নিয়মিতভাবে গেয়ারবী শরীফ ও মীলাদ শরীফ পালনকারীদের মধ্যে কেউ কেউ এ উদ্দেশ্যে কিছু দিন আগে থেকেই ছাগল, মোরগ ইত্যাদি পালন করে এবং এগুলোকে হৃষ্টপুষ্ট করে। ফাতিহার তারিখে এ গুলোকে আল্লাহর নামে যবেহ করে খাবার তৈরী করে ফাতিহা দেয়া হয় এবং গরীব ও নেকবান্দাদেরকে খাওয়ানো হয়। যেহেতু পশুটা সেই উদ্দেশ্যে পালন করা হয়েছে, সেহেতু গেয়ারবী শরীফের ছাগল, গাউছে পাকের গরু ইত্যাদি বলে দেয়া হয়। শরীয়ত মতে এটা হালাল যেমন ওলীমার পশু। কিন্তু ভিন্ন মতাবলম্বীগণ এ কাজকে হারাম, মাংসকে মৃতপশুর মাংসতুল্য এবং এ কাজ যিনি করেন, তাঁকে ধর্মদ্রোহী ও মুশরিক বলে। তাই এ আলোচনাকেও দু’টি অধ্যায়ে বিভক্ত করা হয়েছে। প্রথম অধ্যায়ে এর বৈধতার প্রমাণ এবং দ্বিতীয় অধ্যায়ে এ প্রসঙ্গে উত্থাপিত আপত্তিসমূহের দাঁতভাঙ্গা জবাব দেয়া হয়েছে।
মুসলমান বা আহলে কিতাব যে হালাল পশু আল্লাহর নামে যবেহ করে, তা হালাল এবং মুশরিক বা মুরতাদ যে হালাল পশু যবেহ করে, তা মৃততুল্য অর্থাৎ হারাম। অনুরূপ যদি কোন মুসলমান ইচ্ছা করে বিসমিল্লাহ না বলে খোদা ভিন্ন অন্য কারো নাম নিয়ে যবেহ করে, (যেমন বিসমিল্লাহ আল্লাহু আকবর বলার পরিবর্তে এয়া গাউছ বলে যবেহ করে) তাহলে হারাম হবে। লক্ষ্যণীয় যে এ হালাল হারামটা সাব্যস্ত হচ্ছে যবেহকারী অনুসারে, মালিক অনুসারে নয়। যদি কোন মুসলমানের পশু কোন মুশরিক যবেহ করে দিল, তাহলে মৃত সদৃশ বা নাপাক হয়ে গেল। আর যদি কোন মুশরিক দেবতার নামে কোন পশু পালন করলো কিন্তু কোন মুসলিম একে ‘বিসমিল্লাহ আল্লাহু আকবর’ বলে যবেহ করে দিল, তাহলে সেই পশুর মাংস হালাল হবে। এখানেও যবেহ করার সময় নাম নেওয়াটাই বিবেচ্য; আগে পিছের কথা ধর্তব্য নয়। পশু দেবতার নামে পালন করা হয়েছিল কিন্তু যবেহ করা হয়েছে খোদার নামে, হালাল হবে। আর পশুটা কুরবানীর জন্য রাখা হয়েছিল কিন্তু যবেহ করার সময় অন্য নাম নেওয়া হলো, সেটা মৃত সদৃশ অর্থাৎ হারাম হবে। কুরআন করীম তাই ইরশাদ করেছেন-
وَمَا أُهِلَّ بِهِ لِغَيْرِ اللَّهِ
-‘‘সে পশু হারাম, যেটাকে খোদা ভিন্ন অন্য নামে ডাকা হয়।’’
¶ সূরা বাক্বারা, আয়াত নং-১৭৩।
এখানে ডাকা শব্দের দ্বারা যবেহ করার সময় ডাকাকে বোঝানো হয়েছে। যেমন তফসীরে বয়যবীতে এ আয়াতের প্রেক্ষাপটে উল্লেখিত আছে-
أي رفع الصوت لغير الله به كقولهم: باسم اللات والعزى عند ذبحه.
