প্রসঙ্গঃ হিজরতের পর এক বৎসর পর্যন্ত নবী করিম (দঃ) প্রবাস জীবনের প্রাথমিক কাজ সমাধা করেন। মোহাজির সমস্যা, মদিনার উপকণ্ঠে বসবাসকারী তিনটি ইয়াহুদী গোত্র- বনু কাইনুকা, বনু কোরায়যা ও বনু নযির এবং মদিনার আদিবাসী আউছ ও খাজরাজ গোত্রদ্বয়ের সমন্বয়ে শান্তি ও প্রতিরক্ষা চুক্তি স্বাক্ষর, মসজিদে নববী তৈরী, বিবিগণের বাসস্থান নির্মাণ-ইত্যাদি প্রাথমিক গুরুত্বপূর্ণ কাজ এ সময়ে সমাধা করা হয়। কিন্তু নবীগণের জীবন কখনও কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। নবী করিম (দঃ)-এর ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। নবী করিম (দঃ) এরশাদ করেন:
أَشَدُّ النَّاسِ بَلاءُ الْأَنْبِيَاءُ ثُمَّ الْأَوْلِيَاءُ ثُمَّ الْمُؤْمِنُونَ الْبِدَايَةُ
অর্থাৎ- “সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষা হয় নবীগণের, তারপর অলি-আল্লাহগণের, তারপর সাধারণ মোমেনগণের”
(বেদায়া)
কয়েকমাস (১৬/১৭ মাস) যেতে না যেতেই ইয়াহুদীরা মদিনা চুক্তি ভঙ্গ করে গোপনে মক্কার কোরাইশদের সাথে আঁতাত গড়ে তোলে। অপরদিকে মদিনার আদিবাসী আউছ ও খাজরাজ গোত্রের মধ্য হতে একদল মোনাফেকের সৃষ্টি হয়। এরা প্রকাশ্যে মুসলমান হলেও ভিতরে ভিতরে ইয়াহুদী ও কোরাইশদের সাথে যোগ দেয়। এদের সর্দার ছিল আবদুল্লাহ ইবনে ওবাই। সে নবী করিম (দঃ)-এর পিছনে দাঁড়িয়ে নামায পড়তো। কিন্তু মসজিদের বাইরে গেলেই তার মোনাফেকী শুরু হতো। সে মদিনার সম্ভাব্য নেতা হতে যাচ্ছিল। নবী করিম (দঃ)-এর আগমনের ফলে তার সে আশা চূর্ণ হয়ে গেলো। এই মোনাফেকরাই ইসলামের ক্ষতি করেছে বেশী। এদের আহবানেই মক্কার কোরাইশরা বার বার মদিনা আক্রমণ করতে সাহস পেয়েছিল। হিজরতের দ্বিতীয় বর্ষে বদরের যুদ্ধ, তৃতীয় হিজরীতে ওহোদের যুদ্ধ এবং পঞ্চম হিজরীতে খন্দকের যুদ্ধে মুনাফিকদের যোগ সাজশেই মক্কার কোরাইশরা আক্রমণাত্মক ভূমিকা পালন করে। এরপর থেকেই কোরাইশদের দর্প চূর্ণ হয়ে যায়। ৫ম হিজরী পর্যন্ত নবী করিম (দঃ) আত্মরক্ষামূলক জিহাদ পরিচালনা করতেন। ৬ষ্ঠ হিজরী সন থেকে ইতিহাসের গতি ফিরে যায়। নবী করিম (দঃ) খন্দকের যুদ্ধের পর থেকেই আক্রমণাত্মক যুদ্ধ পরিচালনা করতে সক্ষম হন। খায়বার, মুতা, মক্কা বিজয়, হোনায়ন, তায়েফ ও তাবুক-প্রভৃতি যুদ্ধে নবী করিম (দঃ) মদিনার বাইরে গিয়ে যুদ্ধ পরিচালনা করেন। এসব যুদ্ধে কাফেরগণ পর্যুদস্ত হয়ে যায়। গোটা আরব উপদ্বীপে (জযিরাতুল আরব) ইসলামের বিজয় নিশান উড্ডীন হয়। নবী করিম (দঃ) ইসলামকে বিজয়ী শক্তি হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করেন। আল্লাহর প্রতিশ্রুতি অক্ষরে অক্ষরে বাস্তবে পরিণত হয়। মক্কী জিন্দেগীতে ইসলামের বিধি বিধান পূর্ণ বাস্তবায়িত করা সম্ভব ছিলনা। কেননা, সেখানে মুশরিক শাসন ও প্রতিকূল পরিবেশ বিরাজমান ছিল। ইসলামের মূল পাঁচটি ভিত্তির মধ্যে মাত্র ১টি-বুনিয়াদ- অর্থাৎ কলেমা "লাইলাহা ইল্লাল্লাহু মোহাম্মাদুর রাছুলুল্লাহ" মক্কাতে জারি করতে পেরেছিলেন। বাকী ৪টি রোকন-নামায, রোযা হজ্ব, যাকাত-মদিনাতে এসে বাস্তবায়িত করেন। ইসলামের অন্যান্য হুকুম আহকাম এবং বিধি বিধান মদিনাতেই নাযিল হয়। সুতরাং মদিনার জীবন কন্টকাকীর্ণ হলেও ইসলামের পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান প্রতিষ্ঠিত করার সুযোগ এ সময়েই হয়েছিল। সাফল্যের আনন্দ ও ইসলামের পূর্ণ বিধান প্রতিষ্ঠিত করার সুযোগ মদিনাতেই হয়েছিল। এদিক দিয়ে বিবেচনা করলে নবী করিম (দঃ)-এর হিযরতের সুদূর-প্রসারী সাফল্য লক্ষ্য করা যায়। পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে-হিজরত প্রকাশ্যভাবে দেশ ত্যাগ হলেও প্রকৃত পক্ষে ছিল বিশ্ববিজয়ের সোপান এবং সাফল্যের দারোদঘাটন। এবার ক্রমান্বয়ে ঘটনাবলী বর্ণনা করার চেষ্টা করবে।
পূর্ববর্তী পেইজ | পরবর্তী পেইজ |
(০৫৭) মক্কা শরীফ উত্তম-না কি মদিনা শরীফ উত্তম? | (০৫৯) ভ্রাতৃত্ব বন্ধন |
সূচীপত্র | এরকম আরো পেইজ |