‘আবদ’ এর অর্থ হচ্ছে আবেদ-ইবাদতকারী। তাহলে আবদুন নবীর অর্থ হবে নবীর ইবাদতকারী এবং এ ধরনের অর্থবোধক নাম সুস্পষ্ট শিরক। সুতরাং এ ধরনের নামকরণ নিষেধ।
আবদের অর্থ আবিদ (ইবাদতকারী) ও হতে পারে, আবার খাদিমও হতে পারে। যখন আবদ শব্দটা আল্লাহর দিকে ইঙ্গিত করা হবে, তখন এর অর্থ হবে আবিদ ইবাদতকারী আর যখন গায়রুল্লাহর ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয়, তখন এর অর্থ হবে খাদিম, গোলাম ইত্যাদি। সুতরাং আবদুন নবীর অর্থ হলো নবীর গোলাম।
ফাতওয়ায়ে আলমগীরীর কিতাবুল কারাহিয়াতে تَسْمِيَة الْأَوْلَاد وكناهم وَالْعَقِيقَة শীর্ষক অধ্যায়ে বর্ণিত আছে-
وَالتَّسْمِيَةِ بَاسِمٍ يُوجَدُ فِي كِتَابِ اللَّهِ تَعَالَى كَالْعَلِيِّ وَالْكَبِيرِ وَالرَّشِيدِ وَالْبَدِيعِ جَائِزَةٌ لِأَنَّهُ مِنْ الْأَسْمَاءِ الْمُشْتَرَكَةِ وَيُرَادُ فِي حَقِّ الْعِبَادِ غَيْرُ مَا يُرَادُ فِي حَقِّ اللَّهِ تَعَالَى كَذَا فِي السِّرَاجِيَّةِ.
অর্থাৎ যে নাম কুরআন শরীফে পাওয়া যায়, সে নামে নামকরণ জায়েয। যেমন আলী, রশীদ, বদি। কেননা ওগুলো সংযুক্ত নামসমূহের অর্ন্তভূক্ত এবং বান্দার জন্য এগুলোর সেই অর্থই বোঝানো হবে, যা আল্লাহর জন্য বোঝানো হবে না।’’
¶ মোল্লা নিযামুদ্দীন বলখী, ফাতাওয়ায়ে আলমগীরী, কিতাবুুল কারাহিয়্যাত, খণ্ড-৫, পৃষ্ঠা-৩৬২।
এর থেকে বোঝা গেল যে, আল্লাহর নামও আলী আবার হযরত আলী (رضي الله عنه) এর নামও আলী। অনুরূপ খোদার নামও রশীদ, বদি ইত্যাদি। আবার বান্দার জন্যও এ নাম হতে পারে। তবে আল্লাহর জন্য এসব শব্দের অর্থ এক রকম, আর বান্দার বেলায় অন্য রকম। তদ্রুপ ‘আবদুল্লাহ’ এর অর্থ আল্লাহর আবিদ ইবাদতকারী আর আবদুন নবীর অর্থ নবীর গোলাম। যদি এ ধরনের প্রতি বিধান করা না যায়, তাহলে কুরআনের আয়াত مِنْ عِبَادِكُمْ এর কি অর্থ করা যেতে পারে?
মিশকাত শরীফের الادب الاسامى অধ্যায়ে এবং মুসলিম শরীফের দ্বিতীয় খণ্ড كتاب الالفاظ من الادب বর্ণিত আছে-
لَا يَقُولَنَّ أَحَدُكُمْ عَبْدِي وَأَمَتِي كُلُّكُمْ عَبِيدُ اللهِ، وَكُلُّ نِسَائِكُمْ إِمَاءُ اللهِ، وَلَكِنْ لِيَقُلْ غُلَامِي وَجَارِيَتِي
তোমাদের মধ্যে কেউ عَبْدِي (আমার বান্দা) বলিও না। তোমরা সবাই আল্লাহর বান্দা এবং তোমাদের সমস্ত মহিলা আল্লাহর বাদী। কিন্তু ‘আমার গোলাম’ ও ‘আমার চাকরাণী’ বলতে পারেন।’’
¶ ইমাম নাসাঈ, আস-সুনানুল কোবরা, হা/৯৯৯৯, ইমাম মুসলিম, আস-সহীহ, খণ্ড-৪, পৃষ্ঠা-১৭৬৪, হাদিস/২২৪৯
এর থেকে প্রতীয়মান হলো যে, ‘আবদ’ শব্দটি গায়রুল্লাহর প্রতি ইঙ্গিত করা হাদীছের বিপরীত, তাই হারাম। ‘আবদুন নবী’ নামেও এ ইঙ্গিতটা রয়েছে, তাই নিষেধ।
এ নিষেধাজ্ঞাটা হচ্ছে মাকরূহ তনযিহি পর্যায়ের, অর্থাৎ আমার বান্দা বলা ঠিক নয়, বরং আমার গোলাম বলাই শ্রেয়। উক্ত হাদীছের প্রেক্ষাপটে নববী শরহে মুসলিমে বর্ণিত আছে-
فَإِنْ قِيلَ فَقَدْ قَالَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِي أَشْرَاطِ السَّاعَةِ أَنْ تَلِدَ الْأَمَةُ رَبَّتَهَا أَوْ رَبَّهَا فَالْجَوَابُ مِنْ وَجْهَيْنِ أَحَدُهُمَا أَنَّ الْحَدِيثَ الثَّانِي لِبَيَانِ الْجَوَازِ وَأَنَّ النَّهْيَ في الأول للأدب وكراهة التنزيه لا للتحريم
