ্যে আল্লাহতায়ালার কাছে তারাই অধিক সম্মানিত, যারা সব সময় জিকিরে মশগুল থাকে। কেননা তাকওয়ার শেষ ফল জান্নাত। আর জিকিরের শেষফল আল্লাহর নৈকট্য।
৪৬. দিলের মধ্যে এক ধরনের এমন কাঠিন্য আছে, যা জিকির ছাড়া অন্য কিছুতে নম্র হয় না।
৪৭. জিকির সকল রোগের চিকিৎসা।
৪৮. আল্লাহ্র সঙ্গে বন্ধুত্বের মূল হলো জিকির। আর তাঁর সাথে শত্রুতার মূল- গাফলত।
৪৯. জিকিরের মতো নেয়ামত আকর্ষণকারী ও আযাব দূরকারী কিছু নেই।
৫০. জিকিরকারীদের সাথে আল্লাহ্র রহমত এবং ফেরেশতাবৃন্দের দোয়া থাকে।
৫১. জিকিরের জলসাসমূহ জান্নাতের বাগান।
৫২. জিকিরের জলসা ফেরেশতাদের জলসা।
৫৩. আল্লাহ্পাক তাঁর জিকিরকারীদের বিষয়ে ফেরেশতাদের সমাবেশে গর্ব প্রকাশ করেন।
৫৪. সর্বদা জিকিরকারী হাসতে হাসতে জান্নাতে প্রবেশ করবে।
৫৫. যাবতীয় আমলের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে জিকিরের জন্যই।
৫৬. সেই আমলই সর্বোত্তম, যার মধ্যে আল্লাহ্র জিকির থাকে। যেমন জিকিরময় নামাজ, জিকিরময় রোজা, জিকিরময় জাকাত, জিকিরময় হজ্ব, জিকিরময় জেহাদ ইত্যাদি।
৫৭. হাদিস শরীফে এসেছে, একবার একদল দরিদ্র সাহাবী রসুলেপাক স. এর মহান সাহচর্যে উপস্থিত হয়ে বললেন, হে আমাদের প্রিয়তম রসুল! বিত্তবানেরা তাদের বিত্তের কারণে হজ্ব, ওমরা, জাকাত ও জেহাদের আমলগুলো করার সুযোগ পায়। এভাবে তারা পুণ্যের দিক দিয়ে হয়ে যায় অধিক অগ্রগামী। রসুলেপাক স. বললেন, আমি তোমাদেরকে একটি সহজ আমলের কথা বলে দেই। তোমরা নামাজের পর 'সুবহানাল্লাহ্' 'আলহামদুলিল্লাহ্' ও 'আল্লাহু আকবর' বেশী করে পড়ো। তাহলে তোমরাও পুণ্যার্জনের ক্ষেত্রে পেছনে পড়ে থাকবে না।
৫৮. জিকির অন্যান্য ইবাদত পালনের সহায়ক। জিকির ইবাদতে আস্বাদ আনয়ন করে। সকল ইবাদতকে সহজ করে দেয়।
৫৯. জিকিরের কারণে সকল কষ্টদায়ক কাজ সহজসাধ্য হয়ে যায়। সকল মুসিবত দূর হয়ে যায়।
৬০. যত জিকির করবে, ততোই মন থেকে ভয়-ভীতি দূর হয়ে যাবে। মনে আসবে শান্তি।
৬১. হজরত ফাতেমা তুয যাহরা রা. আটা পেষা, কুয়া থেকে পানি তোলা- এ সকল কষ্টকর গৃহকর্ম করতেন। তিনি রসুলেপাক স. এর কাছে এসকল কাজের জন্য একজন পরিচারক চেয়েছিলেন। তিনি স. তাঁকে রাতে শয্যাগ্রহণের প্রাক্কালে ৩৩ বার সোবহানাল্লাহ্, ৩৩ বার আলহামদুলিল্লাহ্ এবং ৩৪ বার আল্লাহু আকবর পাঠ করার নির্দেশ দিয়ে বলেছিলেন, এই আমল খাদেম লাভকরার চেয়ে উত্তম।
৬২. পরবর্তী পৃথিবীর কল্যাণের জন্য শ্রম স্বীকারকারী সকলেই দৌড়াচ্ছে। তাদের মধ্যে জিকিরকারীগণ রয়েছেন সকলের সামনে।
