রোযা সাধারণত তিন প্রকার:
১. ফরয রোযা, ২. ওয়াজিব রোযা ও ৩. নফল রোযা।
ফরয রোযা দুই প্রকার:
যে সকল নিষিদ্ধ কাজের দণ্ড হিসাবে শরীয়াতে রোযা রাখার বিধান দেওয়া হয়েছে তাকে কাফ্ফারার রোযা বলে। যেমন কসম করে তা ভংগ করা, রামাযানের রোযা রেখে বিনা ওযরে তা ভঙ্গ করা।
যে কোন কারণে রামাযানে রোযা না রেখে পরবর্তী সময়ে ঐ রোযা রাখাকে কাযা রোযা বলে।
যে কোন মানতের রোযা ওয়াজিব রোযা হিসেবে গণ্য। এটা দু'প্রকার:
কেউ যদি রোযা রাখার মানত করে তবে তার জন্য ঐ রোযা রাখা ওয়াজিব হয়ে যায়। যদি ঐ রোযা না রাখে তবে গুনাহগার হবে। কেউ যদি দিন তারিখ নির্দিষ্ট করে মানত করে এবং বলে, হে আল্লাহ! আমার অমুক কাজটি যদি আজ সম্পন্ন হয়ে যায় তবে আগামীকাল আপনার উদ্দেশ্যে একটি রোযা রাখব অথবা এরূপ বলল যে, যদি আমার অমুক কাজটি হয়ে যায় তবে পরশু শুক্রবার দিন আমি একটি রোযা রাখব। ঐকাজ পূর্ণ হলে তার জন্যে ঐ নির্দিষ্ট দিনের রোযা রাখা ওয়াজিব হবে।
জুমু'আর দিন আসার পর রোযা রাখার সময় মানতের নিয়্যত না করে সে যদি শুধু রোযা রাখার নিয়্যত করে অথবা নফল রোযার নিয়্যত করে তবে এতেও মানতের রোযা আদায় হয়ে যাবে। অবশ্য যদি ঐ তারিখে কাযা রোযার নিয়্যত করে এবং মানতের কথা মনে না থাকে অথবা মনে ছিল কিন্তু ইচ্চা করেই কাযার নিয়্যত করেছে তবে কাযা রোযাই আদায় হবে। মানত আদায় হবে না। মানতের রোযা পরে কাযা করতে হবে।
কেউ যদি দিন তারিখ দির্নিষ্ট না করে মানত করে এবং এরূপ বলে যে, আমার অমুক কাজটি যদি হয়ে যায় তবে আল্লাহর ওয়ান্তে আমি একটি রোযা রাখব অথবা শর্তহীনভাবে শুধু একথা বলল যে, আমি আল্লাহর ওয়াস্তে পাঁচটি রোযা রাখব তবে এরূপ মানত করাও দুরস্ত আছে। এভাবে মানত করলে রাত্রেই রোযার নিয়্যত করতে হবে। এ ক্ষেত্রে সুবহে সাদিকের পর মানতের রোযার নিয়্যত করলে অনির্দিষ্ট মানতের রোযা আদায় হবেনা। বরং এ রোযা নফল হয়ে যাবে (মারাকিল ফালাহ্)।
যদি কেউ অর্ধদিন রোযা রাখার মানত করে তবে মানত সহীহ হবে না। যদি কেউ অনির্দিষ্টভাবে একদিন রোযা রাখার মানত করে তবে একদিনের রোযা তার উপর ওয়াজিব হবে। অবশ্য আদায়ের তারিখ নির্ণয় করা তার ইতিয়ারাধীন থাকবে। যে দিন ইচ্ছা সেদিনই তা রাখতে পারবে। যদি কেউ দুই দিন বা তিন দিন অথবা দশ দিন রোযা রাখার মানত করে তবে এ রোযা তার উপর ওয়াজিব হবে। অবশ্য আদায় করার ব্যাপারে সে