-যদি বলা হয় যে, হুযুর (ﷺ) আলামতে কিয়ামত প্রসঙ্গে বলেছেন-বাঁদী নিজের প্রভুকে জন্ম দিবে। (অর্থাৎ বান্দাকে প্রভু বলেছেন) এর দু’রকম উত্তর রয়েছে-
এক. দ্বিতীয় হাদীছটি বৈধতা প্রকাশার্থে এবং প্রথম হাদীছের নিষেধাজ্ঞাটা হচ্ছে সম্মানসূচক এবং মাকরূহ তানযিহি, তাহরীমা নয়।’’
¶ ইমাম নববী, শরহে সহীহ মুসলিম, খণ্ড-১৫, পৃষ্ঠা-৬।
সেই একই জায়গায় মুসলিম শরীফে আছে-
وَلَا يَقُولَنَّ أَحَدُكُمْ لِلْعِنَبِ الْكَرْمَ، فَإِنَّ الْكَرْمَ الرَّجُلُ الْمُسْلِمُ
একই জায়গায় এটাও উল্লেখিত আছে -
لَا تُسَمُّوا الْعِنَبَ الْكَرْمَ، فَإِنَّ الْكَرْمَ الرَّجُلُ الْمُسْلِمُ
অর্থাৎ আঙ্গুরকে করম বল না, কেননা করমতো মুসলমান।’’
¶ ইমাম মুুসলিম, আস-সহীহ, খণ্ড-৪, পৃষ্ঠা-১৭৬৩, হা/২২৪৭।
মিশকাত শরীফের কিতাবুল আদব শীর্ষক অধ্যায়ে বর্ণিত আছে-
إِنَّ اللَّهَ هُوَ الْحَكَمُ وَإِلَيْهِ الْحُكْمُ، فَلِمَ تُكَنَّى أَبَا الْحَكَمِ
-আল্লাহ তো হুকুম এবং হুকুমের মালিক তিনি।’’
¶ সুনানে নাসাঈ, ৮/২২৬ পৃ: হা/৮৩৮৭, ইমাম নাসাঈ, আস-সুনানিল কোবরা, ৫/৪০৩ পৃ: হা/৫৯০৭, ইমাম আবু দাউদ, আস-সুনান, ৪/২৮৯ পৃ: হা/৪৯৫৫
তাহলে তোমার নাম আবুল হুকুম কেন?
মিশকাত শরীফের সেই জায়গায় আরও আছে -
عَنْ سَمُرَةَ بْنِ جُنْدُبٍ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: لَا تُسَمِّيَنَّ غُلَامَكَ يَسَارًا، وَلَا رَبَاحًا، وَلَا نَجِيحًا، وَلَا أَفْلَحَ
-‘‘নিজের গোলামের নাম এসার (প্রাচুর্য) রাবা (উপকার) নজিহ (ধৈর্যশীল) এবং আফলাহ (সাফল্য) রেখো না।’’
¶ খতিব তিবরিযি, মিশকাত, কিতাবুুল আদাব, ৪০৭, সহীহ মুসলিম, ৩/১৬৮৫ পৃ: হা/২১৩৭, ইমাম আবু দাউদ, আস-সুনান, ৪/২৯০ পৃ: হাদিস/৪৯৫৮
উপরোক্ত সমস্ত হাদীছে ওই সব নামের প্রতি যে নিষেধাজ্ঞা জ্ঞাপন করা হয়েছে, তা মাকরূহ তানযিহি হিসেবে বর্ণিত হয়েছে। তা না হলে কুরআন হাদীছের মধ্যে বিশেষ করে হাদীছের সমূহের মধ্যে ভীষণ দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হবে। দেখুন, রব খোদার নাম কিন্তু কুরআন করীমে বান্দাদেরকেও রব বলা হয়েছে। যেমন -
﴿كَمَا رَبَّيَانِي صَغِيرًا﴾ ارْجِعْ إِلَى رَبِّكَ
যদি কোন ব্যক্তি কাউকে নিজের মুরুব্বী বা রব বলে, তাহলে মুশরিক হবে না। তবে এর থেকে বিরত থাকতে পারলে ভাল।
¶ সূূূরা বানি ইসরাঈল, আয়াত নং-২৪, সূরা ইউসূফ, আয়াত নং-৫০।
কারণ এ ধরনের নামকরণ আবশ্যক নয়। অবশ্য বর্তমান যুগের দেওবন্দীদেরকে চেতানোর জন্য যদি এ রকম নাম রাখা হয়, তাহলে ছওয়াবের ভাগী হবে, যেমন হিন্দুস্থানে গাভীর কুরবানী। আমি এর বিশ্লেষণে ফাতিহা শীর্ষক আলোচনায় বলেছি যে, যেই মুস্তাহাব কাজে দ্বীনের শত্রুরা বাধা দিতে চেষ্টা করে ওটা নিশ্চয়ই করা চাই।
পূর্ববর্তী পেইজ | পরবর্তী পেইজ |
(০৩৬) আবদুন নবী, আবদুর রাসুল নামকরণ প্রসঙ্গে আলোচনা | (০৩৮) ইসকাত (নামায রোজার কাফফারা) এর আলোচনা |
সূচীপত্র | এরকম আরো পেইজ |