৬৩. জিকিরকারীদেরকে আল্লাহ্পাক 'সত্যবাদী' বলেন। আর যাদেরকে আল্লাহ্পাক সত্যবাদী বলেন, মিথ্যাবাদীদের সঙ্গে কখনোই তাদের হাশর হতে পারে না।
৬৪. জিকির দ্বারা জান্নাতে গৃহ নির্মাণ করা হয়। বান্দা যখন জিকির বন্ধ করে দেয়, তখন ফেরেশতাদের নির্মাণকর্মও থাকে বন্ধ। তাদেরকে এর কারণ জিজ্ঞেস করলে তারা বলে, নির্মাণ কাজের খরচ এখনো এসে পৌছেনি। এক হাদিসে এসেছে, যে ব্যক্তি 'সুবহানাল্লাহি ওয়া বিহামদিহি সুবহানাল্লাহিল আজীম' সাতবার পাঠ করে, বেহেশতে তার জন্য একটি সবুজ গম্বুজ তৈরী হয়ে যায়।
৬৫. জিকির দোজখের দিকের প্রাচীর। কোনো খারাপ আমলের কারণে দোজখ নির্ধারিত হলেও জিকির মাঝখানে প্রাচীর হয়ে দাঁড়ায়।
৬৬. ফেরেশতারা জিকিরকারীদের জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করে। হজরত আমর ইবনে আস রা. কর্তৃক বর্ণিত হয়েছে, বান্দা যখন 'সুবহানাল্লাহি ওয়া বিহামদিহি' বলে অথবা বলে 'আলহামদুলিল্লাহি রব্বিল আ'লামীন' তখন ফেরেশতারা বলে, হে আল্লাহ্! এই লোকটিকে মাফ করে দাও।
৬৭. কোনো পাহাড়ে বা প্রান্তরে আল্লাহ্র জিকির করা হলে তারা গর্ববোধ করে। এক পাহাড় অন্য পাহাড়কে ডেকে বলে, আজ তোমার উপর দিয়ে কোনো জিকিরকারী পথ অতিক্রম করেছে কি? পাহাড়টি হ্যাঁ বললে প্রশ্নকারী পাহাড়টি আনন্দিত হয়।
৬৮. অত্যধিক জিকির মুনাফিকি থেকে মুক্তিপ্রদায়ক। আল্লাহ্পাক মুনাফিকদের সম্পর্কে বলেন 'লা ইয়াজকুরূনাল্লাহা ইল্লা কুলীলা' (আল্লাহকে তারা অল্পই স্মারণ করে)। সুরা নিসা, আয়াত ১৪২। হজরত কা'ব আহবার রা. বলেন, যে বেশী বেশী জিকির করে, সে মুনাফিকি থেকে মুক্ত।
৬৯. জিকিরের স্বতন্ত্র স্বাদ আছে, যা অন্য কোনো আমলে নেই। অন্য কোনো ফযীলত যদি নাও থাকতো, তবুও জিকির ওই আস্বাদের কারণে হতো অনন্য।
৭০. পৃথিবী ও পরবর্তী পৃথিবী- উভয় স্থানে জিকিরকারীদের চেহারায় জ্বল জ্বল করে নূর।
৭১. যে ব্যক্তি পথে ঘাটে ঘরে বাইরে দেশে বিদেশে অত্যধিক জিকির করবে, কিয়ামত দিবসে তার পক্ষে সাক্ষ্যদানকারীদের সংখ্যা হবে অনেক বেশী। আল্লাহ্পাক এরশাদ করেন 'ইয়াওমাইজিন তুহাদ্দিছু আখবারাহা' (সেই দিন পৃথিবী তাহার বৃত্তান্ত বর্ণনা করিবে)। সুরা যিলযাল, আয়াত ৪।
রসুলেপাক স. এরশাদ করেন, জমিনের খবরা-খবর তোমরা জান কি? সাহাবীগণ তাঁদের অজ্ঞতা প্রকাশ করলেন। তিনি স. বললেন, কোনো স্থানে কোনো পুরুষ ও রমণী কিছু করলে, ওই স্থানের মাটি সে সম্পর্কে বলবে (ভালো-মন্দ যাই হোক না কেনো)। একারণেই বিভিন্ন স্থানে জিকিরকারীদের সাক্ষ্যদানকারী হবে বেশী।
