মুসলিম জাহানের প্রথম দুই খলীফা রাসূলে পাকের শ্রেষ্ঠতম সাহাবী হযরত আবূ বকর সিদ্দীক ও উমর ফারুক (রা.)-এর খিলাফতকালে মুসলিম উম্মাহ্ ছিল ঐক্যবদ্ধ একটি জাতি। মত পার্থক্য কোথাও থেকে থাকলে তা ছিল নিতান্ত ব্যক্তি পর্যায়ের ও ছোট খাট ব্যাপার। বুনিয়াদী বিষয়ে তাঁদের মধ্যে কোন মতভেদ ছিল না। তৃতীয় খলীফা হযরত উসমান গণী (রা.) এর খিলাফত কালে রাজনৈতিক বিশৃংখলা ও কোন্দলের সূত্রপাত হয়। ক্রমান্বয়ে তা প্রকট আকার ধারণ করে এবং চতুর্থ খলীফা হযরত আলী মুরতাযা (রা.) খিলাফতকালে 'তা হানাহানী ও গৃহযুদ্ধের রূপ নেয়।
এ সময়ে বাতিল পন্থী 'খারেজী' দলের উদ্ভব হয়। পরিণতীতে খিলাফতে রাশিদার পরিসমাপ্তির অষ্যবহিত পরেই মুসলিম উম্মাহর মধ্যে সামাজিক ও রাজনৈতিক বিভক্তির সাথে সাথে ধর্মীয় দল উপদলের সৃষ্টি হয়। প্রকৃত মুসলিম উম্মাহর বিরুদ্ধে 'খারেজী' ও 'শী'আ' মতাবলম্বী দু'টি পৃথক উপদল গড়ে উঠে। খারিজী সম্প্রদায় বর্তমান বিশ্বে তাদের সাংগঠনিক অস্তিত্ব হারিয়ে ফেললেও শী'আ সম্প্রদায় আজো সারা বিশ্বে কম বেশ ছিটিয়ে ছড়িয়ে রয়েছে।
খারেজীরা শুধু কুরআন মজীদ ও প্রধানত দুই খলীফার শাসনামলের প্রমাণিত হাদীস সমূহকে গ্রহণযোগ্য বলে মনে করতো। প্রাথমিক অবস্থায় শী'আ মতবাদের আচরণ খারেজীদের প্রায় কাছাকাছি থাকেলও পরবর্তীতে তারাও চরম পন্থী হয়ে যায়। তারা নতুন নতুন ধ্যান-ধারণা অবলম্বন করে একটি স্বতন্ত্র উপদলে পরিণত হয়। উমাইয়া শাসনের মাঝামাঝি সময়ে হক পন্থী উলাময়ে কিরাম দুই ধারায় বিভক্ত হয়ে পড়েন। একটি ধারায় পরিচিত নাম 'আহলুল-হাদীস'। যাঁরা হাদীসের যাহেরী অর্থ অনুসারে আমল করা যরুরী মনে করেন। কিয়াস এবং তুলনামূলক উপমার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান প্রক্রিয়া তাঁরা অপসন্দ করেন। দ্বিতীয় ধারায় তৎকালীন পরিচিত নাম ছিল 'আহলুর রায়'। যাঁরা কুরআন মজীদ ও হাদীসের আলোকে বুদ্ধিমত্তা ও যুক্তিতর্কের প্রয়োজনীয়তা ও কার্যকারিতায় ছিলেন বিশ্বাসী।
প্রথম ধারার অনুসারীরা উদ্ভব ঘটেনি এমন বিষয়ে চিন্তা গবেষণা দোষণীয় ও বর্জনীয় মনে করেন। পক্ষান্তরে দ্বিতীয় ধারাটি সম্ভাব্য ও সংঘটিতব্য বিষয়ে সিদ্ধান্তে উপনীত হবার উদ্দেশ্যে কুরআন মজীদের ও হাদীস শরীফের সুস্পষ্ট ও মৌলিক বিধানের কারণ, উপকারণ ও যুক্তিধারা (أسباب و علل) নিয়ে আলোচনা পর্যালোচনা, পরীক্ষা নিরীক্ষা ও গবেষণার প্রতি আগ্রহী।
হিজায (মক্কা মুকাররমা ও মদীনা মুনাওওয়ারা) -এর অধিবাসী উলামায়ে কিরামের অধিকাংশই ছিলেন 'আহলুল-হাদীস'। ইরাকের অধিকাংশ উলাময়ে কিরাম ছিলেন 'আহ্লুর রায়'। ইমাম মালিক (র.) (ওফাত: ১৭১ হিজরী) ছিলেন হিজায বাসীদের মধ্যে 'আহলুর রায়' হিসাবে উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব। তাঁর উস্তাদ রাবীআতুর-রায় ছিলেন বিখ্যাত কিয়াসপন্থী। ইরাকী উলামায়ে কিরামের মধ্যে খ্যাতিমান ছিলেন ইমাম ইব্রাহীম নাখঈ (র.) এবং তাঁর শাগরিদ ইমাম হাম্মাদ ইব্ন আবূ সুলায়মান (র.) ছিলেন ইমাম আবূ হানীফা (র.)-এর উস্তাদ।
