হুজুর আকরম (সঃ) এর স্কন্ধদ্বয়ের মধ্যবর্তী স্থানে মহরে নবুওয়াত ছিলো, তিনি নবুওয়াতের ধারা সমাপ্তকারী ছিলেন। মহরে নবুওয়াত ছিলো ইষৎ উঁচু মাংশবিশেষ, যা শরীরের বর্ণের মতোই ছিলো স্বচ্ছ ও নূরানী । উক্ত মাংশপিণ্ডকেই মহরে নবুওয়াত বা খতেমুন নবুওয়াত বলা হয়। [আরবী] ‘খতেম’ শব্দটির তা বর্ণে যের দিয়ে [আরবী] ফায়েল' বা কর্তৃকারক পদ হয়, তার অর্থ হচ্ছে, কোনোকিছুর শেষ প্রান্তে পৌঁছে তার পূর্ণতা সাধনকারী । আর যদি খতেম শব্দটির তা বর্ণে যবর দিয়ে পড়া হয়, তখন অর্থ হবে মহর বা আংটি। সার্বিক ভাবে [আরবী] খাতেমুন্নাবিয়্যীন' এর অর্থ দাঁড়ায়, তাঁর পর আর কোনো নবীর আবির্ভাব হবে না। সর্বশেষ নবী যে তিনি, তার প্রমাণ হচ্ছে মহরে নবুওয়াত। খতেমুন্নাবিয়্যীন হিসাবে তাঁকে আখ্যায়িত করার কারণ এই যে, পূর্ববর্তী বিভিন্ন আসমানী কিতাবে তাঁর পরিচিতি এভাবেই প্রদান করা হয়েছে। সুতরাং মহরে নবুওয়াতখানি একটি নিদর্শন, যা দেখে মানুষ বুঝে নিতে পারে যে, তিনিই ঐ আখেরী যমানার নবী যে সম্পর্কে পূর্বে শুভসংবাদ প্রদান করা হয়েছিলো। মহরে নবুওয়াত আল্লাহ্তায়ালার মহান নিদর্শনাবলীর অন্যতম নিদর্শন যা দ্বারা হুজুর আকরম (সঃ) কে বিশেষিত করা হয়েছে। আল্লামা হাকিম (রঃ) স্বীয় মুস্তাদরেক কিতাবে হজরত ওহাব ইবন মুনাববাহ (রঃ) থেকে বর্ণনা করেছেন, জগতে যতো নবী রসূল আবির্ভূত হয়েছেন সকলেরই ডান হাতে আলামতে নবুওয়াত বিদ্যমান ছিলো। কিন্তু আমাদের নবী (সঃ) এর আলামতে নবুওয়াত তাঁর স্কন্ধদ্বয়ের মধ্যবর্তীস্থানে ছিলো। এ সম্পর্কে জনৈক কবি কতইনা সুন্দর বলেছেন
نبوت را توان نامه در مشت
که از تعظیم دارد مبربر پشت
হজরত শায়খ ইবন হাজার মক্কী (রঃ) শরহে মিশকাতে বলেছেন, নবী করীম (সঃ) এর মহরে নবুওয়াতের মধ্যে লিপিবদ্ধ ছিলো
الله وحده لا شريك له
توجه حيث كنت فانك منصور
অর্থাৎ আল্লাহ্ অদ্বিতীয়, তাঁর কোনো শরীক নেই, আপনি যে ভাবেই থাকুন না কেনো তাওয়াজ্জুহ করুন। আপনি অবশ্যই বিজয়ী। বিভিন্ন বর্ণনায় পাওয়া যায়, মহরে নবুওয়াত নূরানী ছিলো যা ঝকমক করতো। কোনো কোনো বর্ণনায় এসেছে, তাঁর ওফাতের পর উক্ত মহরে নবুওয়াত গুপ্ত হয়ে গিয়েছিলো। এই আলামত থেকেই বুঝা গিয়েছিলো যে, তাঁর ওফাত হয়েছে। যেহেতু নবী করীম (সঃ) এর ওফাতের পর মানুষের মধ্যে এই নিয়ে সন্দেহ এবং মতানৈক্য সৃষ্টি হয়েছিলো যে, আসলেই তাঁর ওফাত হয়েছে কিনা। মহরে নবুওয়াত অদৃশ্য হওয়া ছিলো ওফাতের প্রমাণ । কিন্তু আপাতঃদৃষ্টিতে এ মতটি শুদ্ধ বলে মনে হয় না। কারণ, তাঁর ওফাতের পরেও তো তাঁর নবুওয়াতের বিধান বিদ্যমান ছিলো। ওফাতের মাধ্যমে নবীর নবুওয়াত ও রেসালত সমাপ্ত হয় না। বরং বিদ্যমান থাকে। মহরে নবুওয়াত গায়েব হওয়ার মধ্যে আল্লাহতায়ালার কি খাছ ভেদ নিহিত রয়েছে, তা কেবল আল্লাহ্তায়ালাই জানেন। অধিকাংশ বর্ণনায় এসেছে, দুই কাঁধের মধ্যবর্তী স্থানে মহরে নবুওয়াত ছিলো। আবার কোনো কোনো বর্ণনায় এসেছে মহরে নবুওয়াত ছিলো বাম কাঁধের নরোম মাংশপিণ্ডের কাছে।