-‘‘ওই পশুর বেলায় গায়রুল্লাহর নাম দেয়া হয়েছে, যেমন কাফিরগণ যবেহ করার সময় লাত ও উযযার (দেবতা) নাম নিত।’’
¶ ইমাম কাযি নাসিরুদ্দীন বায়যাভী, তাফসিরে বায়যাভী, ২/১১৪ পৃ:, সূরা বাক্বারা, আয়াত নং-১৭৩ এর ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে।
তাফসীরে জালালাইনে এ আয়াত প্রসঙ্গে বর্ণিত আছে-
بِأَنْ ذُبِحَ عَلَى اسْم غَيْره
-‘‘এ রকমই, যেমন খোদা ভিন্ন অন্য নামে যবেহ করা হয়।’’
¶ ইমাম সুয়ূতি, তাফসিরে জালালাইন, ১/১৩৬ পৃ:
এ আয়াতের ব্যাখ্যায় তফসীরে খাযেনে বর্ণিত আছে-
وَما أُهِلَّ لِغَيْرِ اللَّهِ بِهِ يعني ما ذكر على ذبحه غير اسم الله وذلك أن العرب في الجاهلية كانوا يذكرون أسماء أصنامهم عند الذبح فحرم الله بهذه الآية وبقوله: ولا تأكلوا مما لا يذكر اسم الله عليه
-অর্থাৎ সে পশু হারাম, যেটার যবেহের সময় খোদা ভিন্ন অন্য কারো নাম নেয়া হয়েছে এবং এটা এ জন্য যে আইয়ামে জাহিলিয়াতের আরববাসীরা যবেহ করার সময় মূর্তিদের নাম নিত। তাই আল্লাহ তা’আলা ওটাকে এ আয়াত ও ولا تأكلوا আয়াত দ্বারা হারাম বলেছেন।
¶ ইমাম খাযেন, তাফসিরে খাযেন, ২/৭ পৃ:
তাফসীরে কবীরে এ আয়াতের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে-
وَكَانُوا يَقُولُونَ عِنْدَ الذَّبْحِ: بِاسْمِ اللَّاتِ وَالْعُزَّى فَحَرَّمَ اللَّه تَعَالَى ذَلِكَ
আরবের অধিবাসীগণ যবেহ করার সময় বলতো- বিসমে লাত ওয়াল উযযা (লাত উযযার নামে)। সুতরাং আল্লাহ তা’আলা ওটাকে হারাম বলেছেন
¶ ইমাম ফখরুদ্দীন রাজী, তাফসিরে কাবীর, খণ্ড-১১, পৃষ্ঠা-২৮৩।
তাফসীরাতে আহমদীয়ায় এ আয়াতের ব্যাখ্যায় উল্লেখিত আছে-
معناه ما ذبح به لاسم غير الله مثل اللات والعزى واسماء الانبياء
-এ আয়াতের অর্থ হচ্ছে ওটাকে খোদা ভিন্ন অন্য কারো নামে যবেহ করা হয়েছে। অর্থাৎ সেগুলোকে দেবতার নামে যবেহ করা হত।
¶ আল্লামা মোল্লা জিওন, তাফসিরে আহমদিয়া,
এ আয়াতের প্রেক্ষাপটে তফসীরে মাদারেকে বলা হয়েছে-
أي ذبح للأصنام فذكر عليه غير اسم الله ...... أي رفع به الصوت للصنم وذلك قول أهل الجاهلية باسم اللات والعزى
অর্থাৎ দেবতাদের জন্য যে পশু যবেহ করা হয়, সেটা হারাম। সুতরাং ওটার উপর গায়রুল্লাহর নাম নেয়া মানে দেবতাকে ডাকা হয়েছে। এটা ছিল জাহেলিয়াত যুগের লোকদের কথা- ‘বিসমে লাতে ওয়াল উযযা।’
¶ ইমাম নাসাফী, তাফসিরে মাদারেক, খণ্ড-১, পৃষ্ঠা-১৫১।
তাফসীরে লবাবুত তাবিলে এ আয়াতের তফসীর প্রসঙ্গে বলা হয়েছে-
يعني وما ذبح للأصنام والطواغيت وأصل الإهلال رفع الصوت وذلك أنهم كانوا يرفعون أصواتهم بذكر آلهتهم إذا ذبحوا لها
-অর্থাৎ যা দেবতা ও উপাস্যদের জন্য যবেহ করা হয়েছে এবং ডাকার মূল হচ্ছে আওয়াজ করা। ওরা (জাহেলিয়াত যুগের লোকেরা) যবেহ করার সময় তাদের দেবতাদের নাম উল্লেখ করে ডাক দিত।
¶ ইমাম খাযেন, তাফসিরে খাযেন, ১/১০৩ পৃ:
তফসীরে হুসাইনিতে এ আয়াতের বিশ্লেষণে বর্ণিত আছে-
وآنچه آو از برآورده شود بغير الله از برائے غير خدا براں در وقت ذبح آں يعنى بنام بتاں بكشند