৭২. জবান যতক্ষণ আল্লাহর জিকিরে রত থাকবে, ততক্ষণ মিথ্যা কথা, গীবত, বাচালতা এসব কিছু করতে পারবে না। দিলের অবস্থাও তদ্রূপ। হয় আল্লাহ্র স্মরণে নিমগ্ন হবে, না হয় মত্ত হবে মাখলুকের জিকিরে।
৭৩. শয়তান মানুষের প্রকাশ্য দুশমন। জিকির ছাড়া অন্য কোনো কৌশল-বুদ্ধি, শক্তি প্রয়োগ করে তাকে কলব থেকে হঠানো যায় না। শয়তান তাড়ানোর একমাত্র অস্ত্র জিকির (কলবী জিকির)।
৭৪. রসুলেপাক স. বলেন, প্রত্যেক জিনিসকে পরিষ্কার করার যন্ত্র রয়েছে, দিলের ময়লা পরিষ্কার করার যন্ত্র হলো আল্লাহ্র জিকির এবং আল্লাহর আজাব থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য জিকির অপেক্ষা অধিক কার্যকরী আর কিছুই নেই। এই হাদিস দ্বারাও জিকিরের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণিত হয়।
কেননা প্রত্যেক ইবাদত প্রকৃত ইবাদতে গণ্য হয় অন্তর পরিষ্কার থাকলে। এই জন্যই সুফীগণ এর অর্থ আন্তরিক জিকির সাব্যস্ত করেছেন, মৌখিক জিকির নয়। অন্তরকে সর্বদা আল্লাহর সাথে সংযুক্ত রাখার নামই হলো আন্তরিক জিকির আর মানুষ যখন এই পর্যায়ে উপনীত হয়, তখন তার আর কোনো ইবাদত বাদ পড়তে পারে না। যেহেতু জাহেরী এবং বাতেনী সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গই অন্তরের অধীন। অন্তর যার সাথে মিলে যায়, সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গই তার সঙ্গে মিশে যায়। প্রেমিকের অবস্থার কথা কে না জানে? হজরত সালমান ফারসী রা. কে কেউ জিজ্ঞেস করেছিলো, সর্বশ্রেষ্ঠ আমল কী? তিনি বলেছিলেন, তুমি কি কোরআন পড়োনি? কোরআনে পরিষ্কার বর্ণিত আছে-
وَلَذِكْرُ اللَّهِ أَكْبَرُ .
(আল্লাহ্র জিকিরই হলো সর্বশ্রেষ্ঠ)। সুরা আনকাবূত, আয়াত ৪৫। সুতরাং জিক্সে এলাহী হতে উত্তম আর কিছুই হতে পারে না। হজরত সালমান ফারসী রা. উপরোল্লেখিত আয়াতের দিকেই ইঙ্গিত করেছেন। 'মাজালেছুল আবরার' গ্রন্থে উল্লেখ আছে, এই হাদিস দ্বারা আল্লাহর জিকিরকে সক্কা, জেহাদ এবং সমস্ত ইবাদত হতে এই জন্য শ্রেষ্ঠ বলা হয়েছে যে, আসল উদ্দেশ্য হলো আল্লাহ্ জিকির, আর বাকী সব ইবাদত হলো জিকির হাসেল করার উপকরণ। আবার জিকিরও দুই প্রকার। প্রথম মৌখিক জিকির, দ্বিতীয় আন্তরিক জিকির- এটাই শ্রেষ্ঠ জিকির। ফিকির ও মোরাকাবা একেই বলা হয়। ওই হাদিসের মর্মও এটাই, যেমন বর্ণিত হয়েছে, 'ফিক্বাতু ছায়া'তান খইরুম মিন ইবাদাতি সিতিনা সানাহ্' (এক ঘণ্টার মোরাকাবা ষাট বছর ইবাদত করার চেয়ে উত্তম)।
'মুসনাদে আহমদ' নামক গ্রন্থে উল্লেখ আছে, আল্লাহ্ জিকির আল্লাহ্ রাস্তায় খরচ করার চেয়ে সাতলক্ষ গুণ বেশী ফযীলত রাখে।