আল্লামা তাওরিশী (রঃ) বলেন, দু রকম বর্ণনার মধ্যে মূলতঃ কোনো বৈপরীত্য নেই। কেননা দু' কাঁধের মধ্যে কথাটির অর্থ এই নয় যে ঠিক মধ্যবর্তী স্থানে। বাম কাঁধের দিক হলেও তা দু' কাঁধের মধ্যেই ধরতে হবে। যে বর্ণনায় ডান কাঁধের পাশে আছে বলে উল্লেখ আছে, সেখানেও এরূপ সমাধানই প্রযোজ্য হবে। ওয়াল্লাহু আ'লীম ।
বর্ণনাকারীগণ মহরে নবুওয়াতের আকার আকৃতির বর্ণনাও করেছেন । অপরকে বুঝানোর জন্য এর উপমা উদাহরণও পেশ করেছেন। কেউ কেউ বলেছেন, তা কবুতরের ডিমের ন্যায় সাদা ছিলো। আবার কেউ বলেছেন, রক্তিম মাংশপিণ্ডের ন্যায় ছিলো। সাররাহ কিতাবে [আরবী] ‘গুদ্দাহ্' শব্দের ব্যাখ্যা করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে ‘গুদ্দাহ্' শব্দের বহুবচন হচ্ছে [আরবী] ‘গুদূদ' যার অর্থ হচ্ছে গোশতের শক্ত গ্রন্থি। হুজুর পাক (সঃ) এর মহরে নবুওয়াত ‘গুদ্দাহ' এর ন্যায় ছিলো—এর অর্থ হচ্ছে তাতে লাল বর্ণের প্রাধান্য ছিলো। সুতরাং হুজুর পাক (সঃ) এর নবুওয়াত তাঁর দেহের বর্ণের মতো ছিলো বলে যে বর্ণনা করা হয়েছে এই বক্তব্যটি তার পরিপন্থী নয় । কারণ এরূপ বলার উদ্দেশ্য হচ্ছে, যারা বলে মহরে নবুওয়াতের রং কালো বা নীল ছিলো তাদের বক্তব্যকে খণ্ডন করা। যেমন ইবন হাজার মক্কী স্বীয় পুস্তক শরহে শামায়েলে উল্লেখ করেছেন। অন্য এক বর্ণনায় আছে মহরে নবুওয়াত ছিলো [আরবী] 'যাররেহাজালাহ্' (ঝালরের গুণ্ডি) এর ন্যায় ।
[আরবী] ‘যার’ শব্দের অর্থ হচ্ছে গুন্ডি, আর ‘হাজালাহ্' এর অর্থ ঐ স্থান যেখানে ঝালর দিয়ে সাজিয়ে নববিবাহিতা বধূকে বসানো হয় । ‘হাজালাহ্’ শব্দের বহুবচন হচ্ছে ‘হেজাল’। অধিকাংশ এ রকম বলেছেন। আবার কেউ কেউ ‘হাজালাহ্’ এর অর্থ করেছেন, এক প্রকারের পাখি। আর ‘যার’ এর অর্থ পাখির ডিম। অর্থাৎ তাদের মতে মহরে নবুওয়াত ছিলো 'হাজালা' নামক পাখির ডিমের ন্যায়। যে হাদীছে বলা হয়েছে –মহরে নবুওয়াত ছিলো কবুতরের ডিমের ন্যায়-এই মতটি উক্ত হাদীছের বর্ণনার সঙ্গে সাদৃশ্য রাখে। কিন্তু [আরবী] ‘যার' শব্দের অর্থ অভিধানে ডিম লিখা হয় নাই । কোনো কোনো বর্ণনায় [আরবী] 'রাযাইয়াত' অর্থাৎ প্রথমে র এবং পরে যা বর্ণ। এরকম যদি হয় তবে তার অর্থ হবে ডিম। তিরমিযী শরীফের এক বর্ণনায় এসেছে, মহরে নবুওয়াত ছিলো একখানা মাংশপিণ্ড। আবার অন্য এক বর্ণনায় এসেছে [আরবী] ‘মুশত’ এক মুষ্ঠির ন্যায়। যার মধ্যে [আরবী] ছাআলীল' এর ন্যায় তিলক বিদ্যমান ছিলো। 'ছাআলীল' বলা হয় ঐ সমস্ত গোটাকে যা চানার দানার মরা চামড়ার নীচে সৃষ্টি হয়। এ সমস্ত যা কিছু বর্ণনা করা হয়েছে, সবকিছুই মহরে নবুওয়াতের বাহ্যিক আকৃতি ও ধরন সম্পর্কিত। তবে এর অন্তরালে রয়েছে আল্লাহতায়ালার মহান কুদরতের এক অবর্ণনীয় লীলারহস্য - যা কেবল হুজুর আকরম (সঃ) এর জন্যই নির্ধারিত ছিলো। অন্য কোনো নবীর জন্য এরকম ছিলোনা । ওয়াল্লাহু আ'লীম ।
পূর্ববর্তী পেইজ | পরবর্তী পেইজ |
(০২৪) পিঠ মুবারক | (০২৬) পবিত্র বাহুদ্বয় |
সূচীপত্র | এরকম আরো পেইজ |