স্বাধীন, ইচ্ছা করলে পৃথক পৃথকভাবে রাখতে পারবে অথবা একত্রেও রাখতে পারবে। যদি একাধারে রাখার মানত করে তবে একাধারেই রাখতে হবে। পৃথক পৃথকভাবে অথবা মাঝখানে দু'একদিন বাদ দিয়ে রোযা রাখে তাহলে তা আদায় হবেনা। এ ক্ষেত্রে যদি কোন মহিলার হায়িয বা নিফাস আরম্ভ হয়ে যায় তবে তাকে পুনরায় প্রথম থেকে রোযা রাখতে হবে।
কেউ যদি পৃথকভাবে কয়েকদিন রোযা রাখার মানত করে অতঃপর তা একত্রে আদায় করে নেয় তবে মানত আদায় হয়ে যাবে। যদি কেউ বলে, আমি কয়েকদিন রোযা রাখার মানত করলাম তবে কমপক্ষে তিন দিন রোযা রাখতে হবে। আর বহুদিন রোযা রাখার মানত করলে ইমাম আবূ হানীফা (রা.) এর মতে দশ দিন এবং সাহিবাইনের মতে সাতদিন রোযা রাখতে হবে (আলমগীরী, ১ম খণ্ড)।
যদি কেউ এরূপ মানত করে যে আমি বৃহস্পতিবার রোযা রাখব; তাহলে তাকে পরবর্তী বৃহস্পতিবারই সে রোযা রাখতে হবে। কিন্তু যদি প্রত্যেক বৃহস্পতিবারের রোযার মানত করে তবে প্রতি বৃহস্পতিবারই রোযা রাখা ওয়াজিব হবে। বৃহস্পতিবারে ঐ রোযা না রাখলে সে রোযার কাযা ওয়াজিব হবে।
যদি কেউ ঈদের দিন রোযা রাখার মানত করে তবে রোযা তার উপর ওয়াজিব হবে। কিন্তু এ দিনে রোযা রাখা নিষিদ্ধ বিধায় পরবর্তীতে এর কাযা করে নিতে হবে। কেউ যদি এরূপ মানত করে যে, আমি সারা বছর রোযা রাখব তবে দুই ঈদের দিন এবং আইয়ামে তাশরীকের তিন দিন রোযা রাখবেনা। পরবর্তী সময় এ পাচ দিনের কাযা আদায় করে নিবে (আলমগীরী, ১ম খণ্ড)।
ঈদুল ফিত্রের আগে এরূপ মানত করে থাকলে উক্ত হুকুম প্রযোজ্য হবে। যদি শাওয়াল মাসে এভাবে মানত করে তবে ঈদুল ফিতরের কাযা ওয়াজিব হবেনা। এমনিভাবে আইয়ামে তাশরীকের পরে করলে দুই ঈদ এবং আইয়ামে তাশরীকের দিন সমূহের কাযা আবশ্যক হবে না।
আর কেউ যদি পূর্ণ এক বছর রোযা রাখার মানত করে তবে তাকে পূর্ণ এক বছরই রোযা রাখতে হবে এবং রামাযানের ত্রিশ ও দুই ঈদ এবং আইয়ামে তাশরীকের পাঁচদিন মোট পঁয়ত্রিশ দিনের রোযার কাযা করতে হবে। যদি কোন মহিলা নির্দিষ্ট কোন বছরের রোযার মানত করে তবে হায়িযের দিনগুলো ছাড়া বাকী দিনগুলোর রোযা রাখবে। পরে এ দিন গুলোর কাযা আদায় করবে (আলমগীরী, ১ম খণ্ড)।
একদিনের রোযার মানত করতে গিয়ে যদি কারো মুখ দিয়ে এক মাসের কথা বের হয়ে যায়; তবে এক মাস রোযা রাখাই তার উপর ওয়াজিব হবে। কেননা মানতের মধ্যে ইচ্ছা এবং অনিচ্ছা উভয়ই সমান। কেউ যদি অনির্দিষ্টভাবে বলে, আমি এক মাসের রোযা রাখব তবে ত্রিশ দিন রোযা তার উপর ওয়াজিব হবে। যে মাস সে চায় নির্দিষ্ট করতে পারবে। মানতের পর পরই তা আদায় করা ওয়াজিব নয়। তাই বিলম্বে আদায় করলেও গুনাহ হবে না।