যবেহ করার সময় গায়রুল্লাহ নাম ডাকা হয়েছিল অর্থাৎ দেবতাদের নামে ডাক দেয়া হয়েছিল।
উপরোক্ত তফসীর সমূহের ইবারত থেকে বোঝা গেল যে, উক্ত আয়াতে وَما أُهِلَّ (মা উহিল্লা) দ্বারা যবেহ করার সময় খোদা ভিন্ন অন্য কাউকে ডাকা বোঝানো হয়েছে। সুতরাং পশুর জীবিতাবস্থায় কারো প্রতি উৎসর্গ করাটা এখানে ধর্তব্য নয়। এবার ফকীহগণের উক্তিসমূহ পেশ করছি।
তফসীরাতে আহমদীয়ায় আয়াত وَما أُهِلَّ بِهِ لِغَيْرِ اللَّهِ এর প্রেক্ষাপটে উল্লেখিত আছে-
ومن ههنا علم ان البقرة المنذورة للاولياء كما هو الرسم فى زماننا حلال طيب لانه لم يذكر اسم غير الله وقت الذبح وان كانوا ينذرونها
-‘‘এ থেকে বোঝা গেল- যে গাভী আল্লাহর ওলীদের নামে মানত করা হয়েছে যেমন আমাদের যুগে প্রচলিত আছে, তা হালাল, পবিত্র। কেননা এটা যবেহ করার সময় গায়রুল্লাহর নাম নেয়া হয়নি যদিওবা এটা মানতকৃত।
¶ আল্লামা মোল্লা জিওন, তাফসিরে আহমদিয়া,
এ ইবারতে গেয়ারবী শরীফের নামে পশু পালন সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট রায় পাওয়া গেল। এ কিতাবের লিখক মৌলানা আহমদ জিয়ুন (رحمة الله) এক জন বড় বুযুর্গ, যিনি আরব আযমের উলামায়ে কিরামের উস্তাদ। দেওবন্দীরাও তাঁকে মান্য করে।’’
ফাতওয়ায়ে শামীর -الذبح শীর্ষক অধ্যায়ে বর্ণিত আছে-
وَاعْلَمْ أَنَّ الْمَدَارَ عَلَى الْقَصْدِ عِنْدَ ابْتِدَاءِ الذَّبْحِ
-‘‘জেনে রাখা দরকার যে হালাল-হারামটা যবেহ করার সময় নিয়তের উপর নির্ভরশীল।’’
¶ ইমাম ইবনে আবেদীন শামী, ফাতওয়ায়ে শামী, খণ্ড-৬, পৃষ্ঠা-৩১০।
সুস্পষ্ট বোঝা গেল যে, যবেহ করার আগের নিয়ত বা নাম মোটেই বিবেচ্য নয়।
ফাতওয়ায়ে আলমগীরি الذَّبْحِ শীর্ষক অধ্যায়ে উল্লেখিত আছে-
مُسْلِمٌ ذَبَحَ شَاةَ الْمَجُوسِيِّ لِبَيْتِ نَارِهِمْ أَوْ الْكَافِرِ لِآلِهَتِهِمْ تُؤْكَلُ؛ لِأَنَّهُ سَمَّى اللَّهَ تَعَالَى - وَيُكْرَهُ لِلْمُسْلِمِ، كَذَا فِي التَّتَارْخَانِيَّة نَاقِلًا عَنْ جَامِعِ الْفَتَاوَى
-‘‘কোন মুসলমান, অগ্নি উপাসকের সেই গাভী, যেটা ওদের অগ্নি পূজার জন্য ছিল বা কাফিরের যেটা ওদের দেবতার নামে ছিল, যবেহ করলো, ওটা হালাল হবে। কেননা সেই মুসলমান আল্লাহর নাম নিয়েছে। অবশ্য মুসলমানদের জন্য এ ধরনের কাজ মাকরূহ। ফাতওয়ায়ে তাতার খানীতে জামেউল ফাতওয়ার উদ্ধৃতি দিয়ে অনুরূপ বর্ণনা করেছেন।’’
¶ নিযামুদ্দীন বলখী, ফাতওয়ায়ে হিন্দিয়া, ৫/২৮৬ পৃ:
দেখুন উক্ত পশুপালনকারী কাফির এবং যবেহটাও করানো হয়েছে দেবতা বা অগ্নিপূজার নিয়তে। মালিকের পালন ও যবেহ করানো উভয়টা অবৈধ। কিন্তু যেহেতু যবেহের সময় সেই মুসলমান আল্লাহর নাম নিয়ে যবেহ করেছে, সেহেতু পশুটা হালাল। বলুন, গেয়ারবী শরীফ বা মীলাদ শরীফের গরু সেই মূর্তি পূজারীর, গরু থেকেও কি নিকৃষ্ট? ওটা হালাল হলে এটা কিভাবে হারাম হতে পারে? খোদার শুকর, নিখুঁতভাবে প্রমাণিত হলো যে গেয়ারবী শরীফ ইত্যাদির গরু ছাগল হালাল এবং এটা ছওয়াবের কাজ।