মুতা সৌদী আরব সংলগ্ন জর্দানের দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্ত শহর। নবী করিম (দঃ) ইসলামের দাওয়াতপত্র দিয়ে ৭ম হিজরীতে বুছরা অঞ্চলের গাসসানী শাসকের নিকট হারেছ ইবনে ওমাইর (রাঃ) নামক সাহাবীকে দূত হিসাবে প্রেরণ করেছিলেন। দূত মুতা নামক স্থানে পৌঁছলে শাসক সুরাহবিল ইবনে আমর গাসসানী তাঁকে শহীদ করে ফেলে। এর পূর্বে নবী করিম (দঃ) কর্তৃক প্রেরিত কোন দূত শহীদ হননি।
এই সংবাদে নবী করিম (দঃ) ৮ম হিজরীর জমাদিউল আউয়াল মাসে তাঁর পালিত পুত্র হযরত যায়েদ ইবনে হারেছা (রাঃ)-এর অধীনে তিন হাজার সাহাবীকে গাসসানী শাসক সুরাহ বিল-এর বিরুদ্ধে প্রেরণ করেন। সৈন্যবাহিনী প্রেরণ করার সময়ই নবী করিম (দঃ) তিনজন সেনাপতির শাহাদাতবরণের অগ্রিম ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। তিনি এরশাদ করলেন- "যদি তোমাদের আমীর যায়েদ ইবনে হারেছা শহীদ হন, তাহলে পরবর্তী আমীর হবেন জাফর ইবনে আবু তালেব। তিনিও শহীদ হলে তোমাদের আমীর হবেন আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা। তিনিও শহীদ হলে তোমাদের মধ্য হতে যেকোন একজনকে আমীর 'বানিয়ে নেবে"।
এ বলেই তিনি সৈন্য বাহিনী রওনা করে দিলেন এবং নিজে অনেকদূর অগ্রসর হয়ে তাদেরকে বিদায় দিয়ে বললেন, "প্রথমে মুতাবাসীকে ইসলামের দাওয়াত দিবে। কবুল না করলে যুদ্ধ করবে"।
এই সংবাদ পেয়ে সুরাহবিল, একলক্ষ সৈন্য সংগ্রহ করলো। রোমের বাদশাহ্ হিরাক্লিয়াস একলক্ষ সৈন্য নিয়ে বালকা নামক স্থানে সুরাহবিলের সাহায্যার্থে এগিয়ে আসলো। একদিকে তিন হাজার, অপরদিকে দুই লক্ষ সৈন্যের মধ্যে অসম যুদ্ধ শুরু হলো। হযরত যায়েদ ইবনে হারেছা প্রথমে শহীদ হয়ে গেলেন। নবীজীর ইলমে গায়েব বাস্তবে পরিণত হলো। এরপর সেনাপতির দায়িত্ব নিলেন হযরত জাফর (রাঃ)। প্রথমে তাঁর ডানহাত শহীদ হলো। বামহাতে তিনি পতাকা তুলে ধরলেন। এবার তাঁর বাম হাতও শত্রুর তরবারীর আঘাতে শহীদ
হলো। এবার তিনি পতাকা মুখে কামড় দিয়ে বুকে ধারণ করলেন। শত্রুরা তাঁকে শহীদ করে ফেললো। তাঁর শরীরের সম্মুখভাগেই ৭২টি বর্শা ও তীরের আঘাত লেগেছিল।
যখন তিনি শহীদ হয়ে গেলেন- তখন নবী করিম (দঃ) মদিনা শরীফের মসজিদে নববীতে বসে বসে সব কিছুই দেখতে পেলেন। তিনি হঠাৎ করে গায়েবী সালামের জবাব দিয়ে বললেন, 'ওয়া আলাইকুমুছ ছালাম'। উপস্থিত সাহাবাগণ কারণ জিজ্ঞাসা করলেন। নবী করিম (দঃ) এরশাদ করলেন
إِنِّي أَسْمَعُ مَا لَا تَسْمَعُونَ، وَإِنِّي أَرَى مَا لَا تَرَوْنَ
অর্থাৎ: "তোমরা যাহা শুননা- আমি তাহা শুনি; তোমরা যাহা দেখনা- আমি তাহা দেখি”
(বুখারী)
আমি দেখতে পাচ্ছি- আল্লাহ পাক জাফরকে দু'হাতের বদলে দুটি নূরের বাহু দান করেছেন। তিনি ফেরেস্তাসহ আকাশপথে উড়ে যাচ্ছেন- আর আমাকে এভাবে আখেরী সালাম দিচ্ছেন- "আসসালাতু আসসালামু আলাইকা ইয়া রাসুলাল্লাহ”। তাই আমি তাঁর সালামের জবাব দিচ্ছি”। সুবহানাল্লাহ! নবী প্রেমিকদেরকে আল্লাহ এমনিভাবেই সম্মানিত করে থাকেন। নবীজী জমিনে-কিন্তু তাঁর দৃষ্টি আকাশে।]