হিজরী প্রথম শতকের শেষ ভাগে হাদীস বর্ণনার আধিক্যের কারণে জাল হাদীস বর্ণনাকারীদের ফিৎনা তুঙ্গে উঠার ফলে ঘোলাটে পরিস্থিতিতে বিভিন্ন মতাবাদের উদ্ভব ঘটে। এ সময়ে তৎকালীন উমাইয়া খলীফা উমর ইব্ন আবদুল আযীয (র.)-এর হস্তক্ষেপ এবং বিশুদ্ধ হাদীস সংকলনের জন্য তাঁর ফরমান হাদীস সংরক্ষণের কাজকে সঠিক পথে এগিয়ে নিয়ে যায়।
দ্বিতীয় শতকের শুরুতে 'আহলুল-হাদীস' ও 'আহলুর রায়' এর শাখা-প্রশাখা ও ধারা উপধারা বিষয়ে দ্বন্ধের সূত্র ধরে ফিকহ শাস্ত্রেও কতগুলো বিতর্কের উদ্ভব হয়। যেমন:
মোটকথা, দ্বিতীয় শতকের প্রথম চতুর্থাংশ ছিল মূলনীতি ও বিধি বিধান উভয় ক্ষেত্রে আলিম ও ফকীহগণের মতপার্থক্যের সময়। এর সুযোগ নিয়ে ক্ষমতাসীন শাসকগণ নিজেদের মী মুতাবিক মীমাংসা প্রদানে কাযী (বিচারক) গণকে বাধ্য করতেন।
কোন কোন ক্ষেত্রে কাযীগণের পরস্পর বিরোধী ফয়সালার কারণে মুসলিম জনসাধারণ বিভ্রান্তির সম্মুখীন হন। সে সময়ে তাঁদের সামনে সঠিক মাসআলা জানার জন্য কোন সুবিন্যাস্ত সংকলন ছিল না। এদিকে তখন ইসলামের বিজয় অভিযান দিকে দিকে পরিচালিত হতে থাকে। নতুন নতুন দেশ ও জনপদ ইসলামী শাসনের আওতাভুক্ত হয়। ইসলামের এই ব্যাপক প্রসার ও বিভিন্ন সভ্যতা সাংস্কৃতির সংস্পর্শে আসার কারণে নতুন নতুন সমস্যার উদ্ভব হতে থাকে। এবং প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয় এসকল সমস্যার ইসলামী সমাধান সম্বলিত সুস্পষ্ট ও বিধিবদ্ধ আইন-কানুন তথা ফিন্তু ও উসূলে ফিকহ্ প্রণয়নের।
ইমামুল-আয়িম্মা আবু হানীফা নু'মান ইবন সাবিত কৃফী (র.) সর্বাগ্রে এই প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। বণী উমাইয়া যুগের পতনের পরপরই তিনি তাঁর সঙ্গী সাথী ও শাগরিদগণ সমন্বয়ে একটি মজলিস গঠন করেন। এরই মাধ্যমে তিনি ফিকহ সংকলন ও সম্পাদনার গুরু-দায়িত্ব পালনে আত্ম- নিয়োগ করেন। এভাবে তিনি মুসলিম উম্মাহর এক বিরাট খিদমত্ আল্লাম দিতে সক্ষম হন।
ইমাম আবু হানীফা (র.)-এর এ অনবদ্য অবদানের অকুষ্ঠ স্বীকৃতি কিয়ামত পর্যন্ত সকল গুণী জ্ঞানীজনই প্রসংসা ভাষায় প্রকাশ করতে থাকবে। এ জন্যই তিনি সর্বজন স্বীকৃত ইমামে আ'যম-শ্রেষ্ঠ ইমাম। মিল্লাতে ইব্রাহিমী তাঁর কাছে চিরঋণী থাকবে। মানব জীবনের সামগ্রিক দিক তথা আকাইদ, আমাল ও আখলাক ফিকহের অন্তর্ভুক্ত। ইমাম আযম আবূ হানীফা (র.) ফিকহ্-এর পরিচয় দিতে গিয়ে বলেছেন :
"معرفت النفس مالها وما عليها"
ফিকহ হচ্ছে মানব জীবনের সামগ্রিক কল্যাণ অকল্যাণ সম্পর্কিত জ্ঞানের নাম।
পরবর্তী সময়ে আকাইদের বিষয়সমূহ নিয়ে ইলমে কালাম, আল্লাকের বিষয়সমূহ নিয়ে ইলমে তাসাউফ এবং আমালের বিষয়সমূহ নিয়ে ফিকহ্ আলাদা আলাদা শাস্ত্রের উদ্ভব ঘটে।
পূর্ববর্তী পেইজ | পরবর্তী পেইজ |
(০১১) ফিকহ শাস্ত্রের সংজ্ঞা | (০১৩) ফিকহ-এর মূল আলোচ্য বিষয় |
সূচীপত্র | এরকম আরো পেইজ |