একাধারে এক মাস রোযা রাখার মানত করলে তাকে একাধারেই এক মাস রোযা রাখতে হবে। আর যদি একাধারের মানত না করে তবে পৃথক পৃথকভাবে রাখাও জায়িয হবে। কোন মাসকে নির্দিষ্ট করতঃ রোযা রাখার মানত/এ রোযা রাখার সময় যদি এক বা একাধিক দিনের রোযা না রাখে তবে ঐ'দিনসমূহের রোযা কাযা করতে হবে। আর যদি সেই মাসে মোটেই রোযা না রাখে তবে এ রোযার কাযা আদায় করার ব্যাপারে সে স্বাধীন। একাধারে তা রাখতে পারবে এবং ইচ্ছা করলে পৃথকভাবেও রাখতে পারবে (আলমগীরী, ১ম খণ্ড)।
মানতের রোযা যথাসময় না রাখার ফলে তা যদি কাযা হয়ে যায় এবং কাযা আদায়ে বিলম্ব করতে করতে কেউ যদি অতিশয় বৃদ্ধ হয়ে যায় অথবা কেউ যদি সর্বদা রোযা রাখার মানত করে বার্দ্ধক্যের কারণে কিংবা কষ্টসাধ্য পন্থায় জীবিকা উপার্জন লিপ্ত হওয়ার কারণে কাযা আদায়ে অক্ষম হয়ে পড়ে তবে সে রোযা রাখবেনা। বরং এক এক দিনের রোযার পরিবর্তে এক একজন মিস্কীনকে খানা খাওয়াবে। যদি দারিদ্রের কারণে মিস্কীন খাওয়াতে সক্ষম না হয় তবে আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থণা করবে। তিনি অত্যন্ত ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু। যদি প্রচন্ড গরমের কারণে রোযা রাখতে সক্ষম না হয় তবে সে সময় রোযা না রেখে শীতের মৌসূমে এর কাযা আদায় করবে (আলমগীরী, ১ম খণ্ড)।
শর্ত সাপেক্ষে রোযার মানত করতঃ শর্ত পাওয়ার আগে রোযা রাখলে ঐ রোযা যথেষ্ট হবে না। শর্ত পূরণের পরে তা পুনঃ আদায় করতে হবে। নির্দিষ্ট মাসে রোযা রাখার মানত করে ঐ মাস আসার আগেই যদি রোযা রাখা হয়। তবে ইমাম আবু হানীফা এবং ইমাম আবূ ইউসূফ (র.)-এর মতে এ রোযা যথেষ্ট হবে। কিন্তু ইমাম মুহাম্মদ (র.)-এর মতে যথেষ্ট হবে না। কেউ যদি বলে, আমার রোগ ভাল হলে আমি আল্লাহর ওয়াস্তে এত দিন রোযা রাখব। সে ক্ষেত্রে রোগ মুক্তির পর ততদিন রোযা তার উপর ওয়াজিব হবে।
একমাস রোযা রাখার মানত করে মাস অতিবাহিত হওয়ার আগেই কেউ যদি মারা যায় তবে এ বিষয়ে অসিয়্যত করে যাওয়া আবশ্যক। এ অবস্থায় মৃত ব্যক্তির ওলী-ওয়ারিশগণ প্রতিটি রোযার পরিবর্তে এক সা' (সাড়ে তিন সের অথবা ৩ কেজি ৪০০ গ্রাম) গম মিসকীনদের প্রদান করবে।
অসুস্থ ব্যক্তি যদি বলে, আমি আল্লাহর ওয়াস্তে এক মাস রোযা রাখব। এরপর সুস্থ হওয়ার আগে যদি সে মারা যায় তবে তার উপর কোন কিছুই ওয়াজিব হবে ন। যদি এক দিনের জন্যও সুস্থ হয়ে থাকে তবে এক মাস রোযার ফিদয়া আদায়ের অসিয়্যত করে যাওয়া তার জন্য আবশ্যক। কিন্তু ইমাম মুহাম্মদ (র.)-এর মতে যে ক'দিন সুস্থ থাকবে ঐ ক'দিনের অসিয়্যত করে যাওয়া তার জন্য আবশ্যক হবে (আলমগীরী, ১ম খণ্ড)।
ফরযিয়াতের উপর আমল করার সাথে সাথে নফল আমলের অভ্যাস গড়ে তোলা অতি জরুরী। রাসূলুল্লাহ (সা.) নফল নামায এবং নফল রোযার প্রতি বেশ উৎসাহিত করেছেন। এতে বহু ফযীলত রয়েছে। ফরয আদায়ের মধ্যে কোন ত্রুটি থাকলে নফলের দ্বারা তা পূরা করে দেয়া হবে বলে হাদীসে উল্লেখ রয়েছে। সুতরাং ফরয রোযার পাশাপাশি নফল রোযার প্রতি যত্নবান হওয়াও বাঞ্ছনীয়। অবশ্য বছরে পাঁচ দিন রোযা রাখা জায়িয নয়। দুই ঈদের দুই দিন এবং ঈদুল আযহার পর ১১, ১২ এবং ১৩ই যিলহজ্জ মোট এই পাঁচ দিন রোযা রাখা হারাম। এই পাঁচদিন এবং রামাযানের রোযা ছাড়া যে কোন দিন নফল রোযা রাখা জায়িয।
নফল রোযা যতবেশী রাখা যাবে ততবেশী সাওয়াব হবে। 'নফল রোযার কথা' উল্লেখ করে অথবা শুধু রোযার কথা উল্লেখ করে নিয়্যত করলেও নফল রোযা সহীহ্ হবে। 'যাহওয়াতুল কুবরা'র পূর্ব পর্যন্ত নফল রোযার নিয়্যত করা দুরস্ত আছে। সুতরাং এর পূর্ব পর্যন্ত যদি পানাহার এবং স্ত্রী সহবাস না করে থাকে এবং এ সময় রোযা রাখার নিয়্যত করে তবে এ নিয়্যত সহীহ হবে। নফল রোযা আরম্ভ করলে নফল রোযা ওয়াজিব হয়ে যায়। অতএব কেউ যদি নফলের নিয়্যতে রোযা আরম্ভ করে তা ভেঙ্গে ফেলে তবে তার কাযা করতে হবে (কুদূরী)।
স্বামী বাড়ী থাকা অবস্থায় স্ত্রীর জন্য তার অনুমতি ছাড়া নফল রোযা রাখা দুরস্ত নয়। এমনকি স্বামীর অনুমতি ছাড়া নফল রোযা রাখার পর সে যদি তা ভেঙ্গে ফেলার হুকুম করে তবে নফল রোযা ভেঙ্গে ফেলা দুরস্ত আছে। পরে স্বামীর অনুমতি সাপেক্ষে এর কাযা করতে হবে।
মেহমান যদি রোযাদার মেযবানকে নফল রোযা ভঙ্গ করে তার সাথে খানায় শরীক হওয়ার জন্য বলে তবে মেযবানের জন্য রোযা ভঙ্গ করে মেহমানের সাথে খানায় শরীক হওয়া জায়িয আছে। অবশ্য পরে এর কাযা করতে হবে (কাযী খান)।
পূর্ববর্তী পেইজ | পরবর্তী পেইজ |
(০১৫) রোযার সুন্নাত ও আদাব | (০১৭) আশুরার রোযা |
সূচীপত্র | এরকম আরো পেইজ |