যুদ্ধে হযরত জাফর (রাঃ) শহীদ হওয়ার পর হুযুরের পূর্ব নির্দেশ মোতাবেক হযরত আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা (রাঃ) সেনাপতিত্ব গ্রহণ করলেন। বীরবিক্রমে যুদ্ধ করে তিনিও শহীদ হয়ে গেলেন। এবার সাহাবাগণ নবী করিম (দঃ)-এর পূর্ব নির্দেশ মোতাবেক পরামর্শ করে হযরত খালেদ ইবনে ওয়ালিদকে সেনাপতি নিযুক্ত করলেন। হযরত খালেদ বীরবিক্রমে শত্রুর উপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। অসংখ্য শত্রুকে তিনি নিধন করে চললেন। শত্রুরা পলায়ন করলো। অবশেষে আল্লাহ তায়ালা তাঁর হাতে মুসলমানদের বিজয় দান করলেন। বিপুল গণিমতের মাল নিয়ে হযরত খালেদ (রাঃ) মদিনায় প্রর্ত্যাবর্তন করলেন।
[জঙ্গে মৃতার যুদ্ধ পরিস্থিতির আগাম সংবাদ প্রদান করে নবী করিম (দঃ) আল্লাহ্ প্রদত্ত ইল্মে গায়েব প্রমাণ করে দিয়েছেন। তারপর হযরত জাফর (রাঃ) আকাশ পথে নূরের পাখায় ভর করে ফেরেস্তাসহ যাওয়ার পথে নবী করিম (দঃ) কে ছালাম প্রদান করা এবং নবী করিম (দঃ) তাঁকে শূন্যলোকে দেখা- এসবই গায়েবী জিনিস। কোন সাহাবীই এ ঘটনা দেখেননি। কিন্তু নবীজীর কথায় তাঁরা বিশ্বাস করেছেন। নবীজীর ইল্মে গায়েব চাক্ষুস না দেখেও সাহাবীগণ বিশ্বাস করতেন। কিন্তু আলেম নামধারী ভ্রান্ত কিছু লোক আজকাল নবীজীর ইল্মে গায়েবকে অস্বীকার করে চলেছে এবং লেখনির মাধ্যমে মানুষকে গোমরাহ করছে।
বোখারী শরীফের উদ্ধৃত উপরের হাদীসখানায় (মা) শব্দটি দুবার ব্যবহার করা হয়েছে। যার মর্মার্থ দাঁড়ায়-সাহাবাগণের দৃষ্টি ও শ্রবণশক্তির বাইরে যা কিছু আছে- নবী করিম (দঃ) তার সবকিছুই দেখেন ও শুনেন। বস্তুতঃ মানুষের শ্রবণ ও দৃষ্টির অগোচরের সবকিছুই নবী করিম (দঃ)-এর শ্রবণ ও দৃষ্টিসীমার আওতায় রয়েছে। মানুষের পঞ্চ ইন্দ্রিয় ও আকল বহির্ভূত বস্তুকেই গায়েব বলা হয় এবং এ বিষয়ে অবগতির নামই ইল্মে গায়েব। নবীজীর এই ইলমে গায়েব আল্লাহ্ প্রদত্ত।]
জঙ্গে মৃতায় তিনজন শহীদ সিপাহসালারের জানাযা নামায মদিনা শরীফে নবী করিম (দঃ) সঙ্গে সঙ্গে আদায় করেছিলেন এবং ছালাম ফিরিয়ে দোয়াও করেছিলেন। বেদায়া ও নেহায়া গ্রন্থের ৪র্থ খন্ড ২৪৩ পৃষ্ঠায় নবীজীর দোয়ার কথা এভাবে উল্লেখ করা হয়েছে-
فَصَلَّى عَلَيْهِ (زید) رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَقَالَ اسْتَغْفِرُوا لَهُ فَقَدْ دَخَلَ الْجَنَّةَ وَهُوَ شَهِيدٌ ...... فَصَلَّى عَلَيْهِ (جَعْفَرَ ) رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَقَالَ اسْتَغْفِرُوا لا خِيْكُمْ فَإِنَّهُ شَهِيدٌ دَخلَ الْجَنَّةَ وَهُوَ يُطِيرُ فِي الْجَنَّةِ .
অর্থ-"হযরত যায়েদ ইবনে হারেছা (রাঃ) মুতায় শাহাদাত বরণ করার পর নবীজী মদিনা শরীফে তাঁর জানাযা নামায পড়ে সাহাবাগণকে বললেন-তোমাদের ভাই যায়েদ ইবনে হারেছার জন্য দোয়া কর-সে জান্নাতে প্রবেশ করেছে। হযরত জাফর শহীদ হলে হুযুর (দঃ) মদিনা শরীফে তাঁর জানাযা নামায পড়ালেন এবং সাহাবাগণকে বললেন-তোমাদের ভাই জাফরের জন্য দোয়া করো। কেননা, সে শহীদ হয়ে জান্নাতে উড়ে বেড়াচ্ছে”।
(বেদায়া নেছায়া ও ফতহুল কাদীর)
প্রমাণ স্বরূপ দেখুন আমার লিখিত পুস্তক "ফতোয়ায়ে হালাহা"। জানাযা নামাযের পর দোয়া ও মুনাজাত সম্পর্কে হাদীস থেকে ৭টি দলীল তাতে পেশ করা হয়েছে। জানাযা হলো ফরয নামায। ফরয নামাযের পর যে দোয়া করা হয়-তা শীঘ্র কবুল হয়। উক্ত কিতাবে মোনাজাত বিরোধীদের দাঁতভাঙ্গা জবাব দেয়া হয়েছে।
পূর্ববর্তী পেইজ | পরবর্তী পেইজ |
(০৬৭) বিদেশে ইসলামের দাওয়াতঃ ৭ম হিজরী | (০৬৯) মক্কা বিজয় |
সূচীপত্র | এরকম আরো পেইজ |