হুজুর আকরম (সঃ) এর শ্মশ্রু মুবারক এর চুল সম্পর্কে হজরত ইবন আবী হালা (রাঃ) বর্ণনা করেন; হুজুর আকরম (সঃ) এর দাড়ি মুবারকের চুল খুব অধিক ছিলো। অভিধানে [আরবী] ‘কিছুছুন' শব্দের অর্থ করা হয়েছে ঘন। হালকার বিপরীত। আরবী ভাষায় এরূপ বলা হয় [আরবী] 'রাজুলুন কিছছুল লেহইয়াতে'— লোকটি ঘন দাড়িওয়ালা। কাযী আয়ায (রঃ) তাঁর শিফা নামক কিতাবে উল্লেখ করেছেন, হুজুর (সঃ) এর দাড়ি মুবারক এতো ঘন ছিলো যে, তাঁর পবিত্র বক্ষ আচ্ছাদিত হয়ে যেতো। দাড়ির দৈর্ঘ সম্পর্কে নির্দিষ্ট পরিমাপ কোনো কিতাবে পাওয়া যায় না। অবশ্য ওয়াযায়েবুন্নবী নামক কিতাবে উল্লেখ রয়েছে, হুজুর (সঃ) এর পবিত্র দাড়ি স্বাভাবিকভাবে চার আঙ্গুল ছিলো- তার কম নয় । তবে এ বর্ণনার স্বপক্ষে কোনো সনদ পাওয়া যায় না। তবে এটা ঠিক যে, দীর্ঘ দাড়ি সৌন্দর্যের প্রতীক। বিশেষ করে দাড়ি যখন ঘন হয় ।
ওয়াযায়েবুন্নবী এর উদ্ধৃতি শিফা কিতাবের উদ্ধৃতির খেলাফ বলে মনে হয়। আবার তিরমিযী শরীফের বর্ণনারও পরিপন্থী দেখা যায়। তিরমিযী শরীফে এসেছে, ‘হুজুর আকরম (সঃ) দাড়ি মুবারকের চুল মুঠি দিয়ে ধরতেন এবং গোঁফ কর্তন করতেন এবং বলতেন, যে ব্যক্তি মোছ কর্তন করে না, সে আমাদের দলভুক্ত নয়।’
বুখারী ও মুসলিম শরীফে এমর্মে উক্ত হয়েছে যে, তোমরা মুশরিকদের আকৃতির বিপরীত করো। অন্য এক বর্ণনায় আছে, মজুসী অর্থাৎ অগ্নিপূজকদের বিরুদ্ধাচরণ করো এবং খুব বেশী বিরুদ্ধাচরণ করো । দাড়িকে লম্বা করো আর মোছ খাট করো এবং এই কর্তন অতিরিক্ত করো । গোঁফ কর্তন করার ব্যাপারে ইমামগণের মাযহাব ভিন্ন ভিন্ন। তবে কর্তনের ব্যাপারে কমপক্ষে এতটুকু করতে হবে যেন ঠোঁটের কিনারা দেখা যায় । কারও মতে মোছ সম্পূর্ণ কামিয়ে ফেলা বেদাত। আবার কারও মতে সুন্নত । তবে, অহনাফের নিকট এহফা করা অর্থাৎ মূল থেকে তুলে ফেলা সুন্নত। তবে হাদীছ শরীফে এসেছে, হুজুর পাক (সঃ) স্বীয় গোঁফ মুবারককে মেসওয়াক দিয়ে উঠিয়ে ধরতেন, এটাতো বাহ্যত উপরোক্ত মতের পরিপন্থী। এটা সম্ভবতঃ বিশেষ সময়ের জন্য প্রযোজ্য হবে। নতুবা অধিকাংশ সময় তিনি এইফাই করে থাকতেন। আমাদের যুগের হানাফী আলেমগণের মত হচ্ছে, চোখের ভ্রু পরিমাণ রেখে দেয়া। তবে মুজাহিদ- গণের বেলায় এর বিধান স্বতন্ত্র। তাঁদের জন্য মোস্তাহাব হচ্ছে মোছকে (দু'পার্শে) লম্বা করে রাখা যা দেখে দুশমনদের মনে ভীতির সঞ্চার হয় । তবে মোছকে লম্বা করতে যেয়ে এতটুকু করা যাবে না যে, ঠোঁটের প্রান্ত আচ্ছাদিত হয়ে যায়। এরূপ বর্ণনা করা হয়েছে মাতালেবুল মু'মিনীন কিতাবে। মোছের দু'পাশের চুলকে লম্বা করে রাখাতে কোনো দোষ নেই । উলামায়ে কেরাম বলেন, আমীরুল মুমিনীন হজরত ওমর ফারুক (রাঃ) ও তৎসহ আরও বড় বড় সাহাবায়ে কেরাম মোছের দু'পাশের চুলকে লম্বা করে রাখতেন। আর এরূপ লম্বা করার কারণে মোছ দিয়ে মুখ ঢেকে যেতোনা এবং আহারের সময় আহার্য বস্তুও স্পর্শ হতো না। নীচের ঠোঁট সংলগ্ন যে দাড়ি, যাকে [আরবী] 'আনফাকা' বলা হয় তা রাখা বা কামিয়ে ফেলা সম্পর্কেও মতানৈক্য রয়েছে। এক্ষেত্রে উত্তম নীতি হচ্ছে তাকে রেখে দেয়া। তবে ‘আনফাকা’ এর দু পাশে কামানোতে কোনো দোষ নেই। দাড়ি লম্বা রাখার পরিসীমা সম্পর্কেও এতানৈক্য রয়েছে। হানাফী মযহাব অনুসারে চার আঙ্গুল লম্বা রাখতে হবে। তবে তার অর্থ হচ্ছে, এর চেয়ে কম যেনো না হয় (এর চেয়ে বড় হলে ক্ষতি নেই)। কিন্তু অন্য এক বর্ণনা অনুসারে চার আঙ্গুলের অধিক হলে তা কর্তন করা ওয়াজিব। উলামায়ে কেরাম বলেন যে, উলামা ও মাশায়েখগণ যদি এর চেয়ে বেশী লম্বা রাখেন, রাখতে পারেন। দুরস্ত হবে। এই পরিমাপের অধিক দাড়ি লম্বা রাখা বা কর্তন করা সম্পর্কে নিম্নোক্ত দুখানি হাদীছ দলীল স্বরূপ উল্লেখযোগ্য যা বুখারী শরীফের কিতাবুলেবাসের শেষের দিকে উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন—সাইয়েদুনা হজরত ইবন ওমর (রাঃ) তাঁর দাড়িকে মুষ্টি দিয়ে ধরতেন এবং মুষ্টির বাইরের অতিরিক্ত অংশ কেটে ফেলতেন।
হজরত ইবন ওমর (রাঃ) যখন হজ বা ওমরা করতেন, তখন তাঁর দাড়িকে মুষ্টিবদ্ধ করতেন এবং তার অতিরিক্ত যে চুল থাকতো তা কর্তন করে ফেলতেন। আবার হজরত নাফে (রাঃ) হজরত ইবন ওমর (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেন, মোছকে অতিমাত্রায় কর্তন করো এবং দাড়িকে স্বাভাবিক অবস্থায় ছেড়ে দাও। তাতে হস্তক্ষেপ করো না। এখন প্রশ্ন জাগে যে, দাড়িকে যখন স্বাভাবিক অবস্থায় ছেড়ে দেয়ার কথা বলা হয়েছে, তাহলে হজরত ইবন ওমর (রাঃ) মুষ্টির অতিরিক্তটুক কর্তন করতেন কেনো। অথচ তিনিই উক্ত হাদীছের বর্ণনাকারী । হাদীছ ব্যাখ্যাকারগণ তার জবাব দেন এ ভাবে—হজরত ইবন ওমর (রাঃ) যে দাড়ি কর্তন করতেন তা হজ ও ওমরার সময়ের জন্য খাছ ছিলো । অন্য সময় দাড়ি লম্বা রাখতেন। এ ব্যাপারে অনারবদের ন্যায় (দাড়ি কর্তন করা) আমল করতে নিষেধ করা হয়েছে। এ ব্যাপারে সালফে সালেহীনগণের বিভিন্ন আমল ছিলো । বৰ্ণনা করা হয় যে, হজরত আলী (রাঃ) এর বুক ভরা দাড়ি ছিলো। সাইয়্যেদুনা হজরত ওমর ফারুক (রাঃ) ও হজরত উছমান (রাঃ) সম্পর্কে এরকমই বর্ণিত আছে। হজরত সাইয়্যেদুনা গাউছুল আজম মুহীউদ্দীন শায়খ আব্দুল কাদের জীলানী (রঃ) এর দাড়িও দীর্ঘ এবং চওড়া ছিলো ।
পূর্ববর্তী পেইজ | পরবর্তী পেইজ |
(০১৪) পবিত্র কেশরাজি | (০১৬) আনা শরীফ |
সূচীপত্র | এরকম আরো